বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে প্রান্তিক মানুষ ২

 ।।শেষপর্ব।।

‘নবান্ন’র নাট্যধর্ম বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্তিযুক্তভাবে এর ত্রিস্তরীয় বিন্যাসের কথা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। এতক্ষণ যে রাজনৈতিক ইতিহাসের ব্যাপ্ত পটভূমির কথা বলা হল, এটা হল এর প্রথম স্তর, যেখানে একটি সুনির্দিষ্ট কালের রাজনৈতিক আবেগের প্রতিফলন ঘটেছে। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে আমিনপুরের বৃদ্ধ চাষি, প্রধান সমাদ্দারের পরিবার। স্ত্রী পঞ্চাননী ছাড়া দুই ভাইপো কুঞ্জ ও নিরঞ্জন, তাদের স্ত্রীরা যথাক্রমে রাধিকা ও বিনোদিনী, কুঞ্জের ছেলে মাখন, প্রতিবেশী দয়াল মণ্ডল, জনৈক চাষি চন্দর— এদের সবার সমবায়ে কাহিনিটি ক্রমশ রাজনৈতিক বাতাবরণ ছেড়ে পারিবারিক ও সামাজিক চেহারা নেয়। ‘জবানবন্দী’তে যেমন আকাল আরম্ভ হলে পরাণ মণ্ডলের পরিবার কলকাতার ফুটপাতে আশ্রয় নিয়েছিল, ‘নবান্ন’-এও তাই। তবে এখানে দুর্ভিক্ষের পিছনে নাট্যকার তুলে ধরেছন কিছু অর্থলোভী মুনাফাখোর মানুষের অসাধু গোপন কাজকারবার। স্থানীয় জোতদার হারু দত্ত কিংবা চালব্যবসায়ী কালীধন ধাড়ারা মওকা বুঝে চাষিদের একচিলতে জমিটুকু গ্রাস করে কিংবা গুদামে চাল লুকিয়ে রেখে কৃত্রিমভাবে অভাবের সৃষ্টি করে। প্রান্তিকের বিপরীতে এরাই হয়ে ওঠে কেন্দ্র। আগের দুটি নাটকে এই শোষকদের চেহারাটা তেমন স্পষ্ট নয়। ‘নবান্ন’-এ এদের স্বরূপকে একেবারে উন্মোচিত করে দিয়েছেন নাট্যকার। প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যটি বাদে বাকি চারটি দৃশ্যে সমাদ্দার পরিবারের অর্থনৈতিক দুর্দশা ও অন্নাভাব জনিত অশান্তি ও বিপন্নতা উপস্থাপিত। প্রধান তাদের একমাত্র সম্বল একটুকরো ধান জমি হারু দত্তের কাছে বিক্রি করতে না চাইলে, হারু লেঠেল ডেকে কুঞ্জর মাথা ফাটিয়ে দিয়ে যায়। অসহায় হয়ে নিরঞ্জন গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে। জোতদারের অত্যাচারে বাকি পরিবারও গ্রামে টিকতে পারে না। সবাই এসে আশ্রয় নেয় শহরের পার্কে অন্যান্য ছিন্নমূল পরিবারের সঙ্গে। শুরু হয় তাদের অস্তিত্ব রক্ষার কঠোর লড়াই। গ্রামে দুর্ভিক্ষ লাগায় সবাই এসে জড়ো হয়েছে শহরে। শহরের দৃশ্যকে দুটো আলাদা রঙে রেখাঙ্কিত করে দেখিয়েছেন নাট্যকার। একদিকে ধনীর বাড়ির বিবাহোৎসব— প্রচুর ভোজ্য ও পানীয়ের সমারোহ এবং অন্যদিকে মন্বন্তরক্লিষ্ট উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর সীমাহীন বুভুক্ষা। দুটো ভাত, একটু ফ্যান চেয়েও না পেলে তারা ছুটেছে ডাস্টবিনের দিকে উচ্ছিষ্ট কুড়োতে। কিন্তু সেখানেও জোরদার লড়াই— মানুষের সঙ্গে কুকুরের। সবারই আজ অনিবার্য প্রয়োজন খাদ্যের, বেঁচে থাকার যা প্রধান উপাদান। সেই খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে কুঞ্জ কুকুরের কামড়ে রক্তাক্ত হয়। তা দেখে কুঞ্জের স্ত্রী রাধিকা বেদনার্ত হয়। বোঝা যায়, শত দারিদ্র্যেও এরা মানবিক মূল্যবোধটুকু হারিয়ে ফেলেনি। আর এদের বিপরীতে উঠে আসে কালীধন ধাড়ারা, যারা চোরাবাজারে মজুত মাল গোপনে বিক্রি করে প্রচুর টাকা কামায়, জৈব লালসা পরিতৃপ্তির জন্য অভাবী ঘরের যুবতী নারীদের দিকে কামনার হাত বাড়ায়। হারু দত্ত কালীধনের ভোগের জন্য নিরঞ্জনের স্ত্রী বিনোদিনীকে চালান করে দেয়। এইখানেই আকস্মিকভাবে দেখা হয়ে যায় নিরঞ্জনের সঙ্গে বিনোদিনীর।

এ নাটকের তৃতীয় অঙ্কের দুটি দৃশ্য কলকাতার পটভূমিতে উপস্থাপিত। প্রথমটির স্থান সরকারি লঙ্গরখানা। দ্বিতীয়টির অকুস্থল চিকিৎসাকেন্দ্র। লঙ্গরখানায় ঘনীভূত হয়েছে মৃত্যুর কুটিল পরিবেশ। আতঙ্কিত, সন্দিগ্ধ সবার মন। এখান থেকে পালিয়ে যেতে চায় কুঞ্জ। সে রাধিকাকে বলে, ‘চল্ বউ, আমরা গাঁয়ে ফিরে যাই। এ পোড়া মাটির দেশে আর থাকব না।’ রাধিকা এ প্রস্তাবে সায় দেয়, একই সঙ্গে মাখনের দুঃখে কাঁদে— ‘সেখানকার মাটিও তো পুড়ে গেছে আমার ভাগ্যে— যদি আমার মাখন থাকত’।

