।।দ্বিতীয় পর্ব।।
নিজের আফ্রিকিয় উত্তরাধিকার এবং সেটির সঙ্গে তাঁর মার্কিন বর্তমানতার মেলবন্ধনটাকেই টনি মরিসন ভবিতব্যের জীবনবিকাশের মূল সঞ্চয় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেওয়ার আগে যখন তিনি বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদনার চাকুরি করেন তখন থেকেই তিনি আফ্রো-আমেরিকা বিষয়ে সচেতন। মূল্যবান সব প্রকাশনা সম্পাদনা করে কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয় সমৃদ্ধ করেন গোটা বিশ্বকে। র্যান্ডম হাউজ থেকে প্রকাশ করেন মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর জীবনী, হেনরি ডুমাস, এ্যাঞ্জেলা ডেভিস এবং এইচ পি নিউটনের সাহিত্যকর্ম। অনেক লেখকের আবিষ্কর্তাও তাঁকে বলা যাবে। তিনি ভুলতে পারেন না প্রাণবন্ত হেনরি ডুমাসকে যে ১৯৬৮ সালে নিউ ইয়র্কের সাবওয়েতে নিহত হয় বর্ণবাদী হামলায়। ডুমাসের কবিতা ও গল্প প্রকাশ করে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন টনি মরিসন। টনি কেড বাম্বারা, এ্যাঞ্জেলা ডেভিস, ব্ল্যাক প্যান্থার হুয়ে নিউটন, গেইল জোন্স তাঁরই আবিষ্কার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক জগতকে চমকে দেয় তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত দ্য ব্ল্যাক বুক। সেই ১৯২০ সালের দাসত্বের দিন থেকে শূরু করে পৌণে এক শতাব্দীকালের মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ জীবনের এক বহুবর্ণিল বৃত্তান্ত সেটি। ছবি, চিত্রকর্ম, বিবরণ, প্রতিবেদন, ইতিহাস, রচনাকর্ম, প্রামাণ্য দলিল প্রভৃতির এক গ্রন্থিক মহাফেজখানা টনি সম্পাদিত বইটি। এসব থেকে তাঁর মেজাজ এবং চরিত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাই মিলতে পারে। তখনকার গনগনে সত্তর দশক মারাত্মকভাবে ফুটছে আর সে-দশকের আগুনের মধ্য দিয়ে পথ কেটে লেখক হয়ে উঠবেন টনি নিজেও। ভাবা যায়, ১৯৫৮-তে তাঁর বিয়ে হলো হ্যারল্ড মরিসনের সঙ্গে এবং ১৯৬৪ সালে তাঁর সংসার ভেঙে গেল বিবাহবিচ্ছেদের জেরে। টনির কাঁধে দু’জনের সম্মিলিত অবদান দু’টি সন্তান কিন্তু লালন-পালনের ভার একা টনি মরিসনের। ভোর চারটায় তাঁকে জেগে উঠতে হয় রোজ। সংসার শুরুর আগে শুরু হয়ে যায় উপন্যাসের সংসার- প্রথম উপন্যাস দ্য ব্লুয়েস্ট আই রচনার শব্দশ্রম। দিনভর কর্মজীবন আর দু’দুটি সন্তানের দেখাশোনার প্রাণান্ত পরিশ্রম। তবু ভেঙে পড়েন না, ক্লান্তি তাঁকে ক্লিন্ন করতে পারে না। পৃথিবীকে জানানোর মত কত-কত কথকতা যে তাঁর জমে ছিল। এরিমধ্যে আফ্রিকায় ওলি সোয়িংকা, চিনুয়া এ্যাচেবে কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় এ্যাথল ফুগার্ড বিস্ফারিত হয়ে গেছেন নতুন যুগের বার্তা নিয়ে। এলেন টনিও- ব্যাপ্টিজমালের সময়কার অর্জন মধ্যপদ এ্যান্থনিকে সংক্ষিপ্ত ও প্রাথমিকে পরিণত করে- তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যান চিরকালের জন্যে এবং তাঁর নামের সঙ্গেও থেকে যান চিরদিনের জন্যেই।
