জীবনানন্দের প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থ

জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হল – ঝরা পালক। এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের শিরোনাম পৃষ্ঠায় গ্রন্থটির প্রকাশকাল হিসাবে – ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ – লেখা হয়েছিল। গ্রন্থটির ভিতরে ভূমিকা অংশে জীবনানন্দ ভূমিকা লিখে তারিখ দিয়েছিলেন – ১০ই আশ্বিন ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ। কিন্তু গ্রন্থটির ভূমিকায় আশ্বিন মাসের তারিখ থাকলেও জীবনানন্দ গবেষকদের মতে গ্রন্থটি পৌষ মাসের কোনো এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁদের এই ধরণের অনুমানের কারণ হল যে, জীবনানন্দ ঝরা পালক গ্রন্থে গ্রন্থকার হিসাবে নিজের নাম দিয়েছিলেন – শ্রীজীবনানন্দ দাশ। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের পৌষ মাস থেকেই বিভিন্ন মাসিক পত্রে জীবনানন্দের প্রকাশিত কবিতার সঙ্গে তাঁর নামও – শ্রীজীবনানন্দ দাশ – হিসাবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। যেমন – ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসের কল্লোল পত্রিকায় ‘ঝরা ফসলের গান’ শিরোনামে তাঁর যে কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে তাঁর নাম ছিল – শ্রীজীবনানন্দ দাশগুপ্ত। অবশ্য ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসের পরেও কিছুদিন ধরে কোনো কোনো পত্রিকায় তাঁর নামের সঙ্গে ‘দাশগুপ্ত’ পদবীটি অক্ষত অবস্থায় যুক্ত থেকে দু’-একটা কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন – ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কবি’ নামক কবিতাটির সঙ্গে তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল – শ্রীজীবনানন্দ দাশগুপ্ত। অনেকে মনে করেন যে, সেই কবিতাটি তিনি অন্ততঃ দু’-এক মাস আগেই প্রবাসীতে প্রকাশ করবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং তখনও পর্যন্ত তিনি দাশগুপ্তই ছিলেন। অন্যদিকে এই ব্যাপারে কল্লোল পত্রিকার ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, কল্লোল পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ জীবনানন্দের বন্ধু-স্থানীয় ছিলেন, আর কল্লোল পত্রিকার অফিসের পাশেই তখন জীবনানন্দ থাকতেন। কল্লোল সেই সময়ে প্রতি মাসের শেষেরদিকে প্রকাশিত হত, এবং প্রবাসী তখন প্রতি মাসের ১লা তারিখে প্রকাশিত হত। যাই হোক, ঝরা পালক প্রকাশের সময় থেকেই জীবনানন্দ তাঁর গ্রন্থে ও পত্রিকায় সর্বত্রই দাশগুপ্তর গুপ্ত বাদ দিয়ে শুধু দাশ হয়ে গিয়েছিলেন। কেন না, কোন লেখকের বাজারে যে বই বিক্রি হবে তাতে তাঁর নামের সঙ্গে এক পদবী থাকবে, আর মাসিক পত্রিকায় যে কবিতা প্রকাশিত হবে তাতে সেই একই নামের সঙ্গে অন্য পদবী থাকবে – এটা কখনোই সম্ভব নয়। তাই ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসের কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত জীবনানন্দের কবিতাটি দেখে মনে হয় যে, সেই পৌষ মাসেই তাঁর প্রথম গ্রন্থটিও প্রকাশিত হয়েছিল।

