বাংলা সাহিত্যের মুক্তিদাতা মধুসূদন

মধুসূদন দত্তের কাছ থেকে ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য উপহার পাওয়ার পরে তাঁর বাল্যবন্ধু রাজনারায়ণ বসু তাঁকে ১৮৬০ সালের ২৯শে জুন তারিখের একটি পত্রে লিখেছিলেন—
“Your reward is very great indeed, immortality.”
শুধু রাজনারায়ণ বসুই নন, সমকালের ও পরবর্তীকালের সব সাহিত্য সমালোচকই এককথায় স্বীকার করে নিয়েছেন যে, মাইকেল মধুসূদন দত্তই আধুনিক বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণযুগের ভাবরাজ্যে বিপ্লবের প্রথম সার্থক রূপস্রষ্টা ছিলেন এবং একারণেই তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছেন ও ভবিষ্যতেও থাকবেন। বাঙালিমাত্রেই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মধুসূদনকে স্মরণ করে তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করতে বাধ্য। আর একারণেই অতীতে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর যখন মধুসূদনের নিজের হাতে লেখা ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্যের পাণ্ডুলিপি উপহার পেয়েছিলেন, তখন তিনি শুধু নিজেকে ধন্য বলে মনে করে ক্ষান্ত থাকতে পারেননি, বরং নিজের বংশধরদের দৃষ্টিতেও তিনি স্বয়ং যে অশেষ শ্রদ্ধেয় হয়ে গিয়েছিলেন, সেকথা উল্লেখ করে মধুসূদনকে একটি পত্রে লিখেছিলেন—
“I feel sure that my descendants (should I have any) will thus be proud to think that the manuscript in the author’s autograph of the first Blank Verse Epic in the language, is in their possession, and they will honour their ancestor the more, that he was fortunate enough to be considered worthy of such an invaluable present by the Poet himself.” (সাহিত্য সাধক চরিতমালা, ২৩তম খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ৪র্থ সংস্করণ, ১৩৬২ বঙ্গাব্দ, পৃ- ৪৬)

ইতিহাস বলে যে, বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আবির্ভাবের আগে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সুসংবদ্ধ পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ঊনিশ শতকের বাঙালি সমাজ ও ব্যক্তি মানসের বহুল পরিবর্তন সাধিত হতে পেরেছিল বলেই পরবর্তীসময়ের শিক্ষিত সমাজে উন্নত শালীন রসবোধের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। তখন মানুষ আর শুধুমাত্র মধ্যযুগীয় সাহিত্য নিয়ে ব্যাপৃত থাকতে চায় নি। এপ্রসঙ্গে ১৮৬০ সালের ৬ই আগস্ট তারিখের সোমপ্রকাশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ লিখেছিলেন—
“এখন আর লোকের মন সুখময় আদিরস সাগরে মগ্ন হইতে তাদৃশ উৎসুক নহে। এখন দিন দিন লোকের মন যেমন উন্নত হইতেছে তেমনি উন্নত পণ্য সৃষ্টিও আবশ্যক হইয়াছে। অতএব মাইকেল মধুসূদন দত্তের চেষ্টা যথোচিত সময়েই হইয়াছে সন্দেহ নাই।”

