আঠারো শতকের বাংলায় বর্গী হাঙ্গামার ক্ষত ভাল করে শুকোবার আগেই সুবা বাংলা পুনরায় এক তীব্র জটিল রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়েছিল। ইতিহাস বলে যে, ১৭৫৬ সাল থেকে শুরু করে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত বাংলায় একটার পর একটা গুরুতর রাজনৈতিক ঘটনা দ্রুত লয়ে ঘটে গিয়েছিল; যথা—সিরাজউদ্দৌলার মসনদে আরোহণ, ১৭৫৬ সালের জুন মাসে তাঁর কলকাতা আক্রমণ ও জয়, ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তর, আর সবশেষে দিল্লীর মুঘল সম্রাট শাহ আলমের হাত থেকে ১৭৬৫ সালের আগস্ট মাসে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ; অর্থাৎ—ইংরেজদের কাছে পরাভূত, আশ্রিত ও শিখণ্ডী মুঘল সম্রাটের হাত থেকে বাংলার রাজস্ব আদায়ের একচ্ছত্র অধিকার লাভ। এসবের মধ্যে ইতিহাসে ইংরেজদের বাংলার দেওয়ানিলাভের গুরুত্ব সবথেকে বেশি। কারণ, খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার দেওয়ানি লাভ, শুধু বাংলার নয়, গোটা ভারতবর্ষের পক্ষেই একটি যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। এটা মূলতঃ সেকালের একটা রাজনৈতিক ঘটনা হলেও এই রাজনৈতিক ঘটনাটির সূত্র ধরে তখন অন্য যে অরাজনৈতিক দুর্ঘটনাটি ঘটে গিয়েছিল, সেটার কথা বাঙালিমাত্রেই সম্ভবতঃ আজও ভুলতে পারেন নি। এই অরাজনৈতিক যে দুর্ঘনাটি তৎকালীন বাংলার সমাজ ও অর্থনৈতিক বনিয়াদকে সজোরে নাড়িয়ে দিয়েছিল, ইতিহাসে সেটি ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্ত’ নামে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
“অন্ন দে গো অন্ন দে গো অন্ন দে গো অন্নদা”
খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতকের কবি রামপ্রসাদ সেনের নামে প্রচলিত, সমকালীন অজ্ঞাত কোন কবির রচিত এই বিখ্যাত পঙ্ক্তিটিতে অন্নের জন্য কাতর প্রার্থনা তৎকালীন বাংলার যে অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, সেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নিয়ে আলোচনায় প্রবেশ করবার আগে, তৎকালীন দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে এখানে একটু সংক্ষেপে আলোচনা করবার প্রয়োজন রয়েছে।
বর্তমানে প্রায় সকলেই অবগত রয়েছেন যে, ইংরেজরা প্রথমদিকে এদেশে জমিয়ে ব্যবসা করবার জন্যই উপস্থিত হয়েছিলেন, এদেশে রাজত্ব করবার কথা তখন তাঁদের কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন তাঁদের অনুকূলে ছিল,—যখন মীরজাফরের মৃত্যু ঘটেছিল, মীরকাশিম পলাতক হয়েছিলেন, বাংলার মসনদে নাবালক নবাব নজম-উদ্দৌলা আসীন ছিলেন, এবং মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম নিজেই সম্বলহীন অবস্থায় ইংরেজদের সাহায্যপ্রার্থী হয়ে উঠেছিলেন,—এই অবস্থায় শুধু বাংলা নয়, সমগ্র ভাবতবর্ষের পক্ষেই প্রত্যক্ষ বৃটিশ শাসন যে আর দূরের কল্পনা নয়, এই সহজ সত্যিটুকু দূরদর্শী রবার্ট ক্লাইভের দৃষ্টি এড়ায়নি। আর এরপরেই ১৭৬৫ সালের ১২ই আগস্ট তারিখে দিল্লীর সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে ২৬ লক্ষ টাকা কর জমা দেওয়ার বিনিময়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে লর্ড ক্লাইভ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ভারতের ভাগ্যনিয়ন্তা হওয়ার প্রথম পদক্ষেপটি নিয়ে ফেলেছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, তখন কোম্পানির এই দেওয়ানিলাভের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র সুবার ভালোমন্দের দায়িত্বও স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানির হাতে ন্যস্ত হয়েছিল। কিন্তু সুচতুর ক্লাইভ একটি রাজনৈতিক চালে নিজেদের সে দায়িত্বকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তখন বাংলা ও বিহারের রাজস্বের দায়িত্ব যথাক্রমে মহম্মদ রেজা খাঁ ও রাজা সিতাব রায়ের ওপরে অর্পণ করেছিলেন। এরফলে বাংলা ও বিহারে তখন থেকে দ্বৈতশাসন শুরু হয়েছিল। এই দ্বৈতশাসন ছিল ক্ষমতা ও অধিকারের থেকে দায়িত্বকে বিচ্ছিন্ন করে সৃষ্ট কিম্ভুতকিমাকার একটি শাসনব্যবস্থা, যার পরিণামে বাংলার জীবনে অচিরেই এক চরম বিপর্যয় নেমে এসেছিল। তবে ব্যাপক অর্থে আঠারো শতকের বাংলায় মন্বন্তরের বীজ তখনই রোপিত হয়ে গিয়েছিল, যখন মীরজাফরের আমলে বাংলার রাজস্বের সুনির্মিত বনিয়াদে প্রথম ফাটল দেখা দিয়েছিল। এরপরে ১৭৬০ সালে মীরকাশিম তাঁর নবাবী প্রাপ্তির উপহারস্বরূপ কোম্পানিকে বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম ‘নজরান’ দিয়েছিলেন। তবে এর আগেই অবশ্য ইংরেজদের হাতে ২৪ পরগনার জমিদারি তুলে দেওয়া হয়েছিল। আর তখন থেকেই এই জেলাগুলিতে ইংরেজ কোম্পানির রাজস্ব-ব্যবস্থা পরিচালনার মাধ্যমে তাদের বিশ্বগ্রাসী লোভের সঙ্গে বাংলার সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটেছিল। বস্তুতঃ ইংরেজদের এই দেওয়ানিলাভ বাংলার বুকে যে লোভের থাবা বসিয়েছিল, তার ফলে বাংলার অর্থনীতি এরপরে দ্রুত ধ্বংসের পথে এগিয়ে গিয়েছিল, যা আলিবর্দীর সময়ে বারবার মারাঠা আক্রমণের ফলেও ঘটেনি। কারণ, এই দেওয়ানিলাভের পরেই যত তাড়াতাড়ি এদেশ থেকে যতটা সম্ভব বেশি অর্থ সংগ্রহ করে নেওয়াই কোম্পানির সর্বপ্রথম চিন্তা ও প্রচেষ্টা হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে তখন থেকেই এক ধ্বংসাত্মক লীলা শুরু