যে কজন কবি বাংলা সাহিত্যে ভিন্ন ধারায় পথ অন্বেষণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন নিখিলকুমার সরকার। সত্তর দশক থেকে কবিতা চর্চা করলেও নিজেকে নিভৃতে রেখেছেন। কম লেখার চেষ্টা করেও ব্যতিক্রমী হয়েছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘ঋতু, রতি এবং অন্যান্য'(প্রথম প্রকাশ ২০২০) বাংলা কবিতা পাঠকের কাছে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা এনে দিতে সক্ষম। চার ফর্মার কাব্যগ্রন্থটি বেশ ঋজু স্মার্ট আবেদনময়ী তরতাজা যুবতীর মতো।
নিখিলকুমার সরকার কবিতায় আত্মা স্থাপন করেছেন ভেতর থেকে, বাহিরের জৌলুসে তাকে স্পর্শ করা যায় না। গদ্য চালে সাংকেতিক ভাষার কথন ভঙ্গিতে এবং কোথাও সংলাপধর্মী আবেদনে কবিতায় অনন্যতা এনেছেন। মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াগুলির দ্বান্দ্বিক পারম্পর্যকেও কথন ভঙ্গির অন্তরালে প্রতিস্থাপন করেছেন। গতিময় রোমান্টিকতার সাথে অন্তর্দ্বন্দ্বের ভাঙনগুলিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আত্মক্ষরণের অমোঘ পর্যটনে মানব প্রবৃত্তির আশ্চর্য ও আদিম চেতনাকে তিনি ভাষা দিতে পেরেছেন। তবে এই কাব্যের কবিতাগুলি অনেকটাই পরীক্ষিত— কখনও সনেটের মধ্য দিয়ে, কখনও আখ্যান-উপাখ্যানে কবি নিবিষ্ট হয়েছেন। ঋতুকে জীবনের ঋতুতে বদলে দিয়েছেন। আবার জীবনের ঋতু—প্রকৃতির সমূহ ঋতুতেই চিরন্তন বসন্তকে বহন করে নিয়ে গেছে। নয়া বিশ্বের কবি অ্যান ব্র্যাডস্ট্রিট (১৬১২-১৬৭২) লিখেছেন: “If we had no winter, the spring would not so be pleasant.” অর্থাৎ আমাদের যদি শীত না থাকত, বসন্ত এত আনন্দদায়ক হত না। শীতের মধ্যেও বসন্ত বেঁচে থাকে। ‘বসন্ত’ সিরিজের কবিতাগুলিতে অনন্ত জুড়ে দখিন দুয়ার খুলতে দেখা যায়। কবি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন:
“এখন সব ঋতুতেই কোকিল কড়া নাড়ে বন্ধ দরজায়—
বসন্ত ফেরি করে….”
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেজ বক্সে কুহু ডাকের নতুন প্যাকেজ থাকে। তাই বর্ষাতেও কোকিলের অভাব হয় না। শীতেও কোকিল ফিরে আসে। পুঁই-লাউডগার সঙ্গে বিরহিনী শ্যামাও অপেক্ষা করে। বসন্ত ঋতুর সঙ্গে বসন্ত দলুই যুবকেরও নাম মিলে যায়। বসন্তের প্রতীককে নিখিলকুমার সরকার লিখলেন এভাবেই :
“শীতের কবিতায় বিড়ালের অনিবার্য অনুপ্রবেশ ঘটে
তাদের বিমূর্ত থাবার আনাগোনায় কবিতার স্পেসগুলি
নানা রঙের কুয়াশায় ভরে যায়”