আরও পড়ুন: ভালোবাসার মানুষ টনি মরিসন ১
লেখালেখির সঙ্গে কোথাও যেন একটা সম্পর্ক রয়েছে সত্তার সংগ্রামশীলতার। পরিস্থিতি যত বৈরী ও প্রতিকূল লেখক সত্তা ততই প্রকাশোন্মুখ। লেখালেখিটা তার জন্যে অর্থপূর্ণ বর্তমানতা, আপন পৃথিবীর নির্মাণ। দ্য ট্রু কনফেশন্স অব এ্যান এ্যালবিনো টেররিস্ট গ্রন্থের রচয়িতা ব্রেইটেন ব্রেইটেনবাখ তাই বলেন, লেখালেখি হলো বেঁচে থাকবার প্রচেষ্টা এবং চেতনা ও সংবেদনার প্রসারণ। বিষয়টাকে আরও সুন্দর করে বলেছেন মিলোভান জিলাস। তাঁর দৃষ্টিতে যত রুদ্ধতাই আসুক তা লেখককে কোনোভাবেই কব্জা করতে পারবে না। যুগোশ্লাভিয়ার একসময়কার ভাইস প্রেসিডেন্ট জিলাস ছিলেন প্রেসিডেন্ট টিটো’র ঘনিষ্ঠ সহচর। ১৯৫৪-তে তিনি বহিষ্কৃত হন কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে। জীবনের বহু বছর তাঁর কেটেছিল কারাগারে এবং কারাগারেই তিনি তাঁর লেখার অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁর অব প্রিজন্স এ্যান্ড আইডিয়াস পৃথিবীর বৈরী পরিস্থিতিতে থাকা লেখকদের জন্যে প্রকৃত অনুপ্রেরণার উৎস। ইন্দোনেশিয় লেখক প্রামোদিয়া অনন্ত তোয়ের (১৯২৫-২০০৬) তাঁর বিখ্যাত কোয়ার্ট্রটে বুমি মানুসিয়া রচনা করেছিলেন কারাগারে থাকাকালীন। কাজেই ইতিহাস বর্তমান আর প্রতিকূলতার সমূহ চাপ সামলে নিয়ে যখন টনি মরিসনের দ্য ব্লুয়েস্ট আই প্রকাশ পেলো সেটা ঔপন্যাসিক টনি মরিসনের জন্যে এক ধরনের এভারেস্ট আরোহণের ঘটনা হয়ে দাঁড়ালো। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, লোকসাহিত্য, দুঃস্বপ্নসম বাস্তব এবং সঙ্গীত সবকিছু উপন্যাস নামক এতদিনকার প্রচলিত একটি আয়তনে কীভাবে ধরা সম্ভব সেটাই দেখালো উপন্যাসটি। বিভিন্ন স্কুল এবং লাইব্রেরি প্রতিবাদের ঝড় তুললো, মরিসনের উপন্যাসটিকে বাজেয়াপ্ত করা হোক। বাস্তবের এমন দগদগে চেহারাটাকে দেখবার জন্যে তৈরি ছিল না মানুষ অথচ সেই মানুষেরাই সেই বাস্তবের নির্ণায়ক। বর্ণবাদ, যৌন নিপীড়ণ, অজাচার, ধর্মীয় প্রসঙ্গ, বিবাহবিচ্ছেদ এইসব বিষয় গোটা উপন্যাসে এক ভয়াবহ ক্যানভাসের সৃষ্টি করে। এই উপন্যাসটিকেই যখন নিউ ইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটি তাদেও ব্ল্যাক-স্টাডিজ বিভাগের পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করলো এবং আরও কয়েকটি কলেজ মনোনীত করলো তাদের পাঠ্যসূত্র-গ্রন্থ রূপে তখন বোঝা গেল টনি মরিসনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে জ¦লে উঠবার জন্যে।
টনি মরিসনের প্রথম উপন্যাস দ্য ব্লুয়েস্ট আই প্রসঙ্গে স্বয়ং রচয়িতার অনুভূতি জানবার আগে উপন্যাসটি থেকে খানিকটা উদ্ধৃতি লক্ষ করা যেতে পারে-
