।।শেষ পর্ব।।
১৯৮৭ থেকে ১৯৯৭- কালপরিসরটিকে টনি মরিসনের জীবনের ট্রিলজি-দশক হিসেবে অভিহিত করা যায়। ১৯৮৭-তে বেরোয় তাঁর বিলাভেড-ট্রিলজি’র প্রথম উপন্যাসটি, ১৯৯২-তে জাজ এবং ১৯৯৭ সালে প্যারাডাইস। এই ট্রিলজি প্রথমত এক আন্তঃমহাদেশীয় জীবন-বাস্তবতার শক্তিমান কথাচিত্রণ এবং দ্বিতীয়ত এটি টনি মরিসনকে দেয় বিশ্ব পরিচিতি এবং তৃতীয়ত এই ট্রিলজি-দশকেই তিনি অর্জন করেন সাহিত্যের জন্যে নোবেল পুরস্কার (১৯৯৩)। অবশ্য তাঁর প্রথম উপন্যাস এবং ট্রিলজি’র প্রথমটার পূর্বে বেরোয় টনি মরিসনের আরও তিনখানা উপন্যাস- সুলা, সং অব সলোমন এবং টার বেবি। সুলা উপন্যাসটিকে অনেকেই নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার্য বলে মনে করেন। এর কারণ উপন্যাসটির নারী চরিত্রাধিক্য এবং এতে রয়েছে বেশ কয়েকটি চরিত্রের মৃত্যুর ঘটনা যেগুলোতে থাকে নারীর সংশ্লিষ্টতা। তবে সাহসী সমালোচক বারবারা স্মিথ তাঁর কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী সমালোচনামূলক প্রবন্ধে মরিসনের সুলা উপন্যাসটির পাঠ-কে লেসবিয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য বলে মন্তব্য করেন। তাঁর তৃতীয় উপন্যাস সং অব সলোমন অনেকের নিকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস-সমাজতত্ত্বের পাঠ (‘ট্রেক্সট’)। বিখ্যাত অপরাহ্ উইনফ্রে তাঁর ‘বুক ক্লাব’-এর জন্যে গ্রন্থটি মনোনীত করলে এটি বৃহত্তর পাঠকের দৃষ্টি কাড়ে। বিশ শতকের কালপরিধিতে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ পঁচিশটি উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত হয়। ১৯৯৩ সালে সুইডিশ একাডেমির শংসাবচনেও এটির উল্লেখ থাকে। উপন্যাসটিকে বহুসাংস্কৃতিক-বহুজাতিক জীবনের একটি বৃহদায়তন আঙিনা হিসেবে দেখেছেন সমালোচকগণ। আফ্রো-মার্কিন বাস্তবতার শেকড়টিকে যথার্থ রূপেই চিহ্নিত করার কাজটি করেন মরিসন। সং অব সলোমন প্রসঙ্গে পাঠকের মনে পড়তে পারে ইন্দোনিশিয়ার জাভা দ্বীপবাসী লেখক প্রামোদিয়া অনন্ত তোয়েরকে। তাঁর বুরু কোয়ার্ট্রেট নামে খ্যাত বুমি মানুসিয়া (দিস আর্থ অব ম্যানকাইন্ড) উপন্যাসটিকেও এমনিভাবে বহুসাংস্কৃতিক-বহুজাতিক প্রতিফলনের আকর হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। উপন্যাসটিতে ১৮৯৮ সালের দিকে জাভা দ্বীপে গড়ে উঠতে থাকা ঔপনিবেশিকতার সূচনাবিন্দু থেকে পরবর্তী পরিসর। এই কালপর্বটি গুরুত্বপূর্ণ এজন্যেই, শীঘ্র এর ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠবে অদূরের অস্ট্রেলিয়া। জাভা দ্বীপের রাবার, কফি, চিনি, খনিজ দ্রব্য প্রভৃতির হাতছানিতে বহু পথ পাড়ি দিয়ে এসে ঢোকে বহিরাগতরা। ডাচ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, অভিযাত্রীর দল আর অন্যান্য ইউরোপিয় সকলেরই আস্তানা গাড়বার অধ্যবসায় চলমান। বন্দরে ভিড় করে আরও আরব, ভারতীয়, চৈনিক মানুষেরা। অদ্ভুত এক মহাজাতিক মিশেলের পরিণতি জাভা যেখানে প্রত্যেকে সঙ্গে নিয়ে আসে নিজ-নিজ জীবনের কাহিনি।
আরও পড়ুন:
রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, নীতি-নৈতিকতা, কূসংস্কার, ঘৃণা, কল্পনা এবং ভবিতব্য- সবই আছে প্রামোদিয়ার উপন্যাসে। যেমনটি থাকা সম্ভব এমন বাস্তবে ঠিক তেমনটাই। জাভানিজ, ডাচ, মালয়, মাদুরিজ ইত্যাদি বিচিত্র ভাষাভাষী মানুষ সেখানে কথা বলে। একেক শ্রেণির মানুষের আবার একেক ভাষা। যেমন স্থানীয়দের ডাচ ভাষা ব্যবহারের অধিকার ছিল না। এ যেন আর্যাবর্তে প্রাকৃতজনের সংস্কৃতানধিকার। মরিসনের উপন্যাসে পাই মিশিগান অঞ্চলে মার্সি নামের এক কল্পিত শহর যেখানে কাহিনির আবর্তন ঘটে ১৯৩০ থেকে শুরু করে ১৯৬৩ পর্যন্ত। আবার উপন্যাসের নায়ক মিল্কম্যান ডেড-এর পিতামহ-প্রপিতামহদের সূত্রে চলে আসে উনিশ শতকের কালিকতা। উপন্যাসের নায়ক মিল্কম্যান সংগ্রাম চালায় তার পরিবার থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র হয়ে স্বকীয় একটা জীবনের অধীশ্বর হতে। এই বহুবিচিত্র-বহুস্বর পরিবৃত্তের মধ্যে নিজের থাকাটাকে অস্তিত্বপূর্ণ করে তুলতে চায় সে। বলাবাহুল্য, পৃথিবীর খুব কম লেখকই এমন ধারার উপন্যাস সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এর জন্যে প্রয়োজন বিশেষ ধরনের ক্ষমতা অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণ করবার শক্তি। প্রামোদিয়া কিংবা মরিসনের উপন্যাসকে কেউ-কেউ ‘ক্যালাইডোস্কপিক’ উপন্যাসও বলে থাকেন। পর-পর দু’টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে যাওযার পর টনি মরিসন তাঁর তৃতীয় উপন্যাসেই এমন অসাধারণ শক্তির নজির রাখতে সক্ষম হলেন। বস্তুত এটির প্রকাশ-প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই তাঁকে ধ্রুপদী ঔপন্যাসিকের তালিকায় স্থায়ী আসন দিয়ে দেন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ছিল তাঁর সেই ধ্রুপদত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
সং অব সলোমন উপন্যাসের গতিময়-স্বচ্ছ ভাষার প্রশংসা করে থাকেন সমালোচকেরা। উদ্ধৃতি দেওয়া যাক-
“শোবার ঘরে ফিরে মিল্কম্যান ড্রেসিংটেবিলের সামনে ওর জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছিল। ওর যেদিন ষোল বছর বয়স হয়
সেদিন ওর মা ওকে এক জোড়া রূপা-বাঁধানো চিরুনি উপহার দিয়েছিল। গায়ে গাঁথা ওর নামের সংক্ষিপ্ত রূপ যা কিনা
একজন চিকিৎসকের ডিগ্রিও বটে। সে এবং তার মা এটা নিয়ে বেশ কৌতুক করতো। মা খুব করে চাইতেন ও যেন
মেডিকেল স্কুলে পড়াশোনা করে। “কেমন দেখাবে সেটা? এম. ডি., এম. ডি.। তোমার অসুখ হলে তুমি কী এমন কোনো
লোকের কাছে যাবে যার নাম ড. ডেড?” – জোরের সঙ্গে সে বলতো মা’কে। … …
কিন্তু সবকিছুর শুরু এগারোটার দিকে। গিটার এবং মিল্কম্যান রাত সাড়ে আটটার দিকে যখন আসে তখন সত্যিকার অর্থেই চারদিক ফাঁকা। একটা শুঁড়িখানার মধ্যে ঢুকে পড়লো ওরা। অর্ডার করলো স্কচ আর পানির জন্যে। মিল্কম্যান ওর অংশটুকু দ্রুত গলাধঃকরণ করেই আরেকটার জন্যে অর্ডার দিল। গিটারকে জিজ্ঞ্যেস করে সে, “আচ্ছা ওরা আমাকে
মিল্কম্যান ডাকে কি জন্যে?”
“বালের কথা, আমি জানবো কী করে? সেটা তোর নাম, তাই না?”
“আমার নাম ম্যাকন ডেড।”
“আমাকে এই গোটা রাস্তা ডিঙ্গিয়ে আনলি তোর নাম বলার জন্যে?”
