প্রাচীন ভারতে গণিকার স্তর

শুরুতেই প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে প্রাপ্ত ‘গণিকা’ শব্দের প্রতিশব্দগুলির দিকে নজর দেওয়া যাক:—
(১) ঋগ্বেদ— হস্রা (৪:১৬:১৯:৩০), অগ্রু (৪:১৯:৯), সাধারণী (১:১৬৭:৪; ২:১৩:১২, ১৫, ১৭)।
(২) অথর্ববেদ— পুংশ্চলী (১৫:১:৩৬; ২০:১৩৬:৫)।
(৩) শুক্লযজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতা— সাধারণী ও সামান্যা (৩০:১২); ব্রজয়িত্রী, অর্থাৎ— যে আনন্দ দেয় (৩০:১)।
(৪) কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতা— সাধারণী ও সামান্যা (৩:৪৭)।
(৫) তৈত্তিরীয়ব্রাহ্মণ— অতিস্কদ্বরী ও অপস্কদ্বরী, অর্থাৎ— যে (নিয়ম) উল্লঙ্ঘন করে (৩:৪:১১:১); ব্রজয়িত্রী (৩০:১)।
(৬) বিনয়পিটক— মুহুত্তিয়া (সংস্কৃত ভাষায়— মুহূর্তিকা), অর্থাৎ— যে ক্ষণকালের সঙ্গিনী (৩:১৩৮)।
(৭) জাতক— রূপদাসী, বগ্নদাসী, বেশ্যা, নারিষের, গামনী ও নগরশোভিনী ইত্থি এবং জনপদকল্যাণী (১:৪৩, ২:৩৮০; ৩:৫৯-৬৩, ৬৯-৭২; ৪৭৫:৮)।
(৮) অর্থশাস্ত্র— রূপদাসী ও বন্নদাসী (২:২৭), এঁরা অন্য প্রধানা গণিকার অধীনে অথবা স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থীকে আপ্যায়ন করতে পারতেন।
(৯) মহাকাব্যদ্বয় ও বিভিন্ন প্রাচীন পুরাণ— কুলটা, স্বৈরিণী, বারাঙ্গনা, বারস্ত্রী, বারবনিতা, স্বতন্ত্রা ও স্বাধীনযৌবনা। এছাড়া নটী, শিল্পকারিকা, কুন্তদাসী এবং পরিচারিকা শব্দকেও বিভিন্ন প্রাচীন পুরাণে মাঝে মাঝেই গণিকার প্রতিশব্দ হিসেবে দেখা হয়েছিল।
(১০) বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’— গণিকা ও রূপাজীবা (৭:৬:৫৪)।
(১১) জটাধরের ‘শব্দরত্নাবলী’ অভিধান— শালভঞ্জিকা, বারবাণী, বর্বটী, ভণ্ডহাসিনী, কামরেখা, শূলা এবং বারবিলাসিনী।
(১২) ‘শব্দমালা’ অভিধান— লঞ্জিকা।
(১৩) ‘বৈশিকতন্ত্র’— বৃষলী (অভিধাগত মুখ্য অর্থ হল শূদ্রা এবং গৌণ একটি অর্থ হল গণিকা– প্রাচীন ভারতে শূদ্রবর্ণের নারীকে অন্য বর্ণের ভোগ্যা বলে মনে করা হত), পাংশুলা (মলিনা), লঞ্জিকা, বন্ধুরা, কুত্তা (শূলার মত একটি বিদ্ধ করবার অস্ত্র), কামরেখা, বর্বটী ও রণ্ডা (এই বিটের রক্ষিতা)।
(১৪) হেমচন্দ্রের ‘অভিধানচিন্তামণি’— সাধারণস্ত্রী, পণ্যাঙ্গনা, ক্ষুদ্রা, ভুঞ্জিকা ও বারবধূ।
(১৫) ‘রাজনির্ঘণ্ট’ অভিধান— ভোগ্যা ও স্মরবীথিকা।
(১৬) অমরকোষ— বেশ্যা, বারস্ত্রী, গণিকা ও রূপজীবা।
(১৭) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের প্রকৃতি খণ্ডের ২২৭-২৮ অধ্যায় অনুসারে—
(ক) পতিব্রতা হল একপত্নী,
(খ) স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষের প্রতি আসক্ত নারী হল— কুলটা,
(গ) কোন নারী তিনজন পুরুষের প্রতি হলে আসক্ত হলে— বৃষলী বা পুংশ্চলী,
(ঘ) কোন নারী চার থেকে ছ’জন পুরুষের সঙ্গিনী হলে— বেশ্যা,
(ঙ) কোন নারী সাত থেকে আটজন পুরুষের সঙ্গিনী হলে— যুঙ্গী,
(চ) এর থেকে বেশি সংখ্যার পুরুষের সঙ্গিনী হলে সেই নারী— মহাবেশ্যা এবং সকল বর্ণের মানুষের অস্পৃশ্য।

