মাটির গান গাইতে গাইতে নোনাজলে ভেসে বেড়ায় মদন, ছমির মিঞারা। প্রকৃতি কাড়ে তাদের সুখ- স্বপ্ন- আশা- ভরসা। নোনাস্রোতে ভাঙনের সাক্ষী হয় রোজ রোজ। রাত নামলে ছমিরের চোখে ভাসে মেয়ে গোলাপির মুখ। শোনে বিবির অসহায় কান্না।কালক্রমে বাঁজা হারামনি শোনে নারী জীবনের কাঙ্খিত মা ডাক। নোনা জল শোনায় নিখোঁজ হওয়া মানুষের গল্প। আখ্যান জড়িয়ে বাঁচে বিপন্ন লোকসংস্কৃতি, অলৌকিক বিশ্বাস, গ্রাম্য নরনারীর প্রেম, অকাল শোক। ‘নোনা মাটির নোলক’ বস্তুত সমাজ, লোকসংস্কার ও রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষিতে গ্রামীণ বিভাজনের দৃশ্যলিখন, ভাঙনের গান।
দশম পর্ব
নামী দামী অত্নো কতো আচে নদীর বুকি
কেউ করে না যত্নো তেবু চায়রে থাকতি সুকি
কতো ঢেউয়ে নেকে নদী তাগার দুকির কোতা
কতো ঢেউয়ে আচাড় পাচাড় বুকির গোপন ব্যেতা।
ছমির মিঞা ভুলে গেচে নদীর ভাঙা ঢেউ
নোকের বাড়ি ঘুরে ব্যেড়ায় ফকির ডাকে কেউ
এতায় সেতায় ওদে জলে খসে হলদে পাতা
ঘইনে আসে কালো চোকি নোনা জলের সোতা।
পিতীবিতে সেই তো সুকি যার নি কোনো চাওয়া
নোভের জন্যি ছুটে চলা ঘন আঁদার ছাওয়া
বিবি মেয়ে কোতায় আচে কিচ্চু নি তার মনে
নৌকো বাঁদা নদীর চড়ায় দাঁড়ের আবাজ শোনে।
কাঁদে ঝোলে পুটলি-ঝোলা নেগে ধুলো কাদা
ছেঁড়া নুঙি পরে আচে মাতায় গামচা বাঁদা
এরোম করে কোতো জেবোন ভুলে থাকে ব্যেতা
মাতাল হাওয়ায় নোনা জলে জড়ায় কতো কোতা।
আদদিচি কি ওলো ও সই পাকায় হচ্চে ধোঁয়া
এইচি য্যেকোন চিমড়িগুনোর ফেলে দেনা ওঁয়া
নালার জলে মাচের ঝাঁকে বেইচি ছেগুন জাল
শরম পুটি, চুনোচানা ছ্যেলো নাকি কাল।
মাটা কবে আসবে ঘরে বাপের বাড়ি থেকে
বেউলি দিচ্চে কুকুরগুনো কদিন মার না দেকে
শুইকে যাচ্চে পুকুর নালা আগাশে নি জল
কাদা খুচে খাচ্চে গেঁড়ি পোষা হাঁসের দল।
বাজার থেকে আনলো বাবা এট্টা গোটা নাউ
জোড়া পাকায় জাল দিতি গে ভাত করিচি জাউ
ও লো ও সই বোসনা দাবায় জোগাড়জান্তি করি
না খেয়ে কেউ গেলি বেইরে খোসাবে পাশাড়ি।
শোউরো বাড়ি গেলি বুঝবি হাতা খোন্তি নাড়া
ঝেতো নাপাও এ দিক ওদিক খোলা আচে গাড়া
এ ঘর ও ঘর মেয়েমানুষ ঘোরে জেবন ভোর
সোংসার আচে সোহাগ আচে আপোন নয় ঘর-দোর।
ও গোলাপি বলনা কি তোর বুকি বইতেচে ঢেউ
সোত্যি কোতা বলবি একদম মনে ধোরেচে কেউ!
