।।পর্ব – এক।।
সারা পৃথিবীতে বোদল্যারই একমাত্র ব্যতিক্রম যিনি তাঁর বই পড়তে আরম্ভ করবে যে-পাঠক তাঁকেই ‘কপট’ বিশেষণে বিশেষায়িত করতে পারেন। কিন্তু কপট কেবল পাঠকই নন, আগে স্বয়ং কবি এবং তারপর তাঁর কবিতার পাঠক-পাঠকবর্গ। তবে পাঠককে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণই ভেবেছিলেন। একেবারে সূচনায় ‘ও লেকতুঘ’ বা ‘পাঠকের প্রতি’ শিরোনামের চল্লিশ পংক্তির কবিতাটি আমাদের বুঝিয়ে দেয়, পাঠক তাঁর অতি নিকটের জন। পাঠকের জন্যে কবিতা রচনা করবার মাধ্যমে গ্রন্থপ্রবেশের ব্যাপারটাও খানিকটা ব্যতিক্রমীই বটে। হ্যাঁ, এতে তাঁর নিজের কাব্যবোধ, মেজাজ, পরিপার্শ্ব, সমকাল, সমাজ সব বিষয়ের সারাৎসার ধরা থাকে। এটুকু পড়ে নিলে পাঠকের পক্ষে আগাম অনুভব করা সম্ভব, বোদল্যারের কবিতার ফুলগুলি কেমন হবে। আজ থেকে ঠিক দুইশো বছর আগে লে ফ্লুঘ দ্যু মাল-এর কবি তাঁর মূল ভাষায় পাঠককে লক্ষ্য করে যেকথা বলেছিলেন তার খানিকটা অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথমে ফরাসিতে এবং পরে বাংলা উচ্চারণে মূল ফরাসি এবং শেষে বুদ্ধদেব বসুকৃত অনুবাদ এই ত্রিস্তর উপস্থাপনায় স্মরণ করা যাক এই বিশ্বকবিকে। ফরাসি এবং ইংরেজি উভয় ভাষার বর্ণ একই হওয়ায় আমরা ইংরেজি বর্ণমালার শরণ নিচ্ছি, তবে ফরাসি কোনো-কোনো বর্ণের ওপরকার চিহ্নগুলো (আক্সঁ) এখানে বাদই থেকে গেল। ইংরেজি ‘আর’ বর্ণের সমধর্মী বাংলা ‘র’-বর্ণ কিন্তু ফরাসি ভাষায় ‘আর’ বর্ণটির উচ্চারণ বাংলা ‘হ’ এবং ‘ঘ’-এর মাঝামাঝি। আমরা বাংলা ‘ঘ’-কেই নেবো ফরাসি ‘আর’-এর প্রতিস্থাপনায়। কিন্তু ‘বোদল্যার’-এর ক্ষেত্রে ‘র’-কে ‘ঘ’ করা হচ্ছে না বহুকালের অভ্যস্ততার বিপ্রতীপে না-যাওয়ার অভিপ্রায় থেকে। মূল ভাষার প্রথম এবং শেষ চার লাইনের উদ্ধৃতি:
La sottise, l’erreur, le peche, la lesine,
Occupent nos esprits et travaillent nos corps,
Et nous alimentons nos aimables remords,
Comme les mendiants nourrissent leur vermine. … …
C’est l’Ennui! – l’oeil charge d’un pleur involontaire,
Il reve d’echafauds en fumant son houka,
Tu le connais, lecteur, ce monstre delicat,
-Hypocrite lecteur, – mon semblable, – mon frère! [Au Lecteur]
লা সতিজ লেঘুঘ্, ল্য পেশে, লা লেজ্যাঁ,
ওকুপঁ নোজেস্প্রি এ ত্রাভাইয়ঁ নো কোঘ্প্।
এ নুজালিমঁতঁ নোজেমাব্ল রেমোঘ্দ্,
কম্ লে মঁদিয়ঁৎ নুঘিসঁ লঘ্ ভঘম্যাঁ। … …
সে লনুই! – ল্যাল্ সাঘ্ঝে দুন্ প্লঘ্ অঁভোলোঁত্যাঘ্,
ইল্ ঘেভ্ দেশাফোদ্ অঁ ফ্যুমঁ সঁ উকা।