এখানে প্রসঙ্গতঃ জানিয়ে রাখা যেতে পারে যে, জীবনানন্দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপির ভূমিকাতে আশ্বিন মাসের উল্লেখ থাকলেও বইটির প্রথম সংস্করণ এর মাস দুই পরে – অর্থাৎ, অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থটির প্রকাশকাল হিসাবে ধূসর পাণ্ডুলিপিতেই এর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেটার পিছনে কারণ হচ্ছে যে, ভূমিকা সমেত সমস্ত বইটি আশ্বিন-কার্তিক মাসের মধ্যে ছাপা হয়ে গেলেও বইটির কভার সম্ভবতঃ আরো দু’-এক মাস পরে ছাপা হয়েছিল। আর সেজন্যই হয়ত বইটি প্রকাশিত হতে দেরি হয়েছিল। অতএব একথা বলা যেতে পারে যে, জীবনানন্দের ঝরা পালক গ্রন্থটি ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসেই প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থটির প্রকাশকাল পৌষ মাসের প্রথম দিকে হলে ইংরেজি সালের হিসাবে সেটা ১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাস হয়। আর পৌষ মাসের শেষের দিকে হলে সেটা ১৯২৮ সালের জানুয়ারি মাস হয়। খুব সম্ভবতঃ এজন্যই হয়ত, জীবনানন্দের ঝরা পালক গ্রন্থটির প্রকাশকাল ইংরেজি সালের হিসাবে করতে গিয়ে কেউ কেউ, যেমন – সুকুমার সেন তাঁর ‘বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থের ৪র্থ খণ্ডে ১৯২৭ সাল বলে উল্লেখ করেছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেছিলেন ১৯২৮ সাল, যেমন – জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থের শেষে জীবনানন্দের যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া রয়েছে, সেখানে ঝরা পালকের প্রকাশকাল বলা হয়েছে ১৯২৮ সাল।

ঝরা পালক গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণের (দ্বিতীয় সংস্করণ আর প্রকাশিত হয়নি) প্রকাশক ছিলেন সুধীরচন্দ্র সরকার। কলকাতার ৯০/২এ হ্যারিসন রোডে তাঁর দোকান ছিল। তবে গ্রন্থটিতে প্রকাশক হিসাবে সুধীরচন্দ্র সরকারের নাম থাকলেও জীবনানন্দ সম্ভবতঃ নিজেই টাকা খরচ করে সেই বইটি ছাপিয়েছিলেন। কেন না, তাঁর এরপরের দুটি বই – ধূসর পাণ্ডুলিপি ও বনলতা সেন (কবিতা ভবন থেকে প্রকাশিত) – তিনি নিজেই টাকা খরচ করে ছাপিয়েছিলেন।

প্রথমবার প্রকাশিত হওয়ার পরে ঝরা পালক গ্রন্থটির দাম রাখা হয়েছিল– এক টাকা। তাতে মোট ৩৫টি কবিতা ছিল। সেগুলির মধ্যে অনেকগুলি কবিতা আগেই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে জীবনানন্দ উক্ত গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছিলেন— “ঝরা পালক-এর কতকগুলি কবিতা প্রবাসী, বঙ্গবাণী, কল্লোল, কালি-কলম, প্রগতি, বিজলী প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। বাকিগুলি নতুন।”

ঝরা পালকের উৎসর্গপত্রে বড় বড় অক্ষরে শুধু – ‘কল্যাণীয়াসু’ – লেখা হয়েছিল। ঝরা পালক গ্রন্থের ভূমিকায় জীবনানন্দ বিজলী প্রভৃতি পত্রিকায় এই গ্রন্থের কোন কোন কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানালেও পরবর্তীকালে সেই পত্রিকাটির কোন সন্ধান না পাওয়ার জন্য গবেষকরা এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে কিছু জানাতে পারেননি। তবে ১৩৩৩-৩৪ বঙ্গাব্দে – কল্লোল, বঙ্গবাণী, কালি-কলম প্রভৃতি পত্রিকায় জীবনানন্দের যেসব কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলির অনেকগুলিই ঝরা পালক গ্রন্থে ছিল।

