প্রাচীন ভারতে বিষকন্যা

বিষকন্যা নামটি উঠলেই, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের সাথে যাঁরা মোটামুটি পরিচিত, তাঁদের মানসে যে দুটি নাম ভেসে উঠবে, সেগুলি হল— চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য। কিন্তু ইতিহাস বলে যে এই বিষকন্যার ব্যাপারটি কিন্তু সেই আমলের থেকেও বেশি প্রাচীন। অর্থাৎ— মৌর্য্য আমলের আগেও ভারতে বিষকন্যা ছিল, হঠাৎ করেই সেযুগেই বিষকন্যার উৎপত্তি হয়নি। বস্তুতঃ বিষকন্যারা কিন্তু মহাভারতের যুগ থেকেই ভারতে ছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। ইতিহাস বলে যে, এঁরাও একধরণের সুন্দরী গণিকা ছিলেন; কিন্তু অন্য পাঁচজন গণিকাদের সাথে এঁদের পার্থক্য এটাই ছিল যে— এঁরা খুনে গুপ্তচর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। অন্যান্য গণিকাদের মত এঁরাও নিজেদের শরীরকে কাজে লাগাতেন, কিন্তু সেটা যত্রতত্র নয়। আর নিজেদের রূপ, সৌন্দর্য্য ও শরীরকে কাজে লাগিয়ে এঁরা শত্রুপক্ষের সাথে যে কাজ করতেন, সেটা জানলে আতঙ্কিত হতে হয়। কি কাজ? যৌনসম্ভোগকালে ওষ্ঠ-চুম্বনে অথবা দন্তদংশনের মাধ্যমে এঁরা হত্যার জন্য প্রেরিত ব্যক্তির শরীরে প্রথমে বিষ ঢুকিয়ে দিতেন। এরপরে সেই বিষের প্রভাবে সেই ব্যক্তি জ্ঞান হারালে এঁরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করতেন এবং সেই ব্যক্তির পুরুষাঙ্গটিও কেটে নিতেন! মহাভারতের চতুর্দশ অধ্যায়ে বিষকন্যা পাঠিয়ে গুপ্তহত্যার প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। অতীতে এই প্রসঙ্গে সুখময় ভট্টাচার্য তাঁর ‘মহাভারতের সমাজ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন—
“অনেক সময় শত্রুপক্ষ সুন্দর যুবতীকে উপঢৌকন স্বরূপ পাঠাইয়া থাকেন। পরিমিত মাত্রায় বিষ হজম করাইয়া সেই সকল কন্যাকে এমনভাবে তৈয়ারি করা হয় যে, তাহাদের স্পর্শমাত্রই অপর প্রাণী মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া থাকে। সেই সকল কন্যাকে ‘বিষকন্যা’ বলে। গুপ্তচরের মুখে সমস্ত বার্তা অবগত হইয়া অতিশয় সাবধানে বাস করিবে। এই সকল প্রলোভন হইতে নিজেকে রক্ষা করিতে না পারিলে বিনাশ সুনিশ্চিত।”

কিভাবে এঁদের তৈরি করা হত? গবেষকদের মতে, তখন শৈশবকাল থেকেই কিছু সুন্দরী কন্যাসন্তানদের শরীরে অল্প অল্প করে বিষ প্রয়োগ করে তাঁদের শরীরকে বিষ সহনীয় করে তোলা হত। বলাই বাহুল্য যে, সেই প্রক্রিয়াকালে অনেক কন্যাসন্তান বিষের প্রভাবে মারাও যেতেন। কিন্তু যাঁরা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যেতেন, তাঁদের শরীর জুড়ে থাকত বিষের প্রবাহ। একইসাথে তাঁদের গণিকাদের মত বিভিন্ন ছলাকলার প্রশিক্ষণও দেওয়া হত। এঁদের সৃষ্টি থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ দেওয়া— সবকিছুই কিন্তু রাষ্ট্রের আনুকূল্যে ঘটত। অর্থাৎ— রাষ্ট্রই এঁদের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করত। এরপরে এইসব কন্যারা নিজেদের কাজে পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত হয়ে উঠলে তাঁদের শত্রুকে কবজা করবার জন্য অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হত। সেকাজের জন্য এঁরা প্রথমে অন্য পাঁচজন গণিকার মতোই নিজেদের শরীরী-ছলনায় কামুক পুরুষদের দখল নিতেন। তবে যে পুরুষের যৌনকামকে তাঁরা জয় করতে পারতেন না, তাঁকে কবজা করা এঁদের পক্ষে জটিল হয়ে পড়ত; আর জনকে এঁরা জয় করতে পারতেন, এঁদের হাতে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য ছিল। মহাভারতের যুগের পরে মৌর্য্যযুগের ভারতের ইতিহাসে বিষকন্যার প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। তাই একথা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, মাঝের যুগগুলোতেও গণিকারা যেহেতু সবসময়ে ছিলেন, সেহেতু বিষকন্যারাও নিশ্চিতভাবেই ছিলেন। মোট কথা হল যে, ক্ষমতাবান শত্রুকে ধ্বংস করবার জন্য বিষকন্যা পাঠানোর রেওয়াজ প্রাচীন ভারতে বেশ ভালোই প্রচলিত ছিল।

