প্রকৃতপক্ষে মহালয়ার তিথি থেকেই দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে শারদোৎসবের সূত্রপাত হয়ে থাকে। লোকসাংস্কৃতিক গবেষকদের মতে—বাংলা সালপঞ্জির আশ্বিন মাসের অমাবস্যার এই মহালয়া নামটির উৎসের মধ্যেই এর ধর্মীয় সংস্কারগত তাৎপর্যকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এজন্য—এই বিশেষ দিনটিতে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করবার যে রেওয়াজ স্মরণাতীত কাল থেকে প্রচলিত রয়েছে, সবার আগে সেটারই পরিপ্রেক্ষিতে এই নামটির নিহিতার্থ সন্ধান করবার প্রয়োজনীতা দেখতে পাওয়া যায়। আক্ষরিকভাবে আনন্দনিকেতন শব্দটি মহালয়া শব্দের সমার্থ। হিন্দুদের প্রচলিত সংস্কার অনুযায়ী ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে শুরু করে আশ্বিনের কৃষ্ণা পঞ্চদশী, অর্থাৎ—অমাবস্যা পর্যন্ত প্রেতলোক থেকে পিতৃপুরুষের আত্মারা মর্ত্যলোকে নিজেদের ত্যাগ করে যাওয়া গৃহ-পরিজনের মায়ায় ফিরে আসেন, এবং এই মহালয়ায় তাঁদের সকলের আবির্ভাব সম্পূর্ণ হয় বলেই এই দিনটিতে তর্পণের মাধ্যমে তাঁদের পরিতৃপ্তি-বিধান করে প্রতিটি গৃহেই আনন্দোৎসব পালনের বিধি প্রচলিত রয়েছে। একাজের জন্য আলয় যেদিন মহ, অর্থাৎ—আনন্দময় হয়ে ওঠে, সেদিনই হল মহালয়া।
তবে অতীতের কোন একসময়ে আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষ বা পিতৃপক্ষের প্রতিদিনই পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করবার রীতি প্রচলিত ছিল। তাই আজও তাঁদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা সহকারে যে অন্নজল নিবেদন করা হয়, সেটাও শ্রাদ্ধই; আর সেটার মাধ্যমে এইসব আগন্তুক আত্মাদের তৃপ্ত করা যায় বলেই, একে ঐতিহ্যগতভাবে তর্পণও বলা হয়ে থাকে। এককথায় মহালয়া হল—পূর্বপুরুষের প্রেতকে পূজা করবার বিশেষ একটি তিথি।
এই প্রেতপূজা, মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাসে অত্যন্ত আদিম একটি বিশ্বাসের লব্ধফল। আর এই কারণেই লোকসাংস্কৃতিক গবেষকরা বলে থাকেন যে, মহালয়ার মত উৎসবটি স্মরণাতীত কাল থেকেই প্রচলিত রয়েছে। বস্তুতপক্ষে, গবেষকদের মতে—নিয়ান্ডারথ্যাল মানুষও—যাঁরা কম করেও ৪০,০০০ বছর আগেই উন্নততর প্রজাতি ক্রো-ম্যানীয়দের বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে বিলীয়মান হয়ে গিয়েছে—তাঁরা যেভাবে কিছু কিছু বিশেষ রীতি বা আচার মেনে মৃতকে সমাধিস্থ করত, সেটা থেকে একথা পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে—তাঁরা এমন কল্পনাও করত যে মৃতের এই পৃথিবীতে পুনরাগমন সম্ভব। আসলে এই পৃথিবীতে মানব সভ্যতার আদিপর্ব থেকেই প্রয়াত ব্যক্তির সত্তার পুনরাগমন সম্ভব—এমন ধারণা প্রবহমান রয়েছে। একথার উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে, প্রাচীন মিশরের পিরামিড সমাধিগুলির মধ্যে খাদ্য, পানীয় ও বস্ত্র তো বটেই,—এমনকি ফারাওয়ের আত্মা পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে এসে যাতে কোনো রকমের চাহিদা অপরিপূর্ণ থাকবার কারণে কষ্ট না পায়—সেজন্য দাসদাসী ছাড়াও রানীদের পর্যন্ত কোন কোন সময়ে জীবিত অবস্থায় সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। তাই এই প্রেতাত্মার পূজার ব্যাপারটা এদিনের সর্ববিধ শ্রাদ্ধের মধ্যেই সুস্পষ্টভাবে ধরা দেয়।