চতুর্থ অঙ্ক থেকে একে একে এবার সবাই ঘরে ফিরতে থাকে। শুরু হয় প্রান্তীয় মানুষদের অন্যরকম কর্মতৎপরতা। আকাল এসে কেন তাদের ছিন্ন ভিন্ন করে দিল, শুরু হয় তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ। পরস্পর বিচ্ছিন্নতাই যে তাদের দুর্গতির মূল এই সত্যে পৌঁছুল তারা। তাই এবার সংকট প্রতিরোধের কথা ভাবতে লাগল, যাতে নতুন করে কোনো বিপদ এসে তাদের ছারখার করে না দিতে পারে। এই পর্বে বয়স্ক অভিজ্ঞ দয়ালকে নেতৃত্ব দিতে দেখি, যিনি সবাইকে বুঝিয়ে বলেন, ‘প্রত্যেকের জমিতে আমরা যদি সকলে মিলে গাঁতায় খাটব বলে পিতিজ্ঞে করি, তাহলে আমার খুব বিশ্বেস যে, একদানা ফসলও কারো জমির নষ্ট হতে পারবে না। দশ হাতে এ ফসল আমরা গোলায় তুলে ফেলতে পারব।’ মহাজনের করাল গ্রাস থেকে প্রান্তিক চাষিকে রক্ষা করার এই পদ্ধতির উদ্ভাবন ‘নবান্ন’কে খাঁটি কমিউনিস্ট সাহিত্য করে তুলেছে। কেননা কমিউনিজমের গোড়ার কথা হল, ব্যক্তি নয়, সমষ্টি; শোষকের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য একত্র সংঘবদ্ধ গণসংগ্রাম। এই সংগঠিত জনশক্তির কাছে হারু দত্ত, কালীধন ধাড়াদের কৌশলী চাল যে পরাজিত হবে, শোষিত প্রান্তিকদের প্রচেষ্টা জয়যুক্ত হবে— এমন ইতিবাচক পরিণতির ইঙ্গিত দিয়েই নাট্যকার নাটকের যবনিকা পাত ঘটিয়েছেন।

‘নবান্ন’-র পর বিজন ভট্টাচার্য নামলেন এক নতুন ধরনের নাট্যনির্মাণে। নাটকের নাম ‘জীয়নকন্যা’। নতুন ধরনের বলছি এ কারণে যে, তখন এ ধরনের নাট্যআঙ্গিক একটু অপরিচিতই ছিল। নাচ-গান-পাঠ-সংলাপ দিয়ে বানানো একধরনের পরীক্ষামূলক গীতিনাট্য। এখানে আখ্যান খুব সামান্যই। ঘটনাস্থল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে কোনো এক নন্দনপুর নামক গ্রামকে, যেখানে বেদেদের বাস। বেদে সর্দার প্রবীরের কন্যা উলূপীকে সর্পদংশন করে। তাকে বাঁচাতে বেদেদের নানা গোষ্ঠী তাদের বহু বিচিত্র উপকরণ ও প্রকরণ নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টাই হয় ব্যর্থ। সবশেষে আসে বদর আলি। সে বিভিন্ন দলের প্রচেষ্টার মধ্যে সঙ্গতি বিধান করার চেষ্টা করে বলে, ‘আমরা যদি সকলে আজ নিজ নিজ শিক্ষামতো মন্ত্রগুলা সব গলার মিল দিয়া আওড়াই, তখন এই বেমিলের ভিতর ভিতর একটা মিল হয় তো লাগতে পারে, যেখানে মূল ধন্বন্তরী মন্ত্রটায় একটা নাড়া লাগতে পারে।’ সবাই সেই পরামর্শ মেনে নেয়। শুরু হয় সম্মিলিতভাবে বিষঝাড়নের প্রক্রিয়া, আর এই সমবেত চেষ্টাতেই শেষ অব্দি উলূপীর বিষমোক্ষণ হয়। মারা পড়ে কালসর্প, নতুন প্রাণ পায় বেদে-কন্যা। নাটকটির মধ্যে বিজন নন্দনপুর জনপদটিকে ভারতবর্ষের প্রতিভূ করে তুলতে চেয়েছেন এদেশের মানচিত্রের আভাস পটভূমিতে স্থাপন করে। সুতরাং এ নাটকের ভাববস্তু নিছক বেদেজীবনের পরিসীমায় আটকে নেই, এর একটি সুদূরপ্রসারী দেশগত তাৎপর্য আছে। নাটকের শেষেও উলূপীর ক্রমশ বিষমুক্ত হওয়া এবং এতক্ষণ অন্ধকারে আচ্ছন্ন ভারতের মানচিত্রটির আবার পটভূমিকায় পরিস্ফুট হয়ে ওঠা, এই ধারণাকেই সমর্থন করে। পুনর্জন্মপ্রাপ্তা উলূপী ও গৌরবদীপ্ত ভারতমাতাকে এক করে দিয়েছেন নাট্যকার। যাইহোক, আমাদের অন্বেষণ সেখানে নয়। আমরা আসলে এ নাটকে খুঁজে পেয়েছি সমাজের অন্ত্যেবাসী এক শ্রেণির মানুষকে, যারা সভ্যসমাজ থেকে একেবারেই দূরে অবস্থান করে। তাদের জীবনযাপন, লোকাচার, অন্ধবিশ্বাস, মন্ত্রশক্তিতে আস্থা, তাদের দেহাতি উচ্চারণে সমৃদ্ধ লোকভাষা এদেশের এক প্রান্তিক সংস্কৃতিকে দর্শক-পাঠকের সামনে তুলে ধরে। নাট্যকার এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অনেক আগেই ওতপ্রোতভাবে মিশেছিলেন। ‘বিশিষ্ট বিজন’-এ “জনসাধারণের আমি” অংশে তাঁর যে মূল্যবান সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে তার থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া এই কথাগুলো পাই : ‘আমাদের দেশে যেটা লক্ষ করেছি, সাপ ধরে সাপ নাচায়। সাপও প্রচুর এবং ঢাকা মুনশিগঞ্জ side-এ খুব ওস্তাদ ওস্তাদ সাপুড়েও ছিল। সাপুড়েদের পাড়াই আছে। তারা সাপ ধরে, বিক্রি করে। বীরভূম-বাঁকুড়া অঞ্চলের কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সেখানে বংশানুক্রমিক কিছু লোক আছেন যাঁরা সাপটাকে চেনেন, সাপ বলে দিতে পারেন, সাপের species কী, কত রকম সাপ আছে, কোন্ সাপ কোন্ ঘরানার সাপ, তারা সব জানে। এক পক্ষকালের মধ্যে কোন্ সাপ বিষের থলিতে কত বিষ acquire করে, সেটাকে মুখে কামড়াতে হলে কতখানি মুনশিয়ানা লাগে, কতটা বিষ তোলা যেতে পারে, তার মোটামুটি হিসেব তারা জানে।’ বোঝাই যায়, কোনো আজগুবি কল্পনা থেকে নয়, জীবনজাত সজীব অভিজ্ঞতা ‘জীয়নকন্যা’র কথাবস্তু ও অবয়ব নির্মাণ করেছে। বিজন এদেশের প্রান্তজনের সঙ্গে তাদের আত্মার আত্মীয় হয়ে মিশেছেন, তাই তাঁর নাটকে প্রান্তিকরা এতটা আন্তরিকতার সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খতার সঙ্গে চিত্রিত হতে পেরেছে।