মৌর্য্যযুগে বিষকন্যার প্রসঙ্গে জানা যায় যে, নন্দরাজার এক মন্ত্রী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের কাছে একজন বিষকন্যাকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু চাণক্যের কুট-বিচক্ষণতায় সেই বিষকন্যাকে পর্বতক নামের একজন ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই পর্বতক ওই বিষকন্যায় শরীরী ছলনায় আত্মসমর্পণ করলে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। গবেষকদের মতে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের সময়েই প্রাচীন ভারতে বিষকন্যা গণিকাদের সবথেকে বেশি বাড়বাড়ন্ত দেখা দিয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকের প্রথম ও দ্বিতীয়াংশে এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও বিষকন্যার সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া কলকিপুরাণে গন্ধর্ব চিত্রগ্রীবের স্ত্রী সুলোচনা নামের একজন বিষকন্যার কথা জানা যায়। এইসব বিষকন্যার নজরে কোনো পুরুষ পড়লেই সেই পুরুষটির মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত ছিল। বস্তুতঃ শত্রুনিধনের স্বার্থেই প্রাচীন ভারতের শাসকেরা বিষকন্যাদের বিষকন্যাদের নিয়োগ করতেন। এই বিষকন্যারা একদিকে যেমন বহুপুরুষগামী ছিলেন, অন্যদিকে তেমনি হত্যাকারী ছিলেন। প্রাচীন ভারতের বিষকন্যাদের প্রসঙ্গে কবি গুইলাম ডি চেরভেরা রচিত ‘রোমানিয়া’ নামক গ্রন্থে একটি আকর্ষণীয় কাহিনীর সন্ধান পাওয়া যায়। সেই কাহিনীর সাথে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের নাম জড়িয়ে রয়েছে। কাহিনীটি এরকম—
দিগ্বিজয় করতে বেরিয়ে পারস্যের রাজা দরায়ুসকে পরাজিত করে আলেকজান্ডার একসময়ে ভারত ভূখণ্ডে পৌঁছেছিলেন এবং ভারতের মূল ভূখণ্ডের কিছুটা অংশ জয় করে নিয়েছিলেন। তখন পুষ্কলাবতীর রাজা অষ্টক এবং অশ্বক জাতির রাজারা একে একে তাঁর কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন। তক্ষশীলার রাজাও তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এরপরে ভারতীয় এক রাজ্যের রাজা সিকান্দার অর্ধেক পৃথিবীর রাজা তৃতীয় আলেকজান্ডারের শিবিরে বহুমূল্যের সব উপঢৌকনের সঙ্গে পাঁচ অপরূপ সুন্দরী লাস্যময়ী নারীকে পাঠিয়েছিলেন। সেইসব ক্ষীণকটির রূপবৈভবে গ্রিক শিবির মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। নারীর প্রতি আলেকজান্ডারের যে আসক্তি রয়েছে, সেকথা ততদিনে ভারতের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর ভারতীয় রাজা সিকান্দার তাঁর সেই আসক্তিকেই সুচারুভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। আলেকজান্ডারও ঘুণাক্ষরেও ভারতীয় রাজার কৌশল টের পাননি। তিনি লুব্ধ দৃষ্টিতে মোহিত হয়ে সেইসব লাস্যময়ী নারীর দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। গ্রিকশিবিরের তখন আলেকজান্ডারের সঙ্গে তাঁর গুরু, অ্যারিস্টটলও অবস্থান করছিলেন। একদিন আলেকজান্ডার এক লাস্যময়ীর নৃত্যে মোহিত হয়ে গেলেও অ্যারিস্টটল কিন্তু প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলেন। তিনি বিষকন্যার বিষয়ে অবগত ছিলেন বলে আলেকজান্ডারকে সতর্ক করে বলেছিলেন— ‘আর এগিয়ো না বৎস। এই লাস্যময়ী বিষকন্যা।’ আলেকজান্ডার প্রথমে তাঁর গুরুর কথায় বিশ্বাস করতে রাজি হননি। তখন নিজের বক্তব্যের প্রমাণ দেওয়ার জন্য অ্যারিস্টটল হাতের ঈশারায় সেখানে থাকা দু’জন দাসকে নিজের কাছে ডেকেছিলেন এবং তাঁদের আদেশ করেছিলেন— ‘ওই নারীর ওষ্ঠে চুম্বন করো।’ কিন্তু চুম্বন করা তো দূরে থাকুক, সেই লাস্যময়ী নারীর শরীর স্পর্শ করামাত্রই ওই দু’জন দাসই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। এরপরে তিনি সেই নারীকে আলেকজান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ঘোড়াকে স্পর্শ করতে বলেছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, ওই নারীর স্পর্শে মুহূর্তের মধ্যে তেজি ঘোড়াটি নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে দুটো প্রমাণ পেয়ে আলেকজান্ডারের মোহ ভেঙেছিল এবং তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের তলোয়ার দিয়ে সেই গুপ্তঘাতিনী লাস্যময়ী নারীকে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছিলেন। এরপরে তাঁর নির্দেশে সিকান্দারের উপহার পাঠানো বাকি নারীদেরও হত্যা করা হয়েছিল, এবং তাঁদের সকলের মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