তু ল্য কোনে, লেকতুঘ্ স্য মঁস্তঘ্ দেলিকা,
– ইপোক্রিৎ লেক্তুঘ্, – মঁ সম্ব্লাবল্, – মঁ ফ্রেঘ্। [ও লেক্তুঘ্]
মূঢ়তা, প্রমাদ, কার্পণ্যের পাপে
পূর্ণ হৃদয়, দেহ তিলে-তিলে ধ্বংস,
ভিখিরি যেমন পোষে উকুনের বংশ
আদরে জোটাই খাদ্য মনস্তাপে। … …
– নির্বেদ! চোখে অনভিপ্রেত অশ্রু তার,
হুঁকো টানে আর ফাঁসিকাঠ দ্যাখে স্বপ্নে।
পাঠক, তুমিও চেনো এ-পিশাচরত্নে,
– কপট পাঠক, দোসর- যমজ ভাই আমার! [পাঠকের প্রতি, শার্ল বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা]
যে-পাঠককে কপট বলা হচ্ছে তাঁকেই আবার যমজ ভাইয়ের গৌরবে বৃত করা হলো। তাহলে কী কোনো গোপন সংকেত লুকনো এই ব্যাজস্তুতিতে! এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমি তোমাদেরই লোক’। বোদল্যার পাঠকের অর্থাৎ সংবেদনময় এক সমষ্টির মধ্য থেকে কবি-প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন। প্রাথমিক এ-স্বীকারোক্তির সূত্রে বস্তুত কবি পাঠকের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে রচনা করেন সংযোগ। বন্ধু যেমন তুরীয়ানন্দে বন্ধুকে সম্বোধন করতে পারে ‘শ্যালক’ বলে। ঈশ্বরের তুলনায় অতি তুচ্ছ মানব প্রকাণ্ড বিধাতাকে ডাকে ‘তুই’ সর্বনামে। কিন্তু কথা হচ্ছে বোদল্যার পাঠককে ‘হিপোক্রিট’ বলবার কারণ তবে কী! কারণ হচ্ছে, যে-বাস্তব তাঁর কবিতার বাস্তব সেটিকে কোনোভাবেই প্রত্যাখ্যান করা যাবে না কিংবা সে-বাস্তবকে অবিশ্বাস্য বলেও আখ্যা দেওয়া চলবে না। সে-কাজ, সেই কপটতার কর্মটি সাধন করতে পারেন পাঠক-ই। বাস্তবে সেটি ঘটেও ছিল। ক্লেদের যে-ফুলগুলি বোদল্যার তাঁর মালায় সাজিয়েছিলেন সেগুলোর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন লেখাপড়াজানা জ্ঞানগম্যিঅলা ভদ্রলোকেরাই। কবিতানিমজ্জিত নিজের আশিখরনখ সত্তা দিয়ে বোদল্যার যে-কাব্যসৌধ গড়েছিলেন আজ থেকে দুইশো বছর আগে তা যত প্রতর্কেরই জন্ম দিক না কেন তিনি বোদল্যার সারা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা কবিদের অন্যতম। এবং তিনি একজনই, যেমন একজন শেক্সপিয়র, যেমন একজন ইবসেন, রুমি কিংবা রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কবিতার শিল্পতত্ত্বের সন্ধান করতে গেলে সাহিত্যিকের সৃজনশীলতার সঙ্গে তাঁর যাপিত জীবনের কিংবা সাহিত্যিকের বাস্তবতার সঙ্গে তাঁর সমকালের কতটুকু সংযোগ অথবা ব্যক্তি রচয়িতাকে কেন্দ্রে রেখে তারই আবর্তে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র প্রভৃতিকে পরখ করবার অবকাশের প্রয়োজন রয়েছে