আসলে নিজের এই উক্তির মাধ্যমে তিনি যেন তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন মুখী পরিবর্তনের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও এর আগেও বাংলার বহু কবি ইতিহাসে খ্যাত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা কেউই প্রকৃতপক্ষে আধুনিক না হওয়ার ফলে মধুসূদনের মত ভাবজগতে আমূল পরিবর্তনের রূপটি প্রকাশ করতে সমর্থ হননি। অন্যদিকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমগ্র জীবনেই এই পরিবর্তনের স্বাক্ষর দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর জীবনের সঙ্গে পরিচিত মাত্রেই জ্ঞাত রয়েছেন যে, বিভিন্নমুখী আপাতবিরোধী ভাব ও আবেগের দ্বন্দ্বে মধুসূদনের জীবন বারবার পর্যুদস্ত ও অবিন্যস্ত হয়েছিল। আর ঊনিশ শতকের আধুনিক সমাজের জটিলতা তাঁর ব্যক্তি চরিত্রকে অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত করেছিল বলেই সেটার প্রকাশ তাঁর ভাব জগতেও ঘটেছিল। একারণেই মধুসূদনের ভাব জগতের স্বাক্ষর বহন করে তাঁর রচিত সাহিত্য সেকালের আধুনিকতার অগ্রদূত হয়ে উঠতে পেরেছিল। তাঁর জীবন পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, অল্প বয়সে হিন্দুকলেজে ছাত্র থাকাকালীন ১৮৪০ সালেই তাঁর মধ্যে দ্বিমুখী আপাত বিরোধী (স্বদেশপ্রীতি ও ইংল্যাণ্ড প্রীতি) ভাব দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিল। তখন বাংলা ভাষা অশিক্ষিতের ও বর্বরের ভাষা এবং এই ভাষা বিস্মৃত হওয়াই ভাল বলে তাঁর মধ্যে সাধারণ সংস্কার থাকলেও প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাকের অনুরোধে তিনি বর্ষা ঋতুর বর্ণনাচ্ছলে ইংরেজি ভাষায় ‘এক্সটিক’ জাতীয় কবিতার অনুসারে ‘বর্ষাকাল’ নামের একটি কবিতাও বিনা দ্বিধায় রচনা করেছিলেন। (মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, যোগীন্দ্রনাথ বসু, ৪র্থ সংস্করণ, পৃ: ১০০-১০১) আর এই ছাত্রাবস্থাতেই ইংরেজি ভাষার একান্ত সেবক হিসাবেও কবিতা সৃষ্টির সময়ে তাঁর মধ্যে এই একই দ্বন্দ্বের প্রকাশ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। এসময়ে লেখা একটি ইংরেজি কবিতায় তাঁকে যেমন ইংল্যাণ্ডের জন্য নিম্নলিখিতভাবে হা হুতাশ করতে দেখা গিয়েছিল—
“And oh! I sigh for Albion’s stand
As if she were my native land,”
তেমনি আবার অন্য একটি ইংরেজি কবিতায় নিম্নলিখিতভাবে ভারতভূমির জন্য প্রেমের কথা বলতে দেখা গিয়েছিল—
“Oh! how my heart exalteth which I see
These future flowers to deck my country’s brow,
thus kindly nurtured in this Nursery!”

তাঁর এই পরস্পর বিরোধী ভাবানুভূতির যুগপৎ প্রাধান্য আসলে সেকালের ভাবদ্বন্দ্বেরই প্রকাশ ছিল। আর ভাবদ্বন্দ তখন যে শুধুমাত্র মধুসূদনের মধ্যেই ছিল—তা নয়, বরং সেযুগের সব শিক্ষিতদের মধ্যেই অল্পবিস্তর পরিমাণে ছিল। যেমন—রামমোহন রায় একটি ক্ষুদ্র দেশের স্বাধীনতার জন্য ভোজসভার আয়োজন করলেও সমকালে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কিন্তু ততটা উদগ্রীব ছিলেন না; রাধাকান্ত দেব পাশ্চাত্য শিক্ষার ব্যবস্থা করলেও পাশ্চাত্য ভাবধারায় বাংলার সামাজিক ও ব্যক্তিক জীবনও যে পরিবর্তিত হতে পারে, একথা বুঝতে পারেননি; আবার রামমোহন যেমন বেদান্ত শিক্ষার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা চেয়েছিলেন তেমনি ডঃ ডাফের জন্য খৃষ্টান স্কুলের সুব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন, কিন্তু খৃষ্টধর্মের শিক্ষা প্রভাবের বন্যায় যে বেদান্ত শিক্ষা ভেসে যেতে পারে—একথা তিনি ভাবতেই পারেননি। কাজেই সেকালের শিক্ষিত সমাজে এই আপাত বিরোধী ভাবের দ্বন্দ্ব তখন আবেগপ্রধান ব্যক্তিমনের স্থিতিশীলতায় দোলার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এরপরে ভবিষ্যতে মধুসূদনের প্রতীচ্য জ্ঞান ও ডিরোজিওর প্রভাব তাঁর মধ্যে চেতনামূলক দেশপ্রেমাত্মক একটি অরূপ (abstract) ভাবালুতার আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যদিও বঙ্কিম-পূর্ব নাগরিক বাঙালির কাছে স্বদেশপ্রেম ও রাজনৈতিক স্বাতন্ত্রবৃদ্ধি সম্পূর্ণভাবে সমার্থবাচক ছিল না, কিন্তু তবুও পরবর্তী জীবনের বিস্তৃত অভিজ্ঞতা লব্ধ স্থিতদী মধুসূদন প্রতিভার শ্রেষ্ঠ দান ছিল মেঘনাদ বধ কাব্য।