হয়েছিল। এসময়ে জমিদারেরা কোম্পানির বেঁধে দেওয়া সময়মত এবং চাহিদামত অর্থ সরবরাহ করতে না পারলেই এব্যাপারটা আমিলদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হত। আর বাংলায় এই দ্বৈতশাসন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমিলদের চরিত্র এবং ক্ষমতা—এই দুয়েরই রং বদল ঘটেছিল। তখন কোম্পানির পক্ষ থেকে জেলার জমিদারকে স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, নির্ধারিত খাজনার সামান্যতম অংশেরও খেলাপ হলেই তাঁকে বাতিল করে যোগ্যতম ব্যক্তির হাতে তাঁর জমিদারি তুলে দেওয়া হবে। যার ফলে আমিলরা তখন অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গিয়েছিলেন। এর আগে নবাবী আমলে আমিলদের শায়েস্তা করবার জন্য কানুনগোরা ছিলেন। কিন্তু ইংরেজদের প্রবর্তিত নতুন রাজস্ব-নীতিতে কানুনগোর ক্ষমতা একেবারেই সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিল, আর তাঁদের জায়গায় আমিলদের ক্ষমতা অপ্রতিহত হয়ে উঠেছিল। এর ওপরে নায়েব-নাজিম রেজা খাঁ থেকে শুরু করে ইংরেজ সরকারের নিম্নতম স্তরের কর্মচারীটি পর্যন্ত সকলেই কোম্পানির যথাসম্ভব বেশি রাজস্ব সংগ্রহের নীতিটি সহজেই উপলব্ধি করে ফেলেছিলেন; আর যে এই নীতির অংশ হতে পারবেন না, তাঁকেই যে সরে দাঁড়াতে হবে—একথা বুঝতেও তাঁদের একটুও দেরি হয়নি। সুতরাং রায়তদের কল্যাণ-অকল্যাণের চিন্তা তখনও যেসব আমিলদের মধ্যে ছিল, সেসব পুরোনো আমিলদের অচিরেই বিদায় দিয়ে তাঁদের জায়গায় অধিক রাজস্বদানের শর্তে নিযুক্ত নতুন আমিলের দলকে নিয়োগ করা হয়েছিল। এঁরা নিজেদের কাজের সাহায্যের জন্যে বেছে বেছে সেসব কর্মচারীকেই নিযুক্ত করতে শুরু করেছিলেন, তখন শোষণ-পীড়ন-অত্যাচারের ব্যাপারে রীতিমত সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ফলে কোম্পানির সংগৃহীত রাজস্বের পরিমাণ আকাশচুম্বী হতে বেশি দেরি হয়নি। আর এই বিপর্যস্ত-অর্থনীতিই তখন বাংলার বুকে আরেক চরম অভিশাপকে নামিয়ে নিয়ে এসেছিল। এসময়ে প্রকৃতির রুদ্ররোষে বাংলায় পরপর দু’বছর ধরে অভূতপূর্ব এক খরা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল; আর এসবের সঙ্গে কোম্পানির সীমাহীন অর্থলোভ, সর্বব্যাপী দুর্নীতি, চরম দায়িত্বহীনতা আর প্রশাসনিক ব্যর্থতা মিলে নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত বাংলার জনজীবনে ঘন কালো দুর্যোগের ছায়া নেমে এসে সর্বকালের এক মহামন্বন্তরের সৃষ্টি হয়েছিল। ইতিহাসে এর নাম হল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর; ১১৭৬ বঙ্গাব্দ বা ১৭৭০ সালে যার দেখা পাওয়া গিয়েছিল। তবে এসময়ে পর পর দু’বছরের খরার ফলে বাংলায় যে সর্বব্যাপী ধ্বংসলীলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেটার প্রস্তুতিপর্ব কিন্তু দীর্ঘকাল ধরেই চলেছিল।
সাধারণভাবে দুর্ভিক্ষের জন্য আবহমান কাল ধরে রাজা-প্রজা সকলেই খামখেয়ালী প্রকৃতিকেই দায়ী করে থাকেন, এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তরও এর কোন ব্যতিক্রম ছিল না। বস্তুতঃ তখনকার ভারতের মত একটা কৃষিপ্রধান দেশে প্রকৃতির খাম-খেয়ালীপনা, অর্থাৎ—অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি যে বরাবরই গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করত, সেকথা বলাই বাহুল্য। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পূর্ববর্তী সে অনাবৃষ্টি ১৭৬৮ সালে শুরু হয়ে ১৭৬৯ সালের প্রথমদিক পর্যন্ত চলেছিল। (Extracts from Records in the India Office, relating to Famine in India, 1769-81; Letter of Rambolds, 1769; Complied by G. Campbell.) তখনকার এই মন্বন্তরের পূর্ববর্তী খরার খবর যেসব সমসাময়িক চিঠিপত্রে কিছু কিছু পরিমাণে পাওয়া যায়, সেগুলির মধ্যে একটির অংশবিশেষ নিম্নরূপ ছিল—
“… দেশে সুকা হইয়া খরচ পত্র ব্যমহ হইয়াছে তাহা দেখিতে পাইতেছি আমি এদেসে চাকরি করিতে আসা কেবল নাচারিতে দিনপাত হয় না নানান রূপ দায়গ্রস্থ। … এতদর্থে ডিহি মুহরি হইয়া আশীয়াছি দরমাহা পাঁচ টাকার চাকর…।”
উপরোক্ত পত্রাংশ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ঘোষিত হওয়ার আগে থেকেই বাংলার অভাব-তাড়িত মানুষেরা দেশান্তরে চাকরি করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তবে প্রকৃতি এর দু’বছর আগে থেকেই বাংলার উপরে বিরূপ হতে শুরু করেছিল। তখন সামান্য বৃষ্টি হওয়ার কারণে ১৭৬৮ সালের ডিসেম্বরের আমন ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে বাজারে ধানের দর চড় চড় করে উঠে গিয়েছিল। এমনকি এরপরেও একফোঁটা বৃষ্টি হয়নি, আর এরই সঙ্গে প্রখর গ্রীষ্ম চলে এসেছিল। এরপরে দেখতে দেখতে দিন-তারিখের হিসেবে বর্ষাও এসেছিল। কিন্তু আকাশ তখনও নির্মেঘ ও রুদ্রবর্ণই থেকে গিয়েছিল। ফলে সামান্য আউশ ধান হলেও, বাঙালির আসার ফসল আমন ধান রোদে পুড়ে ঝলসে গিয়েছিল। ওই সময়ে ধানখেত শুকনো খড়ের মাঠে পরিণত হয়েছিল, আর ধান-চালের দর গগনচুম্বী হয়ে উঠেছিল। এরপরে একদিন বাজার থেকে সেসবও উধাও হয়ে গিয়েছিল; এমনকি কোথাও ছিটেফোঁটা বীজধানও পাওয়া যায়নি।