বিজন ভট্টাচার্য তাঁর নাটকের পটভূমিকে পল্লীগ্রামের বাইরে প্রথম নিয়ে গেলেন ‘অবরোধ’-এ। এ নাটকের রচনাকাল ১৯৪৭ সাল। ‘অবরোধ’-এর প্রধান বিষয় শ্রমিক মালিকের বিরোধ, সংঘর্ষ ও অন্তিমে শ্রমিক দল কর্তৃক মালিকপক্ষকে ঘেরাও। ন্যাশন্যাল মোটর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। সেখানে দিনরাত খেটে চলেছে শ্রমিক-মজুরেরা। কারখানার মূল মালিক জনৈক রায়বাহাদুর। বয়েস হয়েছে তাঁর। তাঁর পুত্র হেমেন সেন দেখাশোনা করে কারবারের। হেমেন ম্যানেজিং ডিরেকটর। অত্যন্ত ধুরন্ধর, হিসেবি ও কৌশলী। শ্রমিক-শোষণে নিত্য নতুন ফন্দি এঁটে চলেছে। ব্যক্তিচরিত্রে হেমেন খুবই দাম্ভিক, গোঁয়ার, উন্নাসিক। সে শাসনে-ত্রাসনে সবাইকে প্রায় চাবকে রেখেছে। সেনের সহযোগী হল দালাল নকড়ি, ম্যানেজার রেবতীবাবু, কারখানার উচ্চপদস্থ কর্মচারী মি. মুখার্জী এবং মিস্ত্রিদের মধ্যে মঙ্গল মিস্ত্রি। এদের সহায়তাতেই ম্যানেজিং ডিরেকটর সকলের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে থাকে। বিপুল বিত্তের অধিকারী মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না। মজুরি কম দেওয়ার কারণে, অবৈধভাবে ছাঁটাইয়ের কারণে কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। শ্রমিকদের নেতা ঈশ্বর পণ্ডিত আসে মালিক হেমেনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে। হেমেন ঈশ্বরকে নানা সুযোগ সুবিধে পাইয়ে দেবার টোপ দিয়ে দল ভাঙাতে চায়। কিন্তু ঈশ্বর স্বভাবে সৎ, সে শ্রমিকদের সঙ্গে বেইমানি করতে সম্মত নয়। সে চায় মালিক পক্ষের অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ লড়াই। তার পাশে এসে দাঁড়ায় ওসমান, কচি, নাগিন, গিট্টুর মতো লড়াকু শ্রমিকরা। তখন হেমেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চেষ্টা করে। ঈশ্বর পণ্ডিতের বিরোধী মঙ্গল মিস্ত্রিকে কৌশলে ব্যবহার করে। শ্রমিক-দরদী সাজতে গিয়ে হেমেন বোনাস ঘোষণা করলে মঙ্গল মিল-কর্তৃপক্ষের প্রশংসায় মুখরিত হয়। বিরোধী শক্তিকে গুঁড়িয়ে দিতে হেমেন এবার শুরু করল ছাঁটাই। শ্রমিকদের ভাতে মারাই তার লক্ষ্য। আগুনে যেন ঘি পড়ল। ছাঁটাই বন্ধ করতে ঈশ্বর তখন সমস্ত শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ করল। তারা সিদ্ধান্ত নিল ধর্মঘটের। হেমেনের কাছে মনে হল এটা বেয়াদপি। সে ধর্মঘটী শ্রমিকদের শায়েস্তা করতে বাইরে থেকে মজুর এনে কারখানা চালু রাখতে চাইল। তার এ কাজে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল নকড়ি। তারপর শুরু হল শ্রমিক-মালিকের প্রচণ্ড সংঘাত, শেষ বোঝাপড়া। মজুররা তাদের পুনর্বহালের দাবিতে অনড়, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে অটল। হাজার হাজার মানুষের গায়ের শক্তিতে কারখানার গেট ভেঙে পড়ল। প্রাণ গেল দারোয়ান গজাননের। দাম্ভিক রক্তশোষক মিল-মালিক হেমেন সেন ধর্মঘটী মজুরদের দ্বারা অবরুদ্ধ হল। বলাবাহুল্য, এই ভুখা পেটে হরতাল করতে আসা শ্রমিকরাই এখানে প্রান্তিক মানুষ। তারা এখানে উদয়াস্ত শ্রম দেয়, কিন্তু উপযুক্ত মজুরি পায় না, শ্রমিকের প্রাপ্য স্বাচ্ছন্দ্য পায় না। তাদের ওপর নানা দিক থেকে জুলুম খাটায়। তাদেরকে মানুষ জ্ঞান করে না। প্রান্তিকরা এভাবে চিরকাল অবহেলিত অবজ্ঞাত হয়ে থাকে। ক্রমশ তাদের অস্তিত্ব লুপ্ত হয়। এ নাটকে বিজন সেই প্রান্তজনদের মধ্যে বিদ্রোহের আভাস দিয়েছেন। তাদের মধ্যেও যে সুযোগসন্ধানী, স্বার্থান্বেষী মানুষ রয়েছে তার হদিস দিয়েছেন। শেষপর্যন্ত প্রবল অবরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে প্রান্তিকদের শক্তিকে, সংহতিকে জয়ী করেছেন নাট্যকার।

আরও পড়ুন: বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে প্রান্তিক মানুষ (প্রথম পর্ব) 

এ নাটকে আরো এক ধরনের প্রান্তিকের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্ত্রীরা প্রান্তিক। কেননা তারা উপার্জনক্ষম নয়। সবকিছুতেই স্বামীর মুখাপেক্ষী। আর স্বামীরা তাদের পুরুষতন্ত্রের দাপটে স্ত্রীর স্বাধীন অস্তিত্বকে প্রায় অস্বীকার করে বসে। তখন স্ত্রী হয় কেবল নর্মবিলাসিনী, শয্যাসঙ্গিনী। ‘অবরোধ’-এ নারী-পুরুষের এই কেন্দ্র-প্রান্তের সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে হেমেন সেন ও তার স্ত্রী সুচিত্রার মধ্যে। সুচিত্রা উচ্চশিক্ষিতা, কিন্তু হেমেন তাকে যথার্থ মর্যাদা দেয় না। সুচিত্রার তুলনায় বেশি সুন্দরী তার কবি-বন্ধুর পত্নী সাবিত্রী। সাবিত্রীকে নানা কৌশলে হেমেন হস্তগত করতে চায়, ব্যবহার করতে চায় তার ব্যবসায়ের কাজে। তা নিয়েই বাধে সংঘাত। সুচিত্রা উপলব্ধি করে হেমেনের কাছে তার মূল্য। প্রতিমুহূর্তের অবজ্ঞাত সুচিত্রা অন্তিমে এসে বিদ্রূপ আর তীব্র আঘাতে জর্জরিত করে হেমেনকে : ‘পুরুষের লাম্পট্যকে পৌরুষ বলে স্বীকার করে না নিলেই মেয়েরা হয় উদ্ধত। … তোমার এক পা তুমি তুলে দিয়েছ কারখানার মজুরদের বুকের ওপর–- সেটা বাইরে, আর এক পা তুমি তুলে দিয়েছ আমার বুকে। সহ্যের সীমা তুমি বহু আগেই অতিক্রম করে গেছ। মানুষের ক্ষমা অনেক, তাই আজও তারা তোমায় নির্বিবাদে সহ্য করে যাচ্ছে।’ হেমেন সেন তার বলদর্পিতা দেখাতে চাবুক তুলে নেয় হাতে। তা একটুও সুচিত্রাকে ভীত করে না। সে হেমেনের আগের কথার খেই ধরে বলে, ‘কলঙ্ক! তোমার চরিত্র গড়তে গিয়ে আজ পৃথিবীর সবটুকু কলঙ্ক ফুরিয়ে গেছে। সামান্য একটা কীট-পতঙ্গও আজ তোমার চাইতে বেশি সুস্থ।’ নিষ্ঠুর স্বামীর হাতে পুনর্বার লাঞ্ছিত হওয়ার আগেই সুচিত্রা নিজের মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে আত্মহননের সম্মানজনক পথ বেছে নেয়। এও নিষ্ঠুর শক্তিমানের বিরুদ্ধে অসহায় শক্তিহীনের এক অসহায় প্রতিবাদ।

