ভায়লেট হালদার: বরিশাল শহরের কালিবাড়ি রোডে জগদীশ সারস্বত গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের বিপরীত পার্শ্বে অবস্থিত বহুদিন ধরে অবহেলায় পড়ে থাকা শহীদ মিনারটির সম্প্রতি সংস্কার কাজ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এ শহীদ মিনারটি ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মরণে ১৯৭২ সালে নির্মিত হয়েছিল। এর স্থপতি হিসেবে কারো নাম পূর্বে না থাকলেও নতুন যে সংস্কার কাজ করা হয়েছে সেখানে উদয়নী ক্লাব ও ব্যায়ামাগার-শহীদ সেরনিয়াবাত স্মৃতি পাঠাগারের সৌজন্যে দেয়া নামফলকে স্থপতির নাম সংযুক্ত করা হয়েছে এবং লেখা হয়েছে এভাবে: “স্থপতি: প্রকৌশলী মানস কুমার মিত্র”। এ বিষয়ে বরিশালের সাংস্কৃতিক ও সুধীজনরা ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। এ শহীদ মিনারের আসল স্থপতি হলেন চিত্রশিল্পী, মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর চিত্ত হালদার।
ইতিহাস খুঁজলে জানা যায়, এটির নকশা করেছিলেন শিল্পী চিত্ত হালদার ও তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে এটি নির্মিত হয়েছিল। এ কালিবাড়ি রোডেই চিত্র হালদারের ছিল ‘চিত্রালী’ নামে একটি আর্ট গ্যালারি যা তিনি ১৯৬১ সালে শুরু করে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পরিচালনা করেন। চিত্ত হালদার ১৯৭৮ সালে মারা যান। ডেইলি স্টার পত্রিকার জেলা সংবাদদাতা সুশান্ত ঘোষের “বরিশালের দ্বিতীয় শহীদ মিনারটির নকশাকার ছিলেন চিত্ত হালদার” শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন যে, “১৯৭২ সালে সাংবাদিক ও উদয়নী ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাতের উদ্যোগে রাণী ভট্টাচার্য, বদিউর রহমান, মানবেন্দ্র বটব্যাল, কবি মাসুদ আহম্মেদ, নওসের প্রমুখের সহযোগিতায় এখানে এই ব্যতিক্রমী শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়।” সাংবাদিক সুশান্ত ঘোষ তার এই লেখায় আরো উল্লেখ করেন যে, “বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ” এর সভাপতি কাজল ঘোষ জানান, ”এটি নির্মাণে শহীদ সেরনিয়াবাত প্রধান ভূমিকা পালন করেন, তবে এর নকশাকার ছিলেন চিত্ত হালদার।”এ প্রবন্ধে সুশান্ত ঘোষ আরো লেখেন,“প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এস এম ইকবাল বলেন, “আমার যতটুকু মনে পড়ে চিত্তদাই শহীদ মিনারের নক্সা করেছেন।” সুশান্ত ঘোষ গণসঙ্গীত শিল্পী ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুকুল দাসের উক্তি দিয়ে এ প্রবন্ধে লিখেছেন, “চিত্ত হালদার ছিলেন এর নকশাকার।”

বরিশালের তরুণ কবি ও সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদক তুহিন দাস শিল্পী চিত্ত হালদারের স্ত্রী ঝর্ণা হালদারের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। এ সাক্ষাৎকারটি ‘জীবনের জলছাপে শিল্পী ঝর্ণা হালদার’ নামে ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে একুশে গ্রন্থমেলায় ঢাকার মারমেইড প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত “চিত্ত হালদার স্মারকগ্রন্থ’-এ প্রকাশিত হয়। সে সাক্ষাৎকারে ঝর্ণা হালদার বলেছেন যে, “১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে একদিন বিকেলে ভাষাসৈনিক রাণী ভট্টাচার্য আমাদের বাড়িতে আসেন। আমাদের সকলের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময়ের পরে জিজ্ঞাসা করলেন:‘চিত্ত কই?” রাণীদি মুক্তিযুদ্ধের আগেও আমাদের বাসায় আসতেন এবং ওনার সঙ্গে আমাদের সখ্যতা ছিল। চিত্ত হালদারকে তিনি ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। তখন তিনি জগদীশ স্বারস্বত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। তখন উনি বলেছিলেন ভাষা শহীদদের স্মরণে কালীবাড়ি রোডে একটি শহীদ মিনার নির্মাণের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলেন। কিন্তু চিত্ত হালদার তখন বাসায় ছিলেন না। রাণীদি কিছু সময় থেকে চলে গেলেন। রাতে চিত্ত হালদার বাড়ি ফেরার পরে তাঁকে জানালাম যে রাণীদি তার খোঁজ করছিলেন। তিনি বললেন কালীবাড়ি রোডে তাঁর সঙ্গে সন্ধ্যায় দেখা হয়েছে। এরপর চিত্ত হালদার কালীবাড়ি রোডে এখনকার জগদীশ স্বারস্বত স্কুল ও কলেজের সামনে যে শহীদ মিনারটি আছে তার নকশা আঁকলেন। সে নকশা তাঁকে বেশ কয়েকবার কাগজের উপরে বসে আঁকতে দেখেছি। পরে তাঁর নকশানুযায়ী শহীদ মিনারটি তৈরি করা হয়।”