জীবনানন্দের দ্বিতীয় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম হল – ধূসর পাণ্ডুলিপি, এবং সেটির প্রকাশক তিনি নিজেই ছিলেন; অর্থাৎ তিনি নিজেই পকেটের টাকা খরচ করে সেই বইটি ছাপিয়েছিলেন। জীবনানন্দ সেই সময়ে বরিশালে বসবাস করছিলেন বলে, বইটির প্রাপ্তিস্থান হিসাবে কলকাতার কোন এক বইয়ের দোকানের ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল। ধূসর পাণ্ডুলিপি গ্রন্থটি কলকাতায় ছাপা হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসু সেটির প্রুফ দেখে দেওয়ার কাজটি সমাধা করেছিলেন। বুদ্ধদেব বসু তখন কলকাতায় থেকে কলকাতার একটি কলেজে অধ্যাপনা করছিলেন।

ধূসর পাণ্ডুলিপির প্রথম সংস্করণের শিরোনাম পৃষ্ঠার লেখা থেকে জানা যায় যে, উক্ত গ্রন্থটি ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ বা ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। ধূসর পাণ্ডুলিপির প্রথম সংস্করণে মোট ১৭টি কবিতা ছিল। সেই ১৭টি কবিতার অধিকাংশই বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত সম্পাদিত প্রগতি পত্রিকায় আগে প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন— “ধূসর পাণ্ডুলিপির ১৭টি কবিতার ‘পাখিরা’ কল্লোলে, ‘ক্যাম্পে’ পরিচয়ে, ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতায়, আর কোনো কোনোটি ধূপছায়ায় বেরিয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশেরই প্রথম প্রকাশ প্রগতিতে। তার উপর যখন বই ছাপা হলো তখন ধাত্রীর কাজও আমি করেছিলাম। তাই ঐ গ্রন্থটিকে আমার নিজের জীবনের একটি অংশ বলে মনে হয় আমার।”

বুদ্ধদেব বসুর সেই উপকারের জন্য জীবনানন্দ তাঁর ধূসর পাণ্ডুলিপি গ্রন্থটি বুদ্ধদেব বসুকে উৎসর্গ করে তাঁর প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। জীবনানন্দ যে কতটা সরল, অকপট ও কৃতজ্ঞ মানুষ ছিলেন – এই তথ্য থেকে সেটারও সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়।

জীবনানন্দ তাঁর ধূসর পাণ্ডুলিপির একটা ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। সেই ভূমিকাটি এরকম ছিল—
‘আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল – ১৩৩৪ সালে। কিন্তু সে বইখানা অনেকদিন আমার নিজের চোখের আড়ালে হারিয়ে গেছে। আমার মনে হয় সে তার প্রাপ্য মূল্যই পেয়েছে।’

১৩৩৬ সালে আর একখানা কবিতার বই বার করবার আকাঙক্ষা হয়েছিল। কিন্তু নিজ মনে কবিতা লিখে এবং কয়েকটি মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত ক’রে সে ইচ্ছাকে আমি শিশুর মতো ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম। শিশুকে অসময়ে এবং বার বার ঘুম পাড়িয়ে রাখতে জননীর যে-রকম কষ্ট হয়, সেই রকম কেমন একটা উদ্বেগ— খুব স্পষ্টও নয়, খুব নিরুত্তেজও নয়— এই ক’বছর ধরে বোধ ক’রে এসেছি আমি।

আজ ন’বছর পর আমার দ্বিতীয় কবিতার বই বার হ’ল। এর নাম ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ এর পরিচয় দিচ্ছে। এই বইয়ের সব কবিতাই ১৩৩২ থেকে ১৩৩৬ সালের মধ্যে রচিত হয়েছে। ১৩৩২ সালে লেখা কবিতা, ১৩৩৬ সালে লেখা কবিতা— প্রায় এগারো বছর আগের, প্রায় সাত বছর আগের রচনা সব আজ ১৩৪৩ সালে এই বইয়ের ভিতর ধরা দিল। আজ সে সব মাসিক পত্রিকা আর নেই— প্রগতি, ধূপছায়া, কল্লোল— এই বইয়ের প্রায় সমস্ত কবিতাই সেই সব মাসিকে প্রকাশিত হয়েছিল একদিন। সেই সময়কার অনেক অপ্রকাশিত কবিতাও আমার কাছে রয়েছে— যদিও ধূসর পাণ্ডুলিপির অনেক কবিতার চেয়েই তাদের দাবি একটুও কম নয়— তবুও সম্প্রতি আমার কাছে তারা ধূসরতর হ’য়ে বেঁচে রইল।
জীবনানন্দ দাশ।
আশ্বিন ১৩৪৩।”

