ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ (চৌত্রিশ)

।। পর্ব – ৩৪।।

নবীন মাস্টারের দিকে তাকিয়ে তেরো নম্বর বলল, যাক বাবা, তা হলে আমাদের এত দিনের পরিশ্রম সফল হল!
খুব গম্ভীর হয়ে নবীন মাস্টার বললেন, এখনই কিন্তু এ কথা বলা যাবে না।
তেরো নম্বর অবাক। এই সরকার যাতে নন্দীগ্রামে, এমনকী এই রাজ্যের অন্য কোথাও কেমিক্যাল হাব করতে না পারে, সে জন্য জনমত গঠন করতে আঁধারগ্রাম থেকে সে এখানে ছুটে এসেছিল। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই যখন বিশাল জনসভায়, এতগুলো মিডিয়ার সামনে ঘোষণা করছেন, আমরা নন্দীগ্রামে যাব না। কেমিক্যাল হাব করব না। তখনও বলা যাবে না আমাদের উদ্দেশ্য সফল! তা হলে কখন বলা যাবে!
নবীন মাস্টার বুঝি ওর মনের মধ্যে তোলপাড় হওয়া প্রশ্নটি শুনতে পেলেন। তাই বললেন, বাঘ কখন দু’পা পিছিয়ে যায় জানো?
তেরো নম্বর চুপ। কী বলবে সে! বাঘ কখন দু’পা পিছিয়ে যায় সত্যিই সে জানে না! তাই নবীন মাস্টারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। নবীন মাস্টার বললেন, সব সময় মনে রাখবে, বাঘ দু’পা পিছোয় আরও জোর কদমে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। উনি যখন বলছেন, নন্দীগ্রামে যাব না। কোনও দিন যাব না। তখন বুঝতে হবে, উনি যাবেন। যাবেনই। শুধু যাবেন না, যে ভাবে ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তার চেয়েও আরও ভয়ানক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
– কবে?
– নিশ্চয়ই দু’-চার দিনের মধ্যে নয়।
– তা হলে কবে?
– ১৪ মার্চের ঘটনাটা নিয়ে গোটা দেশ যে ভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছে, আমার মনে হয়, ওরা এক্ষুনি কিছু করবে না। ব্যাপারটা একটু থিতোক, তার পর…
– তবুও… দু’মাস? চার মাস? ছ’মাস?
– দু’মাসও হতে পারে, আবার ছ’মাসও হতে পারে। সবটাই নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর। ওদের যখন একবার মাথা নত করতে হয়েছে, ওরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। সুযোগের জন্য ওত পেতে অপেক্ষা করবে। আর সুযোগ পেলেই ফের ও রকম একটা ভয়ংকর কাণ্ড ঘটাবে।
– আবার!
– হ্যাঁ, আবার। আর আমার ধারণা, সেটা হবে ১৪ মার্চের চেয়েও মারাত্মক কিছু একটা। ওরা এখন শুধু অপেক্ষা করবে। যে ভাবে অপেক্ষা করেছিলেন সি পি এমের সর্বোচ্চ ক্ষমতাভোগী স্বয়ং জ্যোতি বসু। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাবে, ১৯৬৪ সালে সি পি আই যখন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল, তখন যাঁরা প্রকৃত শিক্ষিত, তাত্ত্বিক আর অভিজ্ঞ নেতা ছিলেন, যাঁরা সত্যি সত্যিই দেশের ভালর জন্য, দশের ভালর জন্যই রাজনীতি করতেন, তাঁরা কিন্তু সি পি আইতেই থেকে গেলেন। আর যাঁরা গুন্ডা প্রকৃতির, যাঁরা বিশ্বাস করতেন, যা চাই, এক্ষুনি চাই। না পেলে ছিনিয়ে নেব। দরকার হলে সতীর্থ-বন্ধুর পিঠে ছুরি বসাব। যদি উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হয় কিংবা তার চেয়েও অনেক অনেক ধাপ নীচে নামতে হয়, তো নামব। তাঁরা চলে গেলেন সি পি আই এম-এ।