“এটা আমার জানা দরকার।”
“আরে, ইয়ার, পান করো।”
“তুমি তো তোমার নাম জানো, জানো না?”
“বাজে কথা রাখ্। তোর মনের আসল কথাটা বল্ তো?”
“আমার বুড়োটাকে ধরাশায়ী করেছি?”
“ধরাশায়ী?”
“হ্যাঁ। ঘুষি মেরেছি। মেরে ওকে বাঞ্চোত রেডিয়েটরটার ওপর ফেলেছি।”
“ও কী করেছিল তোকে?”
“কিচ্ছু না।”
“কিচ্ছু না? তুই ওর ওপর চড়াও হলি আর ওকে মার লাগালি?”
“হ্যাঁ।”
“কোন কারণ ছাড়াই?”
“ও আমার মায়ের গায়ে হাত তুলেছিল।”
“ওহ্।”
“ও আমার মাকে মেরেছিল। আমি মারলাম ওকে।”
“বেশ শক্ত ব্যাপার।”
“হ্যাঁ।”
“আমি সত্যিই বলছি।”
“জানি।” মিল্কম্যান দীর্ঘশ্বাস নেয়- “আমি জানি।”
“শোন্। আমি বুঝতে পারছি তোর অনুভূতিটা কেমন।”
“ওহ্ ওহ্। তুই বুঝতে পারছিস না। এরকম ব্যাপার তোর না ঘটলে তুই বুঝতে পারবি না।।”
রিচার্ড রাইট কিংবা জেমস বল্ডউইনের উপন্যাসের কৃষ্ণাঙ্গ জীবন মরিসনে মোড় নিয়েছে খানিকটা ভিন্নতায়। আগ্রাসী বা আক্রমণাত্মক কৃষ্ণাঙ্গ অভিব্যক্তির যথেষ্ট বর্তমানতা সত্ত্বেও মরিসন চূড়ান্তভাবে সমন্বয়ের ধারণাতেই স্থিত হ’ন। সং অব সলোমন-এ গিটার চরিত্রটিকে অনেকেই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের অনুসারীদের বিপরীত মেরুর সমান্তরাল কৃষ্ণাঙ্গ অভিব্যক্তি রূপে দেখেছেন। মরিসন দেখিয়েছেন, আফ্রো-মার্কিন বাস্তবতা আমেরিকায় এমনই স্থায়ী ছাপ সৃষ্টি করেছে যে একে অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। ইতিহাসের অনুসন্ধান আসলে প্রয়োজন বর্তমানের বিন্যাসের জন্যেই। পূর্বসুরীদের ভুল বা পাপের প্রায়শ্চিত্ত না হলে ভবিষ্যতে আরও দুর্যোগেরই সম্ভাবনা। ওলে সোয়িংকার কবিতার সেই লন্ডন শহরের শ্বেতাঙ্গ বাড়িঅলির কথা বলা যায় যে কখনও কোনো কৃষ্ণাঙ্গকে বাড়ি ভাড়া দেবে না। কিন্তু ফোনে বাড়ি ভাড়া নিতে চাওয়া নাইজেরিয় যুবকের কণ্ঠ থেকে সে বুঝতে পারে না লোকটি সাদা না কালো। একটি কবিতায় এক বিপুল ইতিহাসের ছায়া ফেলবার দারুণ কৃতিত্ব দেখান সোয়িংকা। মজার ব্যাপার, এই কবিতাটি বর্তমানে ইংল্যান্ডের স্কুলগুলোতে পাঠ্য। ইংরেজরা তাদের বিগত কৃতকর্ম থেকে এই শিক্ষাই গ্রহণ করে, একই অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে। মরিসনের উপন্যাসের ভয়ংকর-কদাকার ইতিহাসের দিকগুলো তখনই সার্থক বলে প্রমাণিত হবে যখন উপন্যাসের পাঠক মনে করবে, হ্যাঁ, উপন্যাস আসলে ইতিহাসের বিশাল প্রেক্ষাপটে যে-গহ্বরগুলো থাকে যে-শূন্যতা থাকে সেগুলোরই ভরাট রূপ। উপন্যাসে বিধৃত ভায়োলেন্সের মরিসনকৃত চিত্রণ থেকে আমরা অনুভব করি, বিশ্বের যে-কোনো স্থানে যে-কোনো আঙ্গিকেই ঘৃণার জন্ম হতে পারে কিন্তু ঘৃণাটাকে জয় করাটাই হবে মানবজাতির জন্যে একটা বড় বিজয়।
আরও পড়ুন:
“আমার বোন পিয়া। মায়ের দুধ পান করার সঙ্গে-সঙ্গে আমি ওর রক্তও পান করেছিলাম। কোনো শব্দ কানে আসবারও আগে যে-শব্দটা আমার কানে আসতো সেটা হলো হামা দিয়ে ওর সিঁড়ি ভাঙার শব্দ। পল ডি’র আগমনের আগ পর্যন্ত ও-ই ছিল আমার গোপন সঙ্গী। সে এসেই ওকে বিদায় করে দিল। খুব ছোটবেলা থেকেই সে ছিল আমার সঙ্গী। যখন বাবা’র বাড়ি ফেরার জন্যে প্রতীক্ষা করে থাকতাম, ও-ই সাহায্য করতো আমাকে। ও এবং আমি অপেক্ষা করতাম কখন বাবা ফিরবে। মা’কে ভালোবাসি আমি কিন্তু আমি জানি মা তার নিজেরই পেটের একটা মেয়েকে হত্যা করেছিল। আর আমার বোনটা যে আমার সঙ্গে রয়েছে সেই ভয়ে আমি কাবু হয়ে থাকি। মা আমার ভাইদের মেরে ফেলতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে এবং আমার ভাইয়েরা সেটা জানতো। ওরা আমাকে ডাইনি-হত্যার গল্প শোনায়। আমাকে দেখিয়ে দেয় কীভাবে সেটা করতে হয়। আমার যদি কখনও তেমনটা করবার প্রয়োজন পড়ে তাই।”