এই বিড়াল বসন্ত বাহক যৌনতার প্রতীক। তার রহস্যময় গতিবিধি চিরদিন একই রকম থেকে যায়। তাই কবি বলেন:’বিড়ালগুলি অদ্যাবধি অচেনাই রয়ে গেছে।’ বিড়ালের বৈশিষ্ট্য হল তার ‘বন্যগন্ধ’। তাই বিড়াল আদিম, চতুর, দ্রুতগামী এবং নিঃশব্দে চলাচলকারী। বিড়ালের গন্ধে নকশিকাঁথাদের ঘুম ভেঙে যায়। মেটাফিজিক্যাল ব্যবহারে অন্তর্গত যৌনচেতনাকে কবি জাগ্রত করেন। পাকিস্তানের করাচিতে জন্ম হ্যাজেল নিকলসন(১৯৩৬) চাইল্ডহুড স্টোরিতে লিখেছেন: ‘A cat is a puzzle for which there is no solution’ অর্থাৎ একটি বিড়াল একটি ধাঁধা যার কোনও সমাধান নেই। এই কাব্যের ‘বিড়াল’ প্রতীকটিও এক সমাধানহীন বিমূর্তসঞ্চার প্রবহমান জীবনে বাহিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই শীতের কবিতায় বসন্তের বিনির্মাণ চলেছে:
“ফুল ফুটেছে অথবা ফোটেনি, আজ বসন্ত এসে গেছে”
এই বসন্তকে ধারণ করেছে মানবপ্রতীকের ‘যশোদি’ নাম্নী এক রমণী। তার কুমারীকাল থেকে মধ্যবয়স্কা হয়ে ওঠা পর্যন্ত মনন-দর্শনে উপলব্ধির স্পন্দন ধ্বনিত হয়েছে। তার খরায় অনন্ত ধরিত্রীর শুষ্কতা ধরা পড়েছে। আর স্বপ্ন অনন্ত বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেছে। তার সফলতা অনন্ত অঙ্কুরোদগমের আকাঙ্ক্ষা করেছে। ‘বৃষ্টি-সম্ভূত যশোদি’ সিরিজের কবিতাগুলিতে যৌনতার গোপন ইশতেহার কবি রচনা করেছেন বৃষ্টিকে কেন্দ্র করেই। জেবি স্যারের সঙ্গে সম্পর্কের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া ইঙ্গিতময় হয়ে উঠেছে। ‘মেঘ’ অর্থে জেগে উঠেছে যৌবন। ‘বর্ষণ’ অর্থে প্রেম। ‘বৃষ্টি’ অর্থে আবেগ। কবি এইভাবে পরিচয় দিয়েছেন:
“এরা সেই মেঘ, যারা পাঠ্যক্রম শেষ না হতেই ইশকুল-ছুট
এরা শুনতে পায় না বয়ঃসন্ধি পেরোনো বীজতলার বাঁশি
খরাক্লিষ্ট মিথুনপথের ঠিকানা এদের অচেনাই থেকে যায়
জানো না, ঠিক কখন কোথায়, সে কোন শৃঙ্গারে
ঝরে পড়তে হয় শূন্য থেকে শূন্যতায়”
স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষায় বৃষ্টিকে লুকিয়ে রাখাও যায়। কিন্তু কিছু বৃষ্টি ঠিকানা পায় না। নিজস্ব উপলব্ধিতে মেঘকে ডেকে নেয় যশোদিও। সব মেঘে যেমন বৃষ্টি হয় না, তেমনি বিনা মেঘেও বৃষ্টি হয়। রহস্যময় অস্তিত্ব কথায় মেঘকে লিখতে থাকেন। কখনও ‘ডোবারম্যান’ সুরের জাদু নিয়ে প্রেমিক ফিরে আসে। কখনও আবার হারিয়ে যায়। ডোবারম্যানও এক আবেগ। আবেগে সিলেবাস বহির্ভূত পাঠদান করেন জেবি স্যার। ‘টিচার’ থেকে হন ‘মলেস্টার’। যশোদি ভিজতে থাকে তখন। তার নিষিদ্ধ পরিক্রমা চলতে থাকে।