এছাড়া বৈদিক ভারতে কোন পুরুষ ও নারী তাঁদের দু’জনের সম্মতিক্রমে নিজেদের বিবাহগণ্ডির বাইরে অবৈধ কোন সম্পর্কে লিপ্ত হলে তাঁরা যথাক্রম— ‘জার’ ও ‘জারিণী’ —বলে অভিহিত হতেন। এই শব্দ দুটি ঋগ্বেদে বহুবার, এমনকি উপমায় উপমানরূপেও ব্যবহৃত হয়েছে বলে দেখা যায়। কাজেই ঋগ্বেদের যুগের ভারতীয় সমাজে বিবাহিত নরনারীর ‘অবৈধ’ প্রণয় নিশ্চিতভাবে একটি পরিচিত ঘটনাই ছিল।

বলা বাহুল্য যে— উপরে গণিকা শব্দটির যেসব প্রতিশব্দের উল্লেখ করা হয়েছে, উদ্ভব একসময়ে হয়নি, এক জায়গাতে হয়নি; বরং ধীরে ধীরে আঞ্চলিক ও কালিক বিকল্পের মধ্যে দিয়েই এই শব্দগুলির সৃষ্ট হয়েছিল।
ভারতবর্ষে গণিকাবৃত্তি ঠিক কত প্রাচীন? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে, ভারতবর্ষে শুধু নয়, যখন থেকে পৃথিবীর সর্বত্রই আদিম মানুষের গোষ্ঠী ও কৌম ভেঙে গিয়ে পরিবারের পত্তন ঘটেছিল; অর্থাৎ— নারীর উপরে যখন পুরুষের স্বত্বাধিকার সমাজ মেনে নিতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই গণিকাবৃত্তির শুরু হয়েছিল। সমাজবিজ্ঞানের গবেষকদের অন্ততঃ সেটাই মত। আর তখন থেকেই পরিবারের নির্দিষ্ট সীমার বাইরে কোনও নারী যখন অন্য পুরুষকে অর্থ বা বস্তু প্রাপ্তির বিনিময়ে নিজের দেহদান করতে শুরু করেছিলেন, তখন তিনি গণিকা বলে চিহ্নিত হয়েছিলেন। তবে গবেষকদের মতে— এর মধ্যেও প্রথম পর্যায়ে নিশ্চই নানা স্তর ছিল; যেমন— আগেই বলা হয়েছে যে— ঋগ্বেদের যুগের ভারতে কোন পুরুষ ও নারী তাঁদের দু’জনের সম্মতিক্রমে নিজেদের বিবাহগণ্ডির বাইরে এমনতর সম্বন্ধ ঘটলে তাঁরা যথাক্রমে— ‘জার’ ও ‘জারিণী’ —বলে অভিহিত হতেন।

