রোকেয়া পদক বিতরণ আর রোকেয়াকে গালি: রাষ্ট্রের দ্বিচারিতার নির্মম প্রতিচ্ছবি

বাংলাদেশে ৯ ডিসেম্বর হলো এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের দিন। এইদিনে সরকারীভাবে পালিত হয় ‘বেগম রোকেয়া দিবস’- নারী জাগরণ, শিক্ষামুক্তি ও মানবমর্যাদার এক কিংবদন্তি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’র প্রতি রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা। কিন্তু সেই একই রাষ্ট্র বছর জুড়ে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে যখন রোকেয়ার নাম চিৎকার করে অপমানিত করা হয়, যখন তার মুখে কালো রং মাখানো হয়, যখন তাকে কাফের, মুরতাদ, মাগী বলে গালি দিয়ে অশ্লীলতা করা হয়। রাষ্ট্র তখন নীরব! অশুভ এই নীরবতা হলো সম্মতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভাষা।

একদিকে রোকেয়া পদক, অন্যদিকে রোকেয়ার প্রতিকৃতিতে কালিমা লেপন- এই দ্বিমুখী চরিত্রটিই আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রকৃত মুখ। এ এক ভয়ঙ্কর ভণ্ডামি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক যখন বেগম রোকেয়াকে কাফের মুরতাদ বলে গালি দেন, তখন তিনি শুধু একজন নারীবাদী পথিকৃতিকে অপমান করলেন না, তিনি নারীর মানবাধিকারকে পায়ে মাড়ানোর রাষ্ট্রীয় অনুমতি আছে বলে প্রমাণ করলেন। রংপুরে প্রতিকৃতিতে মাগী লেখা হলো, ঢাবির এক ছাত্রী গ্রাফিতির চোখ মুখ কালো করে দিল, সামাজিক মাধ্যমে উগ্র গোষ্ঠী তাকে জাহান্নামী, দাইয়ুস, মিয়া খলিফার সমতুল্য বলে নোংরা মন্তব্য ছুড়ে মারল। কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষমতসীনরা একদম চুপ। অন্তবর্তী সরকারে বেশ কয়েকজন নারী উপদেষ্টা রয়েছেন, কী কারণে তারাও মুখে তালা দিয়ে রেখেছেন! বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও যেন মুখে আঙুল দিয়ে সুবোধ বালকের ভূমিকায়! এসব দেখি আর ভাবি, রাষ্ট্রের বিবেক কি সত্যিই মৃত? নাকি রাষ্ট্র ইচ্ছা করেই মৃতের ভূমিকায় অভিনয় করছে?

যে সমাজে নারীর প্রতি ঘৃণা আজ ধর্মের মতো পবিত্র করে রাখা হয়, সেখানে রোকেয়ার মতো এক বিপ্লবী আলোকিত নারীর নাম টেনে অপমান করা সহজ। কারণ বাংলাদেশে নারীরা যত বেশি এগোচ্ছে, উগ্র পুরুষতান্ত্রিক শক্তি তত বেশি চিৎকার করছে, তত বেশি বিষোদ্গার করছে, তত বেশি হিংস্র হচ্ছে। নারীর অগ্রগতি তাদের কাছে মৃত্যুঘণ্টা। নারী এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম, ব্যাংকে, হাসপাতালে, প্রশাসনে, উদ্যোক্তা খাতে সমান কিংবা অধিকতর শক্ত উপস্থিতি নিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই দৃশ্য পিতৃতান্ত্রিক বৃত্তকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। তারা ফুঁসে উঠছে, কারণ এই অগ্রগতি তাদের শত বছরের আধিপত্যকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তাই তারা রোকেয়াকে আঘাত করছে। তারা জানে রোকেয়া হলেন সেই আলোর প্রতীকের কেন্দ্রবিন্দু। রোকেয়া মানে নারী মুক্তির সূচনা। রোকেয়া মানে বিদ্রোহের আগুন। রোকেয়া মানে প্রশ্ন করার সাহস। তাই রোকেয়াকে অপমান করা তাদের কাছে যেন বৃহত্তর নারীবিদ্বেষী যুদ্ধে বিজয়ের অনুভূতি।