নাট্যকার এ নাটকে আর একটি চরিত্র হাজির করেছেন। সে গোপাল— গোপাল দাশগুপ্ত। হেমেনের সহপাঠী বন্ধু। ছাত্রাবস্থায় দুজনের যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল। আজ হেমেন তার নাম পর্যন্ত ভুলে গেছে। গোপাল এসেছে বন্ধুর কাছে কিছু বই বিক্রি করতে। কিন্তু হেমেন এতই ব্যস্ত যে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সময়টুকু বের করতে পারছে না। গোপাল যেন তার কাছে অযাচিত এক আপদ। বই কেনবার ব্যাপারে হেমেনের অনীহা। সে তার বড়োলোকি চাল দেখাতে চায় বন্ধুকে দুশো টাকা দিয়ে সাহায্য করে। আসলে সে সহপাঠী বন্ধুকে টাকা দিয়ে অনুগৃহীত করে রাখতে চায়। গোপাল আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। তাই তার পক্ষে কোনো পাবলিক লাইব্রেরিতে বই দিয়ে টাকা নেওয়াটা অন্যায় বলে মনে হয়। বন্ধুর যে বিপুল খ্যাতি তাকে আকৃষ্ট করে এখানে টেনে এনেছিল, বন্ধুর আচরণে তাকে শতগুণে আহত করে। গোপাল বলে, ‘আমার ভুল হয়েছে তোমার কাছে বই বিক্রি করতে আসা।’ ইতিমধ্যে দুশো টাকার চেক কেটে ফেলেছে হেমেন। ক্ষুণ্ণ গোপাল সে চেক না নিয়েই উঠে পড়ে। আর যাবার সময় বলে, ‘তুমি যে এতটা ইতর…’। গোপালের এই কথাগুলোর মধ্যে ঝরে পড়ে প্রান্তিকের বেদনা আর প্রত্যাঘাত। যে চেক দিয়ে হেমেন দয়া দেখাতে চেয়েছিল তার ধনবত্তার অহংকারে, সেটা অক্লেশে প্রত্যাখ্যান ক’রে গোপাল তার প্রান্তিক হয়ে থাকার অভিমানটুকু রক্ষা করেছে। এও শক্তের বিরুদ্ধে অশক্তের এক ক্ষীণ কিন্তু অভ্রান্ত প্রতিবাদ।

দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে বাংলায় কম নাটক লেখা হয়নি। এ ছিল ভারত ইতিহাসের এমন এক ক্রান্তিকারী ঘটনা যার জের আজও টেনে বেড়াতে হচ্ছে। হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগ দুটোই কট্টর সাম্প্রদায়িক সংগঠন। ধর্মের জিগির তুলে দেশভাগের দাবি আগে তোলে মুসলিম লিগ। তৎকালীন সমন্বয়বাদী কংগ্রেসি নেতারা কোনো পক্ষকেই শান্ত করতে পারেননি। তার ফল ধর্মের ভিত্তিতে দেশ দু’টুকরো হয়ে যাওয়া। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলা আর পাঞ্জাব। অখণ্ড বঙ্গ ছিন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ববঙ্গ হল। পূর্ববঙ্গ তখন লিগ সরকারের দখলে। সেখানকার ভূমিপুত্র হিন্দুরা প্রমাদ গণল। জান-মান-গর্দান যাবে এই আশঙ্কায় পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পালাতে লাগল। তাদের প্রধান গন্তব্য রাজধানী কলকাতা। লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে জড়ো হল শহরে। পথে ঘাটে উদ্বাস্তুর ঢল। কী খাবে কোথায় থাকবে— সে এক মস্ত সমস্যা। যারা ওদেশের জমি জিরেত বাস্তুভিটে খুইয়ে এসেছে তারা এখানে এসে হল পথের ভিখারী। ঠাঁই হল তাদের অস্বাস্থ্যকর ক্যাম্পে, কিংবা এঁদো বস্তিতে। এদের জীবনের সংকট, সমস্যা, সংগ্রাম নিয়ে বিজন ভট্টাচার্য লিখলেন ‘গোত্রান্তর’। নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল ১৯৫৯ সালের ১৬ আগস্ট নিউ এম্পায়ারে ক্যালকাটা থিয়েটারের প্রযোজনায়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক, যার অঙ্ক সংখ্যা তিন, দৃশ্য মোট ছটি। এ নাটকের কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছেন হরেন মাস্টার। হরেন আদর্শবাদী শিক্ষক। পাঠশালার পণ্ডিত। কিন্তু দেশভাগের পর আর কেউ আসে না তাঁর পাঠশালায় পড়তে। যারা আগের পড়ুয়া তারা অভিভাবকদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে গেছে। অগত্যা হরেনকেও আসতে হয় কলকাতা শহরে। তাঁর আশ্রয় জোটে ভাই কেশবের ভাড়া বাড়িতে। কেশব এখানে সিভিল সাপ্লাইয়ের অফিসে একটা অস্থায়ী কাজ পেয়েছিল। একে অন্ধগলি, তায় দেড়খানা ছোটো কামরার ঘর। হরেন এসেছেন স্ত্রী শংকরী ও কন্যা গৌরীকে সঙ্গে নিয়ে। এমন বস্তিজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁদের আগে হয়নি। এখানে এসে হরেন দেখলেন কতটা লড়াই করে বাঁচতে হয় নিচুতলার মানুষদের। তুচ্ছ তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কত না ঝগড়াঝাঁটি, গণ্ডগোল। একদিন বাসাবাড়ির ভাড়া বাকি পড়ল। মালিকের দারোয়ানের সঙ্গে হুজ্জতিতে কেশবকে জেলে যেতে হল। সংসারের হাল ধরতে হরেন নামলেন ফুটপাতে ফেরিওয়ালা হয়ে। তিনি শিক্ষিত, এককালের শিক্ষক, কিন্তু আজ ভাগ্যের ফেরে, বদলে যাওয়া সময়ে হল তাঁর গোত্রান্তর। কাবুলিওয়ালার সুদ শোধ দিতে তাঁদের শেষ সম্বল স্ত্রীর হাতের বালাটুকুও বিক্রি করতে হল।