এছাড়াও ঋগ্বেদে নানা বিকল্প সম্পর্কের চিহ্নও দেখতে পাওয়া যায়। তবে উপহারের বিনিময়ে মিলনকে গণিকাবৃত্তি নাও বলা যেতে পারে, কারণ— উপহার প্রীতির চিহ্ন হওয়াও সম্ভব। ইতিহাসে সেই উপহার কখন মূল্যের বিকল্প হয়েছিল— আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে সেকথা নির্ধারণ করা কঠিন; কারণ— প্রাক-মুদ্রা সমাজের অর্থনীতিতে বস্তু সবসময়েই অর্থের বিকল্প হিসেবে গণ্য হয়েছিল; এবং বস্তুকে যেমন মূল্যরূপে দেওয়া সম্ভব, তেমনি প্রীতি উপহাররূপেও দেওয়া সম্ভব। কাজেই একথা মনে করা যেতে পারে যে— সুদূর অতীতে বিবাহ সম্পর্কের বাইরে কোন বিবাহিতা বা অবিবাহিতা নারী যখন কোন বিবাহিত বা অবিবাহিত পুরুষের ইন্দ্রিয়তৃপ্তিবিধানের মূল্যরূপে কোন অর্থ বা উপহার গ্রহণ করতেন, সেই মূল্যগ্রহণ তিনি মাঝে মাঝেই করুন বা নিয়মিত কোন বৃত্তিরূপেই করুন— তখন সেটিকেই তাঁর গণিকাত্বের লক্ষণ বলে চিহ্নিত করা হত। কাজেই প্রাচীন ভারতে গণিকাবৃত্তি— সামাজিক বিবাহবন্ধনের বাইরে একটি নিয়ামক লক্ষণ এবং মূল্যগ্রহণ —এই দুটির দ্বারা চিহ্নিত ছিল। তবে ঋগ্বেদের জার বা জারিণী, উপপতি বা উপপত্নী কিংবা অবৈধ প্রণয়ী বা প্রণয়িনী— কোন ধরণের মূল্য দান বা গ্রহণ করা দ্বারা চিহ্নিত হননি বলে তাঁদের এইধরণের সম্পর্কে গণিকাবৃত্তি বলা যেতে পারে না।

নারী কিভাবে মূল্যের বিনিময়ে নিজের দেহদান করতে শুরু করেছিল? বর্তমানে এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেওয়া সম্ভব না হলেও, একথা অবশ্যই বলা যেতে পারে যে— প্রাচীন সমাজে বিবাহ ও পরিবার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে নারী যখন নিজের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলেছিল, তখন থেকেই এই বৃত্তির শুরু হয়েছিল। একথার উদাহরণস্বরূপ প্রাচীন ভারতীয় সূত্রসাহিত্যের একটি শ্লোককে উপস্থাপিত করা যেতে পারে—
“পিতা রক্ষতি কৌমারে, ভর্তা রক্ষতি যৌবনে
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বতন্ত্রমহর্হতি।”
অর্থাৎ— কৌমারে পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্র নারীকে রক্ষা করবেন; নারী স্বাধীনতার যোগ্য নন। এবং পিতা, স্বামী বা পুত্রের রক্ষণীয়া, অর্থাৎ— যথাক্রমে লালনীয়া যখন ভোগ্যা-ভরণীয়া এবং পোষণীয়া হয়ে উঠতেন, তখন এসব সামাজিক বন্ধনের বাইরে মূল্য দিয়ে যাঁকে পাওয়া যেত, তিনিই ছিলেন গণিকা। এর সঙ্গে বা অনুক্রমে আরও যে ব্যাপারটি প্রাচীন ভারতে গণিকাবৃত্তির প্রসারে সহায়তা করেছিল, সেটা ছিল— তৎকালীন সমাজে কিছু মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত বিত্তের সঞ্চয়, যে সঞ্চয় তাঁরা তাঁদের জীবনধারণের প্রয়োজন মেটাবার পরে নিজেদের বিলাস ও সম্ভোগের কাজে ব্যয় করতে পারতেন।

উপরের তালিকায় গণিকার যে প্রতিশব্দগুলি দেওয়া হয়েছে, সেগুলি কিন্তু পর্যায়শব্দ নয়; সেগুলির মধ্যেও স্তরবিভাগ ছিল।

