ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ৩৫

।। পর্ব- ৩৫।।

প্রায় দেড়শো বছর আগে আমেরিকার সিয়াটেল জনগোষ্ঠীর এক প্রতিনিধি ওয়াশিংটনের সাদা মানুষদের সর্দারকে লিখেছিলেন, ‘এই পৃথিবী আমাদের মা। আমরা একে তৈরি করিনি। এ-ই আমাদের তৈরি করেছে। তাকে বিক্রি করার কথা তোমরা বলো কী করে? আমরা তোমাদের বুঝতে পারি না।’
যিনি এটা বলেছিলেন, তাঁর নাম জানার কথা নয় ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামের এক নিরক্ষর বৃদ্ধার। তিনি যখন দেখলেন, আন্দোলন করে টানা বারো বছর ঠেকিয়ে রাখার পরেও ওড়িশার কাশীপুরে বক্সাইটের খনি খননের জন্য জঙ্গল কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার চেষ্টা চালাচ্ছে ওড়িশা সরকার, ১৯৯৮ সালে জমায়েত হওয়া বিশাল জনগোষ্ঠীর সামনে তখন তিনি গলা ফাটিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা তৈরি করিনি এই মাটি, এই জঙ্গল। তোমরাও তৈরি করোনি। আমরা কেউ এ সবের মালিক নই। তবে কেন তোমরা এই মাটি, এই জঙ্গল বিক্রি করতে চাইছ?’
সেই একই কথা ২০০৩ সালে কেরলের আরণ্যক আদিবাসী গোষ্ঠীর তেত্রিশ বছর বয়সি এক নেত্রী, সি কে জানু বলেছিলেন, ‘এই জঙ্গল, এই জঙ্গলের মাটি আমাদের মা। মায়ের চেয়েও বেশি আপন। এ কখনও আমাদের ছেড়ে যায়নি। যায় না। যাবে না। তাকে আমরা কিছুতেই কেড়ে নিতে দেব না।’
যাঁরা জমিতে জন্মায়, জমিতেই মারা যায়, জমির স্বাদ, গন্ধ, রং যাঁদের রক্তে মিশে থাকে, তাঁরাই বুঝি এ রকম ভাবে ভাবতে পারে। তাই কেউ তাঁদের জমিতে থাবা বসাতে এলে তাঁরা মরিয়া হয়ে ওঠে। ১৭৬৫ সালে এ দেশে ইংরেজরা আসার পর, ইংরেজদের হাত ধরে এসেছিল তাদের তোষামোদকারী একদল লোভী জোতদার। তারা নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে, তাতেও না হওয়ায়, জোর করে আদিবাসীদের জমি দখল করতে গিয়েছিল। আর তখনই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন আদিবাসীরা। শুরু হয়েছিল মুণ্ডা বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহ দমন করার জন্য আদিবাসীদের ওপর শিকারি কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইংরেজ সেনাবাহিনী। তাদের আধুনিক অস্ত্রের কাছে বারবার পরাজিত হলেও আদিবাসীরা কিন্তু লড়াই ছেড়ে কখনও পালিয়ে যাননি।
তাঁরাই কখনও কোল বিদ্রোহ করেছে। কখনও ভূমিজ বিদ্রোহ, কখনও গারো বিদ্রোহ। কখনও আবার উলগুলান। ১৮৫০ থেকে ১৮৫৫ সাল অবধি করেছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহ উপড়ে ফেলার জন্য চারদিক থেকে ঘিরে ব্রিটিশ বাহিনী একদিনে খতম করেছিল অন্তত দশ হাজার আদিবাসীকে। তাতেও দমেনি আদিবাসীরা। তাই ব্রিটিশ সরকার শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তাঁদের জন্য স্বায়ত্তশাসন ঘোষণা করেছিল। গড়ে উঠেছিল সাঁওতাল পরগনা। দেখা গেছে, শহরের লোকেরা নয়, লোক পালটালেও, বিদ্রোহের নাম পালটালেও, জমির জন্যই বারবার লড়াই চালিয়ে গেছেন এই দেশের আদিবাসী মানুষজনেরাই।