ডিরোজিও প্রচলিত হিন্দু কলেজীয় যুক্তিনির্ভর ও বুদ্ধিগ্রাহ্য সমালোচকের দৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষায় এবং পাশ্চাত্য জ্ঞান ভাণ্ডারলব্ধ জ্ঞানসমৃদ্ধ প্রাপ্তবয়স্ক মধুসূদন প্রতিভা অদ্ভুতভাবে সমাজ সচেতন হয়ে উঠতে পেরেছিল। সব সমাজের সবকিছুই একই নিরিখে বিচার করা হল আধুনিকতার পরিপন্থী। সামাজিক প্রয়োজন অনুযায়ী দৃষ্টি ও বিচার শক্তি না থাকলে কখনোই নিজের সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নতিসাধন করা সম্ভব হয় না। বস্তুতঃ যুগ সচেতন ব্যক্তিত্ব প্রয়োজনমুখী বিশ্লেষণী শক্তি সম্পন্ন হতে পারলেই সমাজের সর্বমুখী পরিবর্তন ও উন্নয়ন সম্ভব হয়। সমালোচকদের মতে, মধুসূদনের মধ্যে এই সমাজ সচেতন সমালোচকের দৃষ্টি এতটাই প্রখর ও বাস্তব ছিল যে, সেকালের বাংলায় কি ধরণের সাহিত্য, ব্যক্তি ও সমাজ সংস্কৃতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতিসাধনের প্রয়োজন—একথা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাই অতীতে যাঁরা তাঁর সাহিত্যকে শেক্সপিয়ারের সাহিত্য বিচারের নিরিখে বিচার করে সমপর্যায়ের রসোপলব্ধিতে সক্ষম হতে পারছেন না বলে অনুযোগ করেছিলেন, তাঁদের সচেতন করে দিতেও তিনি পিছপা হননি। কারণ, এই দুই সমাজ পৃথক হওয়ার জন্য প্রয়োজনও পৃথক ছিল। উল্লেখ্য যে, ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’ প্রসঙ্গে রাজনারায়ণ বসুকে ১৮৬১ সালে একটি পত্রে তিনি লিখেছিলেন—
“I have certain dramatic notions of my own, which I follow invariably as soon as they see a Drama of mine, begin to apply the canons of criticism that have been given forth by the masterpieces of William Shakespeare. They perhaps forget that I write under very different circumstances, Our social and moral developments are of a different character. We are no doubt actuated by the same passions, but in us those passions assume a mild shape.” (মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, যোগীন্দ্রনাথ বসু, ৪র্থ সংস্করণ, পৃ: ৪৯০-৯১)

সমালোচকদের মতে, ভাষার অপূর্ণতা এবং ব্যক্তি ও সমাজজীবনে দ্বন্দ্বের ঘাতপ্রতিঘাতের অভাবের জন্য বাংলার নাট্য ঐতিহ্যে সেকালে আধুনিক দ্বন্দ্বমূলক কোন চরিত্রসৃষ্টি সম্ভব ছিল না। তখন মধ্যযুগীয় ধর্মভাব সর্বত্রই এমনভাবে চরিত্রকে বেঁধে রেখেছিল যে, চরিত্রের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যমুখী ব্যক্তিত্বের স্পষ্টরূপ প্রকাশনা সম্ভব হয়নি। একারণেই তখন সর্বত্র কাব্যের ছড়াছড়ি, বাক্-সবস্ব-বর্ণনা-বহুল নাট্যকাব্যই প্রধানতঃ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। সেযুগের আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানসমৃদ্ধ রসিকেরা দেশীয় প্রাচীন কাহিনী অনুযায়ী এধরণের নাটকে তৃপ্ত হতে পারেননি। আর তাই ‘কৃষ্ণকুমারী’ মধুসূদনের দ্বারা সমৃদ্ধ ও উন্নত পর্যায়ে লিখিত হলেও পাশ্চাত্য আদর্শ অনুযায়ী রচিত হতে পারেনি। কিন্তু এই ত্রুটি শুধুমাত্র মধুসূদনের ছিল না। কারণ, প্রাচ্যপ্রেমী উইলসন সাহেবও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, দেশীয় বাসনা-সংস্কারকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে চললে সৃষ্ট চরিত্র অসংলগ্ন বলে মনে হতে পারে। আর তাই মূল কাহিনী ঠিক রেখে ও আমূল দেশীয় সংস্কার বজায় রেখে নাটকের আধুনিকীকরণ করাই তখন মধুসূদনের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। কারণ, সমালোচকদের মতে, নাটক দেশ ও কাল অনুযায়ী হলে তবেই সার্থক হতে পারে। আর তাই মধুসূদন ১৮৬১ সালে আরেকটি পত্রে রাজনারায়ণ বসুকে লিখেছিলেন—
“But this is not the age for the drama to flourish. We want the public ear to be attuned to the melody of the Blank Verse.” (মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, যোগীন্দ্রনাথ বসু, ৪র্থ সংস্করণ, পৃ- ৪৮৩)