কিনা, থাকলে তা কতখানি এসব কথা আমাদের নিশ্চয়ই ভাবিয়ে তোলে। জালালউদ্দিন রুমির কবিতার অসাধারণ সৌন্দর্যের তত্ত্বের প্রাথমিক উপাদান তাঁরই কবিতা কিন্তু কেন তাঁর মৃত্যুতে মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান সকলেই অশ্রুসজল হয়ে পড়েন, শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন, কেন শুধু ইরান নয় গ্রিস, আর্মেনিয়া, তুরস্ক ও অন্যত্র মানুষ অশ্রু বিসর্জন দেন, সেই জীবনীর পাতা না উল্টিয়ে কেবলই রুমির কবিতার শিল্পবিচার অসম্ভব তো বটেই, অন্যায্যও।
পৃথিবীময় মানুষের মৌল স্বভাব সমধর্মী। যে-পরিস্থিতি আর যে-বর্তমানের গর্ভে কবির অবস্থান সেটির সর্বব্যাপী বৈর চিত্র ফোটাতে কবি তাঁর মাতৃভাষায় যেসব উপমা জড়ো করেছেন বিশ্বের সব ভাষাতেই সেই উপমাগুলো সুলভ। একটির জায়গায় আরেকটির সংস্থাপনে তেমন সমস্যা হয় না। যেমন বোদল্যার বলছেন, পাপের জঘন্য সংসারে ‘শাশাল’, ‘পানতেঘ্’, ‘লিস’, ‘সিংগ্’, ‘এস্কোরপিওঁ’, ‘ভোতুঘ্’, ‘সাঘ্পঁ’ এসবে পরিপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে একটা বিশ্রী-ন্যক্কারময় বৃত্তের ছবিই তিনি আঁকলেন। এটিকে ইংরেজি ভাষায়ও আঁকা যাবে একইভাবে। বোদল্যারের শব্দগুলোর প্রতিস্থাপনে তখন ব্যবহৃত হবে ‘প্যান্থার’, ‘¯স্নেক’, ‘স্করপিয়ন’, ‘জ্যাকেল’, ‘এপ’, ‘হাউন্ড’, ‘হক্’, ‘মনস্টার’ এইসব শব্দ। আর বাংলা ভাষায়ও কমতি নেই এসবের- ‘শার্দূল’, ‘শৃগাল’, ‘শকুন’, ‘সর্প’, ‘বৃশ্চিক’ ‘কীট’, ‘মর্কট’। এদেরই নর্তন, কুর্দন আর উৎকট চিৎকারে সরব কবির সমকাল। এই নরকসম মত্ততাপূর্ণ কোটি কৃমি-পরিবৃত তমসার পূতিগন্ধময় বাস্তবের থকথকে কাদায় হৃদয়জোড়া ‘নির্বেদ’ নিয়ে বসে রয়েছেন এক মানব-সন্তান যার চোখে চিকচিক করে ‘অনভিপ্রেত অশ্রু’। বসে রয়েছেন তাহলে কিসের আশায়- ভালোবাসার? কোত্থেকে আসে ভালোবাসা নামের সেই পারিজাতের সুবাস! আসে কবিরই নিজের অন্তর থেকে। আসে স্মৃতি থেকে, আসে দ্রুত বিলীয়মান হয়ে যাওয়া বর্তমান থেকে, আসে চারপাশের জীবন-জাগানো অযুত তৎপরতা থেকে। আত্ম-অভিজ্ঞতার জগতটিকে এর সূচনাবিন্দু থেকে একেবারে সাম্প্রতিকতা পর্যন্ত কুঁদে-কুঁদে এঁকেছেন বোদল্যার। এঁকেছেন শব্দের শিল্পে যদিও কেবল তিনিই নন, তাঁর পিতাও ছিলেন চিত্রশিল্পী এবং তাঁর বন্ধুদের অনেকেই বিশ্বচিত্রশিল্পী। কবিতার শব্দকে যতদূর সম্প্রসারিত করলে দৃশ্যমানতার সবটা বাস্তব ধারণ করা সম্ভব তার সবটুকুই বোদল্যারের কবিতায় পরিকীর্ণ। সেই সঙ্গে সেই দৃশ্যমানতার আড়ালে থাকা ক্রিয়মানতা নিজের বিশ্বাসের প্রেক্ষাপট