কেন কবিতা লেখেন? পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র নামক খোঁয়াড়ে নিরবিচ্ছিন্ন তৃপ্তির ঢেকুর না তুলে পাঠক কেন কবিতার দিকে হাত বাড়ান? কোন্ ক্ষুধা তার অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দেয়? এই ভাবনাগুলো চিরায়ত। আসলে এসবের সন্তোষজনক কোন উত্তরও হয়তো পাওয়া যাবে না কোনদিন। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলা কবিতা অনেকটাই সাবালক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ত্রিশের অধ্যাপক কবিগণ এতে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। এরা চাইছিলেন কবিতা আর একটু স্মার্ট হোক। এরা বাংলা কবিতার শরীরে বোদলেয়ারের বিষণ্নতা প্রয়োগ করলেন। ইয়েটস-এলিয়ট-পাউণ্ডের বুর্জোয়া দুর্গন্ধ ও নরকযন্ত্রণার স্বাদ এরা কবিতায় চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এদের এই প্রচেষ্টা বাংলা কবিতাকে কতটা স্মার্ট করল অথবা কবিতার আত্মা মৃত্যুযন্ত্রণায় হাঁসফাস করল কি না তা নিয়ে তর্কবিতর্ক এখনো চলছে। ত্রিশের এই কবিদের ভেতর পঞ্চপাণ্ডবের একজন হয়েও যিনি নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিলেন তিনি জীবননান্দ দাশ। তিনিও ছিলেন ইউরোপীয় কেতায় শিক্ষিত, কিন্তু বাংলা কবিতার উপর রাখলেন তার নগ্ন নির্জন হাত। তিনি খুঁজে পেলেন দারুচিনি দ্বীপ, দুধের মতো সাদা নারী।
রবীন্দ্রনাথকে ভয় পাওয়ার বা রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার কোনোটারই দরকার পড়লো না। জীবনানন্দ মুখোমুখি হলেন বনলতা সেনের যাকে তিনি হাজার বছর ধরে খুঁজেছেন।
বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বে অধ্যাপক কবিগণ বাংলা কবিতাকে সভ্যভব্য বানাতে গিয়ে কবিতার আত্মার দিকে তাকাবার সময় পাননি। তারা উপলব্ধি করতে ভুলে গিয়েছিলেন যে, ইউরোপীয় কবিতা, বিশেষত ফরাসি ও ইংরেজি কবিতা, রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লব পার হয়ে এসেছে। শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলেছে সামন্তবাদের ধুলো-কালি। বাংলা তথা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক মননকাঠামো এক্ষেত্রে একেবারেই আলাদা।
আর একটা কথা, ফরাসি কবিতা ও ফরাসি চিত্রশিল্প অনেকটা হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। পরবর্তীতে সম্বন্ধ পাতিয়েছে সিনেমার সঙ্গে। যেমন জ্যাঁ ককতো একাধারে ছিলেন কবি, চিত্রশিল্পী ও সিনেমার পরিচালক। ইতালীয় প্যিয়ের পাওলো পাসোলিনির ক্ষেত্রেও এ কথা সত্যি। প্যিয়ের অগুস্তে রেনোয়া ছিলেন ফরাসি ইম্প্রেশনিজমের অন্যতম গুরুশিল্পী। এই ইম্প্রেশনিজমের আঁচ তার সন্তান সিনেমা নির্মাতা জ্যাঁ রেনোয়ার ওপর পড়েছিল। পরবর্তীকালে রেনোয়া সত্যজিৎকে সহকারী করে কলকাতায় যে ‘দ্যা রেইন’ সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন তাতে এই ইম্প্রেশনিজমের আঁচ আমরা পেয়েছিলাম। কবিতা-চিত্রশিল্প-সিনেমা এক্ষেত্রে একাকার। বাংলায় এটা আমরা জীবনানন্দ দাশে পাই।
‘গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল— অসংখ্য নক্ষত্রের রাত;
সারা রাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে;
মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো;’
