ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র ও হাওড়া জেলা

রবিদাস সাহারায় তাঁর ‘আমাদের শরৎচন্দ্র’ গ্রন্থে জানিয়েছিলেন যে, সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে নিজের রাজনৈতিক গুরুপদে বরণ করে নেওয়ার আগে হাওড়া শহরের বাসিন্দা কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁকে নিজের রাজনৈতিক গুরুপদে বরণ করে নিয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় যে, ১৯২১ সালে দেশবন্ধুই শরৎচন্দ্রকে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি করে দিয়েছিলেন। (আমাদের শরৎচন্দ্র, রবিদাস সাহারায়, পৃ: ১০৯ ও ৯৭) এসময়ে সুভাষচন্দ্র ও শরৎচন্দ্র উভয়ে উভয়ের সতীর্থ হওয়ার জন্য তাঁদের দু’জনেরই মোধ্যে অসামান্য মনের মিল দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। অন্যদিকে বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও সর্বোপরি কর্মী সুভাষকে পেয়ে এবং বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী ও সর্বোপরি পরামর্শদাতা শরৎচন্দ্রকে পেয়ে এসময়ে দেশবন্ধুও যেন নববলে বলীয়ান হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু একইসময়ে আবার একদিকে কংগ্রেসের অনুদার নেতৃত্বের, এবং অন্যদিকে অত্যাচারী ও দলন-নীতি পরায়ণ বৃটিশ সরকারের—এই উভয় পক্ষ থেকেই দেশবন্ধুর উপরে ঝটিকা বর্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে জেলে বন্দি থাকবার কারণে দেশবন্ধু ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেদাবাদে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে, এবং ১৯২২ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। এরপরে ১৯২২ সালের ৯ই আগস্ট তারিখে তিনি কারামুক্ত হয়েছিলেন, আর সেই বছরের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে কংগ্রেসের জাতীয় কাউন্সিলে প্রবেশনীতি নিয়ে তুমুল মতবিরোধ হওয়ার জন্য তিনি সভাপতির পদ ত্যাগ করে কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই তাঁর সমর্থকদের নিয়ে ১৯২৩ সালের ১লা জানুয়ারি তারিখে ‘স্বরাজ্য দল’ নামের একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। এসময়ে সুভাষচন্দ্র ও শরৎচন্দ্র দেশবন্ধুর যথাক্রমে ডান হাত ও বাঁ হাত ছিলেন। (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও সুভাষচন্দ্র, অপর্ণা দেবী, পশ্চিমবঙ্গ নেতাজী সংখ্যা, ১৪০৩ বঙ্গাব্দ, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ: ৫৮-৫৯; আমাদের শরৎচন্দ্র, রবিদাস সাহারায়, পৃ- ৯৮) কিন্তু এভাবে স্বরাজ্যদল গঠন করবার পরে একদিকে বিরুদ্ধ দলের আক্রমণ এবং অন্যদিকে আর্থিক দৈন্যে দেশবন্ধু তখন জেরবার হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর এসময়ের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে রবিদাস সাহারায় তাঁর ‘আমাদের শরৎচন্দ্র’ গ্রন্থের ৯৮-৯৯নং পৃষ্ঠায় জানিয়েছিলেন—
“বিরুদ্ধদল গালিগালাজ না করে কোন কথা বলে না। দেশবন্ধুর সে কি অবস্থা। শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র উদ্বিগ্ন হয়ে চারদিকে ছুটোছুটি করতে থাকেন। … অর্থসংগ্রহের জন্য বড়লোকদের কাছে কাছে ধরনা না দিয়ে উপায় থাকতো না। একাজে সুভাষচন্দ্র ও শরৎচন্দ্র দেশবন্ধুর সঙ্গী হতেন।”
এমনকি একবার প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই—
“দেশবন্ধু শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে শিয়ালদহ অঞ্চলে এক বড়লোকের বাড়িতে অর্থসংগ্রহের জন্য গেলেন।”