আরও পড়ুন: গারো পাহাড়ের চিঠি: পাতিল হাঁটি ও জ্যোতি’র শৈশব

এ নাটকে হরেন মাস্টারের পরিবারকেই শুধু প্রান্তিক করে দেখানো হয়নি, তাঁরা যে বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছেন সেখানকার মানুষজনও সেই একই গোত্রের। এরা সুদখোর কাবুলিওয়ালার দ্বারা শোষিত, সমস্ত রকমের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সেই বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় কানাইয়ের মা শৈলীবুড়ি। বুড়ি সকলকে একজোট হতে পরামর্শ দেয়। যুবক কানাইয়ের সঙ্গে হরেনের তরুণী কন্যার কোথায় যেন এক সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্যাপারটি গৌরীর মা শংকরীর ভালো লাগে না। তিনি বরং বেশি পছন্দ করেন বস্তির মালিক ঘোষদের ছেলে ছোটোবাবুকে। ঘোষবাড়িতে রাঁধুনী বামনীর কাজ নিয়ে সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে চান শংকরী। হরেন্দ্র এসব কিছুর খোঁজ রাখেন না। তাঁর স্কুলের বাতিক। কানাইয়ের সহযোগিতায় বস্তির ছেলেদের নিয়ে স্কুল করেছেন। স্ত্রী প্রতিনিয়ত অন্যত্র উঠে যেতে তাড়া দেয়। কিন্তু কোনো সুরাহ করতে পারেন না। বস্তির মালিক যারা তারা লোক লাগিয়েছে বস্তিবাসীদের উৎখাতের জন্যে। ঘোষবাড়ির সরকার হরিধন আসে পেয়ারাবাগান বস্তিতে। সকলকে উঠে যেতে হুকুম দিয়ে যায়। কিন্তু বস্তির মানুষরা একজোট। মালিক পক্ষ থেকে এবার চলল জোর জুলুম করে উচ্ছেদ করার প্রক্রিয়া। একদিন দলবল নিয়ে এসে হরিধন শৈলীবুড়ির বাড়ির দরজাতে লটকে দিয়ে গেল ডিক্রি জারির নোটিশ। আগুন যেন গায়ের ওপর এসে পড়ল। শংকরী উদ্ব্যস্ত হয়ে হরেন্দ্রকে প্রবল তাড়া দিতে থাকেন। হরেন্দ্র কানাইকে ঘর খুঁজতে অনুরোধ করেন। কানাই সন্ধান করে পায় একটা আস্তানা। সে কথা জানাতে এসে গৌরীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়। গৌরী আসলে ভালোবেসে ফেলেছে কানাইকে, হয়তো কানাইও গৌরীকে। দু’জনের সেই অব্যক্ত ভালোবাসা অনেক উজান পেরিয়ে শেষ অব্দি তাদের মিলনে সফলতা পায়। কানাই-গৌরীর বিয়ের দিন আচমকা হরিধন তার গুণ্ডা লেঠেলদের নিয়ে পেয়ারাবাগান বস্তি আক্রমণ করে বসে। লাঠি চলে। চালা ওড়ে। বস্তির সংসারগুলোর ঘর-গেরস্থালি সব তছনছ হয়ে যায়। কিন্তু সীমাহীন ধ্বংসের বার্তায় নাট্যঘটনা এসে থামে না। দুর্যোগরাত্রি কেটে আসে প্রসন্ন সকাল। আততায়ীর লাঠির ঘায়ে কপাল ফেটে যাওয়া হরেন মাস্টার রক্তচন্দনের তিলক বলে গ্রহণ করেন তাঁর এই আঘাতকে। এ যেন তাঁদের মতো বস্তিবাসী প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চার করে শেষ সংলাপটি বলেন হরেন্দ্র : “হেই বিশ্বকর্মার পুতের দল, চুপচাপ খারাইয়া আছস, হাত লাগাইতে পারস না তরা? হাত চালাত, কাম কর, উঠাও বস্তি।”। হাতে হাতে নির্মিত হয় স্বপ্নের ভুবন, ভালোবাসার পৃথিবী। সমবেত কন্ঠে জয়গান ওঠে মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনের।

না, বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে নেতিবাদের কোনো ঠাঁই নেই। তাঁর ধ্যানে ছিল মার্কসবাদ, আর জাগরণে শত সমস্যাদীর্ণ বাস্তবের ভারতবর্ষ। কমিউনিজমকে তিনি সেই জাদুদণ্ড বলে মনে করেছিলেন, যার ছোঁয়ায় বদলে দিতে চেয়েছিলেন রুগ্ন, নিরন্ন, বিপন্ন, ছন্নছাড়া স্বদেশকে। প্রান্তদলের সঙ্গে ছিল তাঁর নিরন্তর সংযোগ। কেবল ওপর ওপর সহানুভূতি প্রকাশ নয়, ভেতর থেকে জেগে উঠত তাঁর সহানুভূতিও। ১৯৫২ সালে অভিনীত হল তাঁর লেখা নাটক ‘মরাচাঁদ’-এর। তাকে ভেঙে আবার নতুন রূপ দিলেন ১৯৬১-তে। সেটার অভিনয় হয় মিনার্ভা থিয়েটারে। প্রযোজনায় তাঁরই সংগঠন ক্যালকাটা থিয়েটার। সংক্ষেপে বলতে গেলে দিনাজপুরের অন্ধ দোতারা বাদক টগর অধিকারীর বাস্তব জীবনকাহিনিই ‘মরাচাঁদ’-এর বিষয়বস্তু। প্রথম পর্যায়ে এটি ছিল চারটি দৃশ্য সম্বলিত, পরে আরো দুটি দৃশ্য বাড়ে। স্বভাবতই ঘটনার বিন্যাসও পাল্টে যায়। এ নাটকের পটভূমি জুড়ে থাকে গ্রাম বাংলার বাউল বৈরাগীর দল আর কৃষিজীবী সম্প্রদায়। নাটকের উপজীব্য বিষয় সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বিজন ভূমিকায় লিখেছেন, ‘নায়ক পবন বৈরাগী এইসব মানুষেরই একজন। অন্ধ সংগীতশিল্পী সে। গান তার ভিক্ষা সংগ্রহের উপায় মাত্র নয়, সাধনসিদ্ধির উপায়ও বটে। সংগীতকে তাই বাণিজ্যিক করার কথা হলে পবনের শিল্পীসত্তা সংকুচিত হয়। বিরোধের সূত্রপাত … এইখানেই। স্ত্রী রাধা আর তার মাসি দৈনন্দিন জীবনের খাওয়া-পরার ঊর্ধ্বে উঠতে চায় না। তাই ভুল বোঝে পবনকে। পবনের শিল্পীসত্তা তাদের নজরে পড়ে না বলেই ব্যক্তি-সত্তাটিকে মনে হয় সংসার সম্পর্কে উদাসীন। তাই খাওয়া-পরার তুচ্ছ তাচ্ছিল্য খুঁটিনাটি নিয়ে যখন সাংসারিক কলহের সূত্রপাত হয়, তখন সব দোষ গিয়ে পড়ে পবনের উপর।’ ক্রমশ স্বামী-স্ত্রীর তিক্ততা বেড়েই চলে। এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে প্রবেশ করে আর এক কীর্তনীয়া–- সে কেতকাদাস। কেতকাদাসের পদাবলী গানে সস্তা শৃঙ্গাররসের আমদানি। তার বিত্তবৈভবে আকৃষ্ট হয় রাধা। তারপর শুরু হয় গোপন অভিসার। রাধার মাসি সায় দেয় এ সম্পর্কে। রাধা একদিন ত্যাগ করে যায় পবনকে। এরপর ‘আকুল হয়ে ওঠে পবনের শিল্পীসত্তা। আষাঢ়ে ভরা আকাশের মতোই কানায় কানায় মেঘ জমে ওঠে তার বুকে। গলা চিরে বেরিয়ে আসে মেঘমল্লার।’

