মন্দ হাওয়া

হারাধনের কাছে বছরটা অমঙ্গল মনে হচ্ছে। চতুর্দিকে যেন সেই অশনি সংকেত শোনা যাচ্ছে। ইলেকশনের ধকল এখনও শেষ হল না। গ্রামে ডাকাতি বেড়ে চলেছে। বেছে বেছে হিন্দু বাড়িগুলি। রাতে সকলেই উৎকণ্ঠায় আধো ঘুম আধো জাগরণে একরকম সজাগ থাকে। হয়তো দল বেঁধে ওরা আসবে। টাকাপয়সা না পেয়ে মেয়েছেলের খোঁজ করবে। বলবে:‘বড় মুরগিটারে বের কর।’ শহরে যার যেখানে আত্মীয় আছে গ্রামের হিন্দু বাড়িগুলির প্রায় সব মেয়েরাই চলে গেছে। দশরথ, বাসুদেব ওদের মত কিছু সম্বলহীন কৃষকরাই পাঠাতে পারেনি তাদের মেয়েদের। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যখন চতুর্দিকে সংখ্যালঘু নির্যাতন, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ—তখন হারাধন জ্যোৎস্নাকে কিছুদিন শহরে ছোট ভাইয়ের কাছে রেখেছিল, সে শহরের একটি সরকারি কলেজে পিয়নের চাকুরি করে। শহরে থাকা-খাওয়ায় অনেক খরচ। সেওবা কতদিন রাখবে? তাছাড়া, ছোট ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে হারাধনের সম্পর্ক ভাল না। অজাত-কুজাত বলে গালি দেয়। তা দিক, ওরা শুধু ভাল থাক—এই চেয়েছিল হারাধন।

চেয়ারম্যানের সঙ্গে হারাধনের পুরনো বিবাদ ছিল। ইলেকশনের পরবর্তী অস্থিরতায় সুযোগ পেয়ে এবার সে ব্যবহার করল। একদিন সকালে হারাধন তার জমির আইলে পৌঁছতে না পৌঁছতে দেখল তার চাষের জমিটুকু দখল হয়ে গেছে। সেখানে এখন চেয়ারম্যানের বদলারা লাঙল বাইছে। হুস…হুস…করে তাগড়া বলদগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হারাধনের মনে হল ওর বুকের ওপর কারা যেন লাঙল চষে বেড়াচ্ছে। ‘দেহজমি আবাদ করলে ফলতো সোনা’—হারাধনের মুখ থেকে এ শব্দগুলো বেরিয়ে আসতে চাইল। আহা, বাউলের এ গান বরফ হয়ে বুকের কোথাও খানাখন্দে আটকে গেছে। হারাধনের শুধু ঠোঁট নড়ছে। ওর এ অবস্থা দেখে চেয়ারম্যান সহানুভূতিপ্রবণ হয়ে গলায় দরদ এনে বললো :“হারাধইন, অহন বাড়িতে যাও। রাইত-বিরাইতে বুইঝা-শুইন্যা চলবা; দ্যাশ-গাঁওয়ের অবস্থা ভালো না।” জমির আইলে বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে হারাধন অনুভব করলো শরীরের কোথাও তরল স্রোত নেমে যাচ্ছে। সেটা যে কি, ও ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। ধান ভরা জমিনের স্ফীত বুকে আর হাত বুলাতে পারবে না, ভাবতেই হারাধনের বুকে কোথাও কোথাও ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হয়। কে জানি, বারবার সজোরে দাঁড় টানে। আগের আমলে যা কয়েক টাকা ভাতা পেতো এখন তো তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন খাসজমিটুকু দখল হয়ে যাওয়াতে হারাধন চতুর্দিকে কালিগোলা অন্ধকার দেখতে পায়। স্বপ্নে-সন্তর্পণে কেবলই অন্ধকার স্রোত ঘিরে আসে। এমনিতে কিছুদিন আগে বন্যা গেল। খাওন-দাওনের আকাল। ত্রাণ নিয়ে যারা এসেছিল, তারা কিছুক্ষণ সেলফি তুলে, ভিডিও করে আবার চলে গেছে। এনজিও এর দেয়া ওষুধে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ একটু কমেছিল। পশুপাখির মড়ক, খাদ্য নেই, ডাল নেই, ডায়রিয়ায় মানুষ মরছিল—তবুও নাকি বন্যা মোকাবেলা করা গেছে। বীজ ধান, খয়রাতি সাহায্য কাদের দেয়া হবে বন্যার পর ক্ষমতাসীন পার্টির ছেলেরা লিস্ট করলো। ওই লিস্টে হারাধনের নাম ছিল না। সে তো কিছুই পায়নি।

