বালুরঘাট হাসপাতাল। গ্রীষ্মকাল। দুপুর দুটো। গরম হাওয়া বইছিল। মাথার ওপর সূর্য। কড়া রোদে বাইরে থাকা মুশকিল। হাসপাতালে আসা সবাই হাসপাতাল চত্বরে একটি বড় নিমগাছের ছায়াতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমিও হাসপাতালের সীমানার ভেতর সেই নিমগাছটির ছায়াতে রয়েছি। আরও ঘন্টা তিনেক আমাকে এখানে থাকতে হবে। তবে হ্যাঁ, আমার নিকট আত্মীয় বা পরিচিত কেউ কিন্তু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি নেই। আমার বাড়ি বদলপুর। বালুরঘাট থেকে বদলপুরের দূরত্ব প্রায় পঁয়ষট্টি কিলোমিটার। আমার নাম শ্রীমতি। শ্রীমতি সরদার।
হাসপাতালে নতুন শিশুর জন্ম হয়, নতুন মানুষ ভূমিষ্ঠ হয়। হাসপাতালে অসুস্থ লোকেরা সুস্থ হয়ে হাসি মুখে বাড়ি ফেরে। হাসপাতাল পূণ্যস্থান। তবু অনেকেই হাসপাতালের নাম শুনলে ভয় পায়, হাসপাতালে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। যতটা সম্ভব হাসপাতাল থেকে দূরে থাকতে চায়। আমার কিন্তু হাসপাতাল সম্পর্কে কোনও বিরূপ মনোভাব নেই, কোনওরূপ খারাপ মন্তব্য নেই।
বদলপুরে আমাদের বাড়ির কিছুটা দূরে একটা বড় পুকুর আছে। পুকুরপাড়ে রয়েছে একটি বড় বটগাছ। অনেকটা দূরে আছে তালগাছের শাড়ি। পুকুরের ওপর পাড় দিয়ে চলে গেছে কাঁচা রাস্তা। মাঝে মধ্যে আমার মনে হচ্ছে, আমি যদি এখন বদলপুরে আমার বাড়িতে থাকতাম, তাহলে গ্রীষ্মকালের এই দুপুরবেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে একাকী পুকুরপাড়ে গিয়ে বসতাম। পুকুরের পাড়ে বসে আমি দেখতাম, বটগাছ থেকে একটি লাল বটফল’ টুক’ শব্দ করে পুকুরের জলে পড়ত আর সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক মাছ সেই লাল বটফলটিকে মুখে নেওয়ার জন্য জলে ভেসে উঠত, ঠিক যেমন একটি ফুটবলকে দখলে নেওয়ার জন্য বাইশ জন ফুটবল খেলোয়াড় তীব্রভাবে লড়াই করে। আমি দেখতে পেতাম, ভীষণ রোদে কাঁচা রাস্তা দিয়ে যেতে-যেতে ক্লান্ত, পিপাসার্ত পথিক পুকুরের জল পান করে শরীরকে ঠান্ডা করত, সতেজ করত। আমি বুঝতাম, ‘জল’ই জীবন’। আমি শুনতে পেতাম, চাতক পাখির কাতর ডাক, ‘জল দাও, জল দাও’। দূরের সারিবদ্ধ তালগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতাম, দূরের তালগাছগুলো ‘এক পায়ে দাঁড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’। কাঁচা রাস্তা দিয়ে দইওয়ালা ‘দই চাই, দই চাই’ বলে জোরে হাঁক দিয়ে যেত। আমার মনে পড়ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকের অমল ও দইওয়ালার কথা। ডাঙা থেকে নেমে এসে কিছু পাতিহাঁস পুকুরটির জলে ডুব দিয়ে গুগলি খেত। আমি উপলব্ধি করতাম,জ্ঞান সমুদ্রে ডুব দিয়েই জ্ঞান সঞ্চয় করতে হয়, জ্ঞান অর্জন করতে হয়।
মাঝে-মাঝে আমার মনটা বিষন্ন লাগছে এই জন্য, গ্রীষ্মকালের যে-দুপুরবেলায় আমার পুকুর পাড়ে বসে থাকার কথা, সেই সময়ে আমি বালুরঘাট হাসপাতালের নিমগাছ তলায় রয়েছি। আমার মনটা ভারাক্রান্ত লাগছে এই কারণে, আমার যেসময়ে ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’ দেখার কথা, সেই সময়ে আমি বদলপুর থেকে পঁয়ষট্টি কিলোমিটার দূরে বালুরঘাটে আছি। ভেতরে ভেতরে আমার মনটা উদাস লাগছে এই ভেবে যে, গ্রীষ্মের যে-দুপুরবেলায় আমার কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে কাঁধে দইয়ের ভাঁড় নিয়ে হেঁটে যাওয়া দইওয়ালার ‘দই চাই, দই চাই’ ডাক শোনার কথা, গ্রীষ্মের সেই দুপুরবেলায় আমি বালুরঘাট হাসপাতালে অপেক্ষা করছি।
চলবে…