তখনকার এই অবস্থায় বিহারের নায়েব-নাজিম রাজা সিতাব রায় ১৭৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন চম্পারনে ছিলেন, তখনই তাঁকে খরার দরুন সেখানকার প্রজাদের দুর্দশার কথা বিবেচনা করে আগের বছরের রাজস্বের মোট পরিমাণ থেকে, অর্থাৎ—৪,৯২,০৭৫ টাকা থেকে ৮৯,২৩৭ টাকা ১০ আনা মকুব করতে হয়েছিল। এরপরে পাটনা থেকে কোম্পানির রেসিডেন্ট রামবোল্ড কলকাতার সিলেক্ট কমিটিকে সেই বছরের ২৪শে নভেম্বর তারিখে একটি পত্র লিখে জানিয়েছিলেন যে, বিগত বহু বছরে, বিশেষ করে বিহারে এমন প্রচণ্ড খরার কথা সেখানকার গ্রামের কোন বৃদ্ধ ব্যক্তিও স্মরণ করতে পারছে না। (Economic History of Bengal, N. K. Sinha, Vol. II, p- 49) এর ফলে বিহারের ‘ভাদাই’ বা ‘আউশ’ এবং বাংলার ‘চৈতালী’ শস্য সেবারে একেবারেই জন্মায়নি এবং অনাবৃষ্টির ফলে ডিসেম্বরের শস্যও সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে ১৭৬৯ সালের প্রথমদিকে শস্যমূল্য উর্ধ্বগামী হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে তৎকালীন নবাব দরবারের রেসিডেন্টের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৭৭০ সালের জুন মাসে মুর্শিদাবাদে টাকা প্রতি ৬/৭ সের করে চাল বিক্রি হলেও জুলাই মাসে মুর্শিদাবাদ শহরের ৩০ মাইলের মধ্যে টাকা প্রতি ৩ সের করে চাল বিক্রি হয়েছিল; কিন্তু সাধারণভাবে মোটা চালের দর তখন টাকা প্রতি ৫ থেকে ৬ মণ দরে ওঠানামা করবার কথা ছিল। (Economic History of Bengal, N. K. Sinha, Vol. II, p- 49) এছাড়া মন্বন্তরের বছরের বীরভূম জেলার বর্ণনা দিতে গিয়ে এই জেলার সুপারভাইজার হিগিনসন তখন সমগ্র বীরভূমকে ‘বন্ধ্যা জনমানবহীন’ দেশ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এর আগে অন্যান্য বছরে যেখানে সাধারণভাবে টাকায় দুই থেকে আড়াই মণ চাল সুলভ ছিল, মন্বন্তরের বছরে সেটাও দুর্লভ হয়ে গিয়েছিল; আর যদিও বা কিছু জায়গায় টাকা প্রতি মাত্র তিন সের করে কিছু চাল পাওয়া যাচ্ছিল, সেটাও ক্রমে সাধারণের নাগালের একেবারে বাইরে চলে গিয়েছিল। সুতরাং মানুষ তখন পোকামাকড়ের মতোই মরতে শুরু করেছিল এবং মুমূর্ষু মানুষরা তাঁদের সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন। একারণেই ১৭৬৫ সালের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী গোটা বীরভূমের গ্রামের সংখ্যা যেখানে ৬,০০০ ছিল, এরপরে ১৭৭১-৭২ সালে তা থেকে ১,৫০০টি গ্রামের নাম সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
তৎকালীন বর্ধমান জেলার অন্তর্গত খণ্ডঘোষ গ্রামের জনৈক ৭০ বছর বয়স্ক একজন বৃদ্ধের ১১৭৭ বঙ্গাব্দের ২৭শে জ্যৈষ্ঠ তারিখে লেখা একটি পুঁথির পুষ্পিকা থেকে ১১৭৬ বঙ্গাব্দের বাংলায় অনাবৃষ্টির ফলে পরের বছর, অর্থাৎ ১১৭৭—বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ এবং শ্রাবণ, পর পর এই দু’মাসের খাদ্যশস্যের বাজারদর সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এথেকে তখনকার মন্বন্তর-কবলিত বর্ধমানের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে; কারণ, এই বৃদ্ধ নিজের পুঁথিতে যে হিসেবটি দিয়েছিলেন, তাতে তখন প্রতিটি শস্য একটাকা মূল্যে কতটা পাওয়া যেত, সেটাও নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছিল।
অথচ এর ঠিক একমাস পরে, অর্থাৎ—১১৭৭ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে চালের দর টাকা প্রতি চার সের বলে এই পুঁথিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। (বিশ্বভারতী পুঁথি সংখ্যা ৬২৪০) এই হিসাব থেকে সহজেই সেই সময়কার বাংলার গ্রামগঞ্জের চালের দর অনুমান করা যেতে পারে। আর এসবের সাথে তখন মরার উপরে খাঁড়ার ঘা প্রবাদটিকে সত্যি করে দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সর্বগ্রাসী অগ্নিকাণ্ডের বিপদও দেখা দিয়েছিল। প্রচণ্ড দাবদাহে দেশের সমস্ত নদীনালাগুলো যখন শুকিয়ে গিয়েছিল, ঠিক তখনই বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট মজুত গুদামগুলো হঠাৎ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল, এবং এরসঙ্গে বাংলার মানুষের শেষ ভরসারও মৃত্যু ঘটেছিল। অনেকের মতে, তখন খুব সম্ভবতঃ ক্ষুধার জ্বালাতেই মানুষ অনেক জায়গায় লুঠপাটের আশায় এই আগুন লাগিয়েছিল। তখনকার অবস্থা প্রসঙ্গে তৎকালীন বাংলার নায়েব-নাজিম মহম্মদ রেজা খাঁ মুর্শিদাবাদ থেকে ১৭৭০ সালের ১৫ই মে তারিখে কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে একটি পত্রে জানিয়েছিলেন—
“… There is no remedy against the decrees of providence. How can he describe the misery of the people from the severe droughts and the dearness of grain. Hitherto it was scarce, but this year it cannot be found at all. The tanks and springs are dried up and it is growing daily difficult to procure water. In addition to these calamities, dreadful fires have occurred throughout the country, impoverishing whole families and destroying thousands of lives. The small stores of grain which still remained at Rajganj, Diwanganj and other places in the districts of Dinajpur and Purnea, have been consumed by fire. Hitherto each day furnished accounts of the death of thousands, but now lakhs of people are dying daily. It was hoped that there would be some rain during the months of April and May, and that the poor ryots would be enabled thereby to till their lands but up to this hour not a drop of rain has