জীবনের মূল স্রোতকে তুলে আনেন নিখিলকুমার সরকার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্য-শিল্প আন্দোলনের কিউবিজম ধারাকেও তিনি উজ্জীবিত করে তোলেন। এক্ষেত্রে কবির সৃষ্ট জগৎই মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। কবিই সৃষ্টি করেন তাঁর নিজস্ব বাস্তবতা। শিল্প ও প্রকৃতি সমান্তরালভাবে গড়ে ওঠে। কবি একটি গল্পের বাতাবরণে লিখেছেন—পথ ভোলা এক বাঘিনির জন্য একটা আপেল কিনেছেন। তারপর তিনি বলেছেন:
“এক একটা কামড়ে একটু একটু করে আপেলটা ফুরিয়ে যাচ্ছে
বাঘিনি খাচ্ছে, আমি দেখছি”
কবিতার শেষে লিখেছেন:
“এই কবিতাটি জানে— প্রকৃতপক্ষে আপেল নয়, ওই নিম্নবিত্ত দৃশ্যটিই”
এইদৃশ্য একটি ছবি যা একজন শিল্পী আঁকতে পারেন এবং এই ছবিটি শিল্পীর নিজস্ব বাস্তবতা। এই বাস্তবতা ‘শূন্যতার পদাবলি’ হিসেবেই রচিত হয়েছে আত্মরতির ঘোষণায়। আত্মনিগ্রহ থেকে নিজেকে মুক্তি দেওয়ার প্রজ্ঞা। একেই কবি বলেছেন ‘অস্তিত্বের দ্বৈতযাপন’। মনুষ্যজীবনের রাগবৈরাগ্যের ভেতর পঞ্চইন্দ্রিয় খোলা রেখেও নিজেকে ‘কাকতাড়ুয়া’ হিসেবে দেখেছেন। আত্মরতির শীৎকারেই ক্ষেত্রগর্ভ পূর্ণ করেছেন। আবার পঞ্চভূতে বিলীন হবার মধ্য দিয়েই শূন্যতার পদাবলির উপসংহার টেনেছেন। ডুবসাঁতারের অতল ভ্রমণে আত্মঅন্বেষণে কবিতাকে করে তুলেছেন জীবনের স্ক্রিপ্ট। কিন্তু এই স্ক্রিপ্ট সর্বদাই অসম্পূর্ণ। জীবনে কখনও পূর্ণতা আসে না কবিও তা জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং অফস্ক্রিন অনস্ক্রীন জুড়ে গুগল সার্চের মুহূর্তগুলি বোধের তীব্রতায় জীবনের বিভিন্ন পর্যায়কে তুলে এনেছে যা সার্চ ফর ট্রুথ, কবি বলেছেন:
“তুমি হয়ে উঠবে সত্যান্বেষী”
এই সত্যান্বেষণই কবির সাধনা।
“কিন্তু এ যাবৎ অরূপরতনের সন্ধান পাইনি”
সন্ধান কি আদৌ পাওয়া যাবে? এই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। দ্বিধাদ্বন্দ্বের সংঘাতে পর্যুদস্ত কবি বহু সত্তার বহুমুখী পর্যটনে আত্মশরণের প্রজ্ঞাময় চিত্রকল্পে তাঁর ভাবনাকে বিস্তৃতি দান করেছেন। বাৎসায়নের আকাশের প্রমত্ত মেঘকে যেমন দেখেছেন, তেমনি তাঁর জীবনীশক্তির প্রাচুর্যকে আত্মরতির ব্যাপ্তিতে মহীয়ান করে তুলেছেন। যৌনতাও তাই শেষ পর্যন্ত সৃষ্টির স্বয়ংক্রিয় প্রেরণা হয়ে উঠেছে। নিজেকে দেখার এবং জগৎকে দেখার আয়নার সামনেই কবি আমাদের দাঁড় করিয়েছেন।
ঋতু, রতি এবং অন্যান্য: নিখিল কুমার সরকার, রবি প্রকাশ, ৫৭-বীরনগর( উৎস-১), বাঘাযতীন, কলকাতা-৮৬, মূল্য-১২৫ টাকা। প্রচ্ছদ:কৌশিক গুড়িয়া।