এ বয়োসে ফুলি ফুলি আসবে কতো ভোমোর
মধুর নোভে ভাঙবে বাগান ঝেতো দেকাস গোমোর।
এট্টা ছাবাল আসতেচেছ্যেলো আমার পেচোন পেচোন
‘ও গোলাপি তুই না হলি বাঁচবেনে এ জেবোন’
পেচোন দিকি তেইকি দেকি মেঘের নাহান চোক
সুকির ঝিলিক নাগে চোকি অচেনা হই নোক।
বুনোফুলির গন্দেতেনে এলি য্যেকোন কাচে
তার সুবাশে বুকির ভোতর খুশির হাওয়া নাচে
আগের কোতা পড়লি মনে নোজ্জা নাগে খুব
তলে তলে ভালোই আচিস দিচ্চি পেমে ডুব।
কিষ্টোর উপি মোজে ছ্যেলো সুন্দুরি ওই আধা
যমুনাতে ছুটে যেতো ফেলে কুলির বাদা
পিরিতআগুন তুসির মতো ধিকি ধিকি পোড়ে
পোরাণ কাঁদে বন্দুর কাচে যাবো কেরোম করে।
ছাবালটারে দেকতি কোরোম বলদেন আমার কাচে?
শরীর জুড়ে সোনার আংতা হাওয়ায় ঝালোর নাচে
মাতায় ওড়ে দক্ষিণ হাওয়ায় নোম্বা কালো চুল
পেমে পড়লি নোজ্জা ছাড়া কাজে করি ভুল।
মুকটা ঝেনো উপোর থালা ঝরে চাঁদের আলো
গা ঝেনো তার দুদে আলতা জোসনা মুচে গেলো
তোরে দেকে তারও বুকি উঠবে পেমের ঢেউ
আগাশ ভাঙা বিষ্টি হলি ডাকবে কাচে কেউ।
বুকির ভোতর কাঁপন নাগে দেকলি ঝেনো তার
এতায় ওতায় খুঁজে ব্যেড়ায় মন টেকেনা আর
শোনা আচে তাগার বাড়ি দুর গেরামের পারে
সারি সারি গাচগাচালি আস্তার ধারে ধারে।
জল আনতিগে তেইকে দেকি এগলা নদীর পাড়ে
খুইদেচে চোক কারোর ঝেনো সূয্যু নেবার পরে
এসব কোতা বলিসনি সই ঝেন কারোর কাচে
শুনলি আমার মেরে ফেলবে ঝুইলে দেবে গাচে।
বাপটা য্যেমোন শান্তো শিষ্টো আগলি ঝেনো জোম
গিস্মো ইতুর আগুন চোকি বোর্ষাতে ঝম ঝম।
নামটা কি তার বলদেনে খুলে এট্টু আমার কাচে
বন্দো মনের খুললো দরজা পেমিক বাতাস নাচে।
কদিন হলো চোকিতেনে নাগে ঝেনো ঘোর
মনে পড়লি গোপন কোতা পাইনা কোনো জোর
কাঁকের কলসি বাজে হাওয়ায় যাবে কতো ধুর
ঘরে ফেরে কতো পাকি ডেনায় সাঁঝির সুর।
হ্যগা ও বউ বাড়ি আচি পুজোর মাঙন দেরে
বড়ো থানে হাজোত দেবো ভিক্ষে সিক্ষে করে
মা-টা গেচে বাপের বাড়ি দিনটা দশেক আগে
ঠাগমা ভালো দেকতি পায় না চোকি ঝাপসা নাগে।
মাজেমদ্দি বাপটা আসে কতো হাসি খুশি
যেতি হবে হাটে ও সই আনতি গরুর ভুসি
ঠাগমা কি আর সেরোম করে চলতি ফিরতি পারে
চানের জন্যি নে যেতি হয় বড়ো ঘেরির ধারে।
বোশেখ মাসের আগুন ওদে ফুটি ফাটা মাটি
ঘুরে ঘুরে জল বেগোরে ফেটে যাচ্চে ছাতি।
নোটারি আর জোয়া খেল্যায় খুইয়ে দেয় টাকা
সোন্দে হলি মদের ঠেকে যায় কি ধোরে আকা!
ছানি কদিন পড়তি যেতো পুব পাড়ার ইস্কুলি
বইতে আচে গেরোন নাগে তিনজনে এক হলি
কদিন হলো সইটা তো আর আসে না এ বাড়ি
অচেনা কোন বাতাস এসে বাড়ায় ফুলির আড়ি।
নোজ্জা শরম খুইয়ে ওরা ঘুরতো গেরাম ময়
পরের কোতো বলতি গেলি বুকি নাগে ভয়
চুলির মুটি ধরে ছানির দিচ্চে হেঁচকা টান
তুই কি ওরে মেরে ফেলবি নে নিবি কি জান?
ফুলির নোভে আসবে ভোমোর এটকে আকা দায়
বুনো ফুলির অঙিন এনুই মনটা ভাসতি চায়
ওই আবাগির থাকতি দেওয়া ছ্যেলো আঙ্গার ভুল
ধুলোর সোঙ্গে মিইশে দিচ্চে জাতি বংশের কুল।