এঁরাই এক সময় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। আজও ইতিহাস হয়ে আছে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা। বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্ব। তবু, শুধু ইংরেজ আমলেই নয়, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও, এত বছরেও এই দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতো এই রাজ্যের জঙ্গলের আদিবাসী ও অন-আদিবাসীরা যেমন ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধে থেকে বঞ্চিত এবং উপেক্ষিত হয়েছেন, তেমনি বারবার লাঞ্ছিত হয়েছেন পুলিশের কাছে, প্রশাসনের কাছে। এমনকী সংবিধানেও তাঁদের কোনও অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অথচ এঁরা কিন্তু কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসেননি। এই দেশের উপরে সবচেয়ে বেশি অধিকার কিন্তু এঁদেরই। কারণ এঁরাই আসল নাগরিক। প্রকৃত ভূমিপুত্র।
তবুও ওঁরা কোনও দিন কোনও দাবি করেননি। জঙ্গলের যেখানে জল আছে, সেখানে বছরে তিন-চার বার ফসল ফলিয়েছেন। যেখানে জলের তেমন ব্যবস্থা নেই, সেখানে চাষাবাদ করতে পারেননি ঠিকই, তবু কারও মুখাপেক্ষী হয়ে চুপচাপ বসে থাকেননি। বেঁচে থাকার জন্য বন থেকে কুড়িয়ে এনে শালপাতার থালা বানিয়েছেন। সেই থালা বুধবার-বুধবার প্রতি হাজার পিস মহাজনের কাছে বিক্রি করেছেন ৭০ টাকা করে। কেউ কেউ কেন্দুপাতা তুলে বিড়ি বানানোর জন্য সাপ্লাই দিয়েছেন লোকালয়ে। কেউ কেউ জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে এনেছেন জ্বালানি কাঠ। এক গণ্ডা বিক্রি করলেই ৭০ টাকা। এ ছাড়াও করেছেন খেতমজুরি। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টে অবধি কাজ করলেই চল্লিশ টাকা। সঙ্গে বিনে পয়সায় এক বেলা খাওয়া। এই ভাবেই কোনও রকমে কেটে যাচ্ছিল তাঁদের সরল সাদামাঠা জীবন। যাবতীয় দুঃখ, কষ্ট, অসুবিধাটাকে জীবনেরই একটা অংশ মনে করতেন তাঁরা।
কিন্তু হঠাৎ করে স্বাধীনতার ৫৭ বছর এবং পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ২৩ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর ২০০০ সালে এই রাজ্যের অনগ্রসর, আদিবাসী, উপজাতি মানুষদের জন্য কিছু একটা করার কথা প্রথম ভাবা শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেই মতো পুরুলিয়ার ২০টি, বাঁকুড়ার ১৬টি, পশ্চিম মেদিনীপুরের ১৮টি, বীরভূমের ১০টি ও বর্ধমানের ১০টি– মানে, পাঁচটি জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত মোট ৭৪টি ব্লক নিয়ে গড়ে তোলে ‘পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ’, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় প.উ.প।
এই প. উ. প-র মন্ত্রী করে দেওয়া হয় কেশপুরখ্যাত সুশান্ত ঘোষকে। তাঁর উদ্যোগেই এই আদিবাসী মানুষরা এখন কী অবস্থায় কেমন আছেন এবং তাঁদের ঠিক কতটা উন্নয়ন দেওয়া প্রয়োজন, সে সব সমীক্ষা করে বার করার জন্য এই সরকার দায়িত্ব দেয় খড়গপুরের আইটিটি আই-কে।
তাদের সমীক্ষা থেকে জানা যায়, পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের এলাকা ২১,৮২ লক্ষ হেক্টর। ২০০১ জনগণনা অনুযায়ী মোট জন সংখ্যা ১,০০,৩৭,২৫। মোট গ্রাম পঞ্চায়েত ৬৪৮টি। গ্রাম ১২,৫৫৮টি। যার মধ্যে মাত্র ২৮৭০টি গ্রামের সঙ্গে বাস-যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে। প্রতিটি গ্রামেই শৌচালয়ের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র ৯৯৬০টি। মধ্য পর্যায় শিক্ষাকেন্দ্র ৯৯২টি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ১০৩৫টি। সাতটি ব্লকে তো প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রই নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্র ২৫৪২টি। তিনটি ব্লকে কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। হিসেব করলে দেখা যাবে, প্রতি ১৫৭২ জন মানুষের জন্য হাসপাতালে বেড রয়েছে মাত্র একটি করে। প্রতি ১২,৭৫০ জন মানুষ পিছু একজন করে ডাক্তার।