এবং যে-বিবৃতি কবিতায় জীবনভাষ্যে রূপ নেয় সবই বোদল্যারের কবিতায় আসে অননুকরণীয় ও অদৃষ্টপূর্ব ধরনে। তাঁর কবিতার মধ্য দিয়েই ফরাসি বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সের স্থানীয় বাস্তব এর তিন/চারটি দশকের নানা খুঁটিনাটি দিক নিয়ে আভাসিত হলো বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে। বলা যায় ভিক্টর হুগো’র উপন্যাসের বিশালতার আমেজ পাওয়া গেল বোদল্যারের কবিতায়। স্বয়ং হুগোও তাই তাঁকে জানান উদাত্ত ব্যক্তিগত সংবর্ধনা।
শার্ল বোদল্যারের কবিতায় সুন্দরের সন্ধান নেই, আছে জীবনের সন্ধান। সে-জীবন যদি হয় অসুন্দর তবে কবি অসুন্দরেরই প্রদর্শক। বাস্তবে যে-জীবন ক্রুরতায় সর্পিল তাকে কৃত্রিম সৌন্দর্যের মোড়কে আবৃত করবার বিলাসী নন তিনি। যেজন্যে বোদল্যারের কবিতায় স্মৃতিবাহী জগতটা তাঁর বাস্তবের জগতের চাইতে সুন্দর- তাঁর বর্তমান তাঁর ন্যক্কারের উৎস, সে-নির্বেদ ও সে-বিষাদের দেখা পেয়েছেন তিনি অজস্রবার তাঁর নিজেরই জীবনে। বোদল্যারের নিজের জীবনটাই তাঁর কবিতার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সে-শিল্পে তাঁর আস্থা নেই যে-শিল্প রচিত হয় বাস্তবের বাস্তবতাকে আড়াল করবার জন্যে। যদিও লে ফ্ল্যুর দ্যু মাল কাব্যটি তিনি যাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর সেই বন্ধু-কবি থিওফিল গতিয়ে ছিলেন ‘শিল্পের জন্যে শিল্প’ মতবাদের প্রবক্তা। বাস্তবকে আড়াল করেন নি বলেই তাঁর শৈশবের ট্রমাময় জীবন থেকে শুরু করে অতল ট্রমার খাতে বয়ে যাওয়া তাঁর সম্পূর্ণ জীবনটাই বিষাদের এক দীর্ঘ কবিতা হয়ে যায়। সেই অভিজ্ঞতায় কোনো বানোয়াট প্রক্ষেপন নেই। এমনকি তাঁর চোখে প্যারিস নামের যে-শহরের উদগ্র-উন্মুক্ত জীবনের খোলস উন্মোচিত হয় সেটিও ট্রমা-আক্রান্ত। সেটি তাঁর পর্যবেক্ষণের ফল নয়, তা মানবের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরিণাম। বোদল্যার প্যারিসের জীবনটাকে তাই অভিহিত করেন ‘প্যারিস-নির্বেদ’ বা ‘প্যারিস-বিষাদ’ নামে। তিনি যে মার্কিন কবি-কথাশিল্পী এডগার এ্যালেন পো’র সাহিত্যকর্ম ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেন তার মূলেও নিহিত জীবনচেতনা। সত্যি বলতে কি সাহিত্যিক কারণে পো’র রচনা তাঁকে প্রভাবিত করে না। জীবনের সঙ্গে জীবনের সংযোগ দূরত্বাতিরেক এক অদৃশ্য মেলবন্ধনের অনুঘটক হয়ে দেখা দেয় বোদল্যারের জীবনে। এডগার এ্যালেন পো’র (১৮০৯-১৮৪৯) জীবন ও সাহিত্য-সন্নিহিতিতে বিস্ময়াভিভূত বোদল্যার বলে ওঠেন- কী আশ্চর্য সাদৃশ্য তাঁর জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের। গ্লানিময় ও পোড় খাওয়া এক জীবনের অংশীদার পো’র সাহিত্যকর্মও বোদল্যারের সাহিত্যের সঙ্গে সমান্তরাল সাংকেতিকতার দ্যোতক। সেটা জানতেন স্বয়ং কবিও। তাঁর আত্মনিবেদিত পো-অনুবাদ সেই অন্তরতমেরই বিমুগ্ধ প্রকাশ।
