কে. পি. গোস্বামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ভারতের ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র অর্গানাইজার পত্রিকায় ‘মুজিব রিফিউজড টু এল্যাউ ইউ.এস. বেস ইন বে অব বেঙ্গল’ শিরোনামের নিচের কলামটি লেখেন। কলামটি ‘সময়ের শব্দ’ পত্রিকার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের লেখক ও অনুবাদক তুহিন দাস।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ঔপনিবেশিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নয়, এটি বৃহৎ শক্তির রাজনীতির খেলার একটি অংশ–তা বেশ স্পষ্ট। এটা স্পষ্ট যে ইসলামাবাদ পেন্টাগনকে বোঝানোর মাধ্যমে ওয়াশিংটনকে প্রলুব্ধ করতে সফল হয়েছে যে এটি দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের আমেরিকান বৈশ্বিক কৌশলের সাথে খুব ভালভাবে খাপ খায়। প্রকৃতপক্ষে, ইয়াহিয়া খান তার বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সম্মান ও পদক্ষেপের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেননি। ২৫শে মার্চ সেনা অভিযানের আগে ইসলামাবাদ ওয়াশিংটনের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়েছিল এটা এখন কোনো গোপন বিষয় নয়। এ কারণেই রাষ্ট্রপতি নিক্সন বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে দু’ধরনের কথাবার্তা ও দ্বৈত আচরণ করতে দ্বিধা করেননি। যদিও কংগ্রেস, বুদ্ধিজীবীরা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বাংলাদেশের এই গণহত্যায় আতঙ্কিত, এবং নিক্সন প্রশাসনের উপর ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে পাকিস্তানকে সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করার জন্য, রাষ্ট্রপতি নিক্সন নির্লজ্জভাবে সমস্ত বিরোধিতাকে পাশে সরিয়ে রেখেছেন। তিনি প্রাণঘাতী অস্ত্রভর্তি জাহাজ পাঠিয়ে প্রকাশ্যে ও গোপনে পাকিস্তানের সামরিক একনায়কতন্ত্রকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেছেন। তিনি পাকিস্তানকে চলমান রাখতে মুসলিম বিশ্বের অন্তর্ভূক্ত দেশগুলোর সরকারদের থেকে প্রচুর অর্থের ব্যবস্থা করতেও সহায়তা করেছেন।
এটা স্পষ্ট যে পেন্টাগন গণহত্যাকে অপরাধ বলে মনে করে না। তারা এটি ভিয়েতনামে করেছে এবং বাংলাদেশে এটি করতে ইয়াহিয়া খানকে সহায়তা করছে। বিশ্ব বিবেক ইয়াহিয়া খান ও নিক্সন উভয়ের নিন্দা করছে, এই উভয় নাদিরশাহী নেতা [পারস্যের দস্যু শাসক, ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন] গণহত্যার রাজনীতিতে মেতে উঠেছেন। যাই হোক, ইয়াহিয়া খানের নৃশংস পদক্ষেপ বোধগম্য কারণ একটি স্বাধীন বাংলাদেশ মানেই হবে পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলা। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নিক্সনের উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু তদন্ত প্রয়োজন। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিক্সনের আগ্রহ ইয়াহিয়া খানকে সব সম্ভাব্য উপায়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলকে আমেরিকার আধিপত্যের অধীনে রাখতে তার আগ্রহ দেখাতে বাধ্য করে। ওয়াশিংটন জানে যে এটি ভিয়েতনামে তার যুদ্ধ হেরেছে এবং তাদেcrzর সবকিছু প্রত্যাহার করতে হবে। তারা বিশ্বকে দেখাচ্ছে যে তাদের পূর্বের শত্রু মাও সে তুঙ এর সঙ্গে একটি চুক্তির ফলে পিকিং-এর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের শিথিলতার সম্ভাবনা হয়েছে, তারা এটি করছে তাদের মুখ রক্ষা করতে, কারণ তারা পরাজিত হয়েছে। একবার ভিয়েতনামী জট থেকে মুক্ত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে মনোনিবেশ করতে পারে যেখানে ক্রমবর্ধমান সোভিয়েত নৌ উপস্থিতি আমেরিকান আধিপত্যের জন্য একটি হুমকি।
এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রভাবের ক্ষেত্রগুলোর বিভাজন বিশ্ব কূটনীতিতে একটি স্বীকৃত সত্য ছিল। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখতে পেল যে রাশিয়া আমেরিকার থেকে ভূমধ্যসাগরে তার নৌ-আধিপত্যকে শুধু ছিনিয়ে নেয়নি, বরং ভারত মহাসাগরেও একই কাজ করতে বেরিয়েছে, তখন তারা ভয় পেয়ে গেল। তাই তৃতীয় মহাশক্তি হিসেবে প্রভাবের ক্ষেত্রগুলোর ভাগে অংশ নেওয়ার জন্য তারা পিকিংকে প্ররোচিত করতে চায় ও এটিকে ব্যবহার করতে আগ্রহ দেখায়। এই বৈশ্বিক কৌশলে চীন সিঙ্গাপুরের পূর্ব সমুদ্রে এবং এর পশ্চিমে ব্রিটেন ও আমেরিকা আধিপত্য বিস্তার করবে। তাই পশ্চিম ভারত মহাসাগরের দিয়াগো-গার্সিয়া গোলাকার দ্বীপে নতুন নেভাল ও বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করা হচ্ছে। পূর্বে আমেরিকার আরেকটি ঘাঁটি দরকার। ইসলামাবাদের তরফে বাংলাদেশে আমেরিকার হস্তক্ষেপের সূত্র এখানেই রয়েছে।