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও জঙ্গলমহলে নেই পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থা, নেই রাস্তাঘাট, নেই বিদ্যুৎ। এবং এলাকার লোকজনদের জন্য নেই তেমন কোনও কাজও। শুধু নেই, নেই আর নেই।
সরকারের ১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্পের কাজ পাওয়ার ছবি সারা পশ্চিমবঙ্গেই খুব খারাপ। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে এর অবস্থা আরও শোচনীয়। দক্ষিণ দিনাজপুরে বছরে ১০০ দিনের কাজের মধ্যে গড়ে দু’দিনও কাজ পায় না ওখানকার লোক। পশ্চিম মেদিনীপুরে বছরে কাজ পায় গড়ে মাত্র ছ’দিন। মালদহ পায় একদিনের সামান্য একটু বেশি। দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের যে জেলাগুলোতে সব চেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত মানুষের বাস, যে জেলাগুলিতে কোনও কাজ নেই, বেছে বেছে সেই জেলাগুলোতেই ১০০ দিনের কাজের হাল সবচেয়ে করুণ। ফলে পেট পুরে দু’বেলা ডাল-ভাতও খেতে পারেন না তাঁরা। শতকরা ৯৫টি শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে। তার মধ্যে দশ শতাংশের রক্তাল্পতা তীব্র ধরনের। আর এ জন্যই শিশু মৃত্যুর হারও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। না, এটা কারও মন গড়া হিসেব নয়, এটা ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-২ (১৯৯৮-‘৯৯)-এর রিপোর্ট।
দীর্ঘ দিন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সমীক্ষা চালানোর পর পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ‌ এর জন্য ২০০৭ থেকে ২০১৭– এই দশ বছরে মোট ১,৬০,৩,৭৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে সুপারিশ করে খড়গপুর আইটিটি আইয়ের সেই সমীক্ষক দল। কিন্তু এই সরকার তাতে কর্ণপাত না করে ২০০৭-‘০৮ সালে বরাদ্দ করে মাত্র ৩০.৮০ কোটি টাকা। ২০০৮-‘০৯ সালে ৪২.৪৯ কোটি টাকা। মানে, পাঁচটি জেলার ৭৪টি ব্লকের সাড়ে বারো হাজারেরও বেশি গ্রামের প্রায় এক কোটি আদিবাসীদের জন্য বছরে বরাদ্দ মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশ কোটি টাকা। তা হলে মাথা পিছু বছরে কত করে পড়ল? মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা। এক বছরে ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় কারও উন্নয়ন করা একমাত্র পি সি সরকারের পক্ষেই সম্ভব।
তবু, দেরিতে হলেও রাজ্য সরকার আদিবাসীদের উন্নয়নের কথা ভেবেছিল। সত্যিই ভেবেছিল কি! যত দূর জানা যায়, এটা ছিল একটা আই ওয়াশ। আসলে তার বহু আগেই তারা ভিতরে ভিতরে ঠিক করে ফেলেছিল, পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিটা জিন্দাল গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেবে। যাতে জিন্দালরা ওখানে ওদের বৃহত্তম ইস্পাত কারখানাটা গড়ে তুলতে পারে। সে জন্যই এ ধরনের একটা চাল দেওয়া।