আশৈশব দুঃখ-বেদনার সঙ্গী বোদল্যারের চিরসঙ্গী নৈঃসঙ্গ। অথচ তাঁর জীবনের রেখা যদি চলতো নিরুপদ্রব প্রবহমানতায় তাহলে হয়তোবা ফরাসি সমাজে তাঁর চাইতে সুখী আর কেউই হতো না। পিতা সরকারি আমলা এবং শখের চিত্রকর ফ্রাঁসোয়া বোদল্যার যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ কবির মা তাঁর চাইতে ৩৪ বছরের ছোট ক্যারোলাইনের বয়স ৩৩ বছর এবং বোদল্যার ছ’বছর বয়সী এক অনাথ শিশু। বাবা’র ভালোবাসাবঞ্চিত শিশুটি বছর না ঘুরতেই পরবর্তী প্রবঞ্চনার শিকার- মায়ের পুনর্বিবাহ। ফরাসি দেশে পুরুষ বা স্ত্রীর একাধিক বিয়ের ঘটনা নিতান্ত স্বাভাবিক হলেও বলা যায় এ-ঘটনাটিই বোদল্যারের জীবনে এক ঘন কালো মেঘ এবং এক শুভ্র ইশারা হয়ে দেখা দিয়েছিল। কালো মেঘ তাঁর চিরযন্ত্রণার স্মারক হিসেবে এবং শুভ্র ইশারা তাঁর অবাধ স্বাধীনতার সূচক রূপে। এখানেও কবির ভাগ্যে ঘটে আরেক বুর্জোয়া-সংস্রব যে-বুর্জোয়াকে প্রায়শ শ্লেষে কটাক্ষ করতেন তিনি। ক্যারোলাইনের দ্বিতীয় স্বামী বোদল্যারের বিপিতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল ঝাক ওপিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং কর্মসূত্রে বহু দেশের রাষ্ট্রদূতের চাকুরি করতে হয় তাঁকে। ছাত্রজীবনে মেধাবী বোদল্যার যে কিনা স্কুলে মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেন বিবিধ পুরস্কার, ক্রমশ হয়ে পড়েন অস্থির, স্কুলপালানো কিংবা অলসস্বভাবী গন্তব্যহীন এক অসুখী কিশোর। যৌবনের সূচনালগ্ন তাঁর দেহে রেখে যায় বড় করুণ স্মারকচিহ্ন- সিফিলিয়া-গনোরিয়ার মারণ-ছোঁয়া। ১৮৪১ সালে কূটনৈতিক বিপিতা তাঁকে পাঠান ভারতবর্ষ ভ্রমণে, কলকাতায়ও পদচিহ্ন পড়ে তাঁর। ভারতবর্ষ ভ্রমণ তাঁর কবিতার একটি পূর্ব-পর্ব হিসেবে অনুপ্রেরণাদায়ী হয়েছিল। বেশকিছু শব্দ আমরা পাই তাঁর কবিতায় তাঁর এ-ভারতীয় স্মৃতিবাহিতায়, যেমন হুকা। তাছাড়া মৃত্যুর অল্প আগেই বোদল্যার জানান, ভারতবর্ষ বিষয়ে লেখার আগ্রহের কথা, যদিও বাস্তবে তা আর সম্ভব হয় না তাঁর অকাল প্রয়াণের কারণে। ভারতবর্ষ থেকে ফেরার পরের বছরেই বলতে গেলে এক উদ্দাম জীবনাভিজ্ঞতার মুখোমুখি হ’ন কবি। ২১ বছর বয়সে ফরাসি আইন অনুযায়ী তাঁর