যাই হোক, দেশবন্ধুর কেন্দ্রীয় পরিচালনায় সুভাষচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের ঐকান্তিক সখ্যতাতেই এসময়ে হাওড়াতেও স্বরাজ্য দলের একটি শাখা গড়ে উঠেছিল, এবং কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রই এর সভাপতি হয়েছিলেন। (শরৎ স্মৃতি, ডঃ সত্যপ্রসাদ সেনগুপ্ত, পৃ: ৮০ ও ১১৭) প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় যে, স্বরাজ্য দল তখন সিন্ধু ও বাংলা ছাড়া তদানীন্তন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল; এবং হাওড়া জেলাতেই স্বরাজ্য দলের সর্বাধিক প্রভাব ছিল। এরপরে ১৯২৪ সালে হাওড়া মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের নির্বাচনে দেশবন্ধুর নেতৃত্বেই কংগ্রেস একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে দেশবন্ধুকে তখন হাওড়া শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে সভা করবার জন্য উপস্থিত হতে হয়েছিল। এসময়ে দেশবন্ধু ও শরৎচন্দ্রের মধ্যেকার সম্পর্কের নিবিড়তা এমন একটা স্তরে পৌঁছেছিল যে, দেশবন্ধু তাঁর গৃহদেবতা গোবিন্দজীর সেবা পূজার জন্য বিগ্রহটিকে শরৎচন্দ্রের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। আসলে এসময়ে দেশবন্ধু ও তাঁর সহধর্মিনী বাসন্তী দেবী উভয়েই রাজনৈতিক কার্যকলাপে গভীরভাবে লিপ্ত ছিলেন বলে, তাঁরা উভয়েই যদি একত্রে কারান্তরালে চলে যান, তাহলে গোবিন্দদেবের নিত্যপূজার কি হবে— এই আশঙ্কাতেই গোবিন্দদেব বিগ্রহটিকে শরৎচন্দ্রের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। (শরৎ স্মৃতি, ডঃ সত্যপ্রসাদ সেনগুপ্ত, পৃ: ৮০ ও ১১৭)

চৌরীচৌরা ঘটনার পরে বারদৌলিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত করে দেওয়ার পরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এ ঘটনা ‘বারদৌলি হল্ট’ নামে চিহ্নিত হয়েছিল। এসময়ে গান্ধীজির এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি শরৎচন্দ্র যদিও এই ঘটনাকে ‘কণ্ঠরোধ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, কিন্তু তবুও অহিংসার প্রতি গান্ধীজির আন্তরিক শ্রদ্ধার জন্য শরৎচন্দ্র তাঁর প্রতি নিজের শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেননি। সমকালে সুভাষচন্দ্রও এই একই পথ অনুসরণ করেছিলেন। ডঃ প্রদ্যোত সেনগুপ্ত জানিয়েছিলেন যে, তখনকার—
“কংগ্রেস রাজনীতিতে হিংসা-অহিংসা বা বামদক্ষিণ অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রশ্নে শরৎচন্দ্র ছিলেন সুভাষবাদী।” (শবৎচন্দ্র ও বাজে শিবপুর, ডঃ প্রদ্যোত সেনগুপ্ত, হাওড়া জেলা ও শরৎচন্দ্র সম্পাদনা, নির্মল কুমার খাঁ, পৃ: ৪৪-৪৬)

১৯২৩ সালের ২৩শে আগস্ট তারিখে হাওড়া টাউন হলে ১৭তম গান্ধী পুণ্যাহ সভায় সুভাষচন্দ্র তাঁর ভাষণে বলেছিলেন যে—
“শ্রমিকদের সংগঠিত করবার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা আছে এবং সেইদিক থেকে হাওড়া সবচেয়ে ভাল এলাকা। কেন না এইস্থানের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ দিন মজুর, যাঁদের অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন না করে তুললে দেশের পরিত্রাণ ঘটবে না। কেননা এই অঞ্চলের শ্রমিকরা দুই বৎসর আগে গুলিচালনা অগ্রাহ্য করে বিদেশী বস্ত্রের দোকানে পিকেটিং করেছিল।”