কিন্তু এরপরে যে প্রশ্নটা উঠে আসে, সেটা হল যে, তাহলে মহালয়ার ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যটা কি? আসলে বাংলা সালপঞ্জিতে যে সময়ে মহালয়া তিথি পড়ে, তখন খরা বা বন্যায় শস্য নষ্ট না হয়ে গেলে সাধারণভাবে এদেশে ফসলভরা মাঠই দেখতে পাওয়া যায়। তাই এরকম ভরা ফসলের মরশুমে পিতৃপুরুষ নিজের ছেড়ে যাওয়া গৃহে ফিরে আসছেন এবং উত্তরপুরুষের স্বাচ্ছল্য দেখে আনন্দিত হচ্ছেন—এমন কল্পনার পিছনে আজও কিছু আদিম প্রত্যয় ক্রিয়াশীল রয়েছে বলে গবেষকরা মনে করে থাকেন।
তাঁদের মতে—মানুষের আদিম পিতামহরা মনে করতেন যে, তাঁরা যে অন্ন, অর্থাৎ—শিকার বা ফলমূল বা অন্য কোনো খাদ্যবস্তু অর্জন করছেন, সেটা আসলে কোনো না কোনো অলৌকিক শক্তির দান। অতীতে গবেষক ই. বি. টাইলর তাঁর ‘দ্য প্রিমিটিভ কালচার’ গ্রন্থে জানিয়েছিলেন যে, প্রকৃতির অন্তর্লীন বলে কল্পিত এইসব শক্তির নাম হল—মান্যা। তবে এই অলৌকিক শক্তিময় প্রকৃতিনিচয়ের মধ্যে পিতৃপুরুষের আত্মার অস্তিত্ব কল্পনা করবার পিছনে একটা মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি-ও রয়েছে। পৃথিবীর সব মনোবিজ্ঞানীই একথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে—আদিম মানুষের মনের সঙ্গে শিশুর মানসিক-প্রবণতার একটা মৌলিক সমধর্মিতাও বর্তমান রয়েছে। কি রকম? একটি শিশু যেমন তাঁর খাদ্যের জোগানদাতারূপে নিজের পিতা-মাতা বা অন্যান্য সব অভিভাবকদেরই ভাবতে শেখে, সুদূর অতীতের আদিম মানুষেরাও তেমনি নিজেদের খাদ্য—তা সেটা শিকার করা কোন প্রাণী হোক, কিংবা সংগৃহীত ফলমূল হোক—যে অলৌকিক-মান্যা তাঁদের সেসব জোগান দিত, তাঁরা তাঁদের পিতৃপুরুষ—এমনই ধারণা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। এই মান্যা–ই কালক্রমে দেবতায় বিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। সেই কারণেই বর্তমানে দেবতার উদ্দেশ্যে অঞ্জলি-অর্চনা নিবেদন করা এবং পিতৃপুরুষের আত্মার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তর্পণ তথা ভোজ্য উৎসর্গ করা—মূলতঃ একই ব্যাপার হয়ে উঠেছে। এবং অতীতের স্মার্ত-ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিধানের পরিপ্রেক্ষিতে মহালয়ায় এখন এই সংস্কারেরই পরিশীলিত এবং শাস্ত্রবিহিত ব্যাখ্যান দেখতে পাওয়া যায়।
এছাড়া এদিন স্নানান্তে, জলে—বাঞ্ছনীয়তঃ বহমান কোন নদীতে—কোমর পর্যন্ত মগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে করাঞ্জলিতে জল তুলে সূর্যের দিকে মুখ করে মন্ত্রোচ্চারণ করবার পরে হাতের সেই জল মুঠি খুলে নদীতে বা পুকুরে পুনরায় ফেলে দেওয়ার মধ্যে আরো কিছু অতীতকালীন সংস্কার সমাবৃত রয়েছে বলে গবেষকরা মনে করে থাকেন। তাঁদের মতে এই পদ্ধতির মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে সূর্যপূজা এবং নদীপূজার সুপ্রাচীন রীতিও বিমিশ্রিত হয়ে রয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সূর্য উপাসনা কেন্দ্রিক ধর্মধারা বা কাল্ট এবং নদী বন্দনার ধর্মধারাও সংস্কৃতিবিজ্ঞানীদের চোখে উর্বরতাকেন্দ্রিত ধর্মবিশ্বাসেরই এক একটি ভাবগত অভিব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। পণ্ডিতদের মতে মানুষ হয়ত কৃষির উদ্ভবের আগে থেকেই সূর্যকে পুরুষশক্তির এবং নদীকে নারীশক্তির প্রতীকরূপে কল্পনা করতে শিখেছিল, এবং পরবর্তী সময়ে কৃষিকাজ শেখবার পরে রৌদ্র এবং জলের গুরুত্ব কতটা সেটাও তাঁদের উপলব্ধিতে এসেছিল। তাই ফসল যখন মাঠে থাকে, তখন সেই ফসলের আসল উৎস যেসব নিসর্গশক্তি, অর্থাৎ—রোদ এবং জল—সেগুলির উদ্দেশ্যে মানুষের কৃতজ্ঞতার অভিব্যক্তিও এই মহালয়ার তর্পণের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। আসলে প্রয়াত পূর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশ্যে তর্পণ এবং নদী ও সূর্যের উদ্দেশ্যে তর্পণ—মহালয়ায় পৌঁছে মানুষের ভাবনার স্তরে একত্রে সমাহৃত হয়ে গিয়েছে বলে দেখা যায়।