জোটে পিতৃসূত্রের উত্তরাধিকার। সম্পত্তির অধিকার লাভ করামাত্রই বন্ধুসঙ্গ এবং বেলাগাম ব্যয়ের তোড়ে ভেসে উড়ে যেতে থাকেন বোদল্যার। শেষে রাশ টানবার জন্যে তাঁর মাতা ক্যারোলাইন বাধ্য হয়ে আইনের হস্তক্ষেপের শরণ নেন। ফের রুদ্ধতার মুখোমুখি হলেন কবি। ১৮৫০ সালের দিকে, তখনও তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় নি, বোদল্যার প্রবল স্বাস্থ্যঝুঁকি, ঋণগ্রস্ততা আর অনিশ্চয়তার অতলে পড়েন। পাওনাদারদের মুহূর্মুহূ তালাশের হাত থেকে বাঁচতে ঘন-ঘন বাসাবদল করতে হয় তাঁকে।
এখানে উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক নয়, জীবনে হয়তো একটা কবিতাই লিখেছিলেন তিনি ইংরেজি শিরোনামে- ‘এনিহোয়্যার আউট অব দ্য ওঅর্ল্ড’ (‘পৃথিবীর বাইরে যে-কোনোখানে’)। কেন তাঁর এই ভিন্নভাষী অবতারণা তার কারণ অজানা কিন্তু শুরুটাই দেখুন কী আশ্চর্য রকমের আত্মনিংড়ানো উদ্ভাসন:
“এই জীবন এক হাসপাতাল যেখানে সবাই শয্যাবদলের নাছোড় ভাবনাগ্রস্ত; একজন রোগে ভুগতে চায় চুল্লিটার সামনে,
আরেকজনের বিশ্বাস, জানলার পাশে গেলে অসুখ সেরে যাবে তার। এটা সবসময়ই আমার মনে হয় যে সেই জায়গাটাতেই
আমার ভালো লাগবে যেখানটায় আমি নেই এবং অদলবদলের এই প্রশ্নটা সম্পর্কে অবিরত আমি আলাপ করি আমার
সত্তার সঙ্গে।
‘বলো, হে আমার সত্তা, বেচারা শীতার্ত সত্তা, লিসবনে বসবাসের বিষয়ে তোমার কী ভাবনা? সেখানটা নিশ্চয়ই খুব উষ্ণ,
আর সেখানে তুমি একটা ঘড়িয়ালের মত প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। শহরটা সমুদ্রের তীরে; ওরা বলে মার্বেলে তৈরি।
গাছপালা সেখানকার লোকেদের এত অপছন্দ যে তারা সব গাছ উপড়ে ফেলে। সেখানে তুমি পাবে তোমার
পছন্দের নিসর্গ! আলো আর খনিজের তৈরি একটা নিসর্গ এবং সেসবের প্রতিফলনের জন্যে রয়েছে তরল।
নিরুত্তর আমার সত্তা।
‘যেহেতু তুমি ভালোবাসো গতির পাশাপাশি স্তব্ধতা তুমি কী হল্যান্ডে স্থিত হতে চাও, সেই তুরীয়ানন্দের দেশে?
হয়তো তুমি কিছুটা বৈচিত্র্যের দেখা পাবে সেই দেশে, সেখানকার আর্ট গ্যালারিগুলোতে থাকা সে-দেশের
ছবিগুলোর প্রশংসা করতে তুমি প্রায়শ। রটারডাম বিষয়ে তোমার ধারণা কী, তুমি যে কিনা ভালোবাসো বাড়ির
কোণে নোঙর করে রাখা মাস্তুল আর জাহাজের ভিড়?’
মৌন আমার সত্তা।
‘হয়তোবা ব্যাটাভিয়াই তোমাকে টানে বেশি? সেখানে অন্যান্য সব জিনিসের মধ্যে আমরা পাবো উষ্ণমণ্ডলীয়
সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে গাঁথা ইউরোপিয় আত্মাকে।’
একটি শব্দও নেই। আমার সত্তার কী মৃত্যু ঘটলো?
