মালঞ্চা এবং: বটগাছ ও বৃষ্টির মধুরতা

দূর থেকে বৈশালী দেখল, গ্রামের একপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা অনেক বড় বটগাছ রয়েছে। প্রচুর তার ঝুরি। ঝুরিগুলো মাটির মধ্যে প্রবেশ করেছে। দেখে মনে হচ্ছিল,বটগাছটি একজন বৃদ্ধ আর ঝুরিগুলো বৃদ্ধটির দাড়ি আর অসংখ্য দাড়ি নিয়ে গ্রামের মধ্যে প্রবীণ হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বটগাছটিতে বেশ কিছু বিভিন্ন রঙের পাখির ঘর ঝুলছিল। বৈশালী ধীরে-ধীরে বটগাছটির কাছে গেল। দেখল, ইট-সিমেন্ট দিয়ে বটগাছটির গোঁড়াটি গোল করে ভাল মতো বাঁধানো। একটি লোক সেই বাঁধানো জায়গায় বসেছিল। বৈশালী লোকটিকে জিজ্ঞেস করল,”দাদা,এই বটগাছটির বয়স কত হতে পারে?” লোকটি বৈশালীকে বলল, “ম্যাডাম, আমার নাম শম্ভুনাথ। এই বটগাছ বহু বহু ক্লান্ত পথিককে আশ্রয় দিয়েছে। অনেক অনেক নববিবাহিত বর-বউকে ছায়াদান করেছে। অজস্র স্বামী-স্ত্রীকে একসাথে বসার সম্মতি দিয়েছে। প্রচুর প্রেমিক-প্রেমিকাকে প্রেম করার অনুমতি দিয়েছে।”
শম্ভুনাথ নামের লোকটি দম নিয়ে আবার বলল, “ম্যাডাম,আমি বাবা-ঠাকুরদার কাছে শুনেছি, এই বটগাছটির বয়স আনুমানিক চারশো বছরের মতো। গ্রামের অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী এই বটগাছ। বটগাছটি আমাদের মালঞ্চা-গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন, সবচেয়ে বয়স্ক, সবচেয়ে প্রবীন। বটগাছটি আমাদের মালঞ্চা গ্রামের সম্মান। বটগাছটি আমাদের দত্তক-গ্রামের শ্রদ্ধা।”
শম্ভুনাথ চলে গেল। বৈশালী বটগাছটির নিচে বসল। হাওয়া বইতে লাগল। বৈশালী বটগাছটির পাতার-বাতাস খেতে লাগল।

আবার পথে‌ মাথাল মাথায় দেওয়া পঞ্চানন কাকার সাথে বৈশালীর দেখা। পঞ্চানন জিজ্ঞেস করল, “ম্যাডাম,আপনি কোথা থেকে এসেছেন?” বৈশালী বলল, “আমার বাড়ি বুনিয়াদপুর। আমি কলেজে পড়ি। আমি মালঞ্চা-দত্তক-গ্রাম ঘুরতে এসেছি, আমি মালঞ্চা গ্রাম দেখতে এসেছি। সারাদিন আমি এই গ্রামে থাকব।”
পঞ্চানন জিজ্ঞেস করল, “ম্যাডাম,আপনি মালঞ্চা গ্রাম ঘুরতে এলেন কেন?”
বৈশালী বলল, “দত্তক-গ্রামে থাকে অপরূপ রূপ, দত্তক-গ্রামে থাকে অতুলনীয় সৌন্দর্য। আমি দত্তক-গ্রামের মনোহারিনী রূপ, দত্তক গ্রামের অসাধারণ সৌন্দর্য দেখার জন্য মালঞ্চা দত্তক-গ্রামে এসেছি।”

আরও পড়ুন: মালঞ্চা এবং ঘর

বৈশালীর ছায়া পশ্চিম দিকে ক্রমশ লম্বা হতে লাগল। বৈশালী গ্রামের ভেতর হাঁটছিল। মনে তার খুশি। চোখে-মুখে আনন্দ। বৈশালীর চোখে পড়ল, গ্রামের এক ধারে একটি বড় ট্যাঙ্ক বসানো। ট্যাঙ্ক থেকে পাইপ লাগিয়ে ট্যাঙ্কের নিচে কয়েকটি ট্যাপ লাগানো। শম্ভুনাথ তার বাড়ি রঙ করার জন্য গ্রামের একটি রঙের দোকান থেকে রঙ আনতে পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।
বৈশালী শম্ভুনাথকে জিজ্ঞেস করল, “শম্ভুনাথদা,এই ট্যাঙ্কটি কিসের জন্য?”
শম্ভুনাথ বলল, “ম্যাডাম,এই বড় ট্যাঙ্কে আকাশের বৃষ্টির জল ধরে রাখা হয়। এই জলাধারে রয়েছে ঝমঝম বৃষ্টি,রিমঝিম বৃষ্টি, ফিনফিনে বৃষ্টি, আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, টাপুর-টুপুর বৃষ্টি।”
বৈশালী আস্তে-আস্তে ট্যাঙ্কটির কাছে গেল। একটি ট্যাপের দিকে এগিয়ে গেল। বৈশালী ট্যাপটি চালাল। ঝরঝর করে ট্যাপ দিয়ে জল বের হতে লাগল। বৈশালী বৃষ্টির জল দিয়ে তার চোখ-মুখ বেশ ভাল করে ধুতে লাগল।
শম্ভুনাথ বৈশালীকে বলল, “ম্যাডাম,আপনার চোখে-মুখে রয়েছে রিমঝিম বৃষ্টি,ঝমঝম বৃষ্টি, ফিনফিনে বৃষ্টি, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’, ‘টাপুর টুপুর বৃষ্টি’।”
শম্ভুনাথ রঙ আনতে চলে গেল।

বৈশালী দেখতে পেল, অপর পাশে থাকা আর একটি ট্যাপে একজন সুদর্শন যুবক ছেলে ট্যাঙ্কের জলে দিয়ে তার চোখ-মুখ বেশ যত্ন করে ধুচ্ছিল। যুবক ছেলেটির পরনে ছিল নীল জিন্সের প্যান্ট ও বেগুনি রঙের জামা। ফর্সা, সুন্দর, লম্বা, সুঠাম চেহারা। বৈশালী যুবক ছেলেটি দেখতে লাগল। চোখ-মুখ ধোওয়া শেষ করে যুবক ছেলেটি মুখ‌ তুলে তাকাল। চমকে গেল বৈশালী। দেখল,এ তো নির্ঝর। সঞ্চালক নির্ঝর। তার কলেজের নির্ঝর। বৈশালী তার চোখে-মুখে লাগানো ঝমঝম বৃষ্টি, রিমঝিম বৃষ্টি, ফিনফিনে বৃষ্টি,আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, টাপুর-টুপুর বৃষ্টি নিয়ে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে রইল আর যুবক ছেলেটিও তার চোখে-মুখে লাগানো ফিনফিনে বৃষ্টি, রিমঝিম বৃষ্টি,ঝমঝম বৃষ্টি, আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, টাপুর-টুপুর বৃষ্টি নিয়ে বৈশালীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একে-অপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দু’জন।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!