মালঞ্চা এবং: নবীন বরণ

বৈশালী ও নির্ঝর একই কলেজে পড়ে। বৈশালীর মা-বাবা ও এক ভাই আছে। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। মা গৃহকর্ত্রী। বাবার সোনার দোকান। নির্ঝরের বাড়িতে বাবা-মা আছে। এক দাদা ও বৌদি রয়েছে। বাবার বড় কাপড়ের দোকান আছে । বৈশালীর বাড়ি বুনিয়াদপুর। নির্ঝরের বাড়ি মালদা জেলার পান্ডুয়াতে। বুনিয়াদপুর কলেজ। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ত নির্ঝর। প্রথম বর্ষে পড়ত বৈশালী। সবে কলেজে ভর্তি হয়েছিল বৈশালী। খুবই সুন্দরী বৈশালী। ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা। জিন্সের প্যান্ট, ওপরে টপ আর চোখে সানগ্লাস পরে কলেজে আসত। হাতে থাকত দামি মোবাইল।

কলেজে নবীন-বরণ অনুষ্ঠান হচ্ছিল। যে-সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী কলেজে নতুন ভর্ত্তি হয়েছিল, তাদের কলেজ থেকে বরণ করে নেওয়া হচ্ছিল। নবীন-বরণ অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিল নির্ঝর। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে নির্ঝরের ভাল লাগত। বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেছিল। নির্ঝর লম্বা, ফর্সা, সুঠাম চেহারার যুবক। মাথার চুল বাদামি রং করা। ছাই রঙের জিন্সের প্যান্ট, সাদা রঙের টি-শার্ট। স্মার্ট। নির্ঝর সুন্দর ভাবে অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করছিল। অনুষ্ঠান মঞ্চের টেবিলের ওপর রাখা একটি ছোট বাক্স দেখিয়ে নির্ঝর মাইকে ঘোষণা করেছিল, “টেবিলের ওপর রাখা ছোট বাক্সটির ভেতর অনেকগুলো টুকরো কাগজে অভিনয়ের বিভিন্ন বিষয় লেখা রয়েছে। টুকরো কাগজগুলোকে হাত দিয়ে এলোমেলো করে দেওয়া হবে। একজন করে নবাগত ছাত্র -ছাত্রী মঞ্চের ওপর এসে বাক্সের মধ্যে হাত দিয়ে তার পছন্দ মতো একটি কাগজের টুকরো তুলবে। সেই কাগজের টুকরোটিতে যে-বিষয় লেখা থাকবে, সেই বিষয়ে তৎক্ষণাৎ মঞ্চের ওপর একক-অভিনয় করে দেখাতে হবে।” নবাগত ছাত্র -ছাত্রীরা একে-একে মঞ্চের ওপর গিয়েছিল। বাক্সের মধ্যে হাত দিয়ে কাগজের টুকরো তুলেছিল। কাগজে লেখা বিষয়ের ওপর যথাসাধ্য একক-অভিনয় করে আবার নিজের আসনে গিয়ে বসে পড়ছিল। অনুষ্ঠানটি দেখে নতুন ছাত্র-ছাত্রী সহ সকলে খুবই মজা পাচ্ছিল, ভীষণ আনন্দ উপভোগ করছিল। অনুষ্ঠান জমে উঠেছিল। বৈশালী মঞ্চের ওপর উঠে একটি কাগজের টুকরো তুলেছিল। কাগজে লেখা ছিল- ‘প্রেমের প্রস্তাবে অরাজি এক মেয়ের সাথে রাস্তার মধ্যে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া ছেলের দেখা হলে মেয়েটির ভাবভঙ্গি কেমন হবে?’ বৈশালী মঞ্চের ওপর একক-অভিনয়‌ শুরু করেছিল। বৈশালী দু’বার হেঁটে-হেঁটে মঞ্চের একদিক থেকে অপর দিকে গিয়েছিল। তারপর মঞ্চের মাঝখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর বৈশালী বড়-বড় চোখ করে তার সামনে দাঁড়ানো প্রেমপত্র দেওয়া অদৃশ্য ছেলের দিকে তাকিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে তার ফর্সা মুখমন্ডল লাল হয়ে উঠেছিল। নাকটি ফুলে তুলেছিল। পাতলা লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছিল। তার শরীর ফুঁসছিল। এরপর তার সামনে দাঁড়ানো প্রেমের চিঠি দেওয়া অদৃশ্য ছেলেটিকে তর্জনী তুলে শাসিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল। হাততালি আর হাততালি। হাততালিতে ভরে গিয়েছিল চারপাশ। নির্ঝর মাইকে ধরে বলেছিল, “আমরা সকলে বৈশালীর অভিনয়ে খুবই মুগ্ধ। ধন্যবাদ জানাই বৈশালীকে তার সুন্দর পরিবেশনের জন্য। বৈশালী তার আসনে বসেছিল। নির্ঝর বৈশালীর কাছে গিয়ে বলেছিল, “বৈশালী, খুবই সুন্দর হয়েছে তোমার অভিনয়। অপুর্ব! অসাধারণ! অতুলনীয়!”

