জীবনানন্দের নার্স

১৯৫৪ সালের ২২ শে অক্টোবরে জীবনানন্দের মহাপ্রয়াণ হয়ে গেছে, জীবনানন্দ দাশের নার্স শান্তি চুপচাপ ‘বনলতা সেন’ কবিতার বইটি কারো কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আজ রাতে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরে বইটি নিয়ে বসেছেন শান্তি। মনে পড়ছে দুর্ঘটনার পর অজ্ঞান অবস্থা থেকে প্রথমবার জেগে জ্বরের ঘোরে জীবনানন্দ হাসপাতালে গভীর রাতে ভুমেন্দ্র গুহ, সমর চক্রবর্তীদের সবাইকে ডেকে বলেছিলেন:”আমি কি দেখতে পাচ্ছি জানো? ‘বনলতা সেন’-এর পাণ্ডুলিপির রং।”

জীবনানন্দ কেমন জানি কবিতা লেখেন? বইটা উল্টেপাল্টে শান্তির তাই মনে হলো। মাঝেমাঝে তিনি কবিতা পড়েন। কলেজ জীবনে অভ্যাস ছিল কবিতা নিয়মিত পড়ার। তাই এ সময়ে যারা বিখ্যাত তাদের কারো কারো নাম তিনি জানেন। যেমন: বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র তো সিনেমার গানটান লিখে এখন বেশ বিখ্যাত। ‘আবার কুড়ি বছর পরে যদি তার সাথে দেখা হয় যদি’—’বনলতা সেন’ কবিতাটি ছাড়িয়ে এ পর্যন্ত পড়ে শান্তি ধাক্কা খেলেন। জয়দীপের কথা মনে পড়লো তার। জীবনানন্দ জয়দীপের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছেন। জয়দীপ ছিল তার প্রথম প্রেম। সে প্রথম প্রেম তার জীবনে ফিরে এসেছিল ঠিক কুড়ি বছর পরে। কুড়ি বছর পরে জীবনানন্দের মতোই তার দেখা হয়েছিল শেষ শয্যায় এই শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। ‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি, বছরের পার–/তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!’

মেঠোপথ, চাঁদ, এক রাশ পাতার ওপারে মুখ। এক ঝটকায় আবার জয়দীপ ফিরে এলো। আবছা ছায়ার মতো। কুয়াশা ফিরে আসে কার্তিকের রাতের। জয়দীপের মুখটাও যেন জীবনানন্দের মতো, ভেবে অবাক হয় শান্তি। হাওয়া এসে আছড়ে পড়ছে ঘরে, মশারিতে, ভাবনায়। তখন পড়ছে:’গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল-অসংখ্য নক্ষত্রের।’

শান্তির এখন বড্ড লোভ করছে জীবনানন্দকে পুনর্বার দেখার। যেন ঐ মানুষটার মুখ দেখা হলে এসব কবিতার অন্তস্থ উদ্ভাবন খুব সহজ হয়ে যাবে। অথবা কেন জানি সব ঘটনা মিলে যাচ্ছে তার জীবনের সঙ্গে। জীবনানন্দ কি জয়দীপ? জয়দীপ কি জীবনানন্দ? জীবনানন্দের কথা ভাবলে মৃত নক্ষত্রেরা যেন কথা বলে ওঠে। শান্তি জানালা থেকে তাকান আকাশের দিকে, স্বাতী তারার দিকে। সেসব নক্ষত্র যেন জয়দীপের মুখ ভেসে উঠছে কেবলি। বাদুড় উড়ে যায়, কালো ‍ছায়া ওড়ে।

‘শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ।’ শান্তি আবার আকাশের দিকে দেখেন, বুক ভরে গভীর শ্বাস নেন। একবার দীঘা বেড়াতে গিয়ে জয়দীপ তার জন্য একটা শাল এনে দিয়েছিল। সে শাল গায়ে জড়িয়ে তিনি আর জয়দীপ তাদের পুরনো বাড়ির বারান্দায় কতোদিন বসে থেকেছেন। শীতের বেলা। প্রেমিক চিলপুরুষের পাশে। আর জয়দীপ মাঝে মাঝে শালের ওপর থেকেই ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছে। সেই যে ওরা একবার পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল, সেখানে বাংলো বাড়ির বারান্দায় বসে দু’জনে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে সূর্যোদয় দেখা। এখন সেসব স্মৃতি জীবনানন্দ কথিত প্রেমের ভয়াবহ স্তম্ভ হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। যে স্মৃতি নিয়ে বাঁচাও যায় না, আবার মরাও যায় না।