অতীতের কোন একসময়ে এই কাহিনী ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এছাড়া অ্যারিস্টটল আলেকজান্ডারকে যেসব উপদেশ দিয়েছিলেন, অতীতে সেটার একটা সংকলনও প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংকলনটির নাম ছিল— ‘সিক্রেটা সিক্রেটোরাম’। এই সিক্রেট সিক্রেটোরামে পাওয়া যায় যে— অ্যারিস্টটল আলেকজান্ডারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন ভারতের বিষকন্যাদের থেকে শত হাত দূরে থাকেন। একইসাথে অ্যারিস্টটল তাঁকে একথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, অতীতে বহু রাজা এই বিষকন্যাদের সংসর্গে এসে শেষ হয়ে গিয়েছিলেন। এসব কাহিনীর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া গেলেও, একথা অবশ্যই বোঝা যায় যে, প্রাচীন ভারতে বিষকন্যা নামক গণিকারা ছিলেন।

গবেষকদের মতে যে পদ্ধতিতে বিষকন্যাদের বিষসহনে অভ্যস্ত করা হত, সেটার নাম হল— ‘মিথ্রিডেটিজম’। ঐতিহাসিকদের মতে প্রাচীন গ্রিসের পন্টাসের রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডেটস তাঁর নিজের শক্তিশালী শত্রুদের দমন করবার জন্য মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য বিষকন্যাদের বিষময় করে তোলবার পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। শৈশব থেকেই তাঁর মনে এই ভয় ছিল যে— তাঁর নিজের মা তাঁকে বিষ দিয়ে হত্যা করবেন। সেই ভয়েই একটাসময়ে তিনি জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন, এবং সেখানে গিয়ে বনচরদের কাছ থেকে— কিভাবে অল্প পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ নিজের শরীরে প্রবেশ করিয়ে বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করা যায়— সে সম্বন্ধে শিক্ষা নিয়েছিলেন।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে যায় যে, বিষকন্যারা মূলতঃ তাঁদের রূপের জালে রাজা বা রাজপুরুষ বা বণিকদের ফাঁসিয়ে গুপ্তহত্যা করবার চেষ্টা করতেন। সেযুগে কোন শক্তিশালী শত্রু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মানবঘাতক বিষকন্যাদের ব্যবহার করবার সবথেকে বড়ো সুবিধা ছিল যে, তাঁদের বিষকন্যা হিসাবে চিহ্নিত করাটা কারো পক্ষেই অত সহজ ছিল না। ফলে আকণ্ঠ ভোগলালসা ও নারীসঙ্গে ডুবে থাকা রাজারা খুব সহজেই গণিকা বিষকন্যাদের সৌন্দর্য ও লাস্যের ফাঁদে পড়ে নিমিষের মধ্যেই মৃত্যুর দেশে পৌঁছে যেতেন। তবে বিষকন্যাদের যে একেবারেই চিহ্নিত করা যেত না, সেটাও কিন্তু নয়; এবিষয়ে অবগত ও অভিজ্ঞরা তাঁদের ঠিকই চিনতে পারতেন; যেমন চাণক্য চিনতে পেরেছিলেন।