নবীন-বরণ অনুষ্ঠানের ক’দিন পরের ঘটনা। বৈশালী শ্যাম্পু কিনতে একা বাইরে গিয়েছিল। শ্যাম্পু কিনে বৈশালী বাড়ি আসছিল। নির্ঝর বৈশালীর কাছে এসে বৈশালীর হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে গিয়েছিল। নির্ঝর বৈশালীকে প্রেমপত্র দিয়েছিল। বৈশালীর কাছ থেকে প্রেমপত্রের কোনও উত্তর নির্ঝর পায়নি। তারপর পনেরো দিন হল নির্ঝর কলেজে যায়নি।

আরও পড়ুন: বৈশালী ও নির্ঝরের কথা

দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প হল মুখা-শিল্প বা মুখোশ শিল্প। কুশমন্ডীর মহিষবাথানে রয়েছে গ্রামীণ হস্তশিল্প সমবায় সমিতি। এই সমিতিতে মুখা-শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন রকমের মুখোশ তৈরি হয়। মুখোসগুলো বানানো হয় গামা গাছের কাঠ দিয়ে। তবে বাঁশের মুখোশও তৈরি হয়। সমিতি থেকে কাঠ দেওয়া হয়। শিল্পীরা সমিতিতে এসে মুখোশ বানায়। সমিতি-ই মুখোশ বিক্রির ব্যবস্থা করে। বিভিন্ন দেবদেবী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতীর মুখোশ বানানো হয়। মহিষবাথানে প্রতি বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে মুখোশ-মেলা হয়। ঢাক,সানাই, ঘন্টা বাজতে থাকে আর মুখোশ পরে মানুষ খোলা মাঠে প্রচুর দর্শকদের সামনে নাচ করে দেখায়। এটাই মুখা-নাচ। এই শিল্পের জন্য ইউনেস্কো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কলকাতা,মুম্বাই,দিল্লি,গোয়া,বেঙ্গালুরুতে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার মুখোশের ব্যাপক চাহিদা। এই কাঠের তৈরি মুখোশ ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছে এবং ভীষণ সাড়া ফেলে দিয়েছে। মহিষবাথানে মুখা-শিল্প দেখে বাড়ি ফিরছিল বৈশালী। মনে একরাশ মুগ্ধতা। মুখা-শিল্পীদের কাছে বসে কাঠ দিয়ে মুখোস বানানো দেখেছিল।‌ শিল্পীদের হাতের অপুর্ব কাজে কাঠ থেকে বেশ কিছু সময়ের মধ্যে একটি কাঠের মুখোস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বৈশালী আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল,কীভাবে তার চোখের সামনে একটি কাঠ শিল্পীদের হাতের জাদুতে কথা বলে উঠেছিল,কেমন করে শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় কাঠের মুখোসেও ‘হাসি’ ফুটে উঠেছিল। বৈশালী অনুভব করছিল, শিল্পীদের সংস্পর্শে জড়বস্তু কাঠও জীবন্ত হয়ে ওঠে।

রাস্তার মাঝে বৈশালীর সঙ্গে নির্ঝরের দেখা। রাস্তার মধ্যে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বৈশালী। চমকে‌ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল নির্ঝর। বৈশালীর চোখ-মুখের আকৃতি পালটে গিয়েছিল। বৈশালী চোখ বড়-বড় করে নির্ঝরের দিকে তাকিয়েছিল। সমস্ত মুখমন্ডল লাল হয়ে গিয়েছিল বৈশালীর । নাকটি ফুলে-ফুলে উঠছিল। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছিল। সমস্ত দেহ ফুঁসছিল বৈশালীর। শেষে নির্ঝরের সামনে তর্জনী উঁচিয়ে,তর্জনী নাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল বৈশালী। এই ঘটনার প্রায় এক মাস হতে চলল লজ্জায়,অপমানে নির্ঝর আর কলেজমুখো হয়নি।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!