শালবনি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এটা জানতে পেরে জঙ্গলমহলের আদিবাসীরা ফুঁসে উঠেছিলেন। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও কিছু করে উঠতে পারলেন না। সরকারের কড়া নজরদারির মধ্যে গড়ে উঠল জিন্দালদের কারখানা। এ সময় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া আদিবাসীদের পাশে এসে দাঁড়াল অন্য জায়গা থেকে আসা একেবারে অচেনা অজানা, পড়াশোনা জানা কিছু শহুরে ছেলে। তারা বলল, আর কত দিন পড়ে পড়ে মার খাবেন? এ বার ঘুরে দাঁড়ান।
২০০৮ সালের ২ নভেম্বর জিন্দালদের ইস্পাত কারখানার উদ্বোধন করতে এলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং কেন্দ্রীয় ইস্পাত মন্ত্রী রামবিলাস পাশোয়ান। উদ্বোধন সেরে ওই দুই মন্ত্রীর কনভয় যখন সারিবদ্ধ হয়ে কলকাতার দিকে ছুটছে, তখন কলাইচণ্ডীর কাছে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের একটি গাড়িতে আচমকা মাইন বিস্ফোরণ ঘটে গেল। তছনছ হয়ে গেল গাড়িটি। তবে না, কোনও প্রাণহানি ঘটল না। এটা দেখে তাই কেউ কেউ বলল, যারা এটা করেছে, তারা কেউ কাউকে মারার জন্য করেনি। শুধু ভয় দেখাতে চেয়েছে, তারা কী করতে পারে।
কিন্তু এটা করল কারা? গুঞ্জন ওঠার আগেই এই মাইন বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করে নিল মাওবাদীরা। সঙ্গে সঙ্গে মাওবাদীদের ধরতে সে দিনই ছুটোছুটি শুরু করে দিল পুলিশ-প্রশাসন। লালগড় থানার পুলিশ মাওবাদীদের খুঁজতে খুঁজতে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে লালগড়-বিনপুরেও পৌঁছে গেল। তল্লাশিতে বাধা দিতে গিয়েছিলেন লক্ষ্মী প্রতিহার। তাঁকে আছড়ে মেরে ফেলল ক’জন পুলিশ। তাঁর সঙ্গে মারা গেল তাঁর গর্ভস্থ সন্তানও।
তাঁর স্বামী দীপক প্রতিহার যাতে কোনও ট্যাঁ ফুঁ করতে না পারেন, সে জন্য তার পর দিন ৩ নভেম্বর তাঁকে মাওবাদী বলে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল তারা। হাজার মেরেও তাঁকে দিয়ে তাদের লেখা মনগড়া বয়ানে জোর করেও স্বাক্ষর করাতে পারল না। অগত্যা ৪ নভেম্বর, এস পি রাজেশ সিংহের নেতৃত্বে লালগড় থানার ও সি সন্দীপ সিংহ রায়, কেউ যেন পালাবার সুযোগ না পায়, খুব ভোরে, আকাশে আলো ফোটার আগেই বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে পৌঁছে গেল ছোটপেলিয়া গ্রামে। মাওবাদীদের খোঁজার অজুহাতে এক-একটা বাড়ির দরজা-জানালা ভেঙে জোর করে ঢুকতে লাগল ভিতরে। যাঁকে সামনে পেল তাঁকেই মারধর করতে লাগল। মেয়েদের উপর চালাতে লাগল অকথ্য অত্যাচার।
একটা ঘরে পাশাপাশি দুটো খাটিয়ার একটায় শুয়ে ছিলেন চিতামণি মুর্মু। অন্যটায় তাঁর স্বামী। হঠাৎ আবছা আলো-আঁধারিতে চিতামণি দেখতে পেলেন, একটা লোক তাঁর স্বামীর মুখ চেপে ধরে জোর করে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে উঠে উনি রুখে দাঁড়ালেন। লোকটা তাঁর স্বামীর দিকে এক হাতে বন্দুকের নল তাক করে অন্য হাতে মুহূর্তের মধ্যে চিতামণির শাড়ি টান মেরে ছিঁড়ে দিল। শুরু হয়ে গেল ধস্তাধস্তি। বউকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বামীও। দু’জনের সঙ্গে পেরে উঠছে না দেখে লোকটা তখন বন্দুকের বাঁট দিয়ে সজোরে মারল চিতামণির বাঁ চোখে। গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত।