দিনের পর দিন হাঁস-মুরগি, ব্যাঙ, বলদ নিয়ে একত্রে বাস করেছে। বন্যার পর অসুখে তার একটা বলদও মরে গেলো। জোড়া বলদের একটা মরে যাবার পরই হারাধনের কপাল পুড়েছে। জানতো, নতুন বলদ কিনতে পারবে না, সামর্থ নেই, ধার-দেনায় ডুবে আছে। এবার জমিনে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের নতুন ইরিধান বুনে কর্জ শোধ করবে ভেবেছে। ফি বছর কিছু নগদও হাতে থাকতো–তা দিয়ে ঘরখানার চাল ছাইবে, ভেবেছিল। বর্ষায় চুঁইয়ে জল পড়ে। বন্যায় বীজতলা নষ্ট হয়ে গেলো। কয়েকদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছিল, জোয়ালের একপাশে একটা বলদের বদলে নিজেই দাঁড়িয়েছিল। লাঙল চষেছিলো ছেলের হাতে। সে সময় অবলা জন্তুটার কী বোবা চাহনি! কিন্তু এ বয়সে শরীর ধকল সইবে কি করে? পারেনি। ধর্না দিয়েছিলো পঞ্চগ্রাম হাটে, মকসুদ মিয়ার গদিতে–যদি কর্জ পাওয়া যায়। জবাবে, দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিল। আত্মযন্ত্রণায় পিষ্ট হয়ে ফিরে আসতে আসতে হারাধন শুনেছিলো, মকসুদ মিয়া দরাজ কণ্ঠে বলছে: “আগের ঋণগুলান শোধ না দিলে ভিটিখানা লইয়া যামুনে।”

তার ছেলে রমেশ কয়েকদিন ধরে বাড়ি ফিরছিল না। একদিন সংবাদ এল, হারাধনের ছেলে রমেশ ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী বিএসএফ এর গুলিতে মারা গেছে। হারাধন প্রথমে গুজব মনে করেছিলো। বিপদের সময় কতো লোকে কতো কথা ছড়ায়। ওসবে কান দিলে কি চলে? তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাসুদেব-দশরথ-রাজেন্দ্র কে নিয়ে দুই-তিন গ্রাম পথ পায়ে হেঁটে সীমান্তের কাছে পৌঁছে দেখলো সত্যিই ধানিজমিতে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। কেউ তুলে আনেনি। যদি কাঁটাতারের ওপার থেকে জওয়ানরা গুলি করে, সে ভয়ে। হারাধনের শরীর শিরশির করতে লাগলো, কাঁপুনিও উঠলো। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে লুঙ্গি কাছা মেরে জমিতে নেমে গেল। গুলি করলে করুক! জ্বালা জুড়ায়! এখানকার গ্রামবাসীদের সঙ্গে বাসুদেব, রাজেন্দ্র, দশরথও উৎকণ্ঠা নিয়ে দূরে পাকা রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। যে কোন মুহূর্তে শোনা যাবে রাইফেলের আওয়াজ; হারাধন ঢলে পড়বে–ওরা এমন সব দৃশ্যই ভাবছিল। দূরে ভারতীয় সেনা ছাউনি দেখা যায়। কিন্তু না, হারাধন রমেশের দেহ উঁচু রাস্তা পর্যন্ত একাই বয়ে এনে ভ্যানে তুলে একপাশে পা ঝুলিয়ে বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আনমনে বললো:“ভারত চলে যাইতে চাইছিলা বাপ?” কোনও প্রতুত্তর না পেয়ে রাজেন্দ্র-বাসুদেবদের হাতছানি দিয়ে ডাকে সে, উদভ্রান্তের মত হাত নেড়ে নেড়ে বলে:“ল যাই”, শব্দগুলো হারাধন যেন উচ্চারণ করেনি, মুখগহ্বর হতে ছুঁড়ে ফেলেছে। যা কর্কশ ধ্বনিতে সন্ধ্যার আবছা আলোআঁধারিতে চারিদিকে খণ্ডিত হয়ে পড়লো নাকি হারাধনের মুখেই অন্তর্হিত হলো তা বোঝা গেল না।