টনি মরিসনের বিলাভেড উপন্যাস থেকে উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি। পিয়া যে-মেয়েটির নাম সে আসলে মৃত। তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যাকারী তারই জননী। মেয়েকেও যাতে তার মত দাসত্বের শৃঙ্খল বরণ করতে না হয় সেজন্যে শিশুটিকে হত্যা করে সে। কিন্তু জীবনের আগমনকে ঠেকাতে পারে না সেই মা এবং পারে না দাসত্বেরও মূলোৎপাটন করতে কিন্তু তবু এই মৃত্যু ঘটে। আর পিয়া মেয়েটি নিহত হয়েও প্রবলভাবে জীবিত এবং গোটা উপন্যাসে আগাগোড়া তার হত্যাকারী মায়ের এবং আরও বহুজনের অস্তিত্বকে সে কাঁপিয়ে দেয়। মার্কিন গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-১৮৬৫) পরবর্তী কয়েক বছরের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে। আফ্রো-আমেরিকান দাস মার্গারেট গার্নারের জীবনের সত্য ঘটনাকে আশ্রয় করে লেখা বিলাভেড। টনি মরিসন ১৯৭৪ সালে র্যান্ডম হাউজে সম্পাদনার চাকুরি করবার সময়ে গার্নারের কাহিনিটি পড়েন ‘আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট’ (১৮৫৬ সালের একটি সংখ্যায় প্রকাশিত) পত্রিকায়। পরে মরিসন সেটি ছাপেন তাঁর দ্য ব্ল্যাক বুক গ্রন্থে যেটিকে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি আকরগ্রন্থ বিবেচনা করা হয়। বিলাভেড প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আলোড়ন জাগায়। ১৯৮৮ সালে এটি অর্জন করে ‘পুলিৎজার পুরস্কার’, একই বছরে চিত্রায়িত হয় এবং বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব অপরাহ্ উইনফ্রে অভিনয় করেন চলচ্চিত্রটিতে। লক্ষ-লক্ষ কপি বিক্রি হতে থাকে উপন্যাসটির। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার জরিপে উঠে আসে, ১৯৮১ থেকে ২০০৬ এই পঁচিশ বছরের কালপরিধিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসটির নাম টনি মরিসনের বিলাভেড।
বিলাভেড উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে টনি মরিসন কেবল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানই নয় পৃথিবীজুড়ে থাকা দাসত্ব কিংবা বৈরিতায় রুদ্ধ মানবজাতির পক্ষে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। উপন্যাসটি এমনই এক বিভাজনরেখা যে এটিকে সামনে রেখে বলা যেতে পারে- যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ জীবন : বিলাভেড উপন্যাস প্রকাশের পূর্বে এবং পরে। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা ছোট্ট একটি বাক্য যেখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, “সিক্সটি মিলিয়ন এ্যান্ড মোর”। মুহূর্তেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে শুধু কি আমেরিকা-আফ্রিকা কিংবা মরিশাস-ফিজি-অস্ট্রেলিয়া, আমরা চলে যাই সেই খ্রিস্টপূর্বাব্দের গ্রেকো-রোমান পরিপ্রেক্ষিতে। মাঝখানে সমুদ্রের অসীম জলরাশি আর গ্রিসের উত্তর দিক থেকে দাস-মানুষেরা জীবনের অযুত ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে রোমান সাম্রাজ্যে। মরিসনের উৎসর্গপত্রটি হয়তো আটলান্টিক দাস-ব্যবসার পরিণামে নিহত মানুষদের মানবিক গাঁথা তবু বিলাভেড এক বৈশ্বিক বাস্তবতার উপন্যাস। