সুরের সমরাস্ত্র ও অবিনাশী চেতনা: আলতাফ মাহমুদের রক্তঋণ

সময়ের মহাসমুদ্রে কিছু তরঙ্গের অভিঘাত এতটাই তীব্র যে, তা কেবল কূলকে স্পর্শ করে না, বরং তীরের ভূগোলকেই চিরতরে বদলে দেয়। বাঙালির জাতিসত্তা গঠনের মহাকাব্যে শহীদ আলতাফ মাহমুদ ছিলেন সেই প্রলয়ংকরী অথচ সুশীতল এক শ্রাবণ-মেঘ, যাঁর অস্তিত্বের বুক চিরে নেমে এসেছিল দ্রোহ আর শোকের যুগল বারিধারা। ইতিহাসের এক বিশেষ ক্রান্তিলগ্নে, যখন একটি জনপদের আত্মপরিচয় ঔপনিবেশিক আঁধারে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ছিল, তখন সুরের এক অতিভৌতিক জাদুমন্ত্রে তিনি সেই ধুলোবালি থেকেই জাগিয়ে তুলেছিলেন এক মৃত্যুঞ্জয়ী হাহাকার। আলতাফ মাহমুদ কেবল একজন সুরকার ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক অবরুদ্ধ ভূখণ্ডের আদিম আর্তনাদকে আধুনিক মুক্তির সংগীতে রূপান্তরকারী অনন্য ‘সাংস্কৃতিক কারিগর’। তাঁর সৃজনশীলতা ছিল এক প্রকার ‘শব্দজয়ী লড়াই’, যা বুলেটের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে বিদ্ধ করেছিল শোষকের মসনদ।

​১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশালের মুলাদীতে যে নক্ষত্রটির উদয় হয়েছিল, প্রকৃতিই ছিল তাঁর প্রথম মহাকাব্যিক পাঠশালা। শৈশবে দরাজ গলায় মধুর সুরে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত শুনে মুগ্ধ শ্রোতারা ভেবেছিলেন তিনি একদিন বড় ক্বারী হবেন, কিন্তু তাঁর ললাটে মহাকাল লিখেছিল সুরের এক অনন্ত ক্যানভাসে ইতিহাসের ছবি আঁকার দায়। ১৯৪৮ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন শেষ করে চিত্রকলার নেশায় কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া এই তরুণের রেখা ও রঙের ওপর মজ্জাগত দখলই পরবর্তীকালে বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত রাজপথের প্রতিটি আন্দোলনে তাঁর আঁকা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারগুলোকে বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অবিনাশী দলিলে রূপ দিয়েছিল। ছবি আঁকা তাঁর নেশা হলেও সুর ছিল তাঁর অস্তিত্বের গভীরতম তৃষ্ণা। আর তাই বাড়ির সামনের বেঞ্চিতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান গেয়ে তিনি মুগ্ধ করতেন শিক্ষক ও সহপাঠীদের।

​প্রসিদ্ধ সংগীতজ্ঞ সুরেন রায়ের কাছে সংগীতের প্রাথমিক পাঠ নেয়া এই ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন এক বিরল মেধা, যাঁর আঙুলের ছোঁয়ায় হারমোনিয়াম, তবলা, বেহালা, পিয়ানো কিংবা পারকাশন—সবই কথা বলে উঠত। ১৯৫০-এর দশকে করাচিতে অবস্থানকালে ওস্তাদ আব্দুল কাদের খাঁ ও ওস্তাদ গুলাম মোহাম্মদ খাঁ-র কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে দীর্ঘ তালিম এবং পশ্চিমা সংগীত বিন্যাস বা ‘অর্কেস্ট্রেশন’ সম্পর্কে তাঁর বিরল পাণ্ডিত্য তাঁকে উপমহাদেশের সংগীত ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করে। ১৯৫২ সালে পিয়ংইয়ং-এ আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হলেও পাকিস্তানি শাসকরা তাঁর পাসপোর্ট আটকে দেয়—ঠিক যেভাবে চিলির ভিক্টর জারা কিংবা নাইজেরিয়ার ফেলা কুটিকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল তাদের স্বৈরশাসকরা। কিন্তু আলতাফ মাহমুদের সৃজনশীলতাকে কোনো কারাগারে অবরুদ্ধ করা যায়নি। ঢাকা ফেরার পর তিনি শোষিত মানুষের রুদ্ধশ্বাস যন্ত্রণাকে এক বিশ্বজনীন নন্দনতাত্ত্বিক মাত্রা দান করেন। তিনি জানতেন, সুর যখন রাজনৈতিক হয়ে ওঠে, তখন তা কামানের গোলার চেয়েও অধিকতর সংক্রামক। তাত্ত্বিকভাবে তিনি সুরকে শাসকগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক ‘পাল্টা হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