সেই সময় জ্যোতি বসু কিন্তু কোনও দলেই যাননি। টানা ছ’মাস চুপচাপ বসেছিলেন। ওই সময় দু’দলই বারবার তাঁকে তাদের দলে যোগ দিতে ডেকেছে। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি এমন একটা ভান করছিলেন যে, হঠাৎ করে এত দিনের একটা কমিউনিস্ট দলের এই ভাঙনে তিনি এতটাই মর্মাহত হয়ে পড়েছেন যে, এই নিয়ে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি কোন দিকে যাবেন।
হাবভাবে এই কথা বোঝালেও আসলে উনি পুরো ব্যাপারটার উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন, দেখছিলেন, শেষ পর্যন্ত কোন দলটা দাঁড়ায়। কোন দলে গেলে আখেরে তাঁর লাভ হবে। সেই সব হিসেব-নিকেশ করে ছ’মাস পরে উনি সি পি আই এম-এ যোগ দিলেন।
– কিন্তু সি পি আইতে নয় কেন? আমি যদ্দুর জানি, ওখানেই তো ওর সব বন্ধুবান্ধব, এমনকী বড় বড় তাত্ত্বিক নেতারা ছিলেন।
– সেই কারণেই তো গেলেন না। সি পি আইতে তখন তাবড় তাবড় সব নেতা। উনি গেলে ওখানে কোনও পাত্তাই পাবেন না। তাঁদের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হবে। তার থেকেও বড় কথা, যত দিন না তাঁরা মারা যাচ্ছেন, তত দিন দলে তিনি তেমন কোনও বড় জায়গাও পাবেন না। তা ছাড়া উনি যে-ছকে এগোতে চান, ওই সব বুড়োহাবড়া নেতারা সে সবে তো মত দেবেনই না, উলটে জানতে পারলে পদে পদে বাধা দেবেন। না শুনলে দল থেকে বহিষ্কার করে দেবেন। উনি ওঁদের খুব ভাল করে চেনেন। জানেন, সি পি আইয়ে থেকে যাওয়া হীরেন মুখার্জি লাঠি নিয়ে কাউকে তাড়া করতে যাবেন না। সোমনাথ লাহিড়ীও কোথাও বোমা মারতে যাবেন না। বিশ্বনাথ মুখার্জিও কারও কপালে রিভলভারের নল ঠেকাবেন না। অথচ সি পি এমের দিকে ছেলেছোকরারাই বেশি। বয়স্ক নেতাও কম। ফলে উনি ওঁর মতো করে সেখানে ছড়ি ঘোরাতে পারবেন। তাদের যা বলবেন, ওরা তাই করবে এবং সহজেই তাঁকে নেতা হিসেবে মেনে নেবে। ফলে খুব স্বাভাবিক কারণেই উনি বুঝতে পারলেন, তাঁর প্রকৃত জায়গা হল– সিপিএম।
– সেটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো উনি সি পি এমের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পেরেছিলেন।
– সেটা পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এই রাজ্যকে তিনি কী দিয়েছিলেন? এক সময় উনি বলতেন, শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা আনে বিপ্লব। তাঁর বুলি শুনে জনগণ ভেবেছিল, উনি ক্ষমতায় এলে শিক্ষায় নতুন জোয়ার আসবে। শিক্ষার মান অনেক উন্নত হবে। অথচ ১৯৭৭ সালে উনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত বত্রিশ বছর ধরে আমরা শুধু শিক্ষার অবনমনই দেখছি। ২০০১-এর জনগণনার রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে সাত বছর বয়সি বাচ্চাদের মধ্যে ৩১ শতাংশ নিরক্ষর। জেলায় জেলায় এটা আবার আকাশ-পাতাল তফাত। উত্তর চব্বিশ পরগনায় সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৮ শতাংশ, সেখানে উত্তর দিনাজপুরে মাত্র ৪৮ শতাংশ।
২০০৫-২০০৬ সালে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সিদের জন্য আসাম সরকার যেখানে মাথা পিছু বছরে খরচ করেছে ৩৪২১ টাকা। সেখানে ওই বছর ওই বয়সি বাচ্চাদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার খরচ করেছে তার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। মাত্র ১২৭৯ টাকা। দলছুট পড়ুয়াদের স্কুলে আনতে ব্যর্থ এই দেশের প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে এই রাজ্য হল একটি।
– কেন? এই রাজ্য ব্যর্থ হল কেন?