পবনের এমন এক দুর্দিনে পাশে এসে দাঁড়ান গ্রামেরই একজন সমাজসেবী শচীনবাবু। তাকে সান্ত্বনা দেন। শিল্পীরা অমৃতের সন্ধানী, তারা কেন বাঁধা পড়বে ব্যক্তিগত ছোটোখাটো সুখদুঃখের ঘেরাটোপে। আঘাতকে জয় করাই তো শিল্পীর সাধনা। শচীনবাবু পবনের ভাঙা মনকে জোড়া দিতে উৎসাহিত করতে থাকলেন। সমস্ত হতাশা, গ্লানিকে ঝেড়ে ফেলে আবার নতুন করে জীবনের গান গাইতে বললেন। শেষপর্যন্ত উদ্বুদ্ধ হল পবন। নবলব্ধ আত্মদর্শন তাকে জাগিয়ে দিল। ভাঙা ফাটা গলাতেই সে গাইতে শুরু করল নতুন করে বাঁচার গান।

আরও পড়ুন: মহান মে দিবস: আজ আমাদের সংহতির দিন

নাট্যকার ‘মরাচাঁদ’-এর পবনকে এঁকেছিলেন চোখে দেখা টগর অধিকারীকে সামনে রেখে। অদ্ভুত গান গাইতেন মানুষটি। শুনলে সবার মন মোহিত হয়ে যেত। কিন্তু তার জীবনে দুঃখ যেটা পয়সার অভাবে একটি সুন্দরী বউ সে পেলে না। টগরের আক্ষেপ দূর হল যখন চাঁদা তুলে দেওয়া হল তার হাতে। ‘তারপর শুনেছিলাম, টগর বিয়েও একটা করেছিল। উত্তরবঙ্গের পল্লীগ্রামের একটি সুন্দরী মেয়ে। সংসারও একটা পেতেছিল দোতারা সম্বল করে। কিন্তু টগর অধিকারীর সুখের সংসার বেশিদিন টেকেনি। সুন্দরী বউটি কোন এক কপট প্রেমিকের ছলনায় টগরকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।’— ভূমিকায় নাটকটির উৎস-কথা এভাবেই বিবৃত করেছেন নাট্যকার। আসলে টগর, টগররা এভাবেই প্রতারিত হয়। তারা তাদের অন্তহীন দুঃখ নিয়ে বাকি জীবনটা যাপন করে। এদের কাছে কখনো সহমর্মী হিসেবে শচীনবাবু ওরফে বিজনবাবুরা দেখা দেন, কখনো নিজের মধ্যে গুমরে গুমরে তারা মারা যায়। আউল-বাউলদের গুহ্যাচারী প্রান্তিক জীবনের খোঁজ রাখতেন ভূয়োদর্শী নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া একটি আত্মবিশ্লেষক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘টগর অধিকারী একটা টগর অধিকারী নয়, তার পিছনে কুড়িটা টগর অধিকারী ছিল। তাদেরও আমি চিনতাম। তার আগেও বহু আউল-বাউলের সঙ্গে আমার দিনের পর দিন contact হত এবং তাদের এই একই life, একই faith, একই রকম চলন, একই রকম বলন। … এই আখড়া আর বাবাজীদের cult, বৈষ্ণব cult-এর এই ধরনের লোক পূর্ববঙ্গে বহু ছিল, পশ্চিমবঙ্গেও বহু ছিল। এই ফকির-আউল-বাউল সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমরা ছোটবেলা থেকেই মিশতাম, তাদের গান শুনতাম, আখড়ায় যেতাম, থাকতাম, গান শিখতাম, আবার ratify করতাম, তারাও আসত।’ এই জৈবনিক অভিজ্ঞতাই ‘মরাচাঁদ’-এর ভিত গড়ে দিয়েছে। আউল-বাউলরা চিরকালই মূল সমাজের প্রান্তে তাদের নিজস্ব সাধন-ভজন নিয়েই আত্মবিভোর। সুতরাং পবন বৈরাগীর সমস্যা ব্যক্তিগত হতে পারে। কিন্তু এ নাটক যে কাল্টকে উপস্থিত করেছে, তার চরিত্রও প্রান্তিক। বিজন ভট্টাচার্যের বহুচারণার স্মারক হয়ে রইল ‘মরাচাঁদ’।