‘তাহলে কী তুমি রোগগ্রস্ততায় সবকিছু নিরবে মেনে নেওয়ার সেই অসারতার স্তরে পৌঁছালে? তা যদি হয়, তবে চলো
আমরা পালিয়ে যাই মৃত্যু-উপম সেই দেশে। দেখি সেটা কেমন, ওহে বেচারা সত্তা! টর্নিও’র জন্যে আমরা আমাদের
ট্রাঙ্কগুলো গোছগাছ করে নেবো। চলো চলে যাই আরও দূরে বাল্টিকের সর্বশেষ সীমার স্তব্ধতায়; অথবা জীবনের থেকে
আরও দূরের স্তব্ধতায়, যদি তা সম্ভব হয়; চলো আমরা স্থিত হই গিয়ে মেরু অঞ্চলে। সেখানে মৃত্তিকাতলে কেবল
সূর্যেরই তেরছা বিচরণ, আর বৈচিত্র্যকে ঢেকে দেওয়ার ধীর পালাক্রমিক আলো-ছায়া এবং বাড়তে থাকে একঘেঁয়েমি,
সেই আধাআধি না-থাকা। সেখানে দীর্ঘ অন্ধকারের অবগাহনে সক্ষম হবো আমরা আর তখন আমাদের আনন্দের
জন্য মেরুর আলো-ঝলকানি তার গোলাপি রংয়ের রশ্মি পাঠাবে আমাদের যে-আলোকবিচ্ছুরণ ঠিক যেন নরকের
নিজস্ব আতশবাজিরই প্রতিভাস!’
অবশেষে বিস্ফারিত হয় আমার সত্তা এবং সজ্ঞান চিৎকারে ফেটে পড়ে আমার উদ্দেশে: ‘কোথায় সেটা কোনো ব্যাপার
না, কোথায় সেটা কোনো ব্যাপার না! যদি সেটা হয় পৃথিবীরই বাইরে!’
সম্পূর্ণ কবিতাটি পাঠ করলে দেখবো এতে বোদল্যারের সারা জীবনের মর্মকথাটুকু ধরা পড়েছে। এখন বোধকরি এটির ইংরেজি শিরোনাম সম্পর্কে খানিকটা ধারণা করা সম্ভব। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন সারা পৃথিবীর পাঠক ইংরেজি শিরোনামটিকেই যেন মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে। অর্থাৎ সর্বজনবোধ্য একটি আভাস তিনি রেখে যেতে চেয়েছেন তাঁর জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে। তাঁর জীবনী পাঠ করলে দেখা যাবে পিতার মৃত্যুর পর থেকে তাঁর যে-অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, অনারাম, অসহায়তার ক্রমাগ্রাসন তা থেকে তিনি রেহাই কখনও পান নি। ৩৬ বছর বয়সে যে-বছর তাঁর লে ফ্ল্যুর দ্যু মাল বেরোয় কী কাতরভাবে তিনি তাঁর মায়ের স্নেহ-ভালোবাসার কাঙাল হয়ে করুণ মিনতি নিয়ে নিজেকে সঁপে দিতে চাইছেন কিন্তু বিনিময়ে জুটছে কঠিন দেওয়ালের অনুভূতি। একমাত্র নিজের কবিতার ভুবনেই তিনি পেয়েছেন তাঁর আরাধ্য স্বস্তি ও আশ্বাস। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পরিশ্রম করে তৈরি করছেন কবিতার পাণ্ডুলিপি, বন্ধু-প্রকাশক অগাস্ত পুলে মালাসিজের প্রেসে ছাপার জন্য বইয়ের প্রুফ দেখছেন রোগগ্রস্ত শরীরে। তাঁর শারীরিক অসুস্থতা ও ভগ্নতার এতটুকু ছাপ তাঁর সাহিত্যে নেই। যে-ক্লেদের কথা তাঁর কাব্যের শিরোনামে সে-ক্লেদ তাঁর নয়, সেটি সময়ের ও পরিপার্শ্বের। বরং নিজের সত্তার অবিরাম কষ্ট-যন্ত্রণাভোগের কারণে সমকাল ও পরিপার্শ্বের সেই ক্লেদ-গ্লানিকে সম্যকভাবে অনুভব করার কাজটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। নইলে দেখুন যখন তাঁর শারীরিক অবস্থা শোচনীয়, ঋণের দায়ে তিনি জর্জরিত, পাওনাদারদের ঝুঁকি-হুমকি এড়িয়ে ক্রমাগত পলায়নপর তখন সেই দুঃসময়ে তিনি অনুবাদ করে চলেছেন এডগার এ্যালেন পো’র অসাধারণ সব সাহিত্যকর্ম।