– কারণ স্কুলছুটদের স্কুলমুখী করতে বিভিন্ন রাজ্য যে ভাবে নানা রকম পদক্ষেপ নিয়েছে, এ রাজ্য নেয়নি। দলছুট মেয়েদের স্কুলে ফেরাতে এবং ভাল রেজাল্ট করাতে তামিলনাড়ু সরকার তফসিলি জাতি এবং জনজাতিভুক্তদের বিনে পয়সায় স্কুলের শিক্ষকদের দিয়েই বিশেষ কোচিং দেয়। বিহার সরকার তফসিলি জাতি ও জনজাতি ছাত্রদের বিনে পয়সায় স্কুল ইউনিফর্ম সরবরাহ করে। শুধু তাই-ই নয়, দারিদ্ররেখার নীচে থাকা পরিবার থেকে আসা শিশুরা স্কুলে উপস্থিত হলেই প্রতিদিন তাদের এক টাকা করে দেয়। সরকারি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠা দূর থেকে আসা মেয়েদের হরিয়ানা সরকার উপহার দেয় একটি করে সাইকেল। আর এই সরকার?
মাথা দোলাল তেরো নম্বর। সত্যিই তো! অন্য সরকারের তুলনায় এই সরকার কী করে!
তেরো নম্বরের আরও জানার আগ্রহ দেখে নবীন মাস্টার বললেন, আগে ছিল প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য গুরু ট্রেনিং স্কুল। সংক্ষেপে যাকে বলা হত জি টি এস। স্বাধীনতার পরেও কয়েক বছর ওই স্কুলগুলো এই রাজ্যে চালু ছিল ঠিকই, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল ‘যুদ্ধোত্তরকালীন শিক্ষা পুনর্গঠন কমিটি’। সেই কমিটির তিন জন সদস্যের মধ্যে একজন ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ স্যার জন সারজেন। দ্বিতীয় জন শান্তিনিকেতনের বিনয় ভবনের অধ্যক্ষ অনাথবন্ধু বসু। আর তৃতীয় জন হলেন শ্রীমতী জেন ব্ল্যাকডেন। তাঁদের সুপারিশেই মাদার সেন্টার, অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষক ও প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষক তৈরির কেন্দ্রের ওপর প্রথম জোর দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাঁরা এখানে প্রশিক্ষণ নেবেন, তাঁদের আবাসিক হওয়া বাধ্যতামূলক। কারণ, এক বছরের ওই কোর্সে সত্যিকারের মানুষ গড়ার যাবতীয় দিকগুলো নিয়ে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত টানা প্রশিক্ষণ চলবে। যাঁরা প্রশিক্ষণ নেবেন, তাঁদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্যই হবে প্রাথমিক শিক্ষকদের অত্যন্ত সচেতন, মানবিক এবং আদর্শ শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলা। উদ্দেশ্য ছিল, এখান থেকে তালিম নিয়ে বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে ওই সব শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণ দেবেন।
– তাই?
– হ্যাঁ। সেই উদ্দেশ্যেই ওই কমিটির হয়ে বিশিষ্ট শিল্পী যামিনী রায় অনেক জায়গা দেখার পর শেষ পর্যন্ত পছন্দ করেন গাছে-গাছে ছাওয়া, প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্যে ভরা উত্তর চব্বিশ পরগনার হাবড়া থানার বাইগাছি মৌজা। ঠিক হয়, ওখানে যাঁরা প্রশিক্ষণ নেবেন, শিক্ষা শেষে তাঁদেরকে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে এবং তারও পরে সুদূর লন্ডনের বেডিং টিচার্স ট্রেনিং ইউনিভার্সিটিতে পাঠানো হবে। প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিমাংশুবিমান মজুমদার সেই ট্রেনিং নিতে প্রথম লন্ডনে যান। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ড. প্রফুল্ল ঘোষ নির্দেশ দেন, শুধু লন্ডন থেকে ট্রেনিং নিলেই হবে না, এই দেশের জল, বায়ু, মাটি এবং সাধারণ মানুষের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো বোঝার জন্য প্রশিক্ষকদের গাঁধীজির ওয়ার্ধা আশ্রম থেকেও প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
১৯৪৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে যামিনী রায়ের পছন্দ করা ওই জায়গাতেই প্রথম নিম্ন বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু হয়। এর পর রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় একে একে এ ধরনের বাহান্নটি প্রাথমিক শিক্ষক তৈরির বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