fallen. The coarse crop which is gathered in this season is entirely ruined, and though the seed for the August crop is sown during the months of April and May, nothing has been done in that direction for want of rain. Even now it is not too late and if there are a few showers of rain, something may be done. If the scarcity of grain and want of rain were confined to one part of the country, some remedy for the alleviation of distress could be found. But when the whole country is in the grip of famine, the only remedy lies in the mercy of God. The Almighty alone can deliver the people from such distress.” (Calender of Persian Correspondence, Vol. III, Letter no. 209, p: 64-65)
তখনকার এই দুরাবস্থার সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন জেলায় আবার মহামারি হিসেবে বসন্ত রোগের প্রকোপও দেখা দিয়েছিল। (বাংলার অর্থনৈতিক জীবন, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ, পৃ- ২৯) ওই সময়ে কার্টিয়ার এবং তাঁর পারিষদবর্গও স্বীকার এককথায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, বাংলার এই করুন অবস্থার বর্ণনা কোন ভাষাতেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ১৮৭০ সালের ২৮শে মার্চ তারিখে বাংলা থেকে গভর্নর ভেরেলস্ট একটি চিঠিতে কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখেছিলেন—
“… the distress of the people is so great that it cannot be described and requests the addressee to send by water as much grain as may be available with the greatest dispatch.” (Calender of Persian Correspondence, Vol. III, Letter no. 153, p- 41)
এসময়ে বাংলার অনেক অঞ্চলে ক্ষুধার্ত মানুষকে মৃত মানুষের মৃতদেহ ভক্ষণ করেও বেঁচে থাকবার প্রচেষ্টায় রত থাকতে দেখা গিয়েছিল। (Annals of Rural Bengal, W. W. Hunter, p- 22) আর চাষিরা তখন বীজধান তো আগেই খেয়ে ফেলেছিলেন অথবা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এভাবেই তখন বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের মানুষেরা ঘাসপাতা অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে কিছুকাল জীবিত ছিলেন। আর তারপরে গ্রামের নিরন্ন কঙ্কাল-মিছিল তখনকার শহরগুলিতে ভিড় জমিয়েছিল; পথে-ঘাটে-প্রান্তরে অগণিত মানুষের মৃতদেহ ঘিরে শিয়াল-শকুনের মহোৎসব চলেছিল এবং বহু বুভুক্ষু মানুষও তখন যে সেই অলৌকিক মহাভোজে যোগ দিয়েছিলেন, সমকালীন সরকারি নথিপত্রে একথার প্রমাণও পাওয়া যায়। বস্তুতঃ অনেক সভ্য মানুষও তখন খিদের তাড়নায় নরখাদকে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, এমনকি মৃত নরমাংসেও তাঁদের কোন ধরণের অরুচি ছিল না। এই যন্ত্রণার বিলাপ তখন ১৭৭০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত চলেছিল। এরপরে যথাসময়ে ভালো শস্য উৎপন্ন হলেও সেই শস্য ভোগ করবার জন্য অনেকেই তখন আর জীবিত ছিলেন না। আসলে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে বাংলার জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ হ্রাস হয়ে যাওয়ায় এটাই তখন অবশ্যম্ভাবী ছিল। আর একারণেই, যদিও মন্বন্তরের পরের তিনবছর বাংলায় প্রচুর ফসল হয়েছিল, শস্যের দামও কমে গিয়েছিল, কিন্তু তবুও তখন বাংলায় এমন অনেক অঞ্চল ছিল, যেখানে নতুন বছরের শস্যের কোন দাবিদার আর অবশিষ্ট ছিলেন না। অবশেষে ১৭৭০ সালের ২৪শে ডিসেম্বর তারিখে কোম্পানির কলকাতার সদস্যরা লণ্ডনে তাঁদের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন যে, মন্বন্তর সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। (Economic History of Bengal, N. K. Sinha, Vol. II, p- 60)
তবে এই মন্বন্তরের ভয়াল থাবা তখন বাংলা ও বিহারের সব জেলায় যে সমানভাবে পড়েনি, একথার প্রমাণও ইতিহাসে পাওয়া যায়। কিন্তু যেখানে যেখানে এই মন্বন্তরের প্রভাব পড়েছিল, সেখানকার অবস্থা নরকের মতোই ভয়ানক হয়ে উঠেছিল। যেমন—তৎকালীন পূর্ণিয়ার সুপারভাইজার ডুকারেল একটি পত্রের মাধ্যমে কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন—
“The famine continued for about twelve months in a degree of severity hardly to be paralleled in the History of any age or country.” (Economic History of Bengal, N. K. Sinha, Vol. II, p- 50)
উল্লেখ্য যে, এই মন্বন্তরের ফলে তখন শুধুমাত্র বিহারের পূর্ণিয়া জেলাতেই প্রায় দু’লক্ষ মানুষের জীবনহানি ঘটেছিল। অনুরূপভাবে নদীয়া জেলাতেও অবস্থা তখন চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। ১৭৬৯ সালে এই জেলা থেকেই প্রথম শস্যাভাবের খবর পাওয়া গিয়েছিল। মন্বন্তর ছাড়াও সেকালে এই জেলার অনুর্বর জমিতে স্বাভাবিক বছরেই রায়তদের অভাবের কোন শেষ থাকত না। ওই সময়ে নিজেদের জীবিকানির্বাহ করে সরকারকে খাজনা দেওয়া তাঁদের পক্ষে এমনিতেই অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। এরপরে মন্বন্তর এই জেলার রায়তদের একেবারে ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে এখানে চাষের প্রবল ক্ষতি হয়েছিল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১৭৬৮-৬৯ সালে নদীয়ায় যেখানে ১,০৭৬টি পরিবারের বাস ছিল, ১৭৭০-৭১ সালে সেখানে মাত্র ৩৭৩টি পরিবার শেষপর্যন্ত টিকে গিয়েছিল। আর এর মধ্যে পলাতক পরিবারের সংখ্যা ছিল ১৫৩টি। সমকালের খাজনার দিক থেকে হিসেব করলে এসব পরিবারগুলির মোট পরিত্যক্ত জমির পরিমাণ সমগ্র নদীয়া জেলার মোট চাষযোগ্য জমির প্রায় ষোল শতাংশ ছিল। ১৭৭০ সালের মে মাসের একটি রিপোর্টে নদীয়ার সুপারভাইজার কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন যে, নদীয়া জেলার জমিদার তখন অগ্রিম ‘তাকাভি’ (taqavi—জেলার রায়তদের হয়ে জমিদারদের দেয় নতুন ধার্য কর) কর না দেওয়ার জন্য যে লোক আগে ২০ বিঘা জমি চাষ করতেন, তিনি তখন পাঁচ বিঘার বেশি জমি চাষ করতে অসমর্থ হয়েছিলেন। (Economic History of Bengal, N. K. Sinha, Vol. II, p- 60)