সমালোচকদের মতে, মধুসূদন বাংলা নাটকের রুদ্ধগতির কারণ সঠিকভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তখন নতুন নাটকের মধ্যে দিয়ে আধুনিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দ্বান্দ্বিক চরিত্রসৃষ্টির প্রয়াস নতুন ভাবপ্রকাশের মাধ্যমে সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত অসফল হবে বলেই নব প্রকাশ-মাধ্যমের আবিষ্কারে ব্রতী হয়েছিলেন। যদিও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর তখন এই কাজে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের হাস্যোদ্দীপক প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করে আশাবাদী হতে পারেননি, কিন্তু তবুও পাশ্চাত্য জ্ঞানসমৃদ্ধ মধুসূদন অতি অল্প আয়াসেই বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এর আগে ফরাসি সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বিশেষ সাফল্যলাভ করতে না পারবার ফলে তেমনভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু মধুসূদন ভালো করেই জানতেন যে বাংলা অতি সমৃদ্ধিশালিনী ও সংস্কৃত ভাষার দুহিতা। এছাড়া মধুসূদনের কান ও জ্ঞান সংস্কৃত ভাষার নমনীয়তা ও সুললিত অদ্ভুত নতুন শব্দ-সৃজনের ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন ছিল বলেই সংস্কৃত দুহিতা বাংলার এই ক্ষমতার কথা তিনি মুহূর্তের মধ্যেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন। আর তাই তখন মধুসূদনের পরেই হিন্দু কলেজের আরেকজন প্রাক্তন ছাত্র দ্বারা বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের সুষ্ঠু সচেতন প্রয়োগ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘হুতোম প্যাচার নকশা’ গ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের শুরুর দিকে অমিত্রাক্ষর ছন্দে দুটি কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু পাশ্চাত্য জ্ঞান সমৃদ্ধ ছিল না বলে ঈশ্বর গুপ্ত অমিত্রাক্ষর ছন্দের সৃষ্টি করতে গিয়ে শেষপর্যন্ত হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিলেন। (১৮৯২ সালের ১লা ডিসেম্বর তারিখে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের গৌরদাস বসাককে লিখিত চিঠি, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ৪র্থ সংস্করণ, ১৩৬২ বঙ্গাব্দ, পৃ- ৪৪) অর্থাৎ—তখন নবযুগের ভাবপ্রকাশনে পয়ারের ক্ষমতা অতি সীমাবদ্ধ হওয়ার জন্যই অমিত্রাক্ষর ছন্দের অবাধ গতির প্রয়োজন হয়েছিল। শ্লথগতির সমাজ প্রতিভূ ঈশ্বর গুপ্ত তৎকালীন আধুনিক সমাজের গতিধর্ম বুঝতে অপারগ ছিলেন বলেই তিনি এতে অকৃতকার্য হয়েছিলেন, আর অন্যদিকে মধুসূদন তখন অমিত্রাক্ষর ছন্দে ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্যের প্রথম সর্গ লিখে সেটাকে বেনামীতে ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ পত্রিকার শ্রাবণ মাসের সংখ্যায় প্রকাশ করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করতে পেরেছিলেন। পত্রিকাটির তৎকালীন সম্পাদক রাজেন্দ্রলাল মিত্র কবিতাটির ভূমিকায় লিখেছিলেন—
“কোন সুচতুর কবির সাহায্যে আমরা নিম্নস্থ কাব্য প্রকটিত করিতে সক্ষম হইলাম। ইহার রচনাপ্রণালী অপর সকল বাঙ্গালী কাব্য হইতে স্বতন্ত্র। ইহাতে ছন্দ ও ভাবের অনুশীলন ও অন্ত্যযমকের পরিত্যাগ করা হইয়াছে। ঐ উপায়ে কি পর্য্যন্ত কাব্যের ওজোগুণ বর্দ্ধিত হয় তাহা সংস্কৃত ও ইংরাজী কাব্য পাঠকেরা জ্ঞাত আছেন। বাঙ্গালীতে সেই ওজোগুণের উপলব্ধি করা অতীব বাঞ্ছনীয়। বর্তমান প্রয়াসে সে অভিপ্রায় কি পর্য্যন্ত সিদ্ধ হইয়াছে তাহা সহৃদয় পাঠকবৃন্দ নিরূপিত করিবেন।” (বিবিধার্থ সংগ্রহ, জুলাই-আগস্ট, ১৮৫৯ সাল, ৬ষ্ঠ পর্ব, ৬৪তম খণ্ড, পৃ: ৭৯-৮৮)