অতীতে মহালয়া উপলক্ষ্যে পালিত একটি ধর্মাচার পালনের সমস্তটা বিশ্লেষণ করলে এই বক্তব্যটির যথার্থতা প্রতিপন্ন করা সম্ভব। যদিও বর্তমানে অবশ্য প্রায় সর্বত্রই এই আচারটি বিলীয়মান হয়ে এসেছে, তবুও অতীতে—তর্পণান্তে একখণ্ড কাঠের উপরে একটি জ্বলন্ত কয়লার টুকরো বসিয়ে একটা বিশেষ মন্ত্র আবৃত্তি করবার মাধ্যমে সেটাকে ভাসিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল বলে জানা যায়। ডঃ দীনেন্দ্রকুমার সরকার সেই মন্ত্রটির ভাষ্য করতে গিয়ে লিখেছিলেন— “যাঁরা মৃত্যুলোককে ছেড়ে আমার আলয়ে এসেছেন তাঁরা এই উজ্জ্বল আলোকে অনুসরণ করে অগ্রগমন করুন।”
অর্থাৎ—সেই অগ্নিময় উজ্জ্বলতাই তখন পৃথিবীতে আগত আত্মাদের পথবর্তিকা ছিল। আর এখানেই মহালয়ার অনুষ্ঠানে সূর্যের ভূমিকাটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এথেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে—তেজোময় ও রশ্মিময় সূর্যই হল পিতৃপুরুষের আলয়; এবং সুদূর অতীতের কোন একটাসময়ে মানুষের ভাবনার স্তরে সূর্যালোক এবং পিতৃলোক অভিন্ন অবস্থায় ছিল। জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ডটি ছিল সেই তেজ-রশ্মিময়তার প্রতীকী নির্দেশন, আর জলের ওপরে সেটিকে ভাসিয়ে দেওয়ার তাৎপর্য ছিল—যাঁরা জল ও উত্তাপ, অর্থাৎ—যাঁরা মাতৃ ও পিতৃ শক্তিদ্বয়ের প্রতীক—তাঁরা সমন্বিত হয়ে এই শ্রাদ্ধ বা তর্পণকে সার্থক করছেন। গবেষকদের মতে—অতীতে এরকমই একটা ভাবনাই এই আচারের অনুষঙ্গে সক্রিয় ছিল। যেহেতু মহালয়াকে পিতৃপক্ষের শেষদিন বলে গণ্য করা হয়ে থাকে, সেহেতু তখন ঐ ভাসমান অগ্নিখণ্ডকে প্রকৃতপক্ষে পিতৃপুরুষের আত্মাদের পরিতৃপ্ত করে প্রেতলোকে প্রত্যাবর্তনের পথ দেখানোর দ্যোতক বলে গণ্য করা হত—একথা মনে করা চলে। প্রসঙ্গতঃ একথাও উল্লেখ্য যে, বিশেষতঃ আদিমকাল থেকেই মানুষ অগ্নিকে প্রেতভয় দূরীকরণের ক্ষমতাসম্পন্ন বলে মনে করে এসেছে। আর তাই যে সময়ে সমস্ত প্রয়াত মানুষের আত্মারা পৃথিবীতে এসে সমবেত হয়েছে বলে কল্পনা করা হয়, অতীতে ঠিক তখনই এই অগ্নি-প্রজ্জ্বালনের ব্যাপারটা ঘটানো হয়েছিল। এছাড়া এসময়ে অশুভকারী কোনো আত্মা যদি পৃথিবীতে এসে থাকে, তবে তাকে বিতাড়িত করবার জন্যও ওই আগুন জ্বালানোর রেওয়াজটা অতীতে মহালয়ার আচারবিধিতে যুক্ত করা হয়েছিল।
অতএব মহালয়ার মধ্যে—পিতৃপুরুষের আত্মাকে কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্য দেওয়া, সূর্য এবং নদীর পূজা, উর্বরতা-কেন্দ্রিক ধর্মধারার অনুসরণ, অশুভ প্রেত-বিতাড়ন প্রভৃতি বহুবিচিত্র সংস্কার মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে বলে দেখা যায়। আর আশ্বিন মাসের অমাবস্যায় পিতৃপুরুষকে এভাবে নিজেদের ঘরে ফসল তোলবার প্রাক্কালে স্মরণ করবার অনুষঙ্গ বহন করেই সমগ্র কার্তিক মাস ধরে রাতে আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর রেওয়াজ চালু হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। ভরা ফসলের মাঠ এবং ঘর চিহ্নিত করবার প্রয়োজনেই এই প্রদীপ জ্বালানো হয়ে থাকে; এবং নক্ষত্রলোকের বাসিন্দা পিতৃপুরুষেরা যেন এই সমৃদ্ধি দেখে পরিতৃপ্ত হন—এর পিছনে এমনতর কল্পনা রয়েছে। এই আকাশপ্রদীপ আসলে উর্বরতাকেন্দ্রিক কাল্টেরই আরেকটি বহিঃপ্রকাশ।#