রোকেয়া নিজেই বলেছিলেন যখনই কোনো ভগ্নী মাথা তুলতে চেয়েছে, তখনই ধর্মের দোহাই দিয়ে তার মাথা চূর্ণ করা হয়েছে। এই কথাটি আজ আরও নির্মমভাবে সত্য। কারণ আজ ধর্মকে ব্যবহার করে নারীর অগ্রগতির বিরুদ্ধে দ্বিগুণ তাণ্ডব চলছে। নারীর স্বাধীনতাকে শত্রু বানাতে যে ভয়ঙ্কর চক্র সক্রিয়, তারা রোকেয়াকে আক্রমণ করেই নিজেদের মানসিক গহ্বর উন্মোচন করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশে নারীনির্যাতন এতটাই বেড়েছে যে প্রতিদিন সংবাদ পড়তে পড়তেই মানুষ মুষড়ে পড়ে। ধর্ষণ, অপহরণ, বৈবাহিক ধর্ষণ, কর্মক্ষেত্রে নিপীড়ন, পরিবারের ভেতরে প্রতিদিনকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, তালাক দিয়ে বের করে দেওয়া, হত্যার পর লাশ গুম করা – নারীর জীবন যেন অবিরাম যুদ্ধক্ষেত্র। যারা এই সমাজে সবচেয়ে বেশি কাজ করে, সবচেয়ে বেশি লড়াই করে, সবচেয়ে বেশি ধৈর্য ধরে রাখে, সেই নারীরা সবচেয়ে বেশি অত্যাচারের শিকার হয়। আর যখন তারা নিজেদের অধিকার নিয়ে একটু মুখ খোলে, তখনই নোংরা পুরুষতন্ত্র ধর্মের ঢাল তুলে ধরে দাঁত বের করে বলে ওঠে তুমি চুপ থাকো। এই ভয়াবহ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রোকেয়া বিদ্রোহ করেছিলেন। আর তাই আজ তাকে অপমান করলেই যেন নারীকে চুপ করিয়ে দেওয়ার বৈধতা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ”যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমতঃ যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ……ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।”

কথা হলো রাষ্ট্র কি আসলে চায় নারী সাবলম্বী হোক? রাষ্ট্র কি চায় নারী নিজে সিদ্ধান্ত নিক? রাষ্ট্র কি সত্যিই চায় নারী নিজের বুদ্ধি দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিক? যদি চাইত, তাহলে রোকেয়ার অপমানকারীদের বিরুদ্ধে এতদিনে জবাবদিহি হতো। ক্ষমতাসীনদের এই নীরবতা প্রমাণ করে তারা নারীর পক্ষে দাঁড়ানোর ভান করে, অথচ মনে মনে নারীর অগ্রগতি নিয়ে অস্বস্তি বোধ করে। রাষ্ট্র যদি সত্যিই নারীর অধিকারকে গুরুত্ব দিত, তাহলে নারী নিপীড়ন আজ এত অস্বাভাবিক মাত্রায় যেত না। দেশে একজন নারী রাস্তায় নিরাপদ নয়, বাসে নিরাপদ নয়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ নয়, নিজের বাড়িতেও নিরাপদ নয়। আর এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রোকেয়াকে অপমান করা মানে নারীর নিরাপত্তা ও অস্তিত্বকে অপমান করা।

রোকেয়ার লেখা আজও যেন আগুনের মতো জ্বলছে। তিনি বলেছিলেন ”ভগিনীরা চুল রগড়াইয়া জাগিয়া উঠো। আমরা পশু নই, আমরা আসবাব নই। আমরা মানুষ।” তিনি শত বছর আগে নারীদের হাতে যে মশাল তুলে দিয়েছিলেন, আজও সেই মশাল বাংলাদেশের অন্ধকারে আমাদের পথ দেখায়। এই মশালই উগ্র গোষ্ঠীর জন্য হুমকি। তারা জানে মেয়েরা একবার জেগে উঠলে তাদের পুরুষতান্ত্রিক সিংহাসন ভেঙে পড়বে।

রোকেয়াকে অপমান করা কোনো ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়; এটা নারীর অগ্রগতির বিরুদ্ধে উগ্র পুরুষতন্ত্রের ঘোষণা। রোকেয়ার বিরুদ্ধে আজকের আক্রমণ আসলে সমাজের গভীরে জমে থাকা ভয়, ঘৃণা এবং পশ্চাৎপদতার প্রকাশ। যারা নারীর অগ্রগতিকে মানতে পারে না, তারাই সবচেয়ে বেশি রোকেয়াকে ভয় পায়। তারা জানে রোকেয়া তাদের অন্ধকারকে ভেদ করার আলো।

তাই বেগম রোকেয়ার প্রতি প্রতিটি গালি, প্রতিটি থুথু, প্রতিটি অপমান এই দেশের নারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘোষিত একেকটি বিদ্বেষযুদ্ধ। এই দেশ যতদিন নারীর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারবে, ততদিন রোকেয়া এই সমাজের বিবেক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। যতদিন রাষ্ট্র নীরব থাকবে, ততদিন রোকেয়ার শব্দ আরও জোরে প্রতিধ্বনিত হবে। যতদিন উগ্রতার আগুন জ্বলবে, ততদিন রোকেয়ার আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

কারণ রোকেয়া কেবল একজন নারী নন, রোকেয়া মানে জাগরণ। রোকেয়া মানে একটি বিদ্রোহ, একটি ইতিহাস, একটি সংগ্রাম, একটি অগ্নিশিখা, যা কখনো নিভে না। রোকেয়া মানে নারীর স্বাধীনতার প্রথম চিৎকার। আর যারা তাকে অপমান করে, তারা ইতিহাসের অন্ধকার খাতে চিরকাল অচেনা, নোংরা, ঘৃণিত হয়ে থাকবে।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আমাদের শেখান, অসমতার অন্ধকার কাটানোর একমাত্র উপায় হলো আলোকিত মন। তিনি আলো দেখিয়েছেন; সেই আলোতে পথ খুঁজে নেওয়ার দায়িত্ব এখন আমাদের।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!