অন্যদিকে সমকালীন মেদিনীপুর জেলায় প্রবল খরার দরুন শস্যহানির সঙ্গে পোকার আক্রমণও ভয়াবহ ধ্বংসের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এবিষয়ে তৎকালীন মেদিনীপুরের একটি পুঁথির ‘পুষ্পিকা’ অংশে জনৈক লেখক লিখেছিলেন—
“ছেয়াসি (১১৮৬?) সালে ইজারা করিয়াছিলাম সে গ্রামে টোটা পড়িয়াছিল সেই টোটার দায়ে পলাতক হইয়া আঙ্গরোল গ্রামে গিয়াছিলাম তাহাতে এই পুথি বসিয়া লিখিয়াছিলাম ইতি …।” (বিশ্বভারতী পুঁথি সংখ্যা ৩৩২৩)
অর্থাৎ—এই পুঁথির জনৈক লিপিকর তখন তাঁর নিজের গ্রামে টোটা বা উৎপন্ন ফসলে পোকার আক্রমণের কারণে স্বগ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। কৃষকরা ছাড়াও ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এই জেলার প্রত্যেক শ্রেণীর শ্রমিককে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করেছিল। বিশেষতঃ তখন এই জেলার গরুর গাড়ির চালক এবং নৌকার মাঝিরা এত বেশি সংখ্যায় মারা গিয়েছিলেন যে, লবণ ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন পর্যন্ত কিছু সময়ের জন্য সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে গিয়েছিল। এপ্রসঙ্গে ১৭৭০ সালের ২০শে এপ্রিল তারিখে মহম্মদ রেজা খাঁকে লেখা একটি চিঠিতে বলা হয়েছিল—
“… several Calcutta Merchants have complained to the writer to the effect that some time ago they advanced large sums of money for salt to the Zamindar of Raimangal, but that up till now they have not received any salt, nor has the money been returned to them.” (Calender of Persian Correspondence, Vol. III, Letter no. 175, p- 50)
বলাই বাহুল্য যে, এই বিলম্বের কারণ যানবাহনের সমস্যা ছিল। মন্বন্তরের আগে গত বছরের উৎপাদন থেকে হিজলির জমিদার দু’জন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ১৭৭০ সালে যেখানে ১,১৫,৫৭০ মণ লবণ সরবরাহ করতে পেরেছিলেন, সেখানে ১৭৭১ সালে তাঁরা মাত্র ৪৩,৯৫১ মণের বেশি লবণ সরবরাহ করতে পারেননি। (Economic History of Bengal, N. K. Sinha, Vol. II, p- 53) এই পরিসংখ্যান থেকে—তৎকালীন মেদিনীপুর জেলার লবণশিল্পের উপরে মন্বন্তরের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা করা যেতে পারে। তখন এই জেলা থেকেও পলাতক কৃষকদের প্রচুর জমি অকর্ষিত অবস্থায় থেকে গিয়েছিল। সমকালীন বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায় যে, মন্বন্তরের সময়ে এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই দেশত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী মারাঠাশাসিত অঞ্চল উড়িষ্যায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কারণ, সেখানে শুধু খাদ্য নয়, তাঁদের কাজ পাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশি ছিল।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর মালদা জেলার বস্ত্রশিল্পেরও প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছিল। এই দুর্যোগের থাবা তখন এই জেলায় প্রচুর মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল; আর যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদের এতটাই দুর্বল করে দিয়েছিল যে, পরের বছর কোম্পানির বস্ত্রব্যবসায়ের পরিমাণ অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। কারণ, তৎকালীন মালদার বয়নশিল্পীর সংখ্যাও মন্বন্তরের পরের বছরে অর্ধেকে পৌঁছে গিয়েছিল। এরফলে স্বাভাবিকভাবেই বস্ত্রশিল্পের মান নিম্নগামী ও মূল্য ঊর্ধ্বগামী হয়ে গিয়েছিল।
তবে মন্বন্তরের যুগের বীরভূম ও বর্ধমান জেলায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা এবং রায়তদের গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সংখ্যা অত্যন্ত বেশি ছিল। এই দুই জেলার গ্রামের পর গ্রাম তখন মন্বন্তরের কবলে পড়ে জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল। এমনকি এখানকার শহরগুলোতেও তখন এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ ছিলেন না। একারণেই ১৭৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বীরভূম জেলার সুপারভাইজার এই জেলা সম্পর্কে একটি পত্রে লিখেছিলেন—
“বহুশত গ্রাম সম্পূর্ণ জন-শূন্য। এমনকি বড় বড় শহরের এক-চতুর্থাংশ বাড়িতে মানুষের বসবাস নেই। রায়ত চাষীর অভাবে এক বৃহৎ ভূখণ্ডের বিপুল সম্পদ অনাবাদী পড়ে থাকে।”