এছাড়া এদিন সুভাষচন্দ্র তাঁদের জাতীয় আদর্শের খাতিরে যথাসম্ভব ত্যাগ করবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। (সুভাষচন্দ্রের জীবনদর্শন ও রচনা সম্ভার, তথ্যপঞ্জী— অসিতাভ দাশ, পশ্চিমবঙ্গ, নেতাজী সংখ্যা, ১৪০৩ বঙ্গাব্দ, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ- ২৫১)
অনুরূপভাবেই এরপরে ১৯২৯ সালে অনুষ্ঠিত হাওড়া জেলা যুব সম্মেলনের অভিভাষণে তিনি বলেছিলেন যে, বিশ্বের সব মানবীয় সৃষ্টির পিছনেই শক্তিমত্ত যৌবন রয়েছে। গণশক্তিই হলো মূলশক্তি, আর দেশকে বড় করতে গেলে এদের সঠিক পথে চালাতে হবে। আর এজন্য সর্বত্যাগী কর্মীদল দরকার, স্বদেশ সেবাই যাঁদের জীবনের ধ্রুবলক্ষ্য হবে। (সুভাষচন্দ্রের জীবনদর্শন ও রচনা সম্ভার, তথ্যপঞ্জী— অসিতাভ দাশ, পশ্চিমবঙ্গ, নেতাজী সংখ্যা, ১৪০৩ বঙ্গাব্দ, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ- ২৪৬)

সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনেতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, হিন্দু-মুসলিম চুক্তির সুবাদে বাংলায় মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দুদের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের পরিচয় ঘটেছিল। এছাড়া কলকাতা কপোরেশনের মুখ্য কার্যনির্বাহী অফিসার হিসেবে কাজ করবার সময়ে, বস্তিবাসীরা যে কায়েমি স্বার্থবাদীদের অপরিসীম লোভের চিরস্থায়ী শিকার—এটাও তাঁর গোচরীভূত হয়েছিল। (বঙ্গদেশের রাজনীতি ও সুভাষচন্দ্র, বাসব সরকার, পশ্চিমবঙ্গ, নেতাজী সংখ্যা, ১৪০৩ বঙ্গাব্দ, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ- ১৩৬) এরই ফলে শ্রমিক-কৃষকদের প্রতি তাঁর সাধারণ সহানুভূতি জাগ্রত হয়ে উঠেছিল, এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের দ্বারাই তাঁদের এই দীনহীন অবস্থা থেকে মুক্তিলাভ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেছিলেন।

হাওড়ার তরুণদের ব্যাপকভাবে স্বদেশীকার্যে অংশগ্রহণ করবার ফলে জাতীয় কংগ্রেস একসময় এখানে খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। বামপন্থী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ এবং সুভাষ-নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে হাওড়ার হরেন্দ্রনাথ ঘোষের জেলা কংগ্রেস পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করাকে এর প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়ে থাকে। সুভাষচন্দ্র যেমন নিজের অদ্ভুত ক্ষিপ্রতা ও যোগ্যতার সঙ্গে নিখিলবঙ্গ যুবক সমিতি গঠন করে অল্পকালের মধ্যেই বাংলার সব জেলাতে এর শাখা প্রশাখা বিস্তৃত করে দিয়েছিলেন, হরেন্দ্রনাথও তেমনি বিলাত থেকে ফিরে এসে তাঁর দাদা সুরেন্দ্রনাথের হাতে গড়া স্বদেশী আন্দোলনের ক্লাব হাওড়া সেবা সঙ্ঘের পরিচালনার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন, এবং তাঁর দাদা সুরেন্দ্রনাথ, কংগ্রেস নেতা অজিত মল্লিক, হাওড়া কোর্টের বিশিষ্ট ব্যবহারজীবী ধীরেন সেন, সন্তোষ ঘোষাল ও গৌরমোহন রায় প্রমুখের সহযোগিতায় সঙ্ঘের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেছিলেন। এমনকি সামরিক কায়দায় বাদ্যযন্ত্র শিক্ষা করাবার জন্য এসময়ে তিনি হাওড়া ভলান্টিয়ার্স নামের একটি অসামরিক ব্যান্ড পার্টিও তৈরি করেছিলেন। (নেতাজী সুভাষচন্দ্র, শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায়, পৃ- ১০; পাঁচশো বছরের হাওড়া, হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ- ১১৬; বিপ্লবী হরেন্দ্রনাথ ঘোষের সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচয়, অমিয় ঘোষ, ডঃ শিশির কর সম্পাদিত) এই হাওড়া সেবা সঙ্ঘ সম্পর্কে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটীয়ারের পঞ্চদশ অধ্যায়ের ৫৬৩নং পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছিল—
“Established in 1923, the Howrah Seva Sangha since its inception was associated with all national movements for attainment of the country’s freedom. Its office and library are situated at 33/1 Narasingha Dutta Road and Gymnasium and playground at 74, Kalachand Nandy Lane, Howrah. Affiliated to various statewide organisations, it promotes physical culture, sports and games, cultural programmes and community worship.