আমাদের আলোচনার সমাপ্তি টানব তাঁর আর একটি অসামান্য সৃষ্টি ‘দেবীগর্জন’ দিয়ে। ‘নবান্ন’-র মতো এরও জনপ্রিয়তা উঠেছিল তুঙ্গে। আলোচনাও হয়েছিল ব্যাপক। ১৯৪৬-এর ‘কলঙ্ক’ যেন এ নাটকেরই পূর্ব খসড়া। গণনাট্য আন্দোলনের মূলস্রোত তখন থেমে গেছে, কিন্তু বিজন ভট্টাচার্যের শিল্পীচৈতন্য থেকে তার রেশ মুছে যায়নি। রাজনৈতিক ভাষায় বললে, তখনো পশ্চিম বাংলার বুকে অ-কমিউনিস্ট সরকার রাজত্ব করে চলেছে। ১৯৫৭ সালে জমিদারি স্বত্ব আইন বিলুপ্ত হয়। কিন্তু জমিদারি মেজাজ, আধিপত্য, জোতদারদের দাপট একটুও কমেনি। এই জমিদার, জোতদার, মহাজনরা কীভাবে ভূমিহীন কৃষকদেরকে, বর্গাদার চাষিকুলকে নানা উপায়ে শোষণ ও গ্রাস করছিল তারই জ্যান্ত ছবি বিজন ফুটিয়ে তুললেন ‘দেবীগর্জন’-এ। এ নাটকের প্রথম অভিনয় হয় ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ১৯৬৬-র ২১শে ফেব্রুয়ারি। নাটকটি ছিল মার্কসবাদে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাসী বিজন ভট্টাচার্যের একটি ‘ফুল কমিটেড’ রচনা। তাই যখন বই হিসেবে বেরয় তখন উৎসর্গ পত্রে দেখা যায় লেখা আছে–- ‘কৃষক আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশ্যে’। এবং সেটাই স্বাভাবিক। এর আগে গ্রামজীবনভিত্তিক গণআন্দোলনের নাটক হিসেবে তিনি যে ‘নবান্ন’ লিখেছিলেন, তার বক্তব্য থেকে যেন আরো এক কদম এখানে এগিয়ে এসেছেন বিজন। ‘নবান্ন’-এ শোষক আর শোষিত শ্রেণি চিহ্নিত হলেও শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের উত্থান কোনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পথে এগোয়নি। হারু দত্ত, কালীধন ধাড়াদের কৌশলী চালের কাছে পরাজিত হয়ে প্রধান সমাদ্দাররা ভিটে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। প্রান্তিকরা এ নাটকে প্রতিবাদের তুলনায় প্রতিরোধের পন্থা অনুসরণ করেছিল বেশি। গাঁতায় খাটা, ধর্মগোলা গড়ে তোলা যেন সংঘবদ্ধভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়বার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু ‘দেবীগর্জন’ যেখানে আমাদের উত্তীর্ণ করে দেয় সে শুধু প্রতিরোধ নয়, সে এক কঠোর প্রতিবাদ, ভয়ংকর প্রতিশোধ। প্রান্তজনের এমন মারমুখী চেহারা বিজন ভট্টাচার্যের কলম থেকে আগে কখনো বের হয়নি।

আরো একটা কথা। চিরাচরিত সমাজবিন্যাসে উচ্চ অভিজাতরা বরাবর শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কিন্তু নাট্যকার এ নাটকে দেখিয়েছেন শোষকের কোনো ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, তার আছে কেবল শ্রেণিচরিত্র। প্রভঞ্জন সর্দার আদিবাসী সমাজেরই একজন, কিন্তু বিপুল ভূসম্পত্তি, গোলাভরা ধান তাকে প্রভূত পরিমাণে ক্ষমতাবান করে তুলেছে। ভূঁইচাষিদের শোষণ করে নিজে সে স্ফীত হয়। তার এ কাজে সহায়তা করে যেমন আমলা, সরকার, বঙ্কু-ভীমা-সাটোকের মতো লেঠেলরা, তেমনি জনদরদী নেতা সাজতে চাওয়া ত্রিভুবন। এ নাটকে দুটি প্রতিপক্ষকে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন বিজন। জোতদার প্রভঞ্জন এখানে সামন্ততন্ত্রের নির্ভুল প্রতিভূ। সে স্পষ্ট বলে, ‘আমিই রাজা, আমারই নীতি, ইটাই রাজনীতি।’ সে তার শক্তিমত্তার চোখ রাঙিয়ে বাউরি পল্লীর গরিব-গুর্বো ভূঁইচাষিদের কাছ থেকে খামার খরচা, খোলান চাঁছানি, গোলামুছানি আদায় করে। ভাগচাষিদের ন্যায্য ভাগের পাওনা থেকে বঞ্চিত করে। কেউ প্রশ্ন তুললে, উচ্চকণ্ঠ হলে লাঠিয়াল ডেকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে শায়েস্তা করে। তার ভয়ে তাই সবাই তটস্থ। মংলার বাপ বুড়ো সর্দারের অধীনে যতটুকু জোতজমি ছিল কৌশল করে টিপছাপ দিয়ে পুরোটাই গ্রাস করে নেয়। বুড়ো সর্দার ভূমিশূন্য শ্রমিকে পরিণত হয়। কৃষিকাজ ছেড়ে সর্দারের পরিবার ফেরে তাদের আদি জাত-ব্যবসায়— ঝুড়ি-ঝাঁপি-কুলো বোনায়। সর্দারের ছেলে মংলা নিরুদ্দেশ হয়। হয়তো সে যায় কয়লাখাদানে শ্রমিকের কাজ করতে। প্রভঞ্জন ধীরে ধীরে মাকড়সার মতো জাল বিস্তার করতে উদ্যত হয়। তার লক্ষ্য মংলার নববিবাহিতা যৌবনবতী স্ত্রী রত্নাকে ভোগ করা। ত্রিভুবন একাজে তার সহায়ক। সেই চক্রান্তের অঙ্গ হিসেবে ত্রিভুবন এসে রত্নাকে খোলানের কাজে যোগ দেবার আহ্বান জানায়। কুচক্রীর চাল বুঝতে না পেরে রত্না যায় এবং শেষ পর্যন্ত প্রভঞ্জনের লালসার শিকার হয়।