জীবনানন্দের জীবদ্দশায় ধূসর পাণ্ডুলিপির আর দ্বিতীয় কোন সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি। এরপরে ১৩৬৩ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে, অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর দু’বছর কয়েক মাস পরে সিগনেট প্রেস থেকে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংস্করণে ১ম সংস্করণের ১৭টি কবিতার সঙ্গে জীবনানন্দের আরো ১৫টি অপ্রকাশিত কবিতা যোগ করা হয়েছিল। জীবনানন্দের ভাই অশোকানন্দ দাশ গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন। তিনি তাঁর দাদার ঐ ১৫টি অপ্রকাশিত কবিতাকে দ্বিতীয় সংস্করণে যোগ করতে গিয়ে গ্রন্থটির ভূমিকায় লিখেছিলেন— “… ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৪৩ সালের আশ্বিনে। আজ প্রায় কুড়ি বছর পরে তার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে সিগনেট সংস্করণ হিসেবে। এবারে বইখানির কলেবর আগের চাইতে বর্ধিত হচ্ছে। …এই অপ্রকাশিত কবিতাগুলি সংযোজনের ব্যাপারে ঈষৎ সংকোচ বোধ হচ্ছে। কেন না, প্রকাশ করার পূর্বে প্রত্যেকটি কবিতাকে পরিমার্জিত করার অভ্যাস কবির ছিল। …তাই সংযোজিত কবিতাগুচ্ছ যে স্রষ্টার প্রখর অভিভাবকত্ব লাভের সৌভাগ্য থেকে একেবারেই বঞ্চিত, সহৃদয় পাঠককে, এই কথাটি স্মরণে রাখতে অনুরোধ করি।”

গ্রন্থটির ১ম সংস্করণের সঙ্গে ১৫টি অপ্রকাশিত কবিতা যোগ করে ধূসর পাণ্ডুলিপির যে দ্বিতীয় সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল – সেটাই বর্তমানে প্রচলিত রয়েছে।

জীবনানন্দের প্রকাশিত তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের – বনলতা সেন। গ্রন্থটি ১৩৪৯ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে, অর্থাৎ ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। সেটি ডিমাই আকারে মাত্র ষোলো পাতার একটি পুস্তক ছিল, এবং সেই পুস্তকটির প্রকাশকও জীবনানন্দ নিজেই ছিলেন। বইটির প্রথম সংস্করণে লেখা ছিল – প্রকাশক: জীবনানন্দ দাশ, বরিশাল। তবে বইটির প্রাপ্তিস্থান ছিল – কবিতা ভবন, ২০২ রাসবিহারী এভিনিউ, কলকাতা।
উক্ত ২০২ রাসবিহারী এভিনিউতেই বুদ্ধদেব বসু তখন বাস করতেন, এবং সেখান থেকেই তাঁর কবিতা পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কবিতা ভবন’ থেকে তখন – ‘এক পয়সায় একটি’ – গ্রন্থমালা প্রকাশিত করতেন। তাঁর সেই ‘এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থমালার অন্যতম বই হিসেবেই জীবনানন্দের বনলতা সেন প্রথমবারের জন্য আত্মপ্রকাশ করেছিল। সেই ষোলো পাতার বইটির দাম ছিল তখনকার দিনের ষোলো পয়সা বা চার আনা।