“আমাদের বাড়িটা পুরনো, ঠাণ্ডা আর সবুজ। রাতের বেলা একটা কেরোসিন বাতি একটা বড় কামরাকে আলোকিত করে রাখে। অন্য কামরাগুলো ঢাকা থাকে আঁধারে, তেলাপোকা আর ইঁদুরের দখলে। বড়রা আমাদের সঙ্গে কথা বলে না- তারা আমাদের নির্দেশ দেয়। তারা আদেশ হাঁকে আমাদের উদ্দেশ্যে, উপায়-পন্থা এসব বলে দেয়া ছাড়াই। যখন আমরা পা হড়কে পড়ে যাই ওরা চোখ মেলে তাকায় আমাদের দিকে। কোথাও যদি কেটে যায় কিংবা জখম হয়ে যায় তখন ওরা প্রশ্ন করে, তোরা পাগল নাকি? কখনও সর্দি-ঠাণ্ডা লেগে গেলে আমাদের বিবেচনাবোধের অভাবকে লক্ষ করে তারা মাথা নাড়াতে থাকে ঘৃণাভরে। ওরা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, তোরা কিভাবে আশা করিস, তোরা সব অসুস্থ হয়ে গেলে কেউ এসে সব কিছু করে দেবে? আমরা কোনো উত্তর দিতে পারি না সেসব প্রশ্নের। আমাদের রোগ সারানো হয় অবমাননাকর, অপবিত্র কালো অষুধের ঢোঁক আর ক্যাস্টর অয়েল গিলিয়ে- ফলে আমাদের মনটা ভোঁতা হয়ে যায়। … …
আমরা জানতাম, জীবনের আসল সন্ত্রাস ছিল ঘরছাড়া হওয়া। ঘরছাড়া হয়ে পড়াটা ছিল সেইসব দিনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আধিক্যের সমস্ত সম্ভাবনা এর সঙ্গে সঙ্গে নস্যাৎ হয়ে যেতো। দেখা গেল কেউ অধিক পরিমাণে খেয়ে যাচ্ছে, তো তার পরিণতি হয়ে যেতে পারে গৃহহীনতা। কেউ একজন বেশি-বেশি কয়লা জ্বালিয়ে গেল, তো তার পরিণতি হতে পারে গৃহহীন হয়ে যাওয়া। লোকেরা জুয়া খেলা, মদ খাওয়ার পরিণামে ঘরছাড়া হয়ে যেতে পারে। কখনও-কখনও মায়েরা তাদের সন্তানদের ঘরছাড়া করে দিতো। আর সেরকমটা ঘটলে সন্তান কী করেছিল সেটা কোন ব্যাপার নয়, সমস্ত সহানুভূতি থাকতো তার সপক্ষে। সে ঘরছাড়া হলো, হলো তার নিজেরই রক্তমাংসের শরীর দিয়ে। বাড়িঅলার দ্বারা ঘরছাড়া হওয়াটা ছিল দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু এটা জীবনের এমন একটা দিক যার ওপর আপনার কোন হাত নেই, যেহেতু আপনার উপার্জনটাকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কিন্তু কাউকে ঢিলেমি করে ঘরছাড়া করে দেওয়া কিংবা অত্যন্ত হৃদয়হীনভাবে নিকটাত্মীয়কে ঘরছাড়া করাটা সত্যি অপরাধ। … …
আমার পিতার মুখ একটা পাঠের বিষয়। শীত এসে জেঁকে বসে এর ওপর। তাঁর চোখগুলো বরফের পাহাড় হয়ে যায়, যেন তুষারঝড়ের আশঙ্কা। তার চোখের ভ্রূগুলো পত্রশূন্য বৃক্ষের কালো-কালো ডালপালার মত বেঁকে যায়। শীতের সূর্যের বিবর্ণ, ফ্যাকাশে, হলুদ কিরণ পড়ে তার চামড়ায়। তার চোয়াল দেখে মনে হয় যেন বরফাবৃত প্রান্তরের কেটে নেওয়া শস্যের খোঁচা-খোঁচা অবশেষ। তার কপাল যেন ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া ইরি-হ্রদের প্রবাহ যেখানে লুকনো তার শীতল ভাবনারাজির তরঙ্গগুলো অন্ধকারে ঘুরপাক খায়। চিতাবাঘ-হত্যাকারী পরিণত হয় বাজপাখির সঙ্গে লড়–য়েতে। দিনরাত তার কাজ হলো কাউকে দরজার সামনে থেকে এবং জানলার কপাটআঁটা কাঠের নিচ থেকে সরিয়ে দেওয়া। আগুনের শিখা পাহারা দিতে থাকা অগ্নিগিরির মত তিনি আমাদের নির্দেশ দেন, কোন্ দরজাটা বন্ধ রাখতে হবে অথবা কোন্