মধুসূদন দত্ত রেনেসাঁর স্বভাবধর্ম সম্পর্কে এতটাই সচেতন ছিলেন যে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় ভাবধারার অবসান ঘটানোর জন্য ও আধুনিকতার রূপায়ণে অমিত্রাক্ষরের যুগান্তকারী প্রভাব বুঝেই যেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্যটি যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে উৎসর্গ করবার সময়ে লিখেছিলেন—
“যে ছন্দোবন্ধে এই কাব্য প্রণীত হইল, তদ্বিষয়ে আমার কোন কথাই বলা বাহুল্য; কেননা এরূপ পরীক্ষা বৃক্ষের ফল সদ্য পরিণত হয় না। তথাপি আমার বিলক্ষণ প্রতীতি হইতেছে যে এমন কোন সময় অবশ্যই উপস্থিত হইবেক, যখন এদেশে সর্ব সাধারণ জনগণ ভগবতী বাগদেবীর চরণ হইতে মিত্রাক্ষর স্বরূপ নিগড় ভগ্ন দেখিয়া চরিতার্থ হইবেন।”

এভাবেই প্রকৃতপক্ষে মধুসূদনের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য থেকে মধ্যযুগের বিদায়পর্ব যেন সাড়ম্বরে আয়োজিত হয়েছিল। আর এই ছন্দপ্রবর্তনের ফলে শুধু বাংলা কাব্য নয়, বাংলা গদ্যও যেন সতেজ ও ওজস্বী হয়ে ওঠবার অবকাশ পেয়েছিল।

মধুসূদনের বিভিন্ন জীবনী থেকে জানা যায় যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু কলেজের জুনিয়ার শ্রেণীতে ১৮৩৩ সালে পাঠ আরম্ভ করেছিলেন এবং ১৮৪৩ সাল অবধি এই কলেজের সিনিয়র শ্রেণীতে পাঠ করেছিলেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন যে, ১৮৩৪ সালের ৭ই মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিত হিন্দু কলেজের পুরস্কার বিতরণী সভায় তিনি আবৃত্তি করেছিলেন। (সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ২য় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ২য় সংস্করণ, পৃ: ১৯-২০) এরপরে ১৮৪২ সালে তিনি যখন হিন্দু কলেজের সিনিয়র বিভাগের ২য় শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন, তখন তাঁর পিতামাতা কর্তৃক নির্বাচিত আট-নয় বছরের একটি বালিকাকে বিবাহ করতে তাঁর স্বাতন্ত্র্যধর্মী ব্যক্তিত্ব নারাজ হয়ে উঠেছিল। আর তাই এরপরে তিনি শেষপর্যন্ত খৃষ্টধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে সেই বিবাহের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য এবং মিশনারিদের সাহায্যে বিলাতে গমনের দ্বারা নিজের জ্ঞানবৃদ্ধির সাহায্যে ইংরেজ কবিদের সমপর্যায়ের কবিত্ব খ্যাতিসম্পন্ন হওয়ার পথকে বেছে নিয়েছিলেন। এর ফলস্বরূপ এরপরে তাঁকে হিন্দুকলেজ ত্যাগ করে কলকাতার বিশপস কলেজে ১৮৪৪ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৪৭ সালের শেষপর্যন্ত ছাত্ররূপে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। এখানে তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষার শিক্ষা করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, এই কলেজে পড়বার সময়ে মাসিক প্রায় ৬০ টাকা খরচ কিন্তু তাঁর পিতাই তাঁকে যোগান দিতেন। কিন্তু ১৮৪৭ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর অদ্ভুত পোষাকের জন্য তাঁর উপরে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং ঠিক এসময় থেকেই তাঁর পিতাও কোন কারণে তাঁর উপরে বিরক্ত হয়ে উঠে তাঁকে অর্থ সাহায্য করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

