ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ৬

।।ছয়।।

কারা যেন কথা বলতে বলতে ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। কারা? ধড়মড় করে মেঝে থেকে লাফ দিয়ে উঠল তেরো নম্বরের বউ। কান খাড়া করে বুঝতে পারল, একজন নয়, দু’জন নয়, চার-পাঁচ-সাত জনের এক-একটা দল। আগে ক’টা দল গেছে ও জানে না। তবে ও ওঠার পরেও বেশ কয়েকটা দল গেল মনে হল। ওঁরা কী বলতে বলতে যাচ্ছেন, এখান থেকে সব কথা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও, যেটুকু ভেসে আসছে, তাতেই ধরা পড়ছে ওঁদের উদ্বেগ। ওঁদের সংশয় এবং অবশ্যই ভয়াবহ একটা আতঙ্ক। সেই আতঙ্ক ঘিরে ধরল তাকেও। ভয়ে জড়সড় হয়ে গুটিয়ে গেল সে। এই সাতসকালে আবার কী হল!
কাল রাতে যে চুপিচুপি ও এ-বাড়িতে এসেছে, সেটা ওরা টের পায়নি তো! ধড়াস করে উঠল বুক। তড়িঘড়ি ঘরের জানালা দিয়ে তাকাল সে। দাওয়ার এ দিকে শোওয়ার জন্য আর ও দিকটা রান্নার জন্য আলাদা আলাদা দুটো ঘরের মতো বানাতে গিয়ে যত গন্ডগোল হয়েছে। দরমাটা দু’দিক থেকেই এতটা করে টেনে দেওয়া হয়েছে যে, বেঁকেচুরে, কোনাকুনি কাত হয়ে, যাতায়াতের জায়গাটা দিয়ে, অনেক কষ্ট করে কোনও রকমে একচিলতে সরু রাস্তা দেখা যায়। ও সে ভাবেই দেখল। হ্যাঁ, অনেক লোক যাচ্ছে।
তবে লোকগুলো ঝপাঝপ সরে সরে যাচ্ছে দেখে কারওরই মুখ দেখা যাচ্ছে না। ফলে কাউকে চেনাও যাচ্ছে না। এরা কারা? যারাই হোক, নিশ্চয়ই ওরা নয়। ওরা এত সকালে আসে না। আর এ ভাবে পায়ে হেঁটেও আসে না। আর ও এসেছে জানতে পেরে যদি ওরা আসত, তা হলে ও ভাবে বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যেত না। যা করার এতক্ষণে করে ফেলত।
বরকে ফিসফিস করে ডাকল সে। বর কোনও সাড়া দিল না। দু’-তিন বার ধাক্কাও দিল। কিন্তু সে উঠল না। শুধু পাশ ফিরে শুল। গত কাল রাতে আসার পর থেকে ঘরের মেঝেয় বসে স্বামী-স্ত্রীতে কতক্ষণ যে কথা বলেছে, মনে নেই। এত দিনের জমানো কথা উগড়ে দিতেও তো সময় লাগে। সকালের আলো যখন একটু একটু করে অন্ধকার মুছতে মুছতে পৃথিবীতে আসার জন্য এগোচ্ছে, তেরো নম্বর তখন আর চোখ খুলে রাখতে পারছিল না। কাত হতে হতে মেঝেয় পাতা মাদুরের উপরে শুয়ে পড়েছিল। বউয়েরও চোখ লেগে এসেছিল। এমনিতেই পাতলা ঘুম ওর। সেটা আরও পাতলা হয়েছে বর বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে। ইদানীং মাঝরাতে কোনও কুকুর ডেকে উঠলে বা কোনও বেড়াল ম্যাঁও করলেও ওর ঘুম ভেঙে যায়। যখন সবেমাত্র ওর দু’চোখ ঘুমে বুজে এসেছে, ঠিক তখনই হাওয়ায় ভেসে আসা কতগুলো লোকের কথাবার্তায় ওর তন্দ্রা কেটে গেল। একটু পরেই বুঝতে পারল, শুধু কয়েক জনের একটা দলই নয়, খানিক পরে পরেই ও রকম বেশ কিছু লোক দল বেঁধে বেঁধে যাচ্ছে।
কোথায় যাচ্ছে ওঁরা! যাঁদের ভয়ে শুধু ওদের গ্রামই নয়, আশপাশের সব ক’টা গ্রামই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে, তাঁরা নয় বুঝতে পেরে, দরজার খিল খুলে দাওয়ায় পা রাখতে গিয়েই তেরো নম্বরের বউ টের পেল, পুরো মেঝে জুড়ে কে যেন পুরু করে জমাট বাঁধা নরম দই পেতে রেখেছে। পা তুলতে গিয়েই, পায়ের চেটোয় করে উঠে এল এক দলা কাদা-সমেত চলটা।
