গোটা পৃথিবী জুড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জমি নিয়ে যত কেলেঙ্কারি ঘটেছে, তার সালতামামী দিয়ে মাত্র আড়াই দিনে লেখা ৮৬,৩৮৫ শব্দের অসামান্য একটি উপন্যাস ‘উত্তাল’ নিয়মিত প্রকাশ করা হবে।
প্রথম পর্ব
সন্ধের আগে ঢোকা যাবে না। তাই গ্রামের বাইরে পোড়ো শিবমন্দিরের ভিতরে ঘাপটি মেরে বসে আছে তেরো নম্বর। মাঝে মাঝে দু’-একটা চড়াই পাখি ঢুকছে বেরোচ্ছে। মাথার উপরে গম্বুজ মতো ছাদের গায়ে ডানা মেলে লেপটে আছে ঝাঁক ঝাঁক চামচিকে। দেওয়ালগুলোর গা থেকে চলটা-টলটা উঠে এমন চেহারা হয়েছে, মনে হচ্ছে যে কোনও সময় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। কোণে কোণে মাকড়সার পুরু জাল। দেওয়ালগুলিরও চুন-সুরকি খসে খসে দাঁত-মুখ বেরিয়ে পড়েছে। তারই ফাঁকফোকর থেকে হঠাৎ হঠাৎ মুখ বার করছে কাঁকড়াবিছে। সাপ-খোপ যে নেই, কে বলতে পারে!
এরা কামড়ালেও বেঁচে যাওয়ার অনেকটা সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যাদের ভয়ে ও এখানে লুকিয়ে আছে, তাদের হাতে পড়লে তো মৃত্যু অবধারিত। তবু তাকে আসতে হয়েছে।
সেই যে তেইশ দিন আগে মধ্যরাতে তাদের গ্রামে চড়াও হয়েছিল একদল লোক, বাড়ি বাড়ি ঢুকে ভাঙচুর চালিয়েছিল। কারও কারও বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কারও বউ কারও মেয়েকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কেউ বাধা দিতে গেলেই, ওয়ান শটারের টিগার টিপে তার মাথার খুলি এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। বোমা ফাটাতে ফাটাতে চলে যাওয়ার সময় ওদের মধ্যে থেকে কে যেন চিৎকার করে শাসিয়েছিল, বাঁচতে গেলে এই গ্রাম খালি করে দে।
তার আগেই পিছন দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ও গা ঢাকা দিয়েছিল পুকুর পাড়ের কোমর সমান আগাছার জঙ্গলে। ওরা চলে যাওয়ার অনেক অনেক পরে, যখন সকালের আলো ফুটব ফুটব করছে, ও ভয়ে-আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। ওর সারা শরীরে তখন অসংখ্য জোঁক। রক্ত খেয়ে একেবারে টইটম্বুর।
শুধু ও নয়, ওর মতো আরও অনেকেরই অবস্থা সে দিন শোচনীয়। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। কারণ, আগের অভিজ্ঞতা থেকেই ওরা জেনেছিল, থানা-পুলিশ করে কোনও লাভ নেই। যে অভিযোগ ওরা করবে, তিন মিনিটের মধ্যেই তা জেনে যাবে ওই লোকগুলো। আর তার পরিণতি যে কত ভয়ানক, তা ওরা হাড়ে হাড়ে জানে।
যে দিন ওই ঘটনা ঘটেছিল, কোলের পুঁচকে মেয়েটার সে কী ধুম জ্বর। গ্রাম ছাড়লে অন্তত প্রাণে বেঁচে যাবে, এই ভেবে মেয়েরা তাদের বাবা-দাদাদের, বউরা তাদের স্বামীদের, এমনকী বৃদ্ধ শ্বশুর-সমেত ছোট ছোট ছেলেদেরও অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য বারবার করে মিনতি করছিল। কিন্তু মেয়েকে ফেলে কিছুতেই তেরো নম্বর যেতে চাইছিল না। তাই ওর বউ ওকে মেয়ের দিব্যি দিয়েছিল। বলেছিল, তুমি যদি না যাও, তা হলে মেয়ের মরা মুখ দেখবে।
কেন বলেছিল, ও তা বুঝতে পেরেছিল। আসলে কানাঘুষোয় ওরা শুনেছিল, বাইক ছুটিয়ে যখন তখন হুটহাট করে গ্রামে আসা লোকগুলো নাকি অনেক দিন আগেই তাদের আঁধারগ্রামের সতেরো জনের একটা খতম তালিকা তৈরি করেছে। তার মধ্যে তেরো নম্বরে আছে ওর নাম।
তেরো নম্বরে থাকলেও ওরা তো আর তালিকা অনুযায়ী এক দুই তিন– এই ভাবে নাম দেখে দেখে সিরিয়াল অনুযায়ী পর পর তালিকা মিলিয়ে খুন করবে না। যাকে কায়দা মতো আগে পাবে, তাকেই আগে খতম করবে। তার পরে তালিকা থেকে কেটে বাদ দেবে তার নাম।
মেয়ে-অন্ত প্রাণ তেরো নম্বর আবার এই সব দিব্যি-টিব্যি খুব মানে।
বিয়ে হয়েছে তখন তিন মাসও হয়নি। কী একটা কাজে সাত দিনের জন্য শহরে গিয়েছিল সে। যাওয়ার আগে বউ তার গা ছুঁইয়ে দিব্যি কাটিয়ে নিয়েছিল, যত কাজই থাক, সাত দিন মানে কিন্তু সাত দিনই। ঠিক সাত দিনের মাথাতেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে। না হলে… বাকি কথা আর বলতে হয়নি, বউ কি বলতে চাইছে, ও বুঝতে পেরেছিল।
যে দিন ওর ফিরে আসার কথা, তার তিন দিন আগে থেকেই সে কী ঝড়বৃষ্টি। প্লাবন। বন্যায় ভেসে গেল চার দিক। রেড অ্যালার্ট জারি হল বহু জায়গায়। সরকার থেকে যে সব অঞ্চলকে বন্যা কবলিত বলে ঘোষণা করল, তার মধ্যে প্রথম সারিতে যে জায়গাগুলোর নাম উঠে এল, সেগুলোর প্রায় সব ক’টাই আঁধারগ্রামের আশপাশের এলাকা। ওদের গ্রাম অনেকটা উঁচুতে, তাই বন্যার ছোবল সে ভাবে পড়েনি। কিন্তু বন্যা কবলিত গ্রামগুলো না টপকে তো আঁধারগ্রামে ঢোকা যাবে না।
ফলে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে প্রবল ঝঞ্ঝার মধ্যে প্রায় আড়াই ক্রোশ সাঁতরে ভোর হওয়ার অনেক আগেই ভিজে ন্যাতা হয়ে ও যখন বাড়ির দরজায় ধাক্কা মারল, ওকে দেখে যেন ভূত দেখল তার বউ। একটু রাগত স্বরেই বলে উঠল, এই দুর্যোগ মাথায় নিয়ে কেউ আসে? যদি কোনও বিপদ-আপদ হত?
– কী করব? তুমি দিব্যি কাটিয়ে নিয়েছিলে, তাই…
– তাই এই দুর্যোগের মধ্যে আসতে হবে? কেন? আমি কি মরে যেতাম? মরলে মরতাম। তবু এ ভাবে কেউ আসে? তুমি না সত্যিই…চলবে…