১৮৪৮ মাদ্রাজে শিক্ষকতা করতে করতে তিনি সেখানকার একজন ইংরেজ নীলকর কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। ওই সময়ে আয় পর্যাপ্ত না হওয়ার জন্য সাংসারিক প্রয়োজনে তিনি কয়েকটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। ১৮৫১ সালে তিনি ‘Hindu Chronicle’ পত্রিকাটি প্রকাশ ও সম্পাদনার কাজ করেছিলেন। ১৮৪৮-৪৯ সালে ‘Madras Circulator’ নামক একটি পত্রিকায় মধুসুদনের ‘A vision’, ‘Captive Ladie’ এবং অন্যান্য আরও অনেক কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। পিতৃবিয়োগের পরে তিনি কলকাতায় ফিরে বিভিন্ন সরকারি কর্মে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন। এসময় থেকে তিনি তাঁর মাতৃভাষার সেবা ও স্বদেশ সেবা একইসঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন। এর পরিণতিতে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন, বিলাতে গিয়েছিলেন এবং নিজের সম্পত্তি বিক্রি করে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঋণ পরিশোধ করেছিলেন। এরপরে হেনরিয়েটাকে বিবাহ করে তিনি ভারতীয় নারীদের আদর্শ রূপটিরই সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত ১৮৬৫ সালে ভার্সাইতে থাকবার সময়ে চতুর্দশপদী কবিতা রচনাকালে নিজের বন্ধু গৌরদাস বসাককে একটি পত্রে তিনি লিখেছিলেন—
“I should scorn the pretensions of that man to be called ‘educated’ who is not a master of his own language.”

‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের ১ম খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পরে, ১৮৬১ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি তারিখের বিদ্যোৎসাহিনী সভায় কালীপ্রসন্ন সিংহ সভার পক্ষ থেকে তাঁকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করে একটি মানপত্র প্রদান করেছিলেন। বঙ্গসাহিত্যের সেবা করে দেশবাসীর দ্বারা সমর্থিত ও সম্বর্ধিত হওয়ার সৌভাগ্য সম্ভবতঃ মধুসূদনই প্রথম বাংলার ইতিহাসে পেয়েছিলেন। এর দশ বছর পরে ১৮৭১ সনে ঢাকাবাসীরা তাঁকে আরেকটি মানপত্র প্রদান করেছিলেন। এপ্রসঙ্গে ১৮৭১ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখের ‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকায় ঢাকার ‘হিন্দু হিতৈষিণী’ পত্রিকাকে উদ্ধৃত করে লিখেছিল—
“গত শনিবার ঢাকায় জ্ঞানকরী সভায় বহু বিবাহ নিবারণ বিষয়ের আন্দোলন হয়। শ্রীযুক্ত পণ্ডিত শ্রীনাথ তর্কপঞ্চানন মহাশয় মন্ত্রবচনে বহু বিবাহের ব্যবস্থার স্কুল উল্লেখ করিয়াছিলেন। তথায় মাইকেল মধুসুদন দত্ত উপস্থিত ছিলেন। শুনিয়া দুঃখিত হইলাম, দত্তজ মহাশয় মন্বাদি শাস্ত্রের নিন্দা করিয়া তাহা বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করিতে উপদেশ দিয়াছেন।”

আসলে নিজের সামাজিক কর্তব্য সাধনে মধুসূদন বরাবরই হিন্দু কলেজের ঐতিহ্যবাহীদের অনুসারী ছিলেন। আর তাই স্বধর্ম ত্যাগ করেও তিনি স্বাদেশিক এবং ইংরেজি ভাষার সাধনা করেও ‘বঙ্গ ভাষার আদি কবি’ ও রেনেসাঁর বাণীস্বরূপ স্রষ্টা হতে পেরেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের মৌল উপাদানে বাঙালিত্বের মূল অতি গভীরে গাঁথা ছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, তিনি ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্বোক্ত সভায় ভাষণ রাখতে গিয়ে বলেছিলেন—
“আমি সাহেব হইয়াছি এ ভ্রমটি হওয়া ভারি অন্যায়। আমার সাহেব হইবার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আরো, আমি শুধু বাঙ্গালি নহি, আমি বাঙ্গাল, আমার বাটী যশোহর।” (অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৯শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৭২ সাল)