কথাগুলো হাঁ করে গিলছিল তেরো নম্বর। কিন্তু সে দিকে খেয়াল ছিল না নবীন মাস্টারের। তিনি তখন বলেই যাচ্ছিলেন, সুনামের সঙ্গে চলছিলও সে সব। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেই গাঁধীজি আর রবীন্দ্রনাথের আদর্শে অনুপ্রাণিত ওই পাঠ্যক্রমকে একেবারে মূলসমেত উপড়ে ফেলে জ্যোতি বসুর সরকার আশির দশকে পি টি টি আই নামে নতুন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। সি পি এমের নেতা, মন্ত্রী, এম পি, এম এল এ-দের অতি উৎসাহে দেখতে দেখতে এই রাজ্যের অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে ১২২টি পি টি টি আই স্কুল। তার সঙ্গে শুরু হয়ে যায় শাসকদলের ক্যাডার বাহিনীর ঔদ্ধত্য। আর তাদের দাপটেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালন কমিটি থেকে একে একে সরে যেতে বাধ্য হন প্রবীণ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরা।
তার ফলে ক’দিনের মধ্যেই সি পি এমের লোকদের পাল্লা ভারী হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতিকেও ওরা এমন কোণঠাসা করে দেয় যে,‌ উনি চলে যেতে বাধ্য হন। তার পরেই ওরা খারিজ করে দেয় উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের পরিচালক মণ্ডলীকে। আর খালি হওয়া ওই দুই পরিচালক মণ্ডলীর সদস্যপদগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয় সি পি এম-সহ বামফ্রন্টের ছোট-বড় নানান শরিক দলগুলো। যদিও নানা কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সরানো তাঁদের পক্ষে তখন সম্ভব হয়নি। তাই সে বছর নয়, তার পরের বছর, ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে গণতন্ত্রীকরণের দোহাই দিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে একটা অর্ডিন্যান্স জারি করে বাতিল করে দেয় সিন্ডিকেট সেনেট, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, পোস্ট গ্যাজুয়েট ও আন্ডার গ্যাজুয়েট কাউন্সিল। নতুন করে গঠন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল। সেখানে যাঁদের না রাখলেই নয়, সেই সব স্বনামধন্যদের নামকাওয়াস্তে রেখে, যাঁরা কিছুতেই কোনও দিন বামপন্থী হবেন না, তাঁদের চরিত্রহনন করে, তাঁদের গায়ে কাদা ছুড়ে অপদস্থ করা শুরু হয়। শিক্ষাজগতে এ রকম লোক থাকা চলবে না স্লোগান তুলে তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছলচাতুরী করে নিজেদের লোককে ঢুকিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেদের দখলে নিয়ে আসে সি পি এম।
এ সব খবর জানত না তেরো নম্বর। তাই অবাক বিস্ময়ে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, তাই নাকি?
উনি বললেন, হ্যাঁ। আর তার পর থেকেই সমস্ত স্কুল-কলেজে নিয়োগ শুরু হয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অঙ্গুলি হেলনে। যোগ্যতা নয়, বিবেচনা করা হতে থাকে দলের প্রতি সে কতটা আনুগত্য তার উপরে। ফলে অযোগ্য লোকে ভরে যেতে থাকে এ রাজ্যের শিক্ষা জগৎ। অতি সাধারণ মাপের শিক্ষকরাও আলোর সামনে চলে আসেন। যেমন– পবিত্র সরকার। জাল পি এইচ ডি ডিগ্রি নিয়ে, তাঁর থেকে হাজার গুণ যোগ্য, সত্যিকারের শিক্ষিত লোক থাকা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র সি পি এমের বদান্যতায় রিডার থেকে প্রফেসর, এমনকী উপাচার্য পর্যন্ত হয়ে যান তিনি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁকে রাজ্যের সেরা ‘ভাষা বিজ্ঞানী’ আখ্যা দেন। এবং তাঁকেই সাক্ষরতা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার নিয়ামক করে দেন।
কাকে করেন? না, যিনি বাংলা ব্যাকরণ এবং বানান পালটাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বানান অভিধানে ‘জননী’ বানান নতুন করে করেন ‘জননি’। সেটা নিয়ে শিক্ষিত মহলে হইচই শুরু হতেই, ব্যাকরণগত কোনও যুক্তি দেখাতে না পেরে, উনি নিরুপায় হয়ে সেই অভিধানের চতুর্থ সংস্করণে সংশোধন করে ফের আগের মতো ‘জননী’ করে দেন। এর ফলে যে-জননীর এক বছর অন্তর দু’টি সন্তান, তাঁর বড় ছেলে তৃতীয় সংস্করণ পড়ে শিখল ‘জননি’ আর ছোট ছেলে চতুর্থ সংস্করণ পড়ে শিখল ‘জননী’। একবার ভাবো, এই জননী জন্মভূমির কী হাল করে ছাড়লেন সি পি এমের নয়নের মণি, ভুয়ো ডিগ্রিধারী ওই পবিত্র সরকার।
তেরো নম্বর আকাশ থেকে পড়ল। সে কী! এ রকম আবার হয় নাকি?