‘কুরুধম্মজাতক’ গ্রন্থানুযায়ী প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রের সবথেকে নিচু কর্মচারী ছিলেন দ্বারিক (দরওয়ান) এবং গণিকার অবস্থান তাঁরও নিচে ছিল। আবার উক্ত গ্রন্থানুসারে গণিকাই কিন্তু ওই বৃত্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ শ্রেণীর নাম ছিল। এই গ্রন্থানুসারে গণিকার আরেকটি নাম হল— নগরশোভিনী বা জনপদকল্যাণী। প্রাচীন ভারতের জনপদগুলোর জনসংখ্যা বেশি ছিল না অনুমান করে নিয়ে বলা যেতে পারে যে, তখন একটা সম্পূর্ণ জনপদের সাধারণভাবে ভোগ্যা নারীকেই— জনপদকল্যাণী —নামে অভিহিত করা হত। কল্যাণ শব্দের আদিমতম অর্থ হল— সুন্দর, গবেষকদের মতে শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Kale’–র পর্যায়বাচক। অনুমান করা যেতে পারে যে— কোন জনপদের শ্রেষ্ঠা সুন্দরী যাতে শুধুমাত্র একজনের ভোগ্যা না হন, তাই সেই জনপদকল্যাণী— সাধারণী —ছিলেন। অর্থশাস্ত্র, কামসূত্র এবং অন্যান্য গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের গণিকা সম্পর্কে যেসব ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়, সেসব অনুসারে— গণিকার স্থান তখন সমাজে সবথেকে ওপরে ছিল; শুধু সেটাই নয়— রূপে, যৌবনে ও শিক্ষাদীক্ষায় গণিকাই তখন শ্রেষ্ঠ ছিলেন। (কামসূত্র, ১:৩:২০) তাঁদের নিচে ছিলেন— রূপাজীবা–রা, যাঁরা শিক্ষাদীক্ষা ও রূপযৌবন, ধনসম্পদ এবং সামাজিক প্রতিপত্তিতে গণিকার থেকেও নিচে অবস্থান করতেন। তারও নিচে ছিলেন— বেশ্যা, এই নামটি থেকেই বুঝতে পারা যায় যে— বস্ত্রালংকার ও সাজগোজই তাঁদের মূলধন ছিল।

সেযুগে— গণিকারা যখন গণিকালয়ে বাস করতেন, তখন রাষ্ট্র তাঁর শিক্ষার ব্যয়বহন করত এবং তাঁর আয় থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে রাজস্ব আদায় করত; এমনকি কৌটিল্য তাঁর গ্রন্থে বার্ধক্যে গণিকাকে কিছু বৃত্তি দেওয়ারও ব্যবস্থাও রেখেছিলেন। অর্থাৎ— গণিকার তখন প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব এং অধিকার— দুটোই ছিল।

অন্যদিকে কোন রূপাজীবার শিক্ষার দায় তাঁর নিজের বা তার মায়ের অথবা তাঁর গ্রাহকের ছিল। এছাড়া তখন অবরুদ্ধা, অর্থাৎ— রক্ষিতাও ছিলেন, যাঁর সমস্ত দায়িত্ব তাঁর পৃষ্ঠপোষকের ছিল; অর্থাৎ— যে ব্যক্তি তাঁর আর্থিক সব দায়িত্ব বহন করতেন এবং সেসবের বিনিময়ে তিনি একাই তাঁর কাছে যেতে পারতেন, এহেন নারীর সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্য এবং আর্থিক অবস্থা সম্পূর্ণভাবে সেই একজন পৃষ্ঠপোষকের আর্থিক অবস্থা এবং মর্জির ওপরেই নির্ভর করত।

তবে এখানেই শেষ নয়। এদের নিচে ছিলেন নানারকমের বৃত্তিধারিণী; যথা— সৈরিন্ধ্রী, শিল্পকারিকা বা শিল্পদারিকা কৌশিকস্ত্রী, কুম্ভদাসী, বগ্গদাসী, রূপদাসী, নটী, ক্ষুদ্রা, ভুঞ্জিকা, ইত্যাদি। এঁরা মূলতঃ কোন রাজপ্রাসাদে বা কোন ধনীর প্রাসাদে নিজের শিক্ষা অনুসারে কায়িক শ্রম করে জীবিকানির্বাহ করতেন, তবে এঁদের প্রত্যেকেই কিন্তু আবার গৃহস্বামীর ভোগ্যও ছিলেন।

