বাঙালীর পৌষ-পার্বণ

বছর বছর পৌষ-পার্বণ আসে ও চলে যায়, কিন্তু অতীতের মত এই পার্বণ-উৎসবে বাঙালীর প্রাণ আর তেমন করে নেচে ওঠে কি? সেই পিঠে-পুলি খাওয়ার আমোদ; সেই পার্বণী গানের লহর; সেই হাসি-ঠাট্টা, ফুলের সাজ, বেশের ঠাঁট আর আছে কি? এখনও আগের মতোই পৌষ-পার্বণের দিনে গঙ্গা-স্নান করবার জন্য ভিড় হয় বটে, এখনও আগের মতোই গঙ্গাসাগরে অত্যধিক যাত্রী সমাগম হয় বটে, কিন্তু আগেকার মত ফুলমালা আর লতাপাতা দিয়ে নৌকা সাজিয়ে নাচ-গান করতে করতে ত্রিবেণী-স্নানে যাওয়ার ধুম দেখতে পাওয়া যায় না। এখন বাঙালীর সেই হাসি গিয়েছে, উল্লাস বিদায় নিয়েছে; টিকে রয়েছে শুধু সেকালেব কিছু জড়বৎ বিধি-পদ্ধতি। যেহেতু এই দিন গঙ্গা-স্নান করতে হয়, তাই অনেকে সেই নিয়মটুকু মেনে গঙ্গা-স্নান করেন; বিশেষতঃ অনেক বাড়ির প্রাচীনারা আজও সেই পুরোনো রীতি পরিত্যাগ করতে পারেননি; সেই কারণে, অনেক জায়গাতেই তাঁদের আব্দারে নবীন প্রজন্ম এখনও গঙ্গা-স্নানের আয়োজন করে থাকেন। কিন্তু পৌষ-পার্বণের দিন অতীতের সেই মুখভরা হাসি আর বুকভরা উল্লাস, যেটা তখন বাঙালীদের চোখমুখ দিয়ে ফুটে বের হত – সেটা এখন আর দেখা যায় না। কিন্তু কেন এমন হল? কেন বাঙালীর সেই হাসির লহর বন্ধ হয়ে গেল? কেন সেই রসের প্রবাহ শুকিয়ে গিয়েছে?

আসলে এখন বাঙালীর হিন্দুয়ানী – পরাধীন, সেটা কোন চাকরিজীবীর ধর্ম নয়। বাঙালী যেদিন থেকে চাকরি করতে শিখেছে, সেদিন থেকেই তাঁকে নিজের সামাজিকতা এবং ধৰ্ম-কর্ম জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। ইতিহাস বলে যে, পৌষ-পার্বণ মূলতঃ কৃষকদের উৎসব। আগে এই সময়ে ক্ষেত-ভরা ধান ঘরে উঠত, কৃষকদের পরিশ্রম সার্থক হত; ঠিকঠাক ফসল হলে পরের বছর অন্নাভাব থাকবে না, দু’মুঠো অন্নের জন্য অন্য কারো দ্বারস্থ হতে হবে না – এই সুখের চিন্তায় বিভোর হয়ে বাঙালী কৃষকেরা তখন পৌষ-পার্বণের আনন্দে মত্ত হয়ে উঠতেন। তখন বাঙালীর ঘড়ি ধরে দশটা-পাঁচটার চাকরি ছিল না, পরের মন বুঝে চলবার দায় ছিল না, পরের হুকুম মানতে হত না – পায়ের উপরে পা দিয়ে বাড়িতে বসে থাকা, আর দুধ-ভাত খাওয়া – এসবই তখন বাঙালীর কাছে সুখের চূড়ান্ত ছিল। বাঙালীরা তখন শুধু তাঁদের নিজের নিজের আরাধ্য দেবতাকে চিনতেন; দেবতা ছাড়া বাঙালীর তখন অন্য কোন সম্বল ছিল না, অন্য কাউকে বাঙালী ভরসাও করত না। সেই দেবতা বিরূপ হলে বাঙালীর দুঃখের সীমা থাকত না। অতীতে পৌষ-পার্বণের দিন বাঙালীর উপরে দেবতার দয়া বুঝতে পারা যেত, তাই বাঙালী তখন এই বিশেষ দিনে প্রাণ ভরে হাসত। কিন্তু অতীতের কৃষিজীবী বাঙালীর যে সুখ ছিল, সেকথা এখনকার চাকুরে বাঙালীরা কিভাবে বুঝবেন? যাঁরা চিরপরাধীন, তাঁরা সারা বছরের স্বাতন্ত্র্যের মহিমা কিভাবে বুঝবেন? তাই অতীতের বাংলার পৌষ-পার্বণের সেই উল্লাস এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না। তবে যেসব বাঙালী এখনও চাষ-বাস করেন, নিজের হাতে মা লক্ষ্মীর সেবা করেন, তাঁরা ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গু পীড়িত হলেও, শহরের বাবু সমাজের দ্বারা পরিত্যক্ত হলেও, এখনও নিজেদের আউনী-বাউনীর আমোদ সম্পূর্ণভাবে ভুলে যাননি। আজও মুসলমান হলেও তাঁরা পিঠা-পুলি খান, দশজনকে ডেকে নিয়ে এসে খাওয়ান, এবং পান-ভোজনের পরম আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকেন। তাই এখনও পৌষ-পার্বণের দিন অনেক বাঙালী গঙ্গা-স্নানে যান; এখনও তীর্থক্ষেত্রে ভিড় জমান; এখনও বাঙালীর সমাজ-শরীরের ভিতরে যতটুকু সজীবতা রয়েছে, সেটা নড়ে চড়ে হেসে খেলে ওঠে।