অন্যদিকে যে-পো’র জীবনী জেনে বিস্ময়ে নিজেরই ছায়াপাত লক্ষ্য করেন বোদল্যার সেই পো’র জীবনটাও তাঁর জীবনের মতই প্রভূত কষ্ট আর যন্ত্রণার উপলক্ষ্য। মাত্র ৪০ বছরের আয়ূ পেলেও বিশ্বসাহিত্যের এক সেরা লেখক হিসেবে পরিগণিত এডগার এ্যালেন পো (১৮০৯-১৮৪৯)। জন্মের এক বছরের মধ্যেই হারান পিতাকে। সন্তান এবং স্ত্রীকে ত্যাগ করে চলে যান পিতা ডেভিড পো। ঠিক এর পরের বছরেই মৃত্যু হয় মা এলিজা পো’য়ের। ভার্জিনিয়ায় এক পরিবার চিরঅনাথ তাঁকে গ্রহণ করে যেখানে তিনি কেবলই আশ্রিত হয়ে থাকেন কিন্তু পৃষ্ঠপোষিত হ’ন না। উপরন্তু আশ্রয়দাতা জন এ্যালান এবং পো’র মধ্যে চলে তীব্র রেষারেষি- বিষয়, পো’র অপরিসীম দেনা। জুয়াখেলা এবং লেখাপড়ার খরচ যোগাতে ঋণ করতে হয় পো’কে। লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই মেধাবী পো শুরু করেন লেখালেখির পেশা। আামদের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত পো’কেও বেঁচে থাকতে হয় কেবল লেখালেখিকেই সম্বল করে। তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অজানা হলেও বস্তুত রোগশোক, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান, মাদকতা, আত্মহত্যাপ্রবণতা এসব বহু কারণকে দায়ী করা হয়। তাঁর বিখ্যাত ‘র্যাভেন’ কবিতার কথা বলা যায় যেটি প্রকাশ হওয়ামাত্রই পো পৌঁছে যান খ্যাতির শিখরে। কবিতাটির একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র লেনোর নামের একটি মেয়ে যার স্মৃতির আশ্রয়েই রচিত কবিতাটি। বার-বার ঘুরে-ফিরে আসে মেয়েটির স্মৃতি আর ছড়িয়ে দেয় বিষণ্ণতা। ধ্রুবপদের মত কবিতাটিতে বেদনা ছড়িয়ে দেয় এ-বার্তা- লেনোর আর কখনও আসবে না। কবিতাটির ফরাসি ভাষার সংস্করণের ভূমিকায় বোদল্যার লেখেন: কবিতাটিতে রয়েছে হতাশার নির্ঘুমতা; এতে অভাব নেই কিছুরই, ভাবের উত্তাপ কিংবা রঙের সন্ত্রাস, এমনকি যন্ত্রণাভোগের মারাত্মক আস্বাদ যা কবিতাটিকে আরও চরমের দিকে নিয়ে যায়। বোদল্যার এবং তাঁর জীবনের আমেরিকান সংস্করণই হয়তো এডগার পো। আর কবিতাটির লেনোর যেন তাঁরই প্রেমিকা যে তাঁর জীবনে বার-বার আসে এবং তারপর তাঁকে বিষাদে ভাসিয়ে ছেড়ে যায় চিরতরে। সেভাবেই তিনি ছিলেন পো’মগ্ন। এডগার এ্যালেন পো বোদল্যারের সুহৃদ থিওফিল গতিয়ের মত ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ ঘরানার অন্যতম অনুসারী ছিলেন কিন্তু বোদল্যার অত্যন্ত মুন্সীয়ানার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন পো’র জীবন এবং জীবনবাদকে। জীবনের চরম কষ্ট-যন্ত্রণাভোগের পরেও সেই নির্যাতিত জীবনের আলো দিয়েই যে উজ্জ্বল রশ্মির সৃষ্টি করা যায় সেটাকেই বোদল্যার প্রমাণ করতে চেয়েছেন তাঁর মহান পূর্বসূরী পো’র সাহিত্যকর্মের যোগাযোগে।
চলবে…