ঊনবিংশ শতাব্দীর নাগরিক বাংলা অত্যুগ্র ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের যুগ ছিল। তখন শুধু ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর ও রামমোহনের মত কালজয়ী পৌরুষের মধ্যেই যে এই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের রূপটি প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল—এমন নয়, বস্তুতঃ তৎকালীন হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে এটা আরও প্রখর হয়ে উঠেছিল। তাঁরা প্রায় সকলেই কোন না কোনভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন; শুধু ধর্মের দিক থেকে নয়, মর্মের দিক থেকেও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। আর তাঁদের এই বিদ্রোহের আদর্শ চেতনা তখন সেকালের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাংলার উগ্র অমিত বল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র-দম্ভের মর্মমূলে পুঞ্জিত হয়েছিল। আধুনিকতার এক উৎস হল সুস্থ বলিষ্ঠ জননিরপেক্ষ মানব বিশ্বাস। এই মানুষ ধর্ম, সংস্কার, পরিবার, জাতি কোন কিছুরই আগের সংস্কারকে দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করতে চায় না। আর তাই শিক্ষক ডিরোজিওর প্রভাব পুষ্ট মনে তখন ঈশ্বর বিশ্বাসও অবশ্য বিচার্য হয়ে উঠেছিল। এই মানুষরা তখন যেন নিজেদের মধ্যেই মনুষ্যত্বের অমেয় শক্তিকে আবিষ্কার করেছিলেন এবং যেন এই শক্তিই তাঁদের কাছে অমোঘ সত্যরূপে দেখা দিয়েছিল। এই মানুষেরা শক্তির মর্যাদা রক্ষায় নিজেদের সর্বস্ব পণ করতে যেমন কুণ্ঠিত ছিলেন না, তেমনি মর্যাদা রক্ষায় অপারগ হয়ে সর্বস্বের বেশি কিছু বিসর্জন দিতেও পরাম্মুখ ছিলেন না। আর তাই রামায়ণের রাবণের মতোই জীবনে পরাজিত হয়েও তাঁরা কখনো পরাভব স্বীকার করে নেননি। তাঁরা সবংশে হত হয়েছিলেন, কিন্তু তবুও শক্তিহীনতার দুর্বলতাকে কখনো স্বীকার করেননি। এটাই যেন বহুলাংশে তখনকার বাংলার ইয়ংবেঙ্গলের আলেখ্য হয়ে উঠেছিল। আর তাই রামায়ণের রাবণের মতোই ঊনিশ শতকের বাংলার ইতিহাসে ইয়ংবেঙ্গল ও মধুসূদন শুধু ‘গ্র্যান্ড’ নয়, ‘ট্র্যাজিক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন।

আধুনিকযুগের দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে মধুসূদনের হাতেই বাংলা সাহিত্যের বন্ধন মুক্তি ঘটেছিল এবং বাংলা সাহিত্যের আমূল পরিবর্তনের পথও প্রশস্ত হয়েছিল। মধুসূদনই ক্রমে বাংলায় চতুর্দশপদাবলী কবিতার সৃষ্টি করেছিলেন, প্রহসনে সেকালের সমস্যা অতি ঘরোয়াভাবে পরিবেশনের মাধ্যমে নাটকে পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর লেখনীর মাধ্যমেই কথ্য ভাষার সুষ্ঠু প্রচলনের ফলে নাটক সর্বসাধারণের হয়ে উঠেছিল। তাঁর হাতেই বাংলা গদ্যেরও আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। অর্থাৎ—দেশ, কাল ও ব্যক্তির পরিবর্তনে আধুনিকতার মূর্ত রূপটি বাংলা সাহিত্যে তিনিই সর্বপ্রথম সার্থক সচেতন একজন শিল্পীর মতোই সৃষ্টি করেছিলেন এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে কয়েক হাজার বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের প্রশস্ত রাজপথে দ্বিধা ভয় মুক্ত হয়ে দৃঢ় সাবলীল পদক্ষেপ করতে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!