আমি বহু বছর ধরে নরওয়ে প্রবাসী। ২০১৯ সালে আমি বরিশালে যাই এবং কালীবাড়ি রোডের শহীদ মিনারের জরাজীর্ণ চিত্র দেখে আমি ব্যথিত হই। শহীদ মিনারটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে আমি স্থানীয় সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কথা বলি। এরপরে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাদ সাদিক আব্দুল্লাহ’র সঙ্গে দেখা করি এবং তাকেও অনুরোধ করি যাতে তিনি শহীদ মিনারটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন এবং দেওয়ালে একটি নামফলকে নকশাকার হিসেবে চিত্ত হালদারের নাম, নির্মাণের সময়কাল ও প্রেক্ষাপট নিয়ে ২/৪টি লাইন লেখার উদ্যোগ যাতে নেওয়া হয়। শহীদ মিনারটি মেয়র সেরনিয়াবাদ সাদিক আবদুল্লাহর বাড়ির পাশেই স্থাপিত হয়েছিল। এবং এটি নির্মাণের জন্য মূলত উদ্যোগ তার চাচা সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত নিয়েছিলেন। এ জায়গায় গুরুনাথ সেনের সমাধি মন্দির ছিলো। পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালে সমাধি মন্দিরটি গুঁড়িয়ে দেয় এবং জায়গাটি ফাঁকা হয়। এর পরের বছর, আমি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবারও বাংলাদেশে যাই। বরিশালে গিয়ে দেখি শহীদ মিনারের চিত্র কিছুটা বদলেছে। লাল, কালো, নীল ও সাদা নতুন রঙ করা হয়েছে। কিন্তু লেখা হয়নি নকশাকারের নাম ও ইতিহাস। সে বছর বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির সদস্যবৃন্দসহ আমি আমার পরিবারের সদস্যবৃন্দ ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে সে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলাম। সে রাতে অনেকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক আনিসুর রহমান স্বপন, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বৈশাখীর বরিশাল জেলা প্রতিনিধি মিথুন সাহা, সাংবাদিক সুশান্ত ঘোষ।

আমি বর্তমানে নরওয়েতে। কয়েকদিন পূর্বে বরিশালের আমার একজন পরিচিত ব্যক্তি এ শহীদ মিনারটির সদ্য সমাপ্ত সংস্কারকাজের কিছু ছবি ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। ছবিগুলো দেখে সত্যিই আমি আঁতকে উঠেছি। রাতারাতি বদলে গেছে ইতিহাস। নাম ফলকে রয়েছে নকশাকার হিসেবে একটি নতুন নাম: ‘মানস কুমার মিত্র’, যা আগে কখনো বরিশালের কেউ শুনেনি। কোথাও নেই নকশাকার চিত্ত হালদারের নাম। এ ধরনের ইতিহাস বিকৃতি বরিশালের শিল্পী, সাহিত্যিক, সুধীজন ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের মাঝে শঙ্কা ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। আমার মা ঝর্ণা হালদার প্রয়াত হয়েছেন ২০২১ সালে। মা যদি বেঁচে থাকতেন আজ তাহলে এ ইতিহাস বিকৃতি দেখে তিনি যে কী দুঃখ পেতেন তা আমি ভাবলেও শিহরিত হই। তারচে’ এটাই ভালো যে আমার মা ও শিল্পী চিত্ত হালদারের সহধর্মিনীকে এমন ঘটনা দেখতে হলো না। আমরা চিত্ত হালদারের পরিবারের সদস্যরা কখনো ভাবিনি এ ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হবো। আমরা ব্যথিত।
সত্য কখনো চেপে রাখা যায় না। সত্য একদিন না একদিন প্রকাশিত হয়। সত্য আমাদেরকে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রেরণা যোগায়। সুতরাং, সত্য ও সঠিক ইতিহাসকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। বরিশালের ঐতিহ্যবাহী এ শহীদ মিনারটির সঠিক ইতিহাস যাতে অক্ষুণ্ণ রয় সে বিষয়ে এ বিষয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক সহ যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও সচেতন বরিশালবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। শহীদ মিনারটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে নকশাকার চিত্ত হালদারের নামফলক প্রতিস্থাপনের দাবি জানাচ্ছি।