প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত তিন চিকিৎসক— চরক, সুশ্রুত ও ভাগবত —তাঁদের রচিত গ্রন্থে বিষকন্যাদের বিষয়ে শুধু লিখেই ক্ষান্ত হননি, তাঁরা তাতে বিষকন্যাদের চিহ্নিত করবার যেসব সহজ উপায়ের কথা বলেছিলেন, সেগুলি নিম্নরূপ—
(১) অকারণ হাসি,
(২) চুলে আঙুল চালানো,
(৩) সন্দেহজনক আচরণ,
(৪) অতিরিক্ত কথা বলা,
(৫) মাটি আঁচড়ানো,
(৬) ঘনঘন পিছন ফিরে দরজা দেখা,
(৭) কোনো প্রশ্ন করলে নীরব থাকা ইত্যাদি।

সুশ্রুত তো একইসাথে বিষকন্যার বিষের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া সম্ভব এবং তাঁদের জন্য কি কি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে— সেসব কথাও বলে দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে— মেয়েদের অন্ন, দাঁত মাজার সামগ্রী, চুলের তেল, জামাকাপড়, স্নানের জল, চোখের পথ্য, অলংকার, প্রসাধনী দ্রব্য ইত্যাদিতে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, প্রাচীন যুগে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই বিষকন্যাদের ব্যবহার চালু ছিল। বিষকন্যাদের সংসর্গেই বোহেমিয়ার রাজা দ্বিতীয় ওয়েনচেসলাউসের মৃত্যু হয়েছিল। অন্যদিকে খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বিষকন্যাদের ব্যাপক দাপট দেখা দিয়েছিল। তখন বিষকন্যাদের সংসর্গের ফলেই অঙ্গ, কোশল, কাঞ্চী, অবন্তীসহ একাধিক রাজাদের পরাজিত করে মগধের উত্থান সম্ভব হয়েছিল। মুদ্রারাক্ষস ও অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে সেইসব রোমহর্ষক কাহিনীর সন্ধান পাওয়া যায়। নন্দবংশের শাসনামলে ভারতে বিষকন্যা কর্তৃক রাজা ও রাজপুরুষদের গুপ্তহত্যা প্রবলভাবে বেড়ে গিয়েছিল। আগেই বলা হয়েছে যে, ভারতে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য একবার এক বিষকন্যার হাতে মরতে মরতে শেষে চাণক্যের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ইতিহাসের সঙ্গে যাঁরা অবগত রয়েছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই জানেন যে— মৌর্য্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে তৎকালীন মগধসম্রাট ধননন্দের বিরোধ ছিল; সম্রাট হয়ে গদির দখল নেওয়ার আগে দাম্ভিক, প্ৰজাবিদ্বেষী রাজা ধননন্দের ভয়ে চন্দ্রগুপ্তকে জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল। নিজের প্রজ্ঞা ও চতুর কৌশলে চাণক্য ততদিনে আভাস পেয়ে গিয়েছিলেন যে, চারপাশে তখন চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার চক্রান্ত চলছিল; এবং সেইসব চক্রান্তের মধ্যে তাঁর উপরে বিষকন্যা কর্তৃক বিষের আক্রমণের সম্ভাবনাই সবথেকে বেশি প্রবল ছিল। তাই চন্দ্রগুপ্তের খাবারে তিনি গোপনে প্রতিদিন অল্প পরিমাণে বিষ মিশিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। এভাবেই বিষের স্পর্শ থেকে চন্দ্রগুপ্তকে রক্ষা করবার জন্য চাণক্য তাঁর শরীরকে তৈরি করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে ধননন্দের মৃত্যু হলেও ধননন্দের রাক্ষস নামক একজন মন্ত্রী চন্দ্রগুপ্তের কাছে একজন লাস্যময়ী বিষকন্যাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু চাণক্য যেহেতু সেই বিষকন্যাকে দ্রুত চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, তাই তিনি সেই বিষকন্যাকে চন্দ্রগুপ্তের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেননি। তিনি সেই বিষকন্যাকে ধননন্দের পুত্র পর্বতকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পর্বতক তখনও চন্দ্রগুপ্তের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আর চন্দ্রগুপ্তের জন্য পাঠানো সেই বিষকন্যার ছোবলেই শেষে পর্বতকের মৃত্যু হয়েছিল।