পৃথিবীকে, পৃথিবীর রক্ত-ক্লেদ-হাওয়াকে জীবনানন্দ ভালোবেসেছেন, সমস্তটুকু নিজের সত্তায় ধারণ করেছেন। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ সম্পূর্ণ নিজস্ব সত্তা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। আমরা জানি, উপমহাদেশে গোষ্ঠীভিত্তিক শিল্প-আন্দোলনের তেমন ইতিহাস নেই; ষাটের দশকের হাংরি মুভমেন্ট ছাড়া। ছোটখাটো অনেক আন্দোলন ভারতবর্ষে তথা বাংলায় ডানা মেলেছে, কিন্তু শিকড় গেড়ে বসতে পারেনি। জীবনানন্দ যখন লেখা শুরু করেছেন তখন পশ্চিমে দাদাবাদীরা থেমে গিয়েছেন, ইম্প্রেশনিস্টরা নিভুনিভু। ক্রুফো ও গদাঁরসহ NEW WAVE-এর দল চলচ্চিত্রে যে আলোড়ন তুলেছেন সেখান থেকে ফরাসি কবি ও চিত্রশিল্পীরা নিজেদেরকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে পারলেন না। অথবা মুক্ত হতে তাগিদ বোধ করলেন না। চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে সুরিয়ালিজম তাত্ত্বিকভাবে মৃত হলেও শিল্পের অন্তস্তলে সেটা কুলকুল করে বয়ে চলছিল। আর স্পেনে তখন দুই বন্ধু লুই বুনুয়েল ও সালভাদর দালি তো সুরিয়ালিজমের বন্যা বইয়ে দিলেন। একজন সিনেমায় একজন চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে। ‘দ্য আন্দালুসিয়ান ডগ’-এর স্ক্রিপ্টও তো লিখলেন দালি, বন্ধু বুনুয়েলের দাবিমতো। এদের এই আগুন থেকে জীবনানন্দ নিজেকে আড়াল করেননি। তিনি লিখেছিলেন ‘ঘোড়া’। বাংলা কবিতায় পরাবাস্তববাদের সম্ভবত সবচে উৎকৃষ্ট নিদর্শন। যে চোখ লুই বুনুয়েলকে ছুরি দিয়ে কেটে ফেলতে হয়েছিল, জীবনানন্দে সেই চোখ রূপ নিল পাখির নীড়ে।
তাহলে জীবনানন্দ কি রবীন্দ্রনাথের হাতে মারা যাওয়া রোমান্টিসিজমকে পুনর্জীবন দান করলেন? একদম না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুষ্ট হওয়ার সময়টা কবির চোখের সামনে বয়ে চলছিল। তখনও প্রথম মহাযুদ্ধের দগদগে ঘা শুকোয়নি। একদিকে বাঙালি তথা ভারতীয় স্বাধিকার আন্দোলন অন্যদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগুন— কিছুই জীবনানন্দকে এড়িয়ে গেল না। এমন কি প্রজাতন্ত্রী স্পেনে ফ্যাসিবাদের কালো থাবাও না। ‘বনলতা সেন’ এইসব থেকে পালিয়ে বেড়ানোর আশ্রয়স্থল না। ‘নির্জনতার কবি’ বলে যারা এতদিন জীবনানন্দকে একটা Literary Canon-এ বন্দি করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন তারা এতদিনে সম্ভবত নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন, জীবনানন্দের স্বরূপ চিনতে পেরেছেন। পৃথিবী যখন সাম্রাজ্যবাদের চূড়ান্ত লোভ-লালসার শিকার হয়ে হাঁসফাস করছে, সে-সময়ে সেই ১৯৪২ সালে আমরা পাই ‘বনলতা সেন’। এর এক দশকের ভিতর নিওরিওলিজমের তিন মহাগুরু আকিরা কুরোসাওয়া, ভিত্তোরিও ডি সিকা ও সত্যজিৎ রায় আমাদের সামনে আনলেন ‘রশোমন’, ‘বাইসাইকেল থিবস’ ও ‘পথের পাঁচালী’কে। তিনজন বিশ্বের তিন প্রান্তে। কিন্তু মানুষের অপমানের যন্ত্রণা তিনজনকেই সমানভাবে আক্রান্ত করেছিল। জাপান বা ইতালি বা ভারতবর্ষ— কারওরই নিস্তার নেই সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র থাবা থেকে। ফ্যাসিবাদ সাম্রাজ্যবাদেরই এক রূপ। এটা অনুধাবন করতে এই শিল্পীদের একদম বেগ পেতে হয়নি। একজন জাপানি, একজন ইতালীয়, একজন বাঙালি— এদের প্রত্যেকের ভিতর কোথাও না কোথাও বনলতা সেন ছিল— আছে। ফ্রাঙ্কোর ঘৃণা ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসকদের ভেতরও জারিত ছিল। এই ঘৃণাবোধ কত গভীর আর কীভাবে সংস্কৃতিগতভাবে এটা আমাদের চেতনায় চারিয়ে দেওয়া হয়েছে— এটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ে আমরা পাই, তারাশঙ্করে পাই, ওয়ালীউল্লাহতে পাই।