মন্বন্তরের সময়ে মানুষের এই গ্রামত্যাগের ক্রমবর্ধমান তৎপরতার ফলে ১৭৬৫ সালে যে বীরভূমের গ্রামের সংখ্যা ৬,০০০ ছিল, মাত্র ছ’বছর পরে সেগুলির মধ্যে ১,৫০০ গ্রাম মানুষ দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল ও এই গ্রাম সংলগ্ন কৃষিক্ষেত্রগুলি গভীর জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। ১৭৭১ সালের সরকারি বিবরণ অনুযায়ী সমগ্র বীরভূমের আবাদি জমির এক-তৃতীয়াংশ পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং এর পাঁচ বছর পরে আবাদি জমির পরিমাণ আরও কমে অর্ধাংশে পরিণত হয়েছিল। মন্বন্তরের ফলে তখন বীরভূমের কৃষি যেমন বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তেমনি শিল্প-বাণিজ্যও একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। মন্বন্তরের আগে বীরভূমের যে সুতি ও রেশম বস্ত্রের ভারতজোড়া নাম ও চাহিদা ছিল, মন্বন্তরের কালে সেসব মৃতপ্রায় অবস্থায় পরিণত হয়েছিল। এমনকি সে সময়ে এই জেলার চিনি ও লৌহশিল্পের কেন্দ্রগুলিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর মন্বন্তরের ফলে এই জেলার সর্বত্র চাষিদের যে ব্যাপক, গভীর ও প্রতিকারহীন অভাব দেখা দিয়েছিল, কর্ষণযোগ্য ভূমির তুলনায় কৃষকদের সেই সংখ্যাল্পতা পরবর্তী পঞ্চাশ বছরেও আর সম্পূর্ণভাবে পূরণ হয়নি। আলোচ্য সময়ে রায়তদের বিভিন্ন গ্রাম বা জেলা ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়টি তৎকালীন সরকার এবং জমিদারদেরও চিন্তিত করে তুলেছিল। ১৭৭৮ সালের আমিনি কমিশনের (Amini Commission) রিপোর্টে প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, মন্বন্তরের ফলে চাষিদের স্থানত্যাগের কারণে জমি চাষ না হওয়ার জন্য রাজস্ব সংগ্রহের ব্যাপারে স্থানীয় জমিদারদের প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এরফলে তখন জমিদারদের বিশেষ ভাতা দিয়ে সরকারকে নিজেই রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল।
তৎকালীন বর্ধমানের কিছু অঞ্চলের শস্য যে পুরোপুরিভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এবং কিছু অঞ্চলের শস্যের বেশিরভাগই যে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সমকালীন বিভিন্ন পুঁথি থেকে এই সংবাদও পাওয়া যায়। যেমন—তৎকালীন একটি পুঁথি থেকে জানা যায়—
“… সন ১১৭৬ সাল মহামন্বন্তর হইল অনাবৃষ্টি হইল সস্বি হইল না কেবল দক্ষিণ তরফ হইয়াছিল আর কোথাও কোথাও জলাভূমে হইল।” (বিশ্বভারতী পুঁথি সংখ্যা ৬২৪০)
এরফলে যে সমস্ত চাষীরা তখন কমপক্ষে ২০ বছর ধরে জমি চাষ করে আসছিলেন, তাঁরাও তখন নতুন করে কোন বন্দোবস্তের ব্যাপারে নিজেদের না জড়িয়ে রাতারাতি চাষ-আবাদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এপ্রসঙ্গে এখানে সেযুগের দুটি চিঠির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এর মধ্যে প্রথমটির বক্তব্য নিম্নরূপ ছিল—
“মহামহিম শ্রীযুত রাজারাম রাএ জমিদার মহাসয় বরাবরেষু—
লিখিতং শ্রীসেখ জঙ্গু কষ্য ইস্তফা পত্র মিদং লিখনং কাজ্যঞ্চ আগে মহাসএর পতনি মাহালের তরফ জোতপিআরের সাকীম রসুলপুরের গেঠা পুস্কনির হেড়া কোন নাগা ৪ কাত ১॥ ডেড় বিঘা কাত জমা এক টাকা ১। ছএ আনা সরবরাহ করিতে না পারিঞা ইমসন যুরু হালে ইস্তফা করিতেছি মহাসএ অন্য প্রজাকে দিঞা আবাদ করাইবেন আমা হৈতে সব্বাহ হইতে পারে না এ কারণ ইস্তফা পত্র লিখিঞা দিলাম ইতি …।” (বিশ্বভারতী পুঁথি সংখ্যা ৬২৪০)
অর্থাৎ—তখন সেখ জঙ্গু নামক কোন এক রায়ত দেড় বিঘা কৃষিজমির খাজনা এক-টাকা ছ’আনা দিতে না পেরে বছরের প্রথম থেকেই চাষে ইস্তফা দিয়ে জমি ছেড়ে দিয়েছিলেন, এবং অন্য কারো সঙ্গে নতুন করে বন্দোবস্ত করতে বলেছিলেন। কারণ, তাঁরা দ্বারা সরকারকে খাজনা সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছিল না।
অন্যদিকে উপরোক্ত পত্রে উল্লিখিত জমিদার রাজারাম রায়ের গোমস্তা শ্রীকৈলাসনাথ মণ্ডল তখন সেখ জঙ্গুর ‘হালে ইস্তফা’ দেওয়ার কারণ যে একটাকা ছ’আনা খাজনা দিতে না পারবার জন্য তাঁর উপরে আমলাদের জুলুম, একথা জমিদারকে আরেকটি পত্রে লিখে জানিয়েছিলেন। এবং একইসাথে একথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, জমিদার রাজারাম যদি এসব আমলাদের তলব করে নিজের কাছে ডেকে পাঠান এবং তাঁরা যদি তাঁকে লিখিতভাবে জঙ্গুর উপরে পুনরায় কোন জুলুম না করবার প্রতিশ্রুতি দেন, শুধুমাত্র তাহলেই সেখ জঙ্গু পুনরায় উক্ত জমিতে বহাল হতে রাজি আছেন, নতুবা নয়। এখন মালিকের যেমন ইচ্ছা, সেটাই হবে। কৈলাসনাথ মণ্ডলের লেখা পত্রটি নিম্নরূপ ছিল—
“আজ্ঞাকারি শ্রীকৈইলাসনাথ মণ্ডল দণ্ডবৎ প্রণামা কোটী সতং নিবেদনঞ্চ আগে বিসসেস পরে নিবেদন সাঃ ডাঙ্গাপাড়ার শ্রীসেখ জোঙ্গু জোতপিআরের জমি ১ কীত্যা ইস্তফা করে কারণ এই জে প্রজা মাজুকুরকে জিজ্ঞাসা মোধ্যে জাহি করে জে ওই সালি মৌজে ওদ্ধপুরের দানিষদিগরের জুলুমে এ প্রজার এই জোমি ইস্তফা করে জদি দানিষ মণ্ডল দিগর হুজুরে তলপ করি জায় এবং একরার লিখীঞা জাবাদা করেন তবে এই জোমি প্রজা মজুকুর আবাদ করে নতুবা ওই জোমি তাইদ মাজুকুর দিগে আবাদ করাইতে হয় হুজুর মালিক এই বিসএর জেমত আজ্ঞা হইবেক তেমত হয় কোরিব ইতি …।” (বিশ্বভারতী পুঁথি সংখ্যা ৬২৪০)
তখন এভাবে জমি ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে যাওয়া বা চাষ-আবাদ ছেড়ে অন্য উপজীবিকা গ্রহণ করবার প্রসঙ্গেও অনেক সময়ে এক ব্যক্তি অপরকে উপদেশ দিয়ে নিষেধ করেছিলেন, এধরণের কিছু চিঠিপত্রের হদিসও ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেমন—