তবে তালিকার শেষ এখানেই নয়। কারণ, এর নিচে ছিলেন— অশিক্ষিতা, অর্ধশিক্ষিতা, রূপহীনা, বিগত যৌবনা ও নির্বিত্ত বৃহৎ একটি রূপোপজীবিনীর দল। এঁদেরকেই প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে— পুংশ্চলী, কুলটা, স্বৈরিণী, বারবণিতা —ইত্যাদি নাম অখ্যাত করা হয়েছিল। এছাড়া গবেষকদের মতে— বারমুখ্যা, বারাঙ্গনা, বারস্ত্রী —এসবই হল এঁদের পর্যায়বাচক শব্দ, এখানে বার অর্থ হল— যাঁরা পালা অনুসারে পারিশ্রমিক নিতেন।

আয়ের পরিমাপ থেকেও প্রাচীন ভারতীয় সমাজে গণিকার সামাজিক অবস্থানটা বোঝা সম্ভব। গণিকারা তখন রাষ্ট্র থেকে মাসিক ১০০০ পণ বেতন পেতেন, এছাড়া তাঁদের চতুঃষষ্টিকলা শিক্ষা করাবার জন্য রাষ্ট্র নিজের ব্যয়ে বিভিন্ন শিক্ষক নিযুক্ত করত। প্রাচীন বৌদ্ধসাহিত্যে দেখা যায় যে— গণিকা সালাবতীর জন্য তাঁর মা সিরিমা একরাত্রে ১০০০ কাহাপণ (কার্যাপণ = স্বর্ণমুদ্রা) নিতেন। সামাজাতকে বলা হয়েছে যে— কাশীর গণিকা সামার ৫০০ জন অনুচারিণী ছিলেন (জাতক৩:৫৯-৬৩), গবেষকদের মতে তাঁরা সম্ভবতঃ গণিকাদাসী ছিলেন। গণিকা আম্রপালীর দক্ষিণা নিয়ে রাজগৃহ ও বৈশালীর মধ্যে তো রীতিমতো কলহ হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞাত ধর্মকথা নামের একটি প্রাচীন জৈন গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, কোন সর্বাঙ্গসুন্দরী ও শিক্ষিতা গণিকা তখন প্রতি রাত্রে সহস্র কার্যার্পণ যায় করতেন। ‘মৃচ্ছকটিক’ গ্রন্থে পাওয়া যায় যে— একবার বসন্তসেনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজশ্যালক শকার দশ হাজার টাকার গহনাসমেত গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই তখন সামাজিকভাবে ওপরের স্তরে থাকা— রূপযৌবন,যশ ও অর্থে প্রখ্যাত গণিকার আয়ের কোনও লেখাজোখা ছিল না। এমনকি তাঁদের দানের পরিমাণ দেখলেও সেকথা বুঝতে পারা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে— তাঁদের মধ্যে কেউ যেমন বুদ্ধ ও তাঁর একসহস্র শিষ্যকে আহারে আমন্ত্রণ করেছিলেন এবং অর্থ দিয়ে পরিতৃপ্ত অতিথিদের প্রয়োজন মিটিয়ে দিয়েছিলেন, তেমনি কেউ আবার আস্ত আমবাগান দান করেছিলেন, তো কেউ আবার মঠ, বিহার, কানন, চৈত্য, স্তূপ, সেতু, কূপ, চিত্রশালা বানিয়ে দিয়েছিলেন। অবরুদ্ধারা তখন নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদন ছাড়াও প্রতি মাসে এক পণ নগদ হাতে পাতেন। কিন্তু বিগত যৌবনা, রূপহীনা ও অশিক্ষিতা গণিকার যে বৃহৎ দলটি তৎকালীন সমাজে ছিল, সমকালীন গণিকাজগতেও তাঁরা অপাঙক্তেয় ছিলেন। সেই পুংশ্চলী স্বৈরিণীদের কাছে যাঁরা যেতেন, তাঁরা তাঁদের যা কিছু দিতেন— সেটাই তাঁদের গ্রহণ করতে হত। তাঁরা যেহেতু সংখ্যায় বেশি হলেও কম আকর্ষণীয়া ছিলেন, সেহেতু তাঁদের চাহিদা এবং মূল্যও কম ছিলেন। ফলে তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই খুবই দরিদ্র ছিলেন, এবং গ্রাসাচ্ছাদন করাটাই তাঁদের সবথেকে বড় সমস্যা ছিল।