এদিকে যে ত্রিভুবনকে বাউরিরা নিজেদের শুভাকাঙ্ক্ষী বলে মনে করেছিল, তার স্বরূপ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠলে সবাই মিলে ত্রিভুবনকে অগ্রাহ্য করে নতুন পঞ্চায়েত গড়ার ডাক দেয়। নেতৃত্ব দিতে থাকে মংলা আর সঞ্চারিয়া। তারা সংঘবদ্ধ ভাবে সংঘাতের জন্য প্রস্তুত হয়। তারা দাবি জানায় পঞ্চায়েতি শাসনের, যেখানে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে। কর্জাধানের সুদও তারা সরাসরি কাছারিতে জমা দিতে চায়। ভূঁইচাষিদের এই জোট ভাঙবার মতলব করে প্রভঞ্জন আর ত্রিভুবন। কিন্তু এতদিনে বঞ্চিত, শোষিত, চাষিরা এবার যেন জেগে উঠেছে। তারা ধর্মগোলার ধান তাদের কষ্টের সময় নিঃশর্তে ভাগ করে দেবার জোর দাবি জানায়। নতুন পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে দশরথ বলে, ‘পঞ্চায়েতি মতে দশজনই এই সভার ধর্মাবতার। ধর্মাধিকরণ যদ্যপি অনাচারী হন, অধার্মিক হন, তো দশজনই আজ তাঁর বিচার করবে। ই একটা দায়িত্বের কথা।’ শুরু হয় জোতদার প্রভঞ্জনের এতদিনের কাজকর্মের বিচার। দিগম্বর বলে, ‘এতাবৎ খতবন্দী হিসাবে টিপছাপ দিয়ে যে সকল ভূঁইচাষী প্রজাকে উঠবন্দী করান হইয়েছে, উচ্ছেদ করা হইয়েছে জমি থিকা— তাদিগের সকলকে আবার জমিতে দখল দিতে হবে প্রজাস্বত্ব মতে!’ প্রভঞ্জন এসব দাবি মানতে চায় না। সে বলে যে, ধর্মগোলার ধান নাকি পূজার ধান। সেবায়েতের অনুমতি ভিন্ন তাতে হাত দেবার কারো অধিকার নেই। সমবেত চাষিরা সে যুক্তি শুনতে নারাজ। তারা এর একটা হেস্তনেস্ত করতে চায় আজ। প্রভঞ্জন বিপাকে পড়ে লাঠিয়ালদের ডাক দেয়। শুরু হয় দুপক্ষের তুমুল লড়াই। বিপদ বুঝে ত্রিভুবন আগেই পালায়। উন্মত্ত ক্রুদ্ধ জনতা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে প্রভঞ্জনকে। ততক্ষণে মংলা খুঁজে পায় মৃত রত্নাকে, যে মান বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। নাটকের শেষটুকু আর সংলাপে গাঁথেননি নাট্যকার, নাট্যনির্দেশের সাহায্যে তৈরি করে তুলেছেন এক অসাধারণ প্রত্যাঘাতের দৃশ্য : ‘হাত বাড়িয়ে শস্ত্র খোঁজে মহাবলী। ঘুগর‍্যা মংলার হাতে টাঙি এগিয়ে দেয়। একটি মুহূর্ত মাত্র। দৃপ্ত ভঙ্গিতে দু’হাতে ঘুরিয়ে ধরে টাঙি মংলা প্রভঞ্জনের মাথার ওপর। আশপাশের সমস্ত অস্ত্রগুলিও ঝিলিক দিয়ে ওঠে শত্রুকে লক্ষ করে।’ যেন মহিষাসুর বধের একটি স্থির চালচিত্র তৈরি হয়। ‘দেবীগর্জন’ নামটি সার্থক ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। কেননা পৌরাণিক ও আভিধানিক অর্থে দেবী বা ধরিত্রীর রণহুংকারই হল দেবীগর্জন।

আরও পড়ুন: জীবনের দেয়ালা

এই নাটক যথার্থই শ্রেণি সংগ্রামের নাটক। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা ফসল ফলায় জোতদারি কৌশলে তারাই চিরকাল থাকে অভুক্ত। নিজেদের সেই কঠোর শ্রমের মূল্যে পাওয়া মাতৃস্বরূপা মৃত্তিকার ফসলের ওপর নিজেদের সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে আদিবাসী চাষি সম্প্রদায়ের এই জীবনপণ লড়াই এ নাটকের প্রধান উপজীব্য। এইসব বাউরি, সাঁওতাল সমাজের কুলিকামিন ক্ষেতমজুররা একেবারে অন্ত্যেবাসী। এরা শিক্ষাদীক্ষাহীন, অসহায়, ভীরু। কিন্তু মার খেতে খেতে একদিন তাদেরও চোখ ফোটে। তখনই তারা লড়াই শুরু করে ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে, যে পেশিশক্তি দিয়ে এতদিন তাদের দাবিয়ে রেখেছে। বিজন ভট্টাচার্য সেই দুর্বল উৎপীড়িতদের মধ্যে শক্তি, সাহস আর সংঘবদ্ধতা তৈরি করে শ্রেণিসংগ্রামভিত্তিক কৃষক আন্দোলনের জোরালো রূপটি এ-নাটকেই প্রথম উন্মোচন করলেন।

আসলে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন অবজ্ঞাত, অবহেলিত, শোষিত, ব্যথিত মানুষের দৈনন্দিন বেদনার বিশ্বস্ত রূপকার। এদের প্রান্তিক জীবনের তিনিও একজন শরিক। শুধু এদের অর্থনৈতিক কিংবা বুভুক্ষার সমস্যা নয়, এদের ভাষা, সামাজিক রীতিনীতি, কথাবলার ধরনধারণ, আমোদপ্রমোদ, মেঠোসুরের গান, গ্রামীণ লোকশিল্প সম্পর্কে এত নিখুঁতভাবে জানতেন যে, প্রতিটি নাটকেই তার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে প্রান্তিক মানুষের জীবনচর্যাকে মঞ্চের নাগরিক দর্শকদের সামনে সেই পরিবেশকে মূর্ত করে তুলেছেন। নাট্যনির্দেশক হিসেবেও তিনি জোর দিতেন অভিনয়ের মধ্যদিয়ে প্রান্তিকের বাস্তবতাকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে। সায়ক নাট্যপত্র সংকলন (সংখ্যা ১০/১৮)-এর বিশিষ্ট গ্রন্থ শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘থিয়েটারের আকাশে নক্ষত্রমালা’ “বিজন ভট্টাচার্য” প্রবন্ধে দেওয়া হয়েছে নাট্যশিক্ষক বিজনের কাজের খতিয়ান। তারই একটুকরো : ‘নাটক শিক্ষা দেবার সময় নাটকের মহলার সময় বিজনদা প্রচণ্ডভাবে যেটার ওপর জোর দিতেন, এক একটা চরিত্র সে যাতে তার জাতি, তার বয়স, তার সমাজ, তার গোষ্ঠীর সঙ্গে তার ওতপ্রোত যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কটাকে সে যাতে তার কথার উচ্চারণে, তার ভাষায়, তার শরীরের চলনে, চলাফেরায়, এইসব কিছুর মধ্যে যেন সে কোথাও ধরতে পারে। যাতে কাউকে দাঁড়িয়ে বলে দিতে হয় না যে, এ মানুষটি এসেছে সমাজের ওই স্তর থেকে, সমাজের এই অংশ থেকে, ওই বৃত্তি থেকে।’ এভাবেই তাঁর নাটক মঞ্চ থেকে সরাসরি সংযোগ রক্ষা করতে পারত। তিনি একটা বিশেষ সময়ের দাবি নিয়ে নাটকে কথা বলতে শুরু করেছিলেন বলে, আজকের অনেকের কাছে তিনি ব্রাত্য বলে গণ্য হতে পারেন, এ রাজ্যে রাজনীতির অন্য বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি অপাংক্তেয় বলে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে পারেন, কিংবা বন্দি থাকতে পারেন কেবলমাত্র পাঠ্য বইয়ের পাতায়। কিন্তু আমার বিশ্বাস, শোষক ও শোষিত, কেন্দ্র ও প্রান্ত যতদিন সমাজে বিরাজ করবে, ততদিন বিজন ভট্টাচার্যের নাটক আবেদন হারাবে না। এইখানেই তাঁর বিশেষ একটি কালকে আশ্রয় করে সর্বকালীন হয়ে ওঠা, আগের শতকের নাট্যকার হয়েও সমকালীন হয়ে ওঠা। একুশ শতকে তাঁকে, তাঁর নাটককে ফিরে দেখার এটাই একমাত্র প্রাসঙ্গিকতা।#

 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!