গত শতকের বিশের দশকের নজরুল বা সুকান্ত থেকে ত্রিশের কবিরা বেরিয়ে এসেছিলেন। বিষ্ণু দে একমাত্র মার্কসবাদকেই ধ্যানজ্ঞান করে কবিতা লিখেছিলেন। সমর সেন আর প্রেমেন্দ্র মিত্র বামপন্থাকেই কবিতার হাতিয়ার করেছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো পরবর্তীকালে কম্যুনিজম আর কবিতার ভেতর পার্থক্যই রাখলেন না। এর বীজ নিহিত ছিল জীবনানন্দে।
পূর্ববর্তী ৩টি কাব্যগ্রন্থে ছন্দবিজ্ঞানের যে স্ফূরণ আমরা দেখেছি সেটা বনলতা সেনে এসে ফল্গুধারায় প্রকাশিত হতে লাগলো, বাঁধাবন্ধনহীন। এর আগে তর্ক হয়েছে ‘আর্ট’ আর ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে। অর্থাৎ ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ না ‘মানুষের জন্য শিল্প’? কিন্তু জীবনানন্দে এসে এইসব তর্ক আর কূটকচালির কোনো মূল্যই থাকল না। কারণ কবিতাকে ‘কবিতা’ হয়ে উঠতে গিয়ে কোন কিছু বিসর্জন দেওয়ার দরকার হয় না। ফলে জীবনানন্দের ‘মহাত্মা গান্ধী’ যেমন কবিতা তেমনি মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ও কবিতা। মিডিয়াম ও ইডিয়োলোজির যথার্থ টেকচারে এটা সম্ভব। একারণে বাংলা গল্পের যে স্ট্রাকচারে আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত সেই অচলায়তনের বাইরে সুবিমল মিশ্রের ‘হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তী’ গল্প হয়ে উঠেছে।
তবে জীবনানন্দের কবিতা বোঝা বা উপলব্ধির ক্ষেত্রে পাঠকের-সমালোচকের দূরত্ব আজও দূর হয়নি। কবির আক্ষেপ ছিল তার কবিতাকে সার্বিকভাবে কেন Subjective হিসেবে ধরা হয়। তিনি নিজের কবিতাকে dramatic representation হিসেবেই ধরতেন। অন্তত বেশিরভাগ কবিতার ক্ষেত্রেই এটা সত্যি। আমরা অনর্থক ওর কবিতাকে প্রকৃতির, প্রেমের, ইতিহাসের ইত্যাদি বলে সনাক্ত করতে চেষ্টা করি, রবীন্দ্রনাথকে বোঝার সুবিধার্তে যে ছক পূর্বেই আমরা বানিয়ে নিয়েছি সেই ছক ধরে।
বাঙালি আসলে কবিতা পড়া শিখেছে অনেক দেরিতে। কবিতা লেখা শিখেছে আরও দেরিতে।
বাঙালি মূলত কবিতা গেয়ে এসেছে। কবিতা পড়ানোর শিক্ষক মধুসূদন দত্ত। তারপর রবীন্দ্রনাথে এসে বাঙালি সত্যি সত্যি পাঠক হয়েছে। এই পাঠক পরিশুদ্ধ-পরিপুষ্ট হয়েছে জীবনানন্দ দাশে এসে। জীবনানন্দ চান মনোযোগী পাঠক, ইতিহাসে-নৃতত্ত্বে যার আগ্রহ আছে, সমকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অশুদ্ধতাকে যিনি এড়িয়ে যেতে পছন্দ করেন না। কথাটা সুইডিশ কবি ট্রান্সট্রোমারের জন্যও সত্যি। জীবনানন্দের মতো ট্রান্সট্রোমারের বস্তুপুঞ্জও সবাক। পল সেজানের আপেলের মতো। নিজেকে দেখাতে চায়, নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে চায়, অন্যের খাদ্য হতে চায় না।
জীবদ্দশায় জীবনানন্দকে বাঙালি পাঠক বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। এজন্য অবশ্য কবি নিজে দায়ী কম নন। ভাবনা-দর্শনে ত্রিশের অন্যান্য কবিদের কাছাকাছি হলেও জীবনানন্দ নিজের পথ আলাদা করে নিয়েছিলেন। সেখানে বাঙালি পাঠক সমালোচকের অস্বস্তি ছিল যথেষ্ট। কিন্তু ধীরে ধীরে পাঠক যত তার কবিতার কাছাকাছি হয়েছেন তত জড়িয়ে পড়েছেন তার কবিতার ধূসর জগতে।
এখন, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলায় সবচে জনপ্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। তাহলে কি অন্ধকার মিলিয়ে যাচ্ছে? না, দিন দিন বরং গাঢ় হচ্ছে। দাঙ্গা-দুর্ভিক্ষ-মহাযুদ্ধ-দেশবিভাগের যে রক্ত জীবনানন্দের কবিতার অন্তঃসলিলে বহমান, সেখানেই আছেন বনলতা সেন।#