– হয় হয়, কত উদাহরণ দেব? দিয়ে শেষ করা যাবে না। প্রতি পদে পদে এ রকম ঘটেছে। আর সেই যে শিক্ষার পতন শুরু হল, পড়তে পড়তে আজ কোন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা টের পাওয়া যায় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বর্তমান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরে চোখ রাখলেই। ওই কাগজে বড় বড় করে ছাপা হয়েছে শিরোনাম– ‘অধ্যাপক হতে যোগ্যতা পরীক্ষায় ফল শোচনীয়, বাংলায় পাশ মাত্র ৯’। তাতে বলা হয়েছে, ২১টি বিষয়ে ৮ হাজার ৮৮৩ জন পরীক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষা দিয়েছিলেন। অঙ্কে একজনও পাশ করেননি। বাংলায় পাশ করেছেন মাত্র ৯ জন।
এই খবর দেখে প্রশ্ন তুলেছিলেন দীর্ঘ দিন ধরে অধ্যাপনার কাজে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত শ্রীযুক্ত রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তো ওরা উজ্জ্বল মার্কশিট পাচ্ছে। তার মানে, ওরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নম্বর পাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা পাচ্ছে না। আর শিক্ষা পাচ্ছে না বলেই কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় তাদের ফলাফল এমন হতাশাজনক।
প্রশ্ন উঠছে, শিক্ষা পাচ্ছে না কেন? উত্তর একটাই– অযোগ্য শিক্ষক। অযোগ্য শিক্ষক কেন? সি পি এমের রাজনীতি। সি পি এমের রাজনীতি কেন? আঁধারগ্রাম-নন্দীগ্রামের মতো শিক্ষাজগৎকেও দখল করা। দখল করা কেন? ভোট পাওয়া। ভোট পাওয়া কেন? সি পি এমের রাজত্ব চিরস্থায়ী করা।
প্রশ্ন উঠছে, শিক্ষা পাচ্ছে না, অথচ মার্কশিটে ভূরি ভূরি নম্বর পাচ্ছে, এটা কী করে হয়? এখানেও উত্তর সেই একটাই– আদর্শহীন, মেরুদণ্ডহীন, অযোগ্য শিক্ষকেরা নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য সি পি এমের ছাত্র সংগঠন এস এফ আইয়ের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকছে। আর এস এফ আইও ছাত্রদের বেশি বেশি নম্বর পাইয়ে দিয়ে দলে টেনে নিয়ে, ধীরে ধীরে সর্বক্ষণের কর্মী করে তোলার জন্য হাত মেলাচ্ছে ওই সব মাস্টারদের সঙ্গে। ফলে তৈরি হচ্ছে একটা জঘন্য আঁতাঁত। নোংরা রাজনীতি।
– ঠিকই বলেছেন। ছোট্ট মন্তব্য করল তেরো নম্বর। কিন্তু সেটা শুনেও না শোনার ভান করে তার রেশ টেনেই নবীন মাস্টার বললেন, আর এই সব ছাত্রছাত্রীরাই পরবর্তী কালে শিক্ষক হচ্ছে। ২০০২ সালে রাজ্য সরকার আইন পরিবর্তন করে ঘোষণা করে, একমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু ৩৭টি সরকারি ট্রেনিং কলেজে এত বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়েকে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সরকার রাতারাতি ঘোষণা করে, কেউ প্রাইভেট টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট খুললে সরকার তাকে অনুমোদন দিয়ে দেবে। ব্যস, ঝপাঝপ আবেদনপত্র জমা পড়তে লাগল। আর তা অনুমোদনও পেয়ে যেতে লাগল। গড়ে উঠল এক-একটা ইনস্টিটিউশন। সেখানে না-আছে উপযুক্ত পরিকাঠামো। না-আছে উপযুক্ত শিক্ষক। কোনও কোনও বিদ্যালয় তো আবার গড়ে উঠল জবরদখল জমির ওপরে।
আর খাতায়-কলমে অন্য কারও নাম থাকলেও সেই সব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের বেশির ভাগ পরিচালকমণ্ডলীর প্রধান কিংবা মালিকই কিন্তু আসলে কোনও না কোনও সি পি এম দলের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ অথবা বিধায়ক। আর তা না হলে তাঁদের কোনও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ (তেত্রিশ)