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে হাওড়া সেবা সঙ্ঘের অবদানের কথা ইতিহাসে স্বীকৃত। এছাড়া তৎকালীন হাওড়া জেলায় স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠিত করবার ক্ষেত্রে বিভিন্ন যুবসংগঠনগুলিরও বিশেষ ভূমিকা ছিল। এপ্রসঙ্গে প্রথমেই এখানে হাওড়া সঙ্ঘের কথা উল্লেখ্য। যদিও একসময়ে এই হাওড়া সঙ্ঘের একদল যুবক, যাঁরা মূলতঃ এই সঙ্ঘ স্থাপন করেছিলেন, সুভাষচন্দ্র বসু ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের মধ্যেকার রাজনৈতিক বিবাদকে কেন্দ্র করে সেনগুপ্তপন্থী হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু পরে এঁরাও সুভাষচন্দ্রকেই অনুসরণ করতে শুরু করেছিলেন। অন্যদিকে সমকালে সুভাষচন্দ্রের অনুগামীরাই শিবপুর তরুণ সমিতি গড়ে তুলেছিলেন। ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এখানে যাতায়াত করতেন বলে জানা যায়। তবে তিনি কারোর দলেই ছিলেন না। তিনি যুবকদের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ গ্রহণের উপরে জোর দিয়েছিলেন। এই তরুণ সমিতির কর্মকর্তাদের মধ্যে শিবপুরের রামমোহন মুখার্জী লেনের অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের তখন একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। ইনি পরে কমিউনিস্ট আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন, এবং হাওড়া জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ একটা ভূমিকা নিয়েছিলেন। এছাড়া হাওড়া জেলায় কৃষক সংগঠন গড়ে তোলবার ক্ষেত্রেও তাঁর একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। এরপরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তাঁর উপরে পুলিশী নির্যাতন নেমে এসেছিল। আর ইতিমধ্যে শিবপুরের তরুণ সমিতি কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত একটি সংগঠনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।

হাওড়ার কুঞ্জবিহারী দত্তের পুত্র কার্তিকচন্দ্র দত্ত হাওড়া সেবা সঙ্ঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্ব করবার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য ছিল। তিনি হরেন্দ্রনাথের সুযোগ্য সহকারী ছিলেন। তৎকালীন হাওড়া শহর এবং সন্নিহিত গ্রামগুলির প্রায় সব যুব সংগঠনগুলির সঙ্গে তাঁর নিবিড় সংযোগ ছিল। তবে তিনি প্রধানতঃ যুব আন্দোলনের সংগঠক এবং হাওড়া ভলান্টিয়ার দলের নায়ক ছিলেন। (স্বাধীনতা সংগ্রামে হাওড়া জেলার সেনানীবৃন্দ, প্রফুল্ল দাশগুপ্ত সম্পাদিত, পৃ- ১০৫)

১৯২৮ সালে পার্কসার্কাস ময়দানে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র যখন জি. ও. সি. হয়েছিলেন, তখন হাওড়ার হাজার হাজার যুবক এই অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। সেদিন হাওড়া জেলার উনসানির নারায়ণ দাস দে এই বিরাট স্বেচ্ছাবাহিনীকে সাজাবার দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

এরপরে সুভাষচন্দ্র বসুর আহ্বানে এবং হরেন্দ্রনাথ ঘোষের নেতৃত্বে হাওড়ার দানু বসু, বৃন্দাবন বসু, সুনীল দাস, হেমন্ত কুমার দে, ঘন্টু বাবু, ডাঃ আলী ইমাম, উলুবেড়িয়ার বিভূতি (নানু) ঘোষ প্রমুখ তরুণ কর্মীরা কংগ্রেসের যুব সংগঠন গড়বার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এঁদের মধ্যে উলুবেড়িয়ার বিভূতি (নানু) ঘোষ তখন হাওড়া জেলার সর্বত্র যুব সংগঠন শক্তিশালী করবার কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। ফলে সমকালের হাওড়ায় লাঠিখেলা, ছোরা খেলা শিক্ষার সঙ্গে গ্রামে গ্রামে কৃষক সংগঠনও গড়ে উঠেছিল। আর জমিদারি অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকরা আন্দোলন করতে শুরু করেছিলেন। বিশেষতঃ এসময়ে উলুবেড়িয়া মহকুমায় কৃষক সংগঠন জোরদার হয়ে উঠেছিল। এই মহকুমায় তখন ‘কুৎখামার’ প্রথা নামের একটি জঘন্য প্রথার মাধ্যমে কৃষকদের শোষণ করা হত। সুভাষচন্দ্রের অনুগামী আমতা থানার থলিয়া গ্রামের তারাপদ মজুমদারের নেতৃত্বে এখানকার কৃষকেরা তখন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তারাপদ মজুমদারই তখন এখানে কৃষকদের সংগঠিত করবার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিলেন। এছাড়া অন্যান্য যাঁরা তখন এই আন্দোলন পরিচালনা করবার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিভূতি ঘোষ (নানু), মনোমোহন রায়, সত্যচরণ দাস (মেদিনীপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখ্য। (বিপ্লবী হরেন্দ্রনাথ ঘোষের সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচয়, অমিয় ঘোষ, ডঃ শিশির কর সম্পাদিত)