​আলতাফ মাহমুদের এই সৃজনশীল দর্শনের সার্থক প্রতিফলন ঘটে তাঁর সংগীত পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোতে। ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’, ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’, ‘সংসার’, ‘দুই ভাই’ কিংবা ‘নয়নতারা’র মতো চলচ্চিত্রে তিনি যে সুরের মায়া বুনেছিলেন, তা সাধারণ মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল। জহির রায়হানের অমর সৃষ্টি ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে তিনি কেবল সংগীত পরিচালক ও অভিনেতা ছিলেন না, বরং এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপকার ছিলেন। এছাড়াও ‘টাকা আনা পাই’, ‘অবুঝ মন’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘শপথ নিলাম’, ‘সপ্তডিঙ্গা’ কিংবা উর্দু চলচ্চিত্র ‘তানহা’ ও ‘ক্যায়সে কাহু’র মতো ১৯টি চলচ্চিত্রে তাঁর সুরের সুগভীর ব্যাকরণ মিশে আছে। আলতাফ মাহমুদের সৃষ্টিসম্ভারের শ্রেষ্ঠ রত্ন হলো ১৯৫২ সালের অমর একুশের শোকগাথা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক সুর। ১৯৫৩ সালে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর কবিতায় তিনি যখন সুরারোপ করেন, তখন তিনি অজান্তেই তৈরি করেছিলেন একটি জাতির মনস্তাত্ত্বিক সংবিধান। সুরের গহন কাঠামোতে শোকের বিলাপ এবং সংগ্রামের গতির যে অনন্য মেলবন্ধন তিনি ঘটিয়েছিলেন, তা সরাসরি মানুষের অবচেতন মনে আঘাত করে মুক্তির উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলত। এটি কেবল একটি গান নয়, এটি ছিল একটি অবরুদ্ধ জাতির ‘মনস্তাত্ত্বিক জাগরণ’।

​ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন এক মমতাময়ী পিতা; শত ব্যস্ততার মাঝেও স্ত্রী সারা আরা মাহমুদ ও একমাত্র সন্তান শাওন মাহমুদের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে শান্ত ও মধুময় অধ্যায়। কিন্তু সেই কোমল হৃদয়ের মানুষটিই দেশের প্রয়োজনে হয়ে উঠেছিলেন বজ্রকঠিন। ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে আলতাফ মাহমুদ কেবল সুরের জাদুকর রইলেন না, হয়ে উঠলেন এক অকুতোভয় গেরিলা যোদ্ধা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বিপরীতে তাঁর ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাড়িটি হয়ে উঠেছিল একাত্তরের এক ‘দুর্গ বাড়ি’, যেখানে দুর্ধর্ষ ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর যোদ্ধারা মরণপণ লড়াইয়ের ছক আঁকতেন। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দারের নির্দেশে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঐতিহাসিক বিস্ফোরণ অপারেশনের নিভৃত পরিকল্পক ছিলেন তিনি। তাঁর বাসার কাঁঠাল গাছের নিচে মাটির গহিনে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ট্রাঙ্কভর্তি বিস্ফোরক ও মারণাস্ত্র। একই সাথে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য ‘আমি মানুষের ভাই স্পার্টাকাস’ কিংবা ‘এ ঝঞ্জা মোরা রুখবো’র মতো গানগুলো রেকর্ড করে তিনি সীমান্তের ওপারে পাঠাতেন। তাঁর বলিষ্ঠ কন্ঠে গাওয়া সেই সময়ের গণসংগীত কিংবা নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সেই অগ্নিঝরা সুর বাঙালির বুকে সাহসের সঞ্চার করত।

​তাঁকে ভারতে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলে তিনি দৃঢ়তায় সাথে বলেছিলেন, “সবাই ওপারে গেলে এখানে কে থাকবে?” এই দায়বদ্ধতাই তাঁকে ৩০ আগস্টের সেই অভিশপ্ত ভোরে পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। সামাদ নামক এক ব্যক্তির বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়ার পর আলতাফ মাহমুদের ওপর নেমে আসে পৈশাচিক নির্যাতন। ফ্যানের সঙ্গে পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা কিংবা জ্বলন্ত সিগারেট ডলে গায়ে নেভানোও তাঁর উন্নত শিরকে নত করতে পারেনি। ৩ সেপ্টেম্বর চোখ বেঁধে তাঁকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়, এরপর এই সুরসম্রাট আর কোনোদিন ফেরেননি। এই শোক সইতে না পেরে তাঁর মা মস্তিষ্কের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন— যা একটি জাতির ওপর চাপানো সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক আঘাতের এক জীবন্ত ট্র্যাজেডি। ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদক এবং ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত এই বীরের কোনো চিহ্নিত সমাধি নেই। কন্যা শাওন মাহমুদের সেই চিরকালীন আর্তি—“আমার বাবার কবর কোথায়?” আজও বাঙালির বিবেককে তাড়িত করে। আলতাফ মাহমুদ আজ কেবল একটি নাম নন, তিনি এক অবিনাশী চেতনা। যাঁর কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধি নেই, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশই তাঁর সমাধিক্ষেত্র। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, যতদিন একুশের প্রভাতফেরি থাকবে, যতদিন রাজপথ কাঁপানো গণসংগীত জনতাকে জাগিয়ে তুলবে, ততদিন তাঁর সুর আমাদের রক্তে ও অস্থিতে মিশে থাকবে বাঙালির প্রতিটি লড়াইয়ের শানিত প্রেরণা হয়ে।

​আলতাফ মাহমুদ ইতিহাসের সেই ধ্রুবতারা, যিনি জীবনের বিনিময়ে সুরকে দিয়েছিলেন অমরত্বের অধিকার। তাঁর আপাত অনুপস্থিতিই আজ বাঙালির প্রতিটি সংকল্পে তাঁর সবচেয়ে বড় উপস্থিতি। তিনি চিরতরে হারিয়ে যাননি; বরং মিশে গেছেন এই ভূখণ্ডের মাটির গভীরে, বাতাসের মন্দ্রধ্বনি আর কোটি মানুষের হৃদস্পন্দনে— যেখানে প্রতিটি ভোর আজও জেগে ওঠে তাঁর সুরের রক্তঋণ স্বীকার করে। তিনি ছিলেন, তিনি আছেন এবং তিনি চিরকাল অম্লান থাকবেন এক অপরাজেয় সাংস্কৃতিক অগ্নিশিখা হয়ে।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!