শান্তির আড়ষ্টতা কাজ করছে, অস্ফুট স্বরে বলেন নিজেকে: ‘অভিভূত হয়ে গেছি।’ পাশে যেন পৃথিবী নেই, মুছে গেছে কীটের মতোন। এই টেবিল, অন্ধকার ঘর ছাড়া যেন লোকান্তরে কেউ নেই, কিছু নেই। কোথাও যেন জেব্রার চিৎকার শোনা যায়, হৃদয় ভরে গেছে ঘাসের গন্ধে। হৃদয় তো পৃথিবী থেকে সেই কবে গেছে জীবনানন্দ, তুমি কেন আজ আবার ফেরালে কবিতার ছলে। ফেরালেই যদি তুমি নেই কেন? কেন তুমি চলে গেলে মহাপ্রয়াণে? তুমি তো শুনেছিলে মিলনোন্মুক্ত বাঘিনীর গর্জন। বনহংস হওয়া হলো না যে আমার। এখন এই হাসপাতালে রোগ-শোকের করিডরে বাধা পড়ে গেছি হে মহাহিম। আর ফিরে আসি শুধু আমার এই নিরালা নীড়ে।

শস্যের ভেতরে গা ভাসানো দিন সে কবেই চলে গেছে আমার জীবনানন্দ। রক্তের স্পন্দন আর টের পাই না, কারো পাখনায় লাগে না আমার পালক। পিস্টনের শব্দ শুধু তাড়া করে ফেরে নাগরিক কোলাহলে। তোমাকেও শুতে হলো এই স্তব্ধতার মাঝে। সুস্বাদু অন্ধকার! ভাবালে বটে। সত্যিই তো। এই অন্ধকারই তো আমি ভালোবাসি। তাই তো সুস্বাদু। ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে।’ তবু দেখো আমি বেদনা খুঁড়ে বসেছি। তোমার কবিতাই আমার বেদনা খুঁড়ে বের করছে, তোমার কবিতার বই ‘বনলতা সেন’ হাতে নিয়ে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে আছি। তুমি যখন নাকে নল নিয়ে মুচড়ে মুচড়ে উঠছিলে তখন তোমার কবিতার চিল এই শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের ওপরে ওপরে ঘুরে ঘুরে করুণ স্বরে ডাকছিল, কী এক উদাত্ত আহ্বানে আমি জানি না। আমি কি সত্যিই জানি না? টের পাই। কিন্তু ব্যক্ত করতে পারি না। অজস্র। অপারবার তার ডাক। তার ক্ষিপ্র ডানার শব্দ আর কেউ শুনতে না পেলেও গাড়িঘোড়ার শব্দের মাঝেও তা আমার কান পর্যন্ত আসছিল। তুমি যে নক্ষত্রের বিশাল আকাশের পানে চলে যাবে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তুমি ঘুমের ঘোরে একবার আমাকে ডেকেছিলে, কিন্তু তোমার চোখ পড়ে ছিল কবেকার পাড়াগাঁয়ে। আমাকে কি তোমার অরুণিমা সান্যাল মনে হয়নি? আমার ভেতরে কি শব্দহীন জ্যোৎস্না তুমি দেখতে পাওনি? কবি, তোমার দূরদৃষ্টি তো কান্তারের সমান দূর। আমি কিন্তু কোনো এক সন্ধ্যার আঁধারে নীলাভ ব্যথিত চোখ নিয়ে কবি তোমাকে বলতে পারতাম:’তোমাকে চাই’। এই দুধে আর্দ্র স্তন তোমাকে দিতে পারতাম, নিজের স্তনের দিকে তাকায় শান্তি। কতোদিন কোন পুরুষ হাত রাখেনি এখানে। ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!