এছাড়া হাওড়া জেলার শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন সংগঠনে এবং নিজের অনুগামীদের পরিচালনার ক্ষেত্রেও বরাবরই সুভাষচন্দ্রের ব্যাপক কর্মোদ্দীপনা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ১৯২৮ সালের ২৮শে মার্চ তারিখে লিলুয়ায় রেলশ্রমিকদের উপরে পুলিশের গুলিচালনার ঘটনার পরে সুভাষচন্দ্রের হস্তক্ষেপেই হাওড়া জেলার তদানীন্তন জেলাশাসক গুরুদাস দত্ত বামুনগাছি লোকোশেডের ডি.সি.এম.ই মিঃ গোল্ডকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। এরপরে ১৯২৮ সালের ২১শে এপ্রিল তারিখে লিলুয়ার ধর্মঘটি শ্রমিকদের সমর্থনে সুভাষচন্দ্র তাঁর একটি বিবৃতিতে বলেছিলেন—
“দুঃস্থ শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘবের জন্য সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে এবং রাষ্ট্রের যাবতীয় শক্তির সমর্থনপুষ্ট মূলধনের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের লড়াইয়ে যথাসাধ্য করতে জনসাধারণের নিকট আমরা আবেদন জানাচ্ছি।” (দীপ্ত প্রবন্ধ ও পত্রাবলীর আলোকে সুভাষচন্দ্র, ধ্রুব মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ, নেতাজী সংখ্যা, ১৪০৩ বঙ্গাব্দ, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ- ২২৯)

এছাড়া ১৯২৮ সালের ২৭শে নভেম্বর তারিখে বাউড়িয়া চটকল শ্রমিকদের ধর্মঘটের সমর্থনে তিনি তাঁর প্রদত্ত বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন—
“চটকলের শ্রমিকরা ৪ মাস ধরে ধর্মঘট করছেন। তাঁরা অটল, ঐক্যবদ্ধ এবং দৃঢ়সংকল্প। ধর্মঘটীদের এক বিশাল সভায় আমার বক্তৃতা দেবার সুযোগ হয়েছিল এবং আমি দেখেছিলাম তাঁদের মানসিকতা নির্ভীক। দীর্ঘস্থায়ী এই সংগ্রামে তাঁরা যে তেজস্বিতা এবং সাহস প্রদর্শন করেছেন আমি তা শ্রদ্ধা করি। তাঁরা বাইরে থেকে কার্যত কোন সাহায্য পাননি, কিন্তু তবুও তাঁরা বীরের মত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।” (দীপ্ত প্রবন্ধ ও পত্রাবলীর আলোকে সুভাষচন্দ্র, ধ্রুব মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ, নেতাজী সংখ্যা, ১৪০৩ বঙ্গাব্দ, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ- ২৩০)

এসময়ে বামপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষচন্দ্র বসু রাজগঞ্জে ও সাঁকরাইলেও শ্রমিকদের মধ্যে সভা করেছিলেন বলে জানা যায়। (হাওড়া জেলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের ইতিহাস, অমিতাভ চন্দ্র, শারদীয় পদাতিক, ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ, পৃ- ২৭)

এরপরে ১৯২৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি তারিখে লিলুয়া ময়দানে অনুষ্ঠিত একটি শ্রমিক সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে তিনি শ্রমিকদের সুসংগঠিত হয়ে আন্দোলন করবার উপরে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। (সুভাষচন্দ্রের জীবনদর্শন ও রচনা সম্ভার, তথ্যপঞ্জী—অসিতাভ দাশ, পশ্চিমবঙ্গ, নেতাজী সংখ্যা, ১৩০৪ বঙ্গাব্দ, পৃ- ২৭০)