তবে এমন কথাও শোনা যায় যে, বিষকন্যারা একবার কারোর মৃত্যুর কারণ হলে তাঁর শরীর থেকে সমস্ত বিষ শেষ হয়ে যেত। তাই একই সঙ্গে দু’জনের মৃত্যু ঘটানো তাঁদের পক্ষে ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব হত না, যতক্ষণ না নতুন করে তাঁদের শরীরে পুনরায় বিষের জোগান দেওয়া হত। শৈশব থেকেই বিষ হজম করে বড় হতে থাকা সেইসব মেয়েদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। রাষ্ট্রের বিশিষ্ট গণিকা ও নর্তকীদের তত্ত্বাবধানে তাঁদের সমস্ত শিক্ষাদীক্ষা চলত। শরীরের প্রতিটি অঙ্গের ব্যবহার কিভাবে ও কতটা সুচারুভাবে করতে হয়, তাঁরা শৈশব থেকেই সেসবের শিক্ষা নিতেন। এছাড়া তাঁদের মোহময় বাক্যজাল বিস্তার করবার কলাও শিখতে হত। বস্তুতঃ পুরুষকে আকর্ষণ করবার সমস্ত ছলাকলাই তাঁদের শিখতে হত। এসবের সঙ্গে ছদ্মবেশ ধারণ করা ও কামকলাও তাঁদের শিক্ষাসূচির অন্তর্গত ছিল। সব শিক্ষা সমাপ্ত হলে তাঁদের চলনে, বলনে ও শরীরী কটাক্ষে উত্তেজক যৌনতা ঝরে পড়ত, আর সেই যৌনতাতেই তাবড় রাজা-মহারাজা ও বীরপুরুষরা খড়কুটোর মত ভেসে যেতেন।
মজার ব্যাপার হল যে, প্রাচীন ভারতে বিষকন্যাদের মত হত্যাকারিণীদের কোনো শাস্তির বিধান বা নির্দেশ কিন্তু ছিল না। তবে কোনো মেয়েকে বিষকন্যা বলে টের পেলে তাঁর শরীর তলোয়ার দিয়ে প্রথমে টুকরো টুকরো কেটে ফেলা হত, এবং তারপরে সেটাকে মাটিতে পুঁতে দেওয়া কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হত। তবে সবসময়ে যৌনমিলনাকাঙ্খী লোকজনই যে এঁদের হাতে মারা পরতেন, তা কিন্তু নয়। অনেক সময়ে এঁরা রাজাকে বিষযুক্ত খাবার খাওয়ানোর কাজটিও করতেন। সেকাজের জন্য, রাজাকে সন্দেহমুক্ত করবার জন্য তাঁরা নিজেরাও সেই একই বিষ মেশানো খাবার খেতেন। রাজা বিষ-খাবার খেয়ে মারা গেলেও বিষকন্যাদের কিন্তু কিছুই হত না। প্রাচীন ভারতে রাজাদের সাম্রাজ্যগ্রাসের কুটিল রাজনীতিতে বিষই এইসব বিষকন্যাদের জীবনের একমাত্র পরিচয় হয়ে উঠেছিল, যেটাকে সেকালের ধুরন্ধর রাষ্ট্রনেতা ও সমরবিদরা নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করেছিলেন।

গণিকারা তো আজও আছেন, কিন্তু বিষকন্যারা আছেন কি?

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!