১৯৯৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের এন সি টি ই আইন প্রবর্তনের ফলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই প্রশিক্ষণের নতুন নিয়ম জারি হয়– দু’বছরের ট্রেনিং কোর্স। ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ৫০ শতাংশ নম্বর-সহ উচ্চমাধ্যমিক পাশ। কিন্তু এই রাজ্য সরকার সেই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শুরু করে দিল এক বছরের ট্রেনিং কোর্স। ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা, যত কম নম্বরই পাক না কেন, মাধ্যমিক পাশ হলেই হল।
সর্বভারতীয় আইন জারি হওয়ার পরেও এই রাজ্য সরকার কী ভাবে আইন অমান্য করে এই ধরনের একটা কোর্স বছরের পর বছর চালায়? প্রশ্ন উঠতেই ২০০৮ সালের ১ অক্টোবর রাজ্য সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে মহামান্য হাইকোর্ট পি টি টি আই পড়ুয়াদের ডিগ্রি এবং সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১৪২টা পি টি টি আই শিক্ষাকেন্দ্রকে অবৈধ্য বলে ঘোষণা করে। এর ফলে বাতিল হয়ে যায় প্রায় চল্লিশ হাজার কর্মরত প্রাথমিক শিক্ষকের ডিগ্রি। বিপাকে পড়ে ইতিমধ্যে পাশ করা, চাকরির জন্য লাইনে থাকা প্রায় ৭৬ হাজার ছাত্রছাত্রী। হতাশ হয়ে তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জন আত্মহত্যাও করে। অথচ যারা ওই দোষের ভাগিদার, সেই সব মন্ত্রী-আমলারা মহাকরণ থেকে বিকাশ ভবন– সর্বত্র, গদি আগলে বসে থাকেন। এই হচ্ছে রাজনীতি।
আর এই রাজনীতির জন্যই বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে এই রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা। এখানে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া প্রতি ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২০ জন কোনও রকমে টেনেটুনে দশম শ্রেণি পর্যন্ত যেতে পারে। বাকি আশি জন পড়ুয়া মাঝপথেই লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই রাজ্যের ৮.৯৭ লক্ষ শিশু স্কুলশিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে। এটা সরকারি মতে। তা হলে বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা কত হবে, একবার ভেবে দেখো।
এ সবের কিছু কিছু এর আগেও নবীন মাস্টারের কাছে তেরো নম্বর শুনেছে। তবু মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে হাঁ করে আছে। আর নবীন মাস্টার বলে যাচ্ছেন– এক সময় শিক্ষায় বাণিজ্যীকরণ মহারথ থামাতে যাঁরা উঠেপড়ে লেগেছিলেন, ক্ষমতায় এসে তাঁরাই হঠাৎ করে প্রাইভেট স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, নানা রকম ম্যানেজমেন্ট শিক্ষাকেন্দ্র খোলার জন্য শিক্ষা-ব্যবসায়ীদের মদত দিতে শুরু করলেন। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, যেন-তেন প্রকারেণ দলের লোকজনদের সেখানে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করা।
তাঁদের শাসনকালের প্রথম কুড়ি বছর বামফ্রন্ট সরকার গলা ফাটিয়ে দাবি করত, শিক্ষাক্ষেত্রে এই রাজ্যের সাফল্য আশাতীত। সেটা প্রমাণ করার জন্য ‘ভবতোষ দত্ত কমিশন’ নামে একটি কমিশন গঠন করে সরকার। কিন্তু সেই কমিশনের বিভিন্ন মন্তব্য ও সুপারিশ মন-পসন্দ না হওয়ায় তারা সেই রিপোর্টটাকে ধামাচাপা দিয়ে দেয়। ফের নিজেদের লোকজন নিয়ে নতুন করে গঠন করে ‘অশোক মিত্র কমিশন’ নামে আর একটি কমিশন। সেই কমিশন ভুলভাল তথ্য দিয়ে, মিথ্যে তথ্য ভরে, সরকারের মনের মতো করে একটি সাফল্যের খতিয়ান সাজিয়ে দেয়। যদিও মাঝেমধ্যে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বেশ কয়েক বার ইতিমধ্যেই স্বীকার করে নিয়েছেন, শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের কিছু কিছু ভুল হয়েছে।
– ওদের সব থেকে বড় ভুল বোধহয় প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়া, তাই না?