সমকালে ১৯২৯ সালের ১৬ই আগস্ট তারিখে লিলুয়া ময়দানে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেল ইউনিয়নের উদ্যোগে যে শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে সুভাষচন্দ্র সভাপতি পদে ছিলেন। এদিন তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন যে, স্বরাজ আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের কোন পার্থক্য নেই। বরং উভয় আন্দোলনই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। তাই শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিগুলিকে পুস্তকাকারে প্রকাশ করে সারা বিশ্বের কাছে জানাতে হবে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলির প্রথম কর্তব্য হল ইউনিয়নের স্বীকৃতি আদায় করা, স্থায়ী ভিত্তির উপরে সংগঠনকে গড়ে তোলা এবং ঘন ঘন ধর্মঘটের ডাক না দিয়ে শিল্পবিরোধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া।” (সুভাষচন্দ্রের জীবনদর্শন ও রচনা সম্ভার, তথ্যপঞ্জী—অসিতাভ দাশ, পশ্চিমবঙ্গ, নেতাজী সংখ্যা, ১৩০৪ বঙ্গাব্দ, পৃ- ২৫৫)

এরপরে ১৯৩৬ সালে ইউরোপ থেকে বোম্বাইতে পদার্পন করবার পরেই সুভাষচন্দ্র বসু যখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তখন সারা বাংলাব্যাপী বিরাট আন্দোলন শুরু হয়েছিল; এমনকি স্কুল-কলেজেও ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। এসময়ে হাওড়ায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরেন্দ্রনাথ ঘোষ, কৃষ্ণকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু ভট্টাচার্য প্রমুখের নেতৃত্বে বিরাট বিক্ষোভ মিছিল বের হয়েছিল।
১৯৩৭ সালে হাওড়া টাউন হলে জেলা কংগ্রেসের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে শরৎচন্দ্র বসু প্রধান অতিথি হয়েছিলেন।

এরপরে ১৯৩৮ সালে কংগ্রেসে যখন বিভেদ দেখা দিয়েছিল, তখন হাওড়ার হরেন্দ্রনাথ ঘোষ, কৃষ্ণকুমার চট্টোপাধ্যায়, কার্তিক দত্ত, সুহৃদ বিশ্বাস প্রমুখ নেতৃবর্গ সুভাষচন্দ্রকেই সমর্থন করেছিলেন। এছাড়া এসময়ে মূলতঃ সুভাষচন্দ্রের নির্দেশেই হাওড়া জেলায় কৃষক-শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু অন্যদিকে তখন কোন শ্রমিক-কৃষক সংগঠন গড়ে তোলবার ব্যাপারে কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গী কি ছিল, এবিষয়ে সুপ্রকাশ রায় রচিত ‘ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থের ৫৭৭-৫৭৮নং পৃষ্ঠা থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে যা নিম্নরূপ—
“সভাপতির পদ ত্যাগ করিবার পর সুভাষচন্দ্র তাঁহার সমর্থক কংগ্রেস-সভ্যদের এবং কংগ্রেসের চরমপন্থী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীদের একত্র করিবার উদ্দেশ্যে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন হইতে কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করিয়া স্বাধীনতা লাভের জন্য সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করিবার আবেদন জানানো হয়। ইহার সঙ্গে সঙ্গে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ ও অন্যান্য বামপন্থীরা একত্রিত হইয়া পরস্পরের সহিত সংযোগ রক্ষা এবং খণ্ড খণ্ড ও ব্যাপক সংগ্রাম পরিচালনার উদ্দেশ্যে ‘বামপন্থী ঐক্য কমিটি’ (Left Consolidation Committee) গঠন করেন। … ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ ও অন্যান্য বামপন্থীদের সংগ্রামের আহ্বানে শঙ্কিত হইয়া কংগ্রেস-নেতৃবৃন্দ নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির এক অধিবেশনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পাশ করেন। এই সকল প্রস্তাব দ্বারা কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রে আরও কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার প্রবর্তন করা হয়, কংগ্রেস মন্ত্রীদের সম্পর্কে প্রাদেশিক কংগ্রেস-কমিটির অধিকার বিশেষভাবে খর্ব করা হয় এবং কংগ্রেসের উচ্চ নেতৃত্বের সম্মতি ব্যতীত কংগ্রেস কর্মীদের শ্রমিক-কৃষকের আন্দোলন, নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ প্রভৃতি সংগ্রামে যোগদান নিষিদ্ধ করা হয়। শ্রমিক-কৃষক ও জনসাধারণের দৈনন্দিন সংগ্রাম বন্ধ করাই ছিল এই সকল প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।”