আরও পড়ুন: অম্বুবাচী, ইতু, নবান্ন ও পৌষ-পার্বণ: ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা

চাকরিজীবী শহুরে বাবুরা কৃষিজীবী বাঙালীর এই সুখ বুঝতে পারবেন না। তাঁরা কোটি অভাব বিজড়িত নাগপাশে আবদ্ধ দুর্বল জীব। তাঁদের হাল ফ্যাশনের সাজ-পোষাকের জন্য ভাবনা রয়েছে, জুতা-মোজার জন্য ভাবনা রয়েছে, অত্যাধুনিক মোটরগাড়ির জন্য ভাবনা রয়েছে – তাঁদের ভাবনার কি কোন শেষ আছে? যাঁদের এত ভাবনা, তাঁদের প্রাণে কি কখনো সুখ থাকা সম্ভব? যে বিলাসী, সে কি কখনো সুখী হতে পারে, নাকি অন্য দশজনকে সুখী করতে পারে? সামাজিক সুখ কখনোই বিলাসীর উপভোগ্য নয়। তাঁরা যেহেতু এখন শীতের লেপের উষ্ণতা উপভোগ করে সুখনিদ্রায় মগ্ন থাকেন, সেহেতু ভাবতেও পারেন না যে, অতীতে এই দিনে কৃষিজীবী বাঙালী হিন্দুরা হাসতে হাসতে কাঁপতে কাঁপতে গঙ্গাস্নানে যেতেন, দশজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন, দশজনে মিলে আমোদ করতে করতে সাগরের জলে স্নান করতেন। এই দিন তাঁরা দেশ-দেশান্তরের সন্ন্যাসী ফকীর গৃহীত্যাগীকে দর্শন করতেন, কাঙ্গাল দুঃখীকে ভিক্ষা দিতেন, নিজের পরকালের জন্য চিন্তা-ভাবনা করতেন, আর যাঁর কৃপায় তাঁর সংসারে সুখ উথলে পড়ত, তাঁকে আহ্বান করে নিজের জীবন ধন্য করতেন। সমাজ-সুখের জন্য কতটা কষ্ট-স্বীকার করতে হবে, কতটা অর্থ ব্যয় করতে হবে, দশজনকে নিয়ে কিভাবে সুখী থাকা সম্ভব – তাঁরা এসবের চিন্তা করতেন। কারণ, শুধু নিজের দেহটাই তো সবকিছু নয়, আর নিজের দৈহিক সুখই সংসারের সার-সুখ নয়। তাই অতীতের বাঙালী হিন্দুরা পৌষ-পার্বণ উপলক্ষে নিজেদের দেহ-সুখকে অবহেলা করে মনের সুখ – সমাজের সুখ অর্জন করবার চেষ্টা করতেন। শুধু দেহ-সুখ দিয়ে কেউ সুখী হতে পারে কি? দেহ তো নানা ধরণের রোগের আস্তানা। রোগ জর্জরিত শরীর নিয়ে কেউ পিঠা-পুলি খাবেন কিভাবে? হিন্দু হতে গেলে যেমন উপবাস করতে জানতে ও শিখতে হয়, তেমনই নিজে খেতে এবং অন্যকে খাওয়াতেও শিখতে হয়। সেই খাওয়ার রকমই বা কত! নিজে রান্না করে স্ত্রীকে অন্নপূর্ণারূপে উনুনের পাশে বসিয়ে, খাদ্য-ভোজ্য তৈরি করে, আত্মীয়-স্বজনকে খাওয়াতে হয় – তবেই তো খাওয়ার আমোদ ফুটে উঠবে। হিন্দুর মত খেতে ও খাওয়াতে হলে দেহে বল থাকা চাই, জঠরে অগ্নি থাকা চাই, আর হৃদয়ে উল্লাস থাকা চাই। যাঁরা অন্যের হাতে তৈরি করা খাওয়ার খেতে অভ্যস্ত – তাঁদের বাড়ির ভোজে শুধু আর্থিক অহঙ্কারই ফুটে ওঠে, সেখানে অন্নপূর্ণার শ্লাঘা প্রকাশ পায় না। তাঁরা যখন অন্য কাউকে ডেকে এনে খাওয়ান – তখন মনে হয়, অন্যরা বুঝি খেতে পান না! তাই তাঁদের বাড়ির ভোজে শুধু প্রহসনই হয়।