তেরো নম্বর বলতেই নবীন মাস্টার বললেন, সব থেকে বড় ভুল কি না বলতে পারব না। তবে বড় ভুল তো অবশ্যই। ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম’ বলে এই সরকার যে মারাত্মক কেলেঙ্কারি করেছিল, তা সত্যিই নজিরবিহীন। আর তার ফলে, শহর আর শহরতলির লোকেরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল, এই সরকার আসলে এই রাজ্যে দু’টি আলাদা সমাজ তৈরি করতে চায়। একটি ইংরেজি জানা। আর একটি ইংরেজি না জানা। যারা ইংরেজি জানবে না, পরবর্তিকালে প্রতিযোগিতামূলক সব কিছুতেই তারা পিছিয়ে পড়বে। আর যারা ইংরেজি জানবে, তাদের সামনে খুলে যাবে একটার পর একটা দরজা। তাই যেখানে ইংরেজি পড়ানো হয়, সেই সব বেসরকারি স্কুলে অভিভাবকেরা গিয়ে ভিড় করতে লাগলেন। আর ওই সব বেসরকারি স্কুলগুলো ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করল। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বছর বছর বাড়তে লাগল তার খরচাপাতি। নিয়ন্ত্রণ করার কেউ ছিল না। সেই সব স্কুলে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাতে গেলে ডোনেশন দিতে হচ্ছিল স্কুলের রমরমা অনুযায়ী ২৫ হাজার, ৫০ হাজার, কোথাও কোথাও তা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল লাখ টাকার গণ্ডিকেও। যে খরচ বহন করতে গিয়ে কাল-ঘাম ছুটে যাচ্ছিল বহু অভিভাবকের। আসলে এই সরকার পরোক্ষে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে যে, যার যত টাকা, এই রাজ্যে শিক্ষায় তার তত অধিকার।
– হঠাৎ করে এই সরকার ইংরেজি তুলে দেওয়ার মতো এ রকম একটা জঘন্য সিদ্ধান্ত নিতে গেল কেন?
– তার উত্তর খুঁজতে গেলে সি বি আইয়ের বাছাই করা নিরপেক্ষ কয়েক জন প্রতিনিধিকে নিয়ে একটা তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। আর তা হলেই ধরা পড়বে সি পি এমের এক-একটা রাঘব বোয়াল।
– কেন?
তেরো নম্বর প্রশ্ন করতেই নবীন মাস্টার বললেন, কারণ এর পিছনে ছিল তারা। তারাই ইংরেজিটাতে তোলার জন্য কলকাঠি নেড়েছিল। ইংরেজি না তুললে লোকেরা যে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দিতে ঝুঁকবে না। ফলে ব্যবসায়ীরাও নতুন নতুন স্কুল খোলার কথা ভাববে না।
– কেউ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল খুললে তাতে সরকারের কী লাভ?
– কী লাভ মানে? প্রচুর লাভ। এই যে এক-একটা নতুন নতুন স্কুল গজিয়ে উঠেছে, এই সরকারের কাছ থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য শুধু পার্টি ফান্ডে কত টাকা ডোনেশন দেয় জানো?
– না।
– এক-একটা স্কুলে সি পি এমের ক’জন করে চাকরি পায় জানো?
– না।
– সন্ধ্যার পরে সেই সব স্কুলে কত নেতা মদ-মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে জানো?
– না।
– মধ্যরাতে সমাজবিরোধীদের নিয়ে কত রাজনৈতিক গোপন বৈঠক হয় জানো?
– না।
নবীন মাস্টার বললেন, শুধু তুমি নও, তোমার মতো এই রাজ্যের অধিকাংশ মানুষই এগুলো জানে না। নিজেদের আখের গোছাতেই এখানকার নেতা-নেত্রীরা ব্যস্ত। অথচ তাদেরকে সত্যিকারের কোনও কিছু করতে বলো, বলো অন্যান্য রাজ্য স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য এত কিছু করছে, আপনারাও কিছু করুন। দেখবে, অমনি ওরা বলবে, ফান্ড নেই।
তেরো নম্বর জিজ্ঞেস করল, সত্যিই কি এই সরকারের হাতে টাকা নেই?
– না না, টাকা থাকবে না কেন? সি এ জি বলছে, ২০০১-২০০৫ সালের মধ্যে এই রাজ্য সরকার তার শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ ৫২২.৪৮ কোটি টাকা খরচই করতে পারেনি।
– সেকী!
– হ্যাঁ। তুমি কি জানো, ১৯৭৮-‘৭৯ সালে এই রাজ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ছিল ১,৪৯,৩১৩। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর পরে, এত নতুন নতুন স্কুল গজিয়ে ওঠার পর, তখনকার তুলনায় পড়ুয়াদের সংখ্যা আরও আরও অনেক বাড়ার পরেও, ২০০৫-২০০৬ সালে সর্বসাকুল্যে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৪৫১। অর্থাৎ মাস্টারদের সংখ্যা এখন ১,৪৯,৭৬৪।
– তাই? এখন এ রাজ্যে মোট ক’টা স্কুল?
