গীতিকাব্য: নোনা মাটির নোলক (পর্ব- ৩)

মাটির গান গাইতে গাইতে নোনাজলে ভেসে বেড়ায় মদন, ছমির মিঞারা। প্রকৃতি কাড়ে তাদের সুখ- স্বপ্ন- আশা- ভরসা। নোনাস্রোতে ভাঙনের সাক্ষী হয় রোজ রোজ। রাত নামলে ছমিরের চোখে ভাসে মেয়ে গোলাপির মুখ। শোনে বিবির অসহায় কান্না।কালক্রমে বাঁজা হারামনি শোনে নারী জীবনের কাঙ্খিত মা ডাক। নোনা জল শোনায় নিখোঁজ হওয়া মানুষের গল্প। আখ্যান জড়িয়ে বাঁচে বিপন্ন লোকসংস্কৃতি, অলৌকিক বিশ্বাস, গ্রাম্য নরনারীর প্রেম, অকাল শোক । ‘নোনা মাটির নোলক’ বস্তুত সমাজ, লোকসংস্কার ও রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষিতে গ্রামীণ বিভাজনের দৃশ্যলিখন, ভাঙনের গান।

তৃতীয় পর্ব

গে দেকি গে সোকাল ব্যেলায় চারদিক নন্ডভন্ড
নদীর চরায় কাপোড়চোপোড় হুলুস্থূলু কান্ডো
পাঁচু মাঝি চেঁইচে ওটে এদিকতোন সব আয়
নদীর চরায় আনলি তুলে পাণটা বেঁচে যায়।

গেলুনি কেউ ধারে বাড়ে গোলায় তাবিজ দেকে
কোলে তুলে আনলো পাঁচু নোকজনের সপ হেঁকে
ডাঙায় তুলে জলের ছিটে দিচ্চে মুকি চোকি
বন্দো দুচোক খুললো ঝেনো কারোর পোষা পাকি।

মাতা নেড়ে কোনো অকম খেতি চাচ্চে জল
গ্যেন ফিরেচে তেবু ঝেনো শরীলী নি বল।
এরোম কোরে বলদেন কি আর মরোণ দেকতি পারি
জাত অনজাতির বিচের করবে আল্লা যিশু হরি।

জলের তোড়ে ভেসে চলে কতো দুঃকি ঢেউ
ভাঙা বুকি যাবে কোতায় ভাববেনে তো কেউ।
নদী নেকে কতো মরোণ কতো জেবন শোক
পাতা ঝরার আবাজ ওটে নোনামাটির চোক।

বাড়িতেনে ঢুকে দেকে বৌ-টা গেচে খেপে
বুড়ো বয়সে মদ্দোটা কি খাচ্চেরে জল মেপে!
ভালোবাসা ভাগ হলি রে চোকি ঝরে জল
মনেতেনে ভাঙে স্বপ্নো ভাঙা বুকির তল।

হারামণি আগিস নি তুই আমার কোতা শোন
তোরে আমি ঠকাবুনি তুই যে আপোন জন
মাতায় হাত দে বলতিচিরে মোটে মিত্যে নয়
সোয়াগ দেকাতি হবে নে মদ্দো এরোম হয়।

বিস্বেস কর তুই ওই ছানিটা ছ্যেলো নদীর চরে
শেলকুকুরি ছিঁড়ে খেতো না আনলি ওর ঘরে
আঙ্গার পেটে ভাত জোটে না নি ভালো ঘর দোর
ধাড়ি ছানির আনলি ধোরে আকবি কোথায় ওর?

ওই ছানিটার ছুঁইলি এ্যাকোন যাবে আঙ্গার জাত
চাল চুলো নি কেমোর করে দিবি পেটের ভাত!
জাতের ব্যেড়ায় এটকে আচে আঙ্গার বদ্দো মন
সুজ্জ্যু এসে জ্বেইলে দেবে আঁধার ঘন বোন।

তেরপোল টেঁইঙে বাতা মেরে আচি কুঁজি বেঁদে
জলে ঝড়ে ভাঙবে চালা ওটবে বুকটা কেঁদে
দুজন নোকে খাইখাটি আর থাকি খালের ধারে
আটকুড়ো নাম ঘুচবেরে তোর ডাকলি মা মা করে।

জন্মো দিলি হয় নারে মা বলে সব্বো নোকে
জাতের কোতা ভুলে যা না নে না কাচে ডেকে।
জলে হাওয়ায় দোলে শরীর অঙিন ফুলির নাচ
মাটির ছাওয়ায় বেঁচে থাকে যেরোম কোরে গাচ।

ছানিটা সব ভুলে গেচে জলে ডোবার পর
গাচপালা তার আপন ঝ্যেনো আপন নদীর চর
মেগের নাহান কালো চুলি দোলে পুবির হাওয়া
মাতার সিতে ধানের সোয়াগ সোনার আলো ছাওয়া।

ও আদুরি চল না দুজন আনতি কলের জল
খেটে খেটে জের্নো মারা গায় নি কোনো বল
এতো করে বলতিচি মার বদ্দির কাচে যেতি
শুনতো কোতা তুই ঝেদি ওর পেটের মেয়ে হোতি।

বলিসনি আর ও আদুরি না থাকলি আজ ওরা
মরা শরীর কেঁমড়ে খেতো শেয়াল কুকুরিরা
পোষা পাকির জেবন বাঁচে সুকির খড়ো বাশায়
সব হেইরে যে তবুও মানুষ বাঁচে আশায় আশায়।

মাটির কলসি কাঁকে করে চললো দুজন কলে
বুনোফুলির গন্ধে মেকে বাতাস ভেসে চলে
নালচে সূজ্জু ঝিলিক মারে নদীর জলের গায়
সোনার আলোর বাঁধভাঙা ঢেউ ডাকে কাচে আয়।

আয় না কাচে দকিন হাওয়া ফুলসোহাগী সই
বন্দো কুঁড়ি খোলে দোরজা মনের কোতা কই
আয় না কাচে ধুলোর এনু ছোড়াই সিতের বাঁকে
চোটিপাকির বাসার ভোতর কচি ছানা ডাকে।

পাকি ঢোকে তাগার বাসায় ছায়া পড়ে গাচে
টোলার চেপে যাচ্চে কারা আনোন্দে ঢেউ নাচে।
চেইলে চল না ভাবদেচে মা হয়তো আঙ্গার কোতা
কাজে থেকে ফিরলি বাপটা বলবে আমার ঝা তা।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!