এছাড়াও তখন দেবদাসীরা ছিলেন, যাঁদের অন্য নাম ছিল— ত্রিদশালয়বনিতা। গবেষকদের মতে প্রাচীন গ্রিস, রোম, মিশর, ফিনিশিয়া, কলডিয়া, ব্যাবিলন এবং ভারতবর্ষ— সর্বত্রই মন্দিরগণিকার একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। অতীতে যেখানেই নগর-সভ্যতার পত্তন ঘটেছিল এবং কোনও কোনও মন্দির সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছিল, সেখানেই দেবদাসীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল বলে দেখা যায়। প্রাচীন ভারতে মন্দিরপুরোহিত রাষ্ট্রর কাছ থেকে যে বৃত্তি পেতেন, সেটা দিয়ে তিনি দেবদাসীদের ভরণপোষণ করতেন; এছাড়া কখনও কখনও দেবদাসীরাও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বৃত্তি পেতেন। দামোদরগুপ্তের ‘কুট্টনীম’ গ্রন্থে দেবদাসীদের রাষ্ট্র কাছ থেকে বৃত্তি পাওয়ার কথা পাওয়া যায়। অন্যদিকে ‘সংযুক্তনিকায়’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে— তাঁরা খাদ্যশস্য পেতেন। খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের জোগিমারা গুহালিপিতে রূপদক্ষ দেবদত্তের দেবদাসী সুতনুকার প্রতি প্রেমের উল্লেখ পাওয়া যায়। পূজা আরাত্রিকের সময়ে মন্দিরে বা মন্দির প্রাঙ্গণে দেবতার উদ্দেশ্যে নৃত্য করাই দেবদাসীদের কাজ ছিল, এবং এটিই তখন তাঁদের মুখ্য করণীয় ছিল। এরই বিনিময়ে তাঁরা তখন বৃত্তি, খাদ্যশস্য বা ভরণপোষণ পেতেন। এছাড়া তাঁদের গৌণ অথচ সর্বজনবিদিত ভূমিকা ছিল— মন্দিরের পুরোহিতের কামনা চরিতার্থ করা। দেবদাসী তরুণী, সুন্দরী ও নৃত্যকুশলা হলেই চলত; কিন্তু— গণিকা বা রূপজীবারা এবং কখনও কখনও অবরুদ্ধার পাঠ্যতালিকা দীর্ঘ ছিল। পুণ্যবিজয়জি ভাবনগর রচিতজৈন গ্রন্থ— ‘বৃহৎকল্প’ —অনুসারে তাঁদের— লেখা, গণিত, নানারকমের শিল্প, সংগীত, বাদ্যযন্ত্র (বীণা, পটহ, বংশী, ইত্যাদি), দ্যুতক্রীড়া, অক্ষক্রীড়া, কাব্যরচনা (সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ), গন্ধযুক্তি (আতর তৈরি) অলংকারনির্মাণ, সজ্জা, অলংকরণ, সুলক্ষণ ও দুর্লক্ষণ পুরুষ ও নারীর বিচার, অশ্ববিদ্যা, হস্তীবিদ্যা, রন্ধনবিদ্যা, রত্নপরীক্ষা, বিষনির্ণয় ও প্রতিবিধান, স্থাপত্য, শিবির নির্মাণ, সেনা সন্নিবেশ, যুদ্ধবিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা, নিমিত্তনিদান-সহ ইত্যাদি মোট বাহাত্তরটি বিষয় শিক্ষা করতে হত। মনুসংহিতাতেও (২:৬৭) এসম্বন্ধে কিছু কিছু নির্দেশ পাওয়া যায়।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!