দরজাটা রাখতে হবে খোলা। যাতে করে তাপের সুষম বণ্টন বজায় থাকে। আগুন জ¦ালিয়ে দিয়ে কয়লার গুণাগুণ বিষয়ে আলাপ করতে থাকেন। আমাদের শিখিয়ে দিতে থাকেন, কিভাবে আগুন নাড়িয়ে কয়লা স্তূপ করে আগুনটাকে সামলাতে হয়। এবং বসন্তকাল না আসা পর্যন্ত তাঁর এই বাক্সময়তা চলতেই থাকবে।”
উপন্যাসটির পশ্চাৎপটে থাকে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপট- ১৯৪১ সাল আবার বিশ্বযুদ্ধেরও অন্তর্বর্তীকাল। টনি মরিসন একটি ঐতিহাসিক -সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এমন সব বিষয়কে ধারণ করেছেন যেগুলো অধিকাংশ মানুষের নিকটে অস্বস্তিকর বাস্তবতার নামান্তর। কিন্তু বর্ণবাদের ভয়ংকর ক্ষতিকর দিকটাকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই যখন বিপুল জীবনাভিজ্ঞতার ধারক টনি মরিসন স্বয়ং এক সুদীর্ঘকালের বিবর্তনের সাক্ষী। তাঁর সৃষ্ট উপন্যাসটির চরিত্র পেকোলা বর্ণবাদী দৃষ্টিতে পৃথিবীর সবচাইতে কদাকার আর অসুন্দরের প্রতীক। পেকোলার নীল চোখের স্বপ্ন আসলে গায়ের চামড়ার রং কালো হওয়ার কারণে তার মনে যে জমাটবদ্ধ বিষাদাচ্ছন্নতা তা থেকে মুক্ত হওয়া। পেকোলার ক্ষেত্রে সেটি হয়তো নীল চোখের প্রত্যাশা। অন্য কারো প্রসঙ্গে অন্যতর আকাঙ্খা। কিন্তু মূল কথাটা হচ্ছে প্রতি মুহূর্তের দুঃস্বপ্নের তাড়না থেকে বাঁচা। যদিও বাস্তব তাদের প্রত্যাশানুযায়ী অনুকূল থাকে না। বরং বাস্তব আরও ভয়ংকর আরও প্রাণঘাতী পরিণতির দিকে মোড় নিতে পারে। বাস্তবতা এমনই যে পেকোলার মা পলিন সারাক্ষণই সময় কাটায় শ্বেতাঙ্গ মানুষের ঘরে গৃহপরিচারিকার কাজে এবং ধর্মেও তারা খ্রিস্টান। তবু ঈশ্বর শ্বেতাঙ্গ মার্কিনদের ছেড়ে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকিয়দের প্রতি অনুকূল হন না। এক প্রশান্ত ও সম্ভাবনাময় নারী পেকোলার ক্রমে উন্মাদ হয়ে যাওয়াটা ব্যক্তিক বৃত্তের বৃত্তান্ত হলেও এতে ব্যক্তি ছাড়িয়ে বৃহত্তর জাতিগত চেতনার ছায়াপাত ঘটে। পিতার দ্বারা ধর্ষিতা হওয়া পেকোলার বিবর্তনটিকে বিস্ময়কর কুশলতার সঙ্গে সামলান টনি মরিসন। গুপ্ত বাস্তব রূপ নেয় প্রকাশ্য বাস্তবে। উপন্যাসটির প্রকাশের সিকি শতাব্দীকাল পরে ১৯৯৩ সালে টনি মরিসন বলেন, পেকোলার গ্রন্থবদ্ধ জীবনটাকে সঠিকভাবে অনুভব করবার জন্যে পঁচিশ বছর সময় লেগেছে। আর তারও সিকি শতাব্দীকাল পরে এসে এমনকি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের স্বপ্নের বাস্তবায়নের পরবর্তী পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েও বলতে পারা যাবে, পেকোলার জীবনবাস্তবতা বা জীবন-দুঃস্বপ্ন থেকে খুব দূরে সরে যাওয়া যায় নি।
চলবে…