আর কংগ্রেসের এই শেষোক্ত প্রস্তাবের বিরুদ্ধেই ১৯৩৯ সালের ৯ই জুলাই তারিখে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে দেশের সর্বত্র সভা-শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপরে এই ঘটনার শাস্তিস্বরূপই তাঁকে তিন বছরের জন্য বাংলার কংগ্রেস সভাপতির পদ এবং এমনকি কংগ্রেসের কোন কর্মকর্তার পদের জন্যও অনুপযুক্ত বলে কংগ্রেস নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল। এই রাজনৈতিক সঙ্কটের সময়ে হাওড়া জেলার যুবসমাজ এই সুভাষচন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম-বিমুখ উচ্চ কংগ্রেস নেতৃত্বের বিবোধিতা করেছিল। প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় যে, এসময়ে সুভাষচন্দ্র দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন যে—‘হাওড়া আমার দুর্গ।’

এই ঘটনার কিছু পরেই ১৯৩৯ সালের ২২শে জুন তারিখে সুভাষচন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামক রাজনৈতিক দলটি গড়ে তুলেছিলেন। অবশ্য এর আগে থেকেই ঘটনাক্রম আন্দাজ করে তিনি তাঁর নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্য বিবৃত করে বিভিন্ন সভা সমিতিতে বক্তব্য রাখতে শুরু করেছিলেন। এসময়ে ১৯৩৯ সালের ৮ই মে তারিখে হাওড়া বেলিলিয়স পার্কে অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় তিনি তাঁর সংগ্রামী কর্মসূচীর মাধ্যমে শীঘ্রই ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যকে তুলে ধরেছিলেন, এবং ‘আগামী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হোন’—এই ধ্বনি নিয়ে সকলকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বার আহ্বান জানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এসময়ে তিনি কংগ্রেসের সব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিপ্লবী শক্তি ও প্রগতিশীল শক্তিগুলিকেও একজায়গায় মিলিত হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। এরপরে ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে রামগড়ে আপোষ বিরোধী যে পাল্টা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে হাওড়ার স্বেচ্ছাসেবকরা ও হাওড়া সঙ্ঘ, সেবা সঙ্ঘ প্রভৃতির মিলিত ব্যান্ডপার্টির সামরিক শৃঙ্খলাবোধ প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। (বিপ্লবী হরেন্দ্রনাথ ঘোষের সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচয়, অমিয় ঘোষ, ডঃ শিশির কর সম্পাদিত) এই রামগড় কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রকে সমর্থন করবার জন্যই হরেন ঘোষের নেতৃত্বে হাওড়া থেকে মূল স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী তখন সেখানে উপস্থিত হয়েছিল।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সুভাষচন্দ্র যখন কংগ্রেসের সব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং বাইরের প্রগতিশীল ও বিপ্লবীশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ভারতবর্ষে তথা বাংলায় কমিউনিস্ট দলের অথবা মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের অভ্যুদয় ঘটছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সুভাষচন্দ্র তাঁর ‘The Indian Struggle’ গ্রন্থে কমিউনিস্টদের সম্বন্ধে খুব একটা ভালো ধারণা পোষণ তো করেনই নি, বরং কমিউনিজম ও ফ্যাসিজমকে তিনি অনেকটা এক করেই দেখিয়েছিলেন; এবং এই উভয় মতবাদের একটা মিলন (Synthesis) ঘটাতে চেয়েছিলেন, যা ইতিহাসগতভাবে অসম্ভব ছিল। তবে ১৯৩৮ সালের গোড়ার দিকে বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির বিখ্যাত নেতা রজনীপাম দত্তের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি কমিউনিস্টদের সম্বন্ধে তাঁর মতপরিবর্তনের কথা জানিয়েছিলেন, এবং পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন যে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মোর্চায় পরিণত করে একাধারে স্বাধীনতা অর্জন ও অন্যদিকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসময়ে রজনীপাম দত্তের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র যে মত ব্যক্ত করেছিলেন, পরবর্তীসময়ে দুর্গাপ্রসাদ মজুমদার তাঁর ‘সুভাষচন্দ্র বসুর অর্থনৈতিক চিন্তার ক্রমবিকাশ’ শিরোনামের প্রবন্ধে তা উদ্ধৃত করেছিলেন। এই প্রবন্ধের প্রাসঙ্গিক অংশ নিম্নরূপ—
“My political ideas have developed further since I wrote my book three years ago … I should point out also that communism as it appeared to be demonstrated by many of those who were supposed to stand for it in India seemed to me anti-national, and this impression was further strengthened in view of the hostile attitude which several among them exhibited towards the Indian National Congress. It is clear, however, that the position to-day has fundamentally altered.
I should add that I have always understood and am quite satisfied that communism, as it has been expressed in the writings of Marx and Lenin and in the official statements of policy of the Communist International, gives full support to the struggle for national independence and recognizes this as an integral part of the world out-look.
My personal view to-day is that the Indian National Congress should be organized on the broadest anti-imperialist front, and should have the two-fold objective of winning political freedom and the establishment of a socialist regime.” (পশ্চিমবঙ্গ, নেতাজী সংখ্যা, ১৪০৩ বঙ্গাব্দ, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ- ১২৬)