চাকরি করে, দশটা-পাঁচটার অফিসে আবদ্ধ থেকে, সাহেবিয়ানা শিখে – শহুরে বাঙালীরা এখন বাঙালীয়ানা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছেন। তাঁদের জীবনে অতীতের বাঙালীর সরল আনন্দের সেই আদর্শ আর নেই। তাঁরা খরচ করতে জানেন না, করতে পারেন না। তাঁদের উপার্জিত সব ধনই নিজেদের দেহের সেবাতেই ব্যয় হয়ে যায়; তাঁরা অন্যকে খাওয়াবেন বা নিজেদের স্বজন-পরিজনদের নিয়ে আমোদ করবেন কিভাবে? আর যদিও বা তাঁরা সেই আমোদ করতেও চান, তাহলেও সেটা করতে গিয়ে তাঁদের টাকার অহঙ্কার এতটাই ফুটে ওঠে যে, তাঁরা মিতব্যয়ীর মত কোন কাজ করতে পারেন না। ফলে, প্রাণভরা আমোদ উপভোগ করা তাঁদের ভোগ্যে জোটে না। সস্তার আমোদ, বাঙালী হিন্দুর আমোদ হল – পৌষ-পার্বণ; চাল, তিল, কড়াই, গুড়, মুগ আর দুধ – এগুলো নিয়েই পিঠা-পুলি তৈরি হয়। কিন্তু এই পিঠা-পুলি গড়তে জানতে হয়, এই ব্যাপারে বাড়ির মহিলাদের উৎসাহী হতে হয় – তবেই এই আমোদ উপভোগ করা সম্ভব। শহুরে বাবুয়ানি ছাড়তে না পারলে, কৃষকের পরিশ্রম বুঝতে না পারলে, আর মোটা-ভাত মোটা-কাপড়ে তুষ্ট হতে না জানলে – ভাগ্যে এমন আমোদ ঘটে না। বাংলার কপাল দীর্ঘদিন আগেই পুড়েছে, তাই পৌষ-পার্বণের আমোদও দীর্ঘকাল আগেই বিদায় নিয়েছে। এই দিন কাউকে না খাইয়ে নিজে খেতে নেই – বাঙালী একথা আবার যেদিন শিখবে আর বুঝবে, সেদিন বাংলার বুকে আবার পৌষ-পার্বণের আমোদ সুবাসিত ফুলের মত ফুটে উঠবে।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!