সেটা দেখেও খুব একটা গা করল না সে। বুঝতে পারল, জলের ঝাপটায় ভিজে ভিজে দাওয়াটার দশা এ রকম হয়েছে। একটু গাঢ় করে গোবর-মাটি দিয়ে লেপলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে দাওয়ার একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল। যাঁরা যাচ্ছিলেন, তাঁদের দেখেই বুঝতে পারল, না। যাদের কথা ভেবে ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল, এরা তারা নয়। এরা সকলেই তাদের গ্রামের লোক। কেবল দু’-চার জন ছাড়া। তারা বোধহয় ওদিককার গ্রামের লোক। এত সকালে এরা কোথায় যাচ্ছে! ওদেরকে জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে! ও যখন দোনোমোনো করছে, ততক্ষণে পাঁচ- ছ’জনের আর একটা দল তাদের বাড়ির একদম সামনে চলে এসেছে। সেই দলেরই একজন বলে উঠলেন, কী গো বউমা, খবর শুনেছ?
আগুপিছু সে কিছু জানে না। কথাটা যে বলছে, তাকেও ঠিক মতো চেনে না। তবু মাথায় ঘোমটা টানতে টানতে সে বলল, কীসের?
– বীজেশের।
বীজেশকে সে খুব ভাল করেই চেনে। বিয়ের আগে তাকে যারা দেখতে গিয়েছিল, ও ছিল তাদের মধ্যমণি। সে দিনই আলাপ হয়েছিল। পাকা কথার দিনও ও গিয়েছিল। তার পর এখানে বিয়ে হয়ে আসার পর ওই বাড়ির সঙ্গে দারুণ একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল ওর। বীজেশ যখন তখন এ বাড়ি আসত। তার স্বামীও ওর বাড়ি যেত যখন খুশি। যে কোনও ছোটখাটো একান্ত পারিবারিক অনুষ্ঠানেও এক বাড়ি অন্য বাড়িতে সপরিবার নিমন্তন্ন করত। বীজেশকে ও ঠাকুরপো বলে ডাকত। নিজের ঠাকুরপোকেও বুঝি কেউ এতটা ভালবাসে না। বীজেশ ছিল ওর বরের ছোটবেলাকার বন্ধু। তবে এই গ্রামে জমি নিয়ে ঝামেলা শুরু হওয়ার পর থেকেই সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক কেমন যেন হয়ে গেছে। কে যে ‘জমি বিক্রি করব না’ বলেও, তলে তলে জমি বেচে দিচ্ছে, কালেক্টরের অফিস থেকে চেক নিয়ে নিচ্ছে, কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখছে। ভাইরা ভাইকে। ছেলেরা বাবাকে।
তার আঁচ পড়েছিল ওদের মধ্যেও। মন কষাকষি চলছিল। ফলে বেশ কিছু দিন ধরে কোনও যোগাযোগ ছিল না। সামনাসামনি দেখা হলেও কেউ কারও সঙ্গে কথা বলত না। এমনকী একজন অন্য জনের নামটুকু পর্যন্ত উচ্চারণ করত না। তেরো নম্বররা যখন স্বামী-স্ত্রীতে নিজেদের মধ্যে কথা বলত, তখন অনেক সময়ই ওরা বীজেশের নাম না-করে বলত, তোমার ‘পুরোনো বন্ধু’ কিংবা ‘তোমার ঠাকুরপো’ অথবা বলত, ‘তেজেশ জেঠুর ছেলে’।
সেই বীজেশের কী হয়েছে ও কিছুই জানে না। তাই বলল, কই, না তো।
– ওরে কারা যেন খুন করসে।
– খুন? হঠাৎ পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল তার। সারাক্ষণ আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগের মধ্যে থাকলে খুব কাছের মানুষকে হারালেও মানুষ বুঝি কাঁদতে ভুলে যায়। তাই কান্না-ভেজা গলায় নয়, ভয়ার্ত গলায় সে আঁতকে উঠে বলল, সেকী!