এর কয়েকদিন পরে তার মেয়ে জ্যোৎস্না বাড়ি ফিরে এসে, পুনরায় লাল হোণ্ডায় চড়ে আশেপাশের গ্রামেগঞ্জে যায়। মহিলাদের নিয়ে বৈঠক করে, উন্নয়ন, সমতা বুঝায়। সমবায়, চক্রবৃদ্ধি হার, সাবলম্বীতা ইত্যাদি। গ্রাম্য নারীরা নতুন স্বপ্ন আহরণে জেগে উঠতে না উঠতেই আবার তাদের অন্ধকার ঘিরে ধরে। জ্যোৎস্না যে উঠোনে বৈঠক করতো, সেই বাড়িটি ছিলো মহাজন মাকসুদ মিয়ার। একদিন দুপুরে বাড়ি ফিরে বৈঠকের কারণে তার ভাত পেতে দেরী হয়। তখনি সে সকলের সামনে তার বউকে এক হাতে কিল-ঘুষি ছোঁড়ে, অন্য হাতে জ্যোৎস্নাকে শাসায় :“মাইয়া ছাওয়াল গো বেপথু করস; তোরে যেন এহানে আর না দেহি।“

জ্যোৎস্না কি এতেই দমে যাবার পাত্রী? সে আবার মহিলাদের সংগঠিত করে। অন্য বাড়ির উঠোনে তার কার্যক্রম যথারীতি চালিয়ে যায়। ক্রমে জ্যোৎস্নাকে নিয়ে কানা-ঘুষা শুরু হয়। চেয়ারম্যানের সান্ধ্যআড্ডার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। এনজিও এর কর্মকান্ড, তার বেশভূষা, মহিলাদের হাতে নিজস্ব নগদ টাকা বৃদ্ধি তাদেরকে ভীতসন্ত্রন্ত করে তোলে। প্রসঙ্গক্রমে ওঠে রাজেন্দ্রর কথা। বন্যার পর অসুখে ওর বউ-ছেলে-মেয়ে সবই মরলো। জ্যোৎস্না ও এনজিও এর মাঠকর্মীরা গ্রামে ওষুধ বিতরণ না করলে রাজেন্দ্রও মরতো, ওর ভিটেও দখল করা যেত। ভিটেবাড়ি দখল করতে না পারার আক্রোশে জোৎস্নাকে জব্দ করার চক্রান্ত আঁটে সবাই মিলে।

একদিন বৈঠকরত অবস্থায় জ্যোৎস্নাকে ধরে এনে সুপারিগাছের সঙ্গে বাঁধা হয়। বিচারপর্বে উপস্থিত ছিল মকসুদ মিয়া, আহলে হাদীস মসজিদের ইমাম সাহেবও। খবর পেয়ে হারাধন ও তার বউ ছুটে আসে। অনুনয়-বিনয় করে। কিন্তু কারো মন গলে না, বরঞ্চ আল্লাহর কাফের বান্দাদের উচিত শিক্ষা দেয়ার সংকল্প করে মনে মনে। একঘরে করে, জবর-দখলের পরও যখন ওদের দমানো গেলো না, এইবার বুঝবো মজা। প্রথমে ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারার কথা উঠেছিলো। কিন্তু তাতে অনেক ঝামেলা-হুজ্জত। এমনিতে এনজিওর মেয়ে। “অগো ফান্ডের টাকা আয় নাকি আমেরিকা থেইকা।”