সেই বইয়ে জীবনানন্দের মোট ১২টি কবিতা সংকলিত করা হয়েছিল। কবিতাগুলির নাম ছিল – বনলতা সেন, কুড়ি বছর পরে, ঘাস, হাওয়ার রাত, আমি যদি হতাম, হায় চিল, বুনো হাঁস, শঙ্খমালা, নগ্ন নির্জন হাত, শিকার, হরিণেরা, এবং বিড়াল।

বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কালের পুতুল’ প্রবন্ধে সেই বইটির কথা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন- “যদিও চার আনা দামের চটি বই এবং এগারোটি মাত্র কবিতা আছে, তবু এটি আমাদের বিশেষভাবে আলোচ্য।”

কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যও তাঁর ‘কবি জীবনানন্দ দাশ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন — “জীবনানন্দের ষোলোটা কবিতা নিয়ে— এক পয়সায় একটি সিরিজের পুস্তিকা বেরোয় বনলতা সেন নামে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবন থেকে।”
উপরোক্ত উদ্ধৃতি দুটি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বনলতা সেন গ্রন্থে জীবনানন্দের কবিতার সংখ্যার কথা বলতে গিয়ে তাঁরা উভয়েই ভুল করেছিলেন।

জীবনানন্দ তাঁর বনলতা সেন কবিতাটির নাম নিয়েই বইটির নামকরণ – বনলতা সেন – করেছিলেন। বর্তমানে প্রায় সকলেই একথা জানেন যে, ‘বনলতা সেন’ তাঁর লেখা একটি অতি বিখ্যাত কবিতা। কবিতা পত্রিকার ১ম বর্ষের ২য় সংখ্যায়, অর্থাৎ ১৩৪২ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে এই কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতা ভবন থেকে প্রকাশিত বনলতা সেন গ্রন্থের ১২টি কবিতাই বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। জীবনানন্দ তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটি কাউকে কাউকে উৎসর্গ করলেও এই বইটি কিন্তু কাউকেই উৎসর্গ করেননি।

কবিতা ভবন থেকে প্রকাশিত বনলতা সেন বইটি অত্যন্ত চটি ছিল বলেই হয়ত পরে এই বইটির উপরে জীবনানন্দের আকর্ষণ কমে গিয়েছিল। তাই তিনি এই বইয়ের সব ক’টি কবিতার সঙ্গে আরও ২৩টি নতুন কবিতা দিয়ে, অর্থাৎ মোট ৩৫টি কবিতাকে একত্রিত করে, পরে আরেকটি বই প্রকাশ করেছিলেন এবং সে বইটির নাম দিয়েছিলেন – ‘মহাপৃথিবী’।

১৩৫১ বঙ্গাব্দে কলকাতায় পি ১৩ গণেশচন্দ্র এভিনিউয়ে অবস্থিত ‘পূর্বাশা লিমিটেড’ থেকে ‘মহাপৃথিবী’ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বন্ধু সত্যপ্রসন্ন দত্ত সেই বইটির মুদ্রক ও প্রকাশক ছিলেন। বইটির দাম ছিল দেড় টাকা, এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল – রয়‍্যাল ৮ পেজি ৮+৪০। বইটির উৎসর্গ পত্রে লেখা ছিল — “প্রেমেন্দ্র মিত্র, সঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রিয়বরেষু”।

‘কবিতা ভবন’ থেকে প্রকাশিত বনলতা সেনের ১২টি কবিতা, মহাপৃথিবীর অন্য দুটি কবিতা এবং আরও ১৬টি নতুন কবিতাকে একত্রিত করে জীবনানন্দ পরে আরেকটি বই প্রকাশ করেছিলেন এবং সেটিরও নাম দিয়েছিলেন – ‘বনলতা সেন’। সেই বইয়ের কবিতাগুলির রচনাকাল সম্বন্ধে জীবনানন্দ বইয়ের প্রথমেই লিখেছিলেন – ১৩৩২-১৩৪৬। উক্ত বইটির সিগনেট সংস্করণ – বনলতা সেন – হিসাবে ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্ত সেই বইটির প্রকাশক ছিলেন। খুব সম্ভবতঃ প্রকাশকের আগ্রহেই জীবনানন্দ তখন সেই বইটি তৈরি করেছিলেন। বর্তমানে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ নামে যে গ্রন্থটি বাজারে প্রচলিত রয়েছে, এই বইটিই সেই বই।

