ধারাবাহিক উপন্যাস: উত্তাল দ্বিতীয় পর্ব

গোটা পৃথিবী জুড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জমি নিয়ে যত কেলেঙ্কারি ঘটেছে, তার সালতামামী দিয়ে একটি অসামান্য উপন্যাস ‘উত্তাল…

দ্বিতীয় পর্ব 

ও এসেছিল। সে বার ছিল বউয়ের দিব্যি। আর এ বার তো মেয়ের! ও থাকে কী করে! সে দিন আরও অনেকের সঙ্গে ও গ্রাম ছেড়েছিল। আজ তেইশ দিন হতে চলল। মেয়েকে না দেখে এত দিন যে কী ভাবে ও কাটিয়েছে, সেটা কেবল ও-ই জানে।
আর থাকতে পারছে না ও। মরলে মরবে। এই ভাবে তিল তিল করে মরার চেয়ে ওদের হাতে একবারে মরা অনেক ভাল। তাই গ্রামে ঢোকার আগেই নির্জন পথের ধারে পোড়ো শিবমন্দিরে এসে গা ঢাকা দিয়েছিল সে। অন্ধকার নামলেই চুপিচুপি গ্রামে ঢুকবে।
দেখতে দেখতে সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। তার আলোর রেশটুকুও ফিকে হতে হতে মিলিয়ে গেছে। ঝিঁঝি পোকারা ডাকতে শুরু করেছে। জোনাকিরা বিন্দু বিন্দু তারার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে চার দিকে। দূরে কোথাও মাঝেমধ্যে ডেকে উঠছে দু’-একটা কুকুর। কখন কোন কাঁকড়াবিছে, সাপ-টাপ এসে দংশায়, তার কোনও ঠিক আছে? না, মেয়ের মুখ না দেখে সে মরতে চায় না। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে এ দিক ও দিক ভাল করে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এল তেরো নম্বর। বাইরে তখন হুহু করে হাওয়া দিচ্ছে। থেকে থেকেই, আছড়ে পড়ছে ধুলোঝড়। পিনের মতো হাতে-পায়ে-গায়ে বিঁধছে। সারা মুখ বালিতে কিচকিচ করছে। অন্ধকার আরও ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে এল। এলোপাথাড়ি ঝড়ে পটাস পটাস করে ভাঙতে লাগল গাছপালার ডাল-মগডাল। একশো দেড়শো দুশো বছরের পুরনো সব বিশাল বিশাল গাছের ঝাঁকড়া মাথাগুলো উথালিপাথালি খেতে লাগল। কী এক ভয়ঙ্কর আঁতঙ্কে বাসা ছেড়ে কা কা করতে করতে ডানা ঝাপটাতে লাগল কাকেরা। মাঝে মাঝেই হুক্কা হুয়া করে তারস্বরে ডেকে উঠতে লাগল শেয়ালেরা। এই বুঝি রসাতলে গেল পৃথিবী!
দিক-পাশ না চেয়ে তড়িঘড়ি ছুটতে ছুটতে ও হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। আর একটু হলেই ডালটা তার মাথায় পড়ত। না, এ ভাবে অন্ধের মতো ছুটে চলা তার ঠিক হচ্ছে না। এই তাণ্ডবের মধ্যে পড়ে সে যেন চেনা রাস্তাটাও গুলিয়ে ফেলেছে। ঠিক যাচ্ছে তো সে!
বিশাল পাকুড় গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে সে ঠাওর করতে লাগল, সে ঠিক যাচ্ছে কি না। হ্যাঁ, সে ঠিকই যাচ্ছে। কিন্তু এই পচা গন্ধটা কীসের! আশপাশে কেউ কি কোনও মরা কুকুর-বিড়াল ফেলে গেছে! হতে পারে! নইলে এই গন্ধটা আসবে কোত্থেকে!
ভাগ্যিস হাওয়া দিচ্ছে। তাই মাঝে মাঝে ভক্ করে গন্ধটা নাকে এসে লাগলেও তা বেশিক্ষণ থাকছে না। দমকা বাতাসের তোড়ে উড়ে যাচ্ছে। ফের বাড়ির দিকে পা বাড়াল তেরো নম্বর।
আর তখনই মনে হল, কারা যেন তাকে ফলো করছে। ওই দিকের গাছপালার আড়ালে ছায়া ছায়া মতো কারা সরে সরে যাচ্ছে। কারা ওরা! হাঁটার গতি কমিয়ে দিল তেরো নম্বর। সে যে গ্রামে ঢুকছে, তবে কি ওরা টের পেয়ে গেছে! যে কোনও সময় তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে! কয়েক জন মিলে হাত-পা চেপে ধরে খুর দিয়ে টুক করে কেটে দিতে পারে গলার নলি! অথবা ছুরি দিয়ে পর পর আঘাতে ফালা ফালা করে দিতে পারে ভুঁড়ি!
কিন্তু তাই বা কী করে হয়! যদি ওরাই হত, তা হলে যা করার, ওরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে করে ফেলত। চারি দিক এমন জনমানব শূন্য, তার উপরে ও একদম একা, এমন সুযোগ কি ওরা হাতছাড়া করত? না, ওরা নয়। তবে কি কোনও ভূত-টুত! হ্যাঁ, সেটা হতে পারে! আর এটা মনে হতেই ভয়ে কেমন যেন জড়সড় হয়ে গেল ও। মনে মনে নয়, বেশ জোরে জোরেই বলতে লাগল, ভূত আমার পুত, পেতনি আমার ঝি, রাম-লক্ষ্মণ বুকে আছে, ভয়টা আমার কি? ভূত আমার পুত, পেতনি আমার ঝি, রাম-লক্ষ্মণ বুকে আছে, ভয়টা আমার কি? ভূত আমার পুত, পেতনি আমার ঝি, রাম-লক্ষ্মণ বুকে আছে, ভয়টা আমার কি…

চলবে… 

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস: উত্তাল প্রথম পর্ব  

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!