“… জমা জমির বিশয় পলানা কর্তব্য নহে অতএব কিছু খরচ হইবেক কৃসি জমি করিতে চারা কি … অন্নাভাব করা কি দেবতা জা করেন …।” (বিশ্বভারতী পুঁথি সংখ্যা ৬২৪০)
অর্থাৎ—জমিজমার বিষয়ে খরচ তো হয়েই থাকে, কিন্তু এর ভয়ে চাষাবাদ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়া উচিত নয়। আর অন্নাভাবের দায় দেবতার উপরে অর্পণ করাই বিধেয়।
এছাড়া যদিও মন্বন্তরের সময়ে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকেরা দলে দলে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র দিনমজুরের কাজের সন্ধানে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু অন্য গ্রামে গিয়েও তখন তাঁদের কাজের বিশেষ কোন সুবিধা হয়নি। কারণ, কোন নতুন লোককে অন্য গ্রামের কেউ কাজ দিতে রাজি হননি। তখন এবিষয়ে সমকালীন একটি পুঁথিতে বলা হয়েছিল—
“… ষুক বছর দেবতা বরিসিল না য়তএব পুতি লিখিলাম কোন কম্ম নাই আর গ্রামের লোক গৈতনপুর জাইতে লাগিল য়তএব চেলে ভাই চবিবশ সের ২৪ সের হইল তাই মেলে নাই আর গ্রামের য়দ্যেখান লোকে অন্য জোটে নাই আর গ্রামের লোক বলে বেলঙ্কে লোক এ লোক রাখা হবে না জদি রাখা জায় তবে আপনাদের জদি চাকর ছাড়িএ রাখা জায় তবে ওই লোক মাহ কাত্তিক মাসে জদি দেবতা জল হৈলে ওই লোক বলিবে কি আমাদের দেশে জল হয়্যাছে বাড়ি জাই চলরে কম্ম বসাইতে হবে য়তএব রাখে না …।” (বিশ্বভারতী পুঁথি সংখ্যা ৬২৪০)
অর্থাৎ—তখন খরার বছরে চাষের কাজ বন্ধ ছিল বলে আলোচ্য পুঁথির লিপকর পুঁথি লেখবার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন। ওই সময়ে দারুণ খরার কারণে চালের দর ঊর্ধ্বগামী হয়ে টাকায় ২৪ সের হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরপরে সেটাও আর পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে এই লিপিকরের গ্রামের মানুষেরা তখন নিজেদের গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে (গৈতনপুর) কাজের সন্ধানে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও কোন অপরিচিত লোককে কেউ কাজ দিতে রাজি হননি। কারণ, এঁদের কাজে বহাল করলে অনেক অসুবিধা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আর সেই গ্রামের মানুষেরা যদি নিজেদের চাকরকে ছাড়িয়ে এঁদেরকে কাজে বহাল করতেন, তাহলে ঈশ্বরের কৃপায় পরে যদি বৃষ্টি হত, তখন এঁদের আবার নিজেদের গ্রামে চাষাবাদ করবার জন্য ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই অন্য গ্রামের কেউ এঁদের কাজে বহাল করতে রাজি হননি। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে মন্বন্তর কবলিত গ্রামের অর্ধেক মানুষই তখন অন্নাভাবে নিজেদের দিন কাটিয়েছিলেন। তবে এসবের মধ্যেও কিছু কিছু মানুষ তখন গ্রামান্তরে নিজেদের জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। আর এর ফলস্বরূপ তৎকালীন বাংলার জেলাগুলির বেশিরভাগ জমিই খাস বা পতিত হয়ে গিয়েছিল। এসময়ে কোম্পানির শর্ত অনুসারে রাজস্ব মেটানোর ভাবনা বর্ধমানের রাজাকেও ভীষণভাবে আশঙ্কাগ্রস্ত করে তুলেছিল। আর একারণেই কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তখন খাজনা আদায়ের দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে বর্ধমানের রাজার ভরণ-পোষণের জন্য বৃত্তি মঞ্জুর করে দিয়েছিলেন।
তবে আলোচ্য সময়ে মন্বন্তরের ফলে বর্ধমানের থেকেও হুগলি জেলা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এসময়ে ওলন্দাজদের অধিকারে থাকা চুঁচুড়ার গঙ্গার তীরে পড়ে থাকা মৃতপ্রায় মানুষের দেহগুলিতে প্রাণ থাকতেই সেগুলিকে শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খেয়েছিল। তাছাড়া এই জেলার বিশেষ কতগুলি পরগনা আবার মন্বন্তরের ফলে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যেমন—সাতসিকা পরগনা। এখানে তখন কিছুদিনের জন্য এমন একজন মানুষও পাওয়া যায়নি, যিনি জেলার খাজনা সংগ্রহ করবার ভার নিতে পারেন। (Economic History of Bengal, Vol. II, N. K. Sinha, p- 52) এমনকি দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বছরগুলিতেও এই জেলায় শ্রমিকের অভাব দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। সেকালে সাধারণতঃ এই জেলা থেকেই কলকাতা ও মুর্শিদাবাদে শ্রমিক সরবরাহ করা হত। কিন্তু তৎকালীন হুগলির ফৌজদার মহম্মদ রাজিউদ্দীন খানের সঙ্গে সরকারপক্ষের পত্রালাপ থেকে জানা যায় যে, মন্বন্তরের পরে এই জেলায় শ্রমিকের সংখ্যা প্রবলভাবে কমে যাওয়ার জন্য মাথাপিছু মাসিক চার সিক্কা টাকার পরিবর্তে ছয় সিক্কা টাকাতেও লোক পাওয়া তখন কঠিন হয়ে উঠেছিল। প্রসঙ্গতঃ এখানে ১৭৭০ সালের ২৩শে জানুয়ারি তারিখে হুগলির ফৌজদার মহম্মদ রাজিউদ্দীন খানকে সরকারপক্ষ থেকে লেখা একটি পত্রের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যে পত্রের বয়ানটি পড়লে, তৎকালীন হুগলি জেলায় শ্রমিক-মৃত্যুর হার কোথায় পৌঁছে গিয়েছিল, একথা অনুমান করতে বিশেষ কোন অসুবিধে হয় না। পত্রটি নিম্নরূপ ছিল—
“To Raziud-Din Mahammad Khan, Faujdar of Hooghly.—Has received the Khan’s letter saying that workmen cannot be had for less than a monthly rate of Rs. 6 per man. I Am surprised to hear this, for the workman from Murshidabad is satisfied with Rs 4 per man in spite of the greater distance they have come from and of the great scarcity that prevails at Calcutta. Desires the Khan to try to procure workmen at a monthly rate of Rs 4 per man and send them to Calcutta.” (Calender of Persian Correspondence, Vol. III, Letter no. 38, p- 7)