আসলে সুভাষচন্দ্র কিন্তু কোন সময়েই কমিউনিজমের আদর্শ অনুযায়ী শ্রেণী সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু তবুও এদেশ থেকে তাঁর মহানিষ্ক্রমণের অব্যবহিত পূর্বে বিশিষ্ট কমিউনিস্ট ব্যবহারজীবী স্নেহাংশুকান্ত আচার্যচৌধুরীর কাছ থেকে অর্থ সাহায্য গ্রহণ, কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত পাঞ্জাবের কৃষক সংগঠন ‘কীর্তি কিষাণ পার্টি’র কর্মীদের সক্রিয় সহযোগিতায় মহানিষ্ক্রমণের সময়ে ভারত-সীমান্তে গমন এবং দেশত্যাগের পরে ভারতের বা আন্তর্জাতিক স্তরের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির সম্পর্কে কোন ধরণের বিরূপ মন্তব্য না করবার মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্টদের সম্পর্কে তাঁর ধারণার পরিবর্তন কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়।

যাই হোক, ১৯৪০ সালের ২৮ বা ২৯শে জুন তারিখে হাওড়ার রামরাজাতলায় প্রায় দশহাজার মানুষের যে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে সুভাষচন্দ্র প্রধানবক্তা ছিলেন। এদিন তিনি পাঁচটার সময়ে সভায় উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও শেষপর্যন্ত রাত ন’টায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বৃটিশ বিরোধী চেতনায় মানুষরা এদিন সভাস্থল ত্যাগ করেন নি।

১৯৩৯ সালে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠিত হওয়ার পরে হরেন্দ্রনাথ ঘোষের নেতৃত্বে কংগ্রেসের বিশিষ্ট কর্মকর্তারা এতে যোগ দিয়েছিলেন যোগ দেন। এসময়ে হরেন ঘোষ হাওড়া জেলা ফরওয়ার্ড ব্লকের সভাপতি, এবং বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য এর সম্পাদক হয়েছিলেন। সমকালে সন্তোষ ঘোষাল, কৃষ্ণ চ্যাটার্জী, ধীরেন সেন প্রমুখ ব্যক্তিরাও ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে অরুণ ব্যানার্জী, কার্তিক দত্ত, বঙ্কিম কর, বিজন চক্রবর্তী, ডাঃ বেণী দত্ত প্রমুখ ব্যক্তিরা এসময়ে কংগ্রেসেই থেকে গিয়েছিলেন। (হাওড়া জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা, ডঃ শিশির কর)

লক্ষ্য করবার বিষয় হল যে, এরপরে হাওড়া জেলাই সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। তখন এই জেলায় কোন সভা-সমিতি অনুষ্ঠিত হলেই তাঁকে আহ্বান করা হত এবং তিনি তাতে উপস্থিতও হতেন। এমনকি এরপরে দেশত্যাগ করবার আগে হাওড়া জেলার শালকিয়াতেই তিনি তাঁর শেষ জনসভা করে গিয়েছিলেন।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!