কিন্তু মহাপৃথিবী থেকে ১৪টি কবিতা সরিয়ে নেওয়ার ফলে বইটি আয়তনে ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল, এবং জীবনানন্দও সেই বইটি পুনঃ প্রকাশের ব্যাপারে আর কোন আগ্রহ দেখাননি। তাই তাঁর জীবদ্দশায় সেই বইয়ের আর কোনো সংস্করণ, এমনকি তাতে অন্য নতুন কোন কবিতা যোগ করে সেটার কলেবর বৃদ্ধি করে প্রকাশ করবার চেষ্টাও করা হয়নি।

জীবনানন্দের মৃত্যুর প্রায় ১৫ বছর পরে বইটিতে আরো কিছু নতুন কবিতা যোগ করে সিগনেট প্রেস থেকে ‘সিগনেট সংস্করণ— মহাপৃথিবী’ হিসাবে ১৩৫১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে নতুন সংযোজিত কবিতাগুলি ১৩৪২ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৫১ বঙ্গাব্দের মধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

সেই ‘সিগনেট সংস্করণ— মহাপৃথিবী’ সম্পাদনা করতে গিয়ে গ্রন্থটির সম্পাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘সম্পাদকের নিবেদন’–এ বলেছিলেন — “আমরা ১৩৪২ থেকে ১৩৫১ বঙ্গাব্দের মধ্যে (স্মরণীয়: মহাপৃথিবীর প্রকাশকাল ১৩৫১) প্রকাশিত কবিতা থেকে অন্তত কিছু কবিতা সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। এর পিছনে আমাদের বিনীত অভিপ্রায় ছিল এই যে, মহাপৃথিবী থেকে যে ১৪টি কবিতা অন্যত্র সরানো হয়েছে, অন্তত সেই সংখ্যক নতুন কবিতা যোগ করে তাকে প্রায় একটি পূর্ববৎ আকার দেয়া। … যাতে এই নতুন গ্রথিত কবিতাগুলো আলাদা করে শনাক্ত করা যায়, সেই জন্যই ‘আমিষাশী তরবার’ নাম দিয়ে তাদের পৃথক করা হ’ল।”

সেই ‘সিগনেট সংস্করণ— মহাপৃথিবী’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে – ‘শ্রীমতী মঞ্জুশ্রীকে: বাবার আশীর্বাদ’ – লেখা হয়েছিল। অথচ মূল ‘মহাপৃথিবী’ গ্রন্থটি জীবনানন্দ – প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে উৎসর্গ করেছিলেন। পূর্বাশা লিমিটেড থেকে প্রকাশিত ‘মহাপৃথিবী’ এবং সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘মহাপৃথিবী’ – দুটো পৃথক বই ভেবেই কি জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে কেউ উৎসর্গপত্রটি বদল করে দিয়েছিলেন? যদি সেটাই হয়, তাহলে ধূসর পাণ্ডুলিপি গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ, এবং ধূসর পাণ্ডুলিপি গ্রন্থের সিগনেট সংস্করণ – এ দুটিও তো পৃথক বই; অথচ সেই বইটি প্রথম সংস্করণে যাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছিল, পরবর্তী সংস্করণেও সেই একই ব্যক্তিকে – অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসুকে – উৎসর্গ করা হয়েছিল; সেখানে কিন্তু উৎসর্গপত্রে কোনও বদল করা হয়নি।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!