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সেথে’র পিঠে অজ চাবুকের দাগ যে-বৃক্ষের ইমেজ এঁকে দেয় সেটি যেন সমগ্র মানবজাতির জন্যে একটি ‘জিনিয়ালজিক্যাল ট্রি’ যেখান থেকে গ্রহণ করতে হয় মানবিকতার প্রকৃত পাঠ। বিলাভেড উপন্যাসটি নিজেই জন্ম দিয়েছে অনেক ইতিহাসের। এর ক্যানভাসে চিত্রিত ভয়াবহতাকে সবাই যে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল তা কিন্তু নয়। আটচল্লিশজন আফ্রো-আমেরিকান লেখক স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবাদপত্র ছাপা হয় নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়Ñ উপন্যাসটির সপক্ষে এবং শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণাঙ্গ হয়েও মরিসন অর্জন করে নেন বিখ্যাত সব পুরস্কার। অনেকেই এটিকে ভূতের গল্পের কারিগরি-আশ্রিত শিল্পকর্ম রূপে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার, সেথে’র কন্যা পিয়া’র চরিত্রটি বাস্তব না সে পুনরুত্থিত আত্মা সেটা উপন্যাসে খানিকটা সংশয় বা ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে বটে কিন্তু এই চরিত্রায়ণ উপন্যাসটিকে বরং আরও তীব্রতা দেয়। ২০০৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি স্কুল বিলাভেড উপন্যাসের পাঠ নিষিদ্ধ করে তাদের শিক্ষায়তনে। শুধু তা-ই নয় বহু স্কুলে-কলেজে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে উপন্যাসটির বিরুদ্ধে ঘোরতর আপত্তির কথা জানা যায়। সবার একটাই কথা, এতে আছে বর্বরতা, শিশুহত্যা, যৌনতা এবং সন্ত্রাস। কিন্তু এটাও তো সত্য এসবের স্রষ্টা টনি মরিসন নন, ইতিহাসের মানুষেরাই। এতকাল তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় নি কেউ, কিন্তু এত বিশাল অন্যায় আর অমানবিকতাকে কোনোভাবেই যে ছাড় দেওয়া চলে না সেটাই করে দেখিয়েছেন জীবনবাদী টনি মরিসন।
আরও পড়ুন:
বলেছি, টনি মরিসনের সব উপন্যাসই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি, সমষ্টি, জাতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সন্ত্রাস যাকিছুই আমরা বুঝতে চাই না কেন তার একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপট প্রয়োজন। টনি মরিসনের উপন্যাস হলো সেই প্রেক্ষাপট- সমগ্র বিশ্বের জন্যে। জাজ-এ তিনি তাঁর আফ্রিকা-সত্তা থেকে পাওয়া সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তিকে ব্যবহার করেন আঙ্গিক হিসেবে। জাজ-সঙ্গীতের টুকরো-টুকরো নোটেশনের মত দৃশ্য-চরিত্র-সংলাপ নির্মিত হয় এতে। প্যারাডাইস উপন্যাসে দেখা যাবে সামাজিক নারী-অবস্থানের চমৎকার নিরীক্ষা। ২০০৮-এ প্রকাশিত এ মার্সি উপন্যাসের কথা বলা যায় যেখানে আমেরিকার প্রাথমিক পর্বের দাসজীবনকে নতুনভাবে চিহ্নিত করা হয়। এতে নারী-সত্তার প্রবল শক্তির পরিণতি মাতা এবং কন্যার চরিত্রে বিধৃত। সেই সঙ্গে মার্কিন জীবনের নেপথ্যে যেসব অন্ধকারাবৃত ইশারার সংস্থান সেগুলোকে তুলে আনা হয় সাহসের সঙ্গে। এতে বাইবেলের ধার্মিকতার উপজীব্যও প্রতীকতায় ধরা পড়ে। মোটকথা পাঠকের প্রাণের মানুষ বা ভালোবাসার মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবেন টনি মরিসন।#