– আমরা তো সেখানেই যাইতাছি। গ্রাম ছাড়াইয়া ওই দিকটায় যে পোড়ো শিবমন্দিরটা আছে না? ওই দিকে যাইতে যে বিশাল পাকুড় গাছটা পড়ে, তার কয়েক হাত দূরেই নাকি ওর বডি পইড়া আছে। কাল ঝড়জলের জন্য তো তপুর বড় ছেলেটা গ্রামে ফিরতে পারে নাই। পাশের গ্রামে ওর মাসির বাড়িতে আছিল। আজ খুব ভোরে গ্রামে আইতে গিয়া দেখে এই কাণ্ড। শুনলাম, একেবারে নাকি পইচা গেছে। নাক রাখা যাইতাছে না।
– কবে মেরেছে?
– সেটা কমু কী কইরা? তবে কয়েক দিন ধইরাই তো ও নিখোঁজ ছেল। তখনই হয়তো মারসে। কাল দুর্যোগ ছেল, জানে রাতের বেলায় ওই দিকটায় কেউ যাইব না। তাই সুযোগ বুইঝা কাল রাতেই মনে হয় ওরে ওইখানে ফেইলা গ্যাছে। না হইলে কারও না-কারও নজরে তো পড়তই।
ওদের মধ্যে থেকেই অন্য আর একজন বলে উঠলেন, তার খবর কী?
‘তার’ মানে কার কথা জিজ্ঞেস করছেন বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করল ও। যাতে তার উত্তর দেওয়ার আগেই তাঁরা যেখানে দল বেঁধে যাচ্ছেন, সেখানে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে, দলের মধ্যে থেকে অন্য কেউ তাড়া লাগালে, তার উত্তর শোনার জন্য যেন তিনি আর অপেক্ষা না-করেন। চলে যান।
কিন্তু ওঁদের মধ্যে থেকে চলে যাওয়ার কারও কোনও চাড় না দেখে, কী বলবে বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করতে লাগল ও। প্রথম জনের পাশে যিনি ছিলেন, তিনি বললেন, ভয়ে পলাইয়া থাকলি চলবে না। গ্রাম ছেড়ে যে যেখানে আছে, প্রত্যেককে এ বার আসতে হবে। না হলে এ গ্রাম কিন্তু ছারখার হয়ে যাবে। আজ বীজেশ গেছে। কাল আমি যাব। পরশু অন্য কেউ। দেখতে দেখতে গোটা গ্রাম শ্মশানে পরিণত হবে। এক্ষুনি প্রতিরোধ বাহিনীটাকে আরও জোরদার করে গড়ে না তুলতে পারলে সামনে কিন্তু সমূহ বিপদ। যে ভাবে পারো, তেরো নম্বরকে খবর দাও।
যে বয়স্ক মানুষটি ‘কী গো বউমা, খবর শুনেছ?’ বলে কথার সূত্রপাত করেছিলেন, তিনি ফের গলা তুললেন, ও ঠিকই কইসে। ভয় পাইয়া লুকাইয়া থাকলি হইব না। মুখোমুখি হইতে হইব। বইলা দিও। আমাদের সঙ্গে যেন যোগাযোগ করে। কেমন? আসি গো বউমা, কোনও অসুবিধা হইলে কইও।

চলবে…

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ পঞ্চম পর্ব 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!