জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) কীভাবে আমাকে ডেকে নিলেন যৌবনের অন্ধকারে কোন প্রাগৈতিহাসিক অবসরে আমি বিনীত নিবেদিত হয়ে গেলাম আজ বলার কোনও অর্থ নেই তার। ‘রূপসীবাংলা’র কবিতায় সেই ধানসিঁড়ি আর শালিক পাখির একাকিত্ব আমার ভেতরেও বিস্তৃত হল। ভেতর ভেতর এক একটি গানের জন্ম হল। নরম জলের দিকে ছিপ ধরে বসে থাকি। শুনতে পাই সরপুঁটি-চিতলের উদ্ভাসিত স্বর মীনকন্যাদের মতো। দেখা যায় সবুজ জলের ফাঁকে তাদের পাতালপুরী ঘর। সন্ধ্যা নেমে আসার সাথে সাথে বিগত কত সন্ধ্যার ইতিহাস মিশে যায়। রাজা আর রাজকন্যাদের ভিড় মনে পড়ে যায়। জীবনানন্দ পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে পাঠ করে চলেন:
‘পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে;
পউষের শেষ রাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে
ফিরে এল; রং তার কেমন জানে অই টসটসে ভিজে জামরুল,
নরম জামের মতো চুল তার, ঘুমুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল;-
পউষের শেষরাতে নিমপেঁচাটির সাথে আসে সে যে ভেসে’
এক আবহমান প্রেমে ডুবে গেলাম, অনুভূতির আকাশ আরও দীর্ঘ হয়ে উঠল। অস্তিত্বজুড়ে বাংলার পদধ্বনি আর মৃত্যুধ্বনির অনিবার্য আততি। হলুদ শাড়ি,ঘাস, চাঁদ, নদী, ভাঁটফুল, খইয়ের ধান —দোয়েল পাখি ভিড় করে এল সব। শাদা ছেঁড়া পালতোলা নৌকায় বার বার ফিরছি। রূপশালি ধানের ঘ্রাণে নবান্নের উৎসব জেগে ওঠে। মৃত্যু মুছে দিলেও প্রাণে প্রাণে প্রেমের বাজনা। ‘প্রেম যে তবুও প্রেম স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে রবে, বাঁচিতে সে জানে।’ এই বহুমুখী অন্বয়েই জীবনানন্দ বাঁচবার চাবিকাঠি খুঁজে পেয়েছেন।
তখনই অন্ধকার দেখতে শিখেছি। আলো দেখতে শিখেছি।ভালোবাসায় নিজেকে বাঁধতে শিখেছি।আর আমাদের প্রেমিকার মধ্যেও বারবার ‘শঙ্খমালা’ আবিষ্কৃত হয়ে চলেছে—
‘চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো—দুধে আর্দ্র—কবেকার শঙ্খিনী মালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।’
আদিম ক্যানভাসে ভেসে ওঠা নারীর একাকিত্বে আমাদেরও বিরহ লেগে যায়। যদিও বিকেলের বারান্দায় সব জীর্ণ নরনারী চেয়ে থাকে পড়ন্ত রোদের পারে সূর্যের দিকে। জীবনের ঘন মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে ঘুমজাগরণে অস্তিত্বেরই অনিঃশেষ পুনর্বিন্যাসে মিশে যাই। অন্ধকারের উৎসে প্রেমকেই আলোকের প্রার্থনা বলে জানি। অনুভূতির অভিঘাত সেই নিরিখেই প্রেমকে আহ্বান জানায়। মুখোমুখি বসবার আয়োজনেও তারই দেখা পান। সেই সত্তাই এসে এসে নাড়া দেয় আমাকে। একাকিত্ব বানান করতে থাকি। যৌবনের সোনালি হাঁস উড়ে গেলে বোধেরও দরোজা খুলে যায় । লাশকাটা ঘরের অন্ধকারে তখনও বোধের কাজ চলতে থাকে। যুগের হলাহল পান করে যুগোত্তীর্ণ হবার বাসনায় আর জেগে থাকার ইচ্ছা থাকে না। তবু ঘুমের ভেতর থেকে নদীর ছল ছল শব্দ শুনবার অনুভাবনাটি নঞর্থক হয়েও অস্তিত্বেরই জাগরণ বজায় রাখে। তখনই পেয়ে যাই নিজেকে খুঁজে। সব কাজ তুচ্ছ মনে হলেও, পণ্ড মনে হলেও, শূন্য মনে হলেও নির্ভার জাগতিক বোধে পার্থিবের ক্ষেত্র আলোঝলমলে হায় ওঠে। মহীনের ঘোড়াদের জন্ম দেয়। অবিরাম কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে তখন আমরা উড়তে শিখি। তিমির বিলাসী হয়েও তিমির হননে প্রবৃত্ত হই। এক সর্বব্যাপী প্রেমক্রিয়ার উপস্থিতি জীবনপ্রক্রিয়াকে আরও ঘনীভূত করে। ঘাই হরিণীর আহ্বান রাত্রিকে তোলপাড় করে তোলে। অতিজীবিতের প্রাগভাষ আকন্ঠ মগ্নতায় নোনামানুষীর কাছে নোনামানুষটিও পৌঁছায় সেই আদিম ইংগিতে। কবি সিন্ধুসারসকে বলেন–
‘পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই; –আর তার প্রেমিকের ম্লান
নিঃসঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ, তুমি তাহা কোনোদিন জানিবে না; সমুদ্রের নীল জানালায়
আমারই শৈশব আজ আমারেই আনন্দ জানায়।’
ইতিহাস আর ভূগোলের, সময় আর অনন্ত সময়ের, ব্যক্তি আর আবহমান মানবের চিরন্তন প্রবৃত্তিও আকুতির সমন্বয় হয়ে ওঠে জীবনানন্দের কবিতা। সেই বহুস্বরের চিরন্তন প্রবৃত্তির কাছে, আবেগের কাছে মাথা নুয়ে আসে আমার।#