তখন এই চিঠির উত্তরে হুগলির ফৌজদার মহম্মদ রাজিউদ্দীন সরকার কর্তৃপক্ষকে শুধু একথাই জানিয়েছিলেন যে, চার টাকায় তাঁর পক্ষে হুগলি থেকে তখন কোন শ্রমিক সগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছিল না, সম্ভব হলে তিনি অবশ্যই জানাবেন।
সমকালে ২৪ পরগনা জেলায় মন্বন্তরের ফলে মানুষের মৃত্যুর হার অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক কম হলেও, তখন এই জেলার কিছু জায়গার ক্ষুধার্ত মানুষও যে গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকবার চেষ্টা করেছিলেন—একথাও বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথি থেকে জানতে পারা যায়। (Annals of Rural Bengal, W. W. Hunter, p- 22) এরফলে মন্বন্তরের পরবর্তী বছরগুলিতে এই জেলার মানুষের বিভিন্ন রোগে ভুগে মৃত্যুর সংখ্যা প্রবলভাবে বেড়ে গিয়েছিল।
মন্বন্তরের ফলে বাঁকুড়া জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখন পতিত জমিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বিষ্ণুপুরে পুকুর শুকিয়ে যাওয়ার জন্য জলের অভাবে কৃষকদের চাষ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং খাদ্যের অভাবে ও রাজস্বের দাবি মেটাতে না পেরে তাঁরা এই জেলা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে সরকারের ঘরে রাজস্ব বাকি পড়বার অভিযোগে এই জেলার রাজাকে তখন বন্দি করা হয়েছিল।
সুতরাং উপরোক্ত ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে একথা বলা যেতে পারে যে, সামগ্রিকভাবে মন্বন্তরের ফলে আঠারো শতকের বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল, এবং চাষীদের মধ্যে অর্ধেকই তখন মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন। এবিষয়ে ১৭৭২ সালের এপ্রিল মাসে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস এক চিঠিতে কোম্পানির বিলেতের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন—
“I was not in Bengal at the time of the famine, but I had always heard the loss of inhabitants reckoned at a third and in many places near one-half of the whole.” (Economic History of Bengal, Vol. II, N. K. Sinha, p- 54)
তবে এর আগে ১৭৭০ সালের জুন মাসে নবাব দরবারে অবস্থানরত কোম্পানির রেসিডেন্টের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, তখন বিগত কয়েক মাসের বিপর্যয়ের ফলে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল—
“Six to Sixteen of the whole inhabitants.”
অন্যদিকে জন মিলের মতে—
“The first year of his (Cartier’s) administration was distinguished by one of those dreadful famines which so often affect the provinces of India, a calamity by which more than a third of the inhabitants of Bengal were computed to have been destroyed.” (The Fifth Report from the Select Committee of the House of Commons on the Affairs of the East India Company, Vol. III, p- 486)
আর মন্বন্তরের বিষয়ে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের মত ছিল যে—
“… at least one third of the inhabitants of the province” (The Fifth Report from the Select Committee of the House of Commons on the Affairs of the East India Company, Vol. III, p- 486)
—তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল।
অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল যে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের এই বিভীষিকা সমকালীন সরকারি কর্মচারীদের রিপোর্টে ফুটে উঠলেও কোম্পানির ভূমি-রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থায় এর কিছুই কিন্তু প্রতিফলিত হয়নি। বরং ওই সময়ে খাজনা আদায়ের কড়াকড়ির ওপরে এই মন্বন্তরের কোন প্রতিক্রিয়াই পড়েনি। এবিষয়ে হান্টারের ভাষায় বলতে গেলে—
“Remissions of the land-tax and advances to the husbandmen, although constantly urged by the local officials, received little practical effect. In a year when thirty five percent of the whole population and fifty percent of the cultivators perished, not five percent of the land-tax was remitted, and ten percent was added to it for the ensuing year (1770-71).” (Annals of Rural Bengal, W. W. Hunter, p- 28)
তখন কোম্পানির দেওয়ানিভুক্ত অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের বছরে সংগৃহীত রাজস্বের পরিমাণ আগের বছরের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি না পেলেও, এর পরবর্তী বছরগুলির রাজস্ব সংগ্রহ কিন্তু আশাতীতভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছিল।#

 
                         
                         
                         
                         
                         
                         
															