এই বৃহৎ পরিকল্পনায় আমেরিকার সবচেয়ে বড় দ্বীপের প্রয়োজন যা সন্দীপ নামে পরিচিত, যা বঙ্গোপসাগরে মেঘনা নদীর মোহনার দক্ষিণে অবস্থিত। এটি একটি নৌঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করার জন্য ইয়াহিয়া খান গোপনে দ্বীপটি আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হয়েছিলেন বলে জানা গেছে। এটি মার্কিন নৌবাহিনীকে এই অঞ্চলে একটি বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ ও আয়ত্ত করতে ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত নৌ আধিপত্য দমন করার জন্য সাহায্য করবে। ঘটনাক্রমে, এটি উল্লেখ করা যেতে পারে যে পাকিস্তানের পেশওয়ারে সদ্য ভেঙে ফেলা আমেরিকান গুপ্তচর বিমান ঘাঁটিটি স্বল্পমেয়াদী লিজের ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হতে পারে যাতে মার্কিন বিমানবাহিনী সোভিয়েত সামরিক স্থাপনাগুলোতে উঁকি দিতে পারে।
যেহেতু কসাই ইয়াহিয়া খানের কাছে কোনো বিকল্প নেই, বাংলাদেশে তার ভরাডুবি থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে তিনি কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত। ইয়াহিয়া খান আসলে নিজেকে বাঁচাতে পারবেন কিনা সন্দেহ, তবে তাকে ও তার সামরিক জান্তাকে পূর্ববাংলা থেকে বিতাড়িত করা হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখানে এটি লক্ষণীয় যে রাষ্ট্রপতি নিক্সনের প্রতিশোধমূলক মনোভাব বাংলাদেশের প্রতি ইয়াহিয়া খানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর নেপথ্যের কারণ এই যে ২৫শে মার্চ সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের আগে শেখ মুজিবুর রহমান নৌ-ঘাঁটি নির্মাণের জন্য চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ দ্বীপ ওয়াশিংটনের কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করার সাহস করেছিলেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ঢাকায় মুজিবের সাথে দেখা করেছিলেন ও এই প্রস্তাবে রাজি হলে আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মুজিব যদি রাজি হতেন, তাহলে নিক্সন ইয়াহিয়া খানকে বঙ্গোপসাগর থেকে বের করে দিতে দ্বিধা করতেন না। নিক্সন পাকিস্তানে তার প্রতিনিধির মাধ্যমে মুজিবের কাছে এই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন।
মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিক্ষেপ করার পাঁচ মাস পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত মুজিবের সামনে তার স্বাধীনতার বিনিময়ে আমেরিকান প্রস্তাব রাখার জন্য তার সঙ্গে দু’বার দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। মুজিব বারবার তার সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এ কারণে যে যারা তার নিরস্ত্র মানুষদের গণহারে হত্যা করতে সাহায্য করেছে তাদের সাথে তার চলার পথ এক হবে না। এমনকি নিক্সনের বিশেষ ব্যক্তিগত প্রতিনিধি কিসিঞ্জারকেও এ কথা বলা হয়, তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পিকিংয়ের বন্ধুত্বের জন্য যাত্রা করেছিলেন, তিনিও বঙ্গোপসাগরে প্রস্তাবিত নৌ-ঘাঁটি বিনিময়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের মধ্যে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব দিয়ে মুজিবের সমর্থন চেয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। আসলে তিনি এসব শুনতেও পাত্তা দেননি।
বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদী সেনাবাহিনীর সংঘটিত কসাই ও লুণ্ঠনের অভিযানে আমেরিকার নির্লজ্জ ও ঘৃণ্য জড়িত থাকার রহস্য এটাই। কিন্তু মুক্তিবাহিনী দেখেছে রক্তের নদীতে ভাসছে স্বাধীনতার ফুল, তবে সময় লাগতে পারে, কিন্তু বাঁচবে। সোভিয়েত হুমকি মোকাবেলায় ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারের ওয়াশিংটনের বৃহৎ পরিকল্পনা বিফলে যাবেই।#