– এই মুহূর্তে ৪৯,৯৮৬টা। মানে, হিসেব করলে দেখা যাবে, স্কুল পিছু মাত্র ৩ জন করে শিক্ষক। বহু দিন ধরেই খালি পড়ে আছে ৫০ হাজারেরও বেশি শিক্ষকপদ। একজনকেও নিয়োগ করা হয়নি। বলা হয়, স্কুল শিক্ষায় মহিলাদের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। সব রাজ্যেই সেটা মানা হয়। কেরালায় যেখানে ৭৩ শতাংশ মহিলা শিক্ষক। এ রাজ্যে সেখানে মাত্র ২৫ শতাংশ।
তেরো নম্বর বলল, এ রাজ্য যখন বরাদ্দ টাকা খরচই করতে পারছে না, তখন আর কিছু না হোক, সেই টাকায় তো কিছু পার্ট টাইম শিক্ষক-শিক্ষিকা নিতে পারত।
– শিক্ষক-শিক্ষিকা নেবে কী? ২০০৫ সালের একটি হিসেবে দেখা গেছে, অন্তত ৩৭ শতাংশ স্কুল অত্যন্ত জরাজীর্ণ। ভেঙে ভেঙে একটি মাত্র ঘরে এসে ঠেকেছে। এ রকম বিদ্যালয়ের পরিমাণ ২১ শতাংশ।
– তাই নাকি?
– শুধু তাই-ই নয়, ২২ শতাংশ প্রাথমিক স্কুলে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ নেই ৯১.৫ শতাংশ স্কুলে। মেয়েদের আলাদা বাথরুম নেই ৮৪ শতাংশ স্কুলে। যার ফলে ঋতুমতী হলে বেশির ভাগ মেয়েই আর স্কুলের দিকে পা মাড়ায় না।
– শুনেছি, এই সরকারই নাকি এক সময় বলেছিল, প্রতিটি শিক্ষার্থীর বাড়ির এক কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত একটি করে প্রাথমিক স্কুল তৈরি করে দেবে?
নবীন মাস্টার বললেন, বলেছিল। কিন্তু আজও তা হয়নি। আর যেখানে যেখানে হয়েছে, তার মান এত নীচে যে, চতুর্থ শ্রেণির অনেক ছাত্র এক লাইনের একটা সরল বাক্য পর্যন্ত পড়তে পারে না। লেখার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। সামান্য যোগ-বিয়োগ করতে গিয়েও হোঁচট খায়।
তেরো নম্বর জিজ্ঞেস করল, তা হলে এ রকম স্কুল রেখে লাভ কী?
– লাভ একটাই। যাদের মাথা কোনও কাজ করে না। শুধু হাত-পা কাজ করে। যারা কোথাও কোনও দিন কোনও চাকরি পাবে না, হাতে করে তুলে দিলেও অযোগ্যতার জন্য মাত্র ক’দিনেই ভরাডুবি করে দেবে ব্যবসা, সেই ক্যাডারদের ওই সব স্কুলে চাকরি দিয়ে প্রায় বসিয়ে বসিয়ে মাস-মাইনে পাইয়ে দেওয়া।
– তাতে লাভ?
– দরকারের সময় তাদের কাজে লাগানো।
– তাই যদি হয়, তা হলে তো ওই সব ক্যাডার নামিয়েই এই নন্দীগ্রামেও ওরা কেমিক্যাল হাব তৈরি করতে পারে।
– না, পারবে না।
– কেন?
নবীন মাস্টার বললেন, কারণ ১৪ মার্চের ঘটনার পর সবার নজর এখন এ দিকে। তাই ওরা এখন ক’টা মাস কিচ্ছু করবে না। ঘাপটি মেরে পড়ে থাকবে।
– তা হলে অত দিন আমরা কী করব?
– কিচ্ছু না।
– তা হলে চলুন না, এর মধ্যে ক’দিনের জন্য একটু আঁধার গ্রামে যাই।
– না, এখন আঁধারগ্রামে আমাদের কোনও ভূমিকা নেই।
তেরো নম্বর অবাক। এখানে এমনি এমনি বসে থাকব?
– না।
– তা হলে?
– আমরা কাল জঙ্গলমহলে যাব।
– জঙ্গলমহলে! তেরো নম্বর হতবাক হয়ে গেল।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!