চেয়ারম্যান বাকীটুকু উহ্য রাখে। তার নিরবতা থেকেই যে যার মতো বুঝে নেয়। অনেকেরই রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তারা জ্যোৎস্নার বিচার প্রক্রিয়াকে একটি ধর্মীয় লেবাস দিতে চায় এবং সে অনুযায়ী ইমাম সাহেবের প্রস্তাবনায় মাথা কামিয়ে ১০১ ঘা বেত্রাঘাত করা হয়। হারাধনের ভাবলেশহীন মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল না ওর প্রতিক্রিয়া। তবে সে মুখে আলোর রেশমাত্র ছিলো না। হারাধনের বউয়ের বিলাপ, বেতের বাতাস কেটে শরীরে ঘা দেবার দেবার শব্দ আর উপস্থিত কারো কারো চাপা উচ্ছ্বাস একত্রে মিশে যাচ্ছিলো। আর আকাশে সার বেধে ক্রমে জমতে শুরু করেছে পুঞ্জ পুঞ্জ কৃষ্ণমেঘ।

তারপর তিনদিন-তিনরাত বৃষ্টি হলো। তুমুল বৃষ্টি আর দুর্যোগের মাঝেই প্রবল জ্বরগ্রস্ততা ও ব্যথাভরা শরীরে বাড়ির পেছনের আমগাছের নিচু ডালে ঝুলে পড়া জ্যোৎস্নাকে নিয়ে পড়শিরা একরকম বিপাকেই পড়লো। চাদরে পেঁচানো শরীর ফুলে ঢোল হয়ে উঠতে চাইছিলো। তার আগেই হারাধনের ভিটের পাশে ঝাকড়া বটগাছের নিচে জ্যোৎস্নাকে পুড়িয়ে ফেলা হলো। জ্যোৎস্না তো মরলো, ক্ষোভে-দুঃখে। কিন্তু চেয়ারম্যানের লোকেরা গ্রামে নানা কথা চালান করতে থাকলো। “জ্যোৎস্নার উপর দেত্য-পরীর আছর আছিলো, পোয়াতি আছিলো।” রমেশের মৃত্যুতে যে শোক হারাধনকে কাবু করতে পারেনি, জ্যোৎস্নার মৃত্যুশোক তাকে পুরোপুরি জ্বরাগ্রস্ত করে ফেললো। স্বাস্থ্য-শরীর দ্রুত ভেঙে পড়লো। দিনের পর দিন জ্বর। ঘোরে প্রলাপ বকতো। প্রলাপে প্রায়ই বলতো উন্নয়নের কথা। ডাক্তার এসে দেখে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দিলো। হারাধন শহরে যাবে ঠিকই। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হতে চায় না। এ দেশে এক টুকরো খালি জায়গা হবে না? যেখানে গিয়ে শুধু শুয়ে থাকবে। ওর কোন দাবি নেই। জমি ফেরত চায় না। মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও চায় না। এখন না খেয়েই মরতে চায়। স্ত্রী বসুধাকে ডেকে বারবার বলছে: “রাজেন্দ্রকে ডাইকা আমারে শহরে লইয়া যা। না খাইয়া মরুম, মরলে পুড়িস না- গাঙ্গে ভাসাইয়া দিস। শ্মশানটাও একদিন দখল হইয়া যাইবো।”

বিঃদ্রঃ ২০০১ সালে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সংখ্যালঘুদের উপরে নিপীড়ন নিয়ে লেখা গল্প।

Facebook
Twitter
LinkedIn
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!