শুধু চিতামণি নয়, ওই দিন সকালে ওই গ্রামের গঙ্গামণি মুর্মু, ছবিরানি সোরেন, কল্পনা হাঁসদা, রাধিকা মুর্মু, ডমনি মুর্মু, ফুলমণি মুর্মু, পানমণি মুর্মু-সহ পনেরো জন মহিলা বন্দুকের কুঁদোয় আহত হন। কারও চোখ, কারও পা, কারও হাত, কারও আবার বুক-পিঠ-ঘাড় জখম হয়। ‘মাওবাদীদের লুকিয়ে রেখেছিস কেন? সর’ বলে ঘরে ঘরে ঢুকে তাণ্ডব চালায় তারা। জিনিসপত্র তছনছ করে। লুঠপাট চালায়। তল্লাশির নামে স্কুল থেকে ফেরা কিশোরী মেয়েদের প্রকাশ্য রাস্তায় দাঁড় করিয়ে, জামা-প্যান্ট খুলে সারা শরীর হাতরায়। তিন জন অল্পবয়সি ছাত্রসমেত এগারো জনকে মাওবাদীদের এজেন্ট বলে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায়। আর বড়দের, হাতের সামনে যাঁদের পেল অকথ্য ভাবে মারতে মারতে তাঁদের থানায় নিয়ে গেল।
তাঁদের কেন মারছে? কেন থানায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে? কী তাঁদের অপরাধ? গ্রামবাসীদের শত প্রশ্নেও কিছু জানাল না পুলিশ-প্রশাসন। উপরন্তু কুকুর-বেড়ালের মতো দূর ছাই দূর ছাই ব্যবহার করতে লাগল। ফলে ৫ নভেম্বর থেকে শুরু হল আদিবাসীদের আন্দোলন। দলিলপুর ও তার আশপাশের গ্রামের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। পুলিশের জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নন্দীগ্রামের কায়দায় রাস্তা কাটা শুরু করলেন। রাস্তার উপরে বড় বড় গাছ কেটে ফেলে রাস্তা অবরোধ করলেন। যাতে পুলিশের গাড়ি না আসতে পারে। তেরো দফা দাবিতে বলা হল, অভিযুক্ত পুলিশদের ক্ষমা চাইতে হবে।
ক্ষমা? বিদ্রুপের হাসি হাসল পুলিশমহল। কেউ কেউ বলল, আদিবাসীদের এত বড় সাহস? ঠিক আছে, আমরা ওদের দেখে নেব। এর পর মাওবাদী খোঁজার নামে আদিবাসীদের উপর শুরু হয়ে গেল এক ন্যক্কারজনক নিপীড়ন।
আচমকা পুলিশি আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যান দীর্ঘ দিন ধরে রাষ্ট্রীয় দমন, পীড়ন, অনুন্নয়ন, অনাচার, বঞ্চনার পাশাপাশি সি পি এমের অত্যাচারে জর্জরিত, শোষিত, নিপীড়িত, জঙ্গলের সহজ, সরল, সাধারণ, মানুষগুলো। বাধ্য হয়ে তাঁরা এককাট্টা হয়ে তৈরি করেন ‘পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি’। সেই কমিটির হাল ধরতে এগিয়ে আসেন ছত্রধর মাহাত, সিধু সোরেন, সন্ধ্যা মাহাত, লালমোহন টুডুরা।
আদিবাসীরা যে সি পি এম আর বামফ্রন্ট সরকারের কাছে বারবার আক্রান্ত হয়ে কোণ ঠাসা হতে হতে শেষ অবধি জোটবদ্ধ হয়েছে, সে খবর মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ল লালগড় থেকে ছত্রিশগড়। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ ছাড়িয়ে মালকানগিরির প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনজাতিদের মধ্যে।
সে খবর পেয়ে নবীন মাস্টার আর তেরো নম্বর যখন জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের সঙ্গে দেখা করল, তখন তাঁরা সাফ জানিয়ে দিলেন, আমরা মোটেও যুদ্ধ করতে চাই না। কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করলে আমরা যুদ্ধ করতে তৈরি।
তাঁদের কথা শুনে নবীন মাস্টারের মনে পড়ে গেল সেই বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান– মা, তোমার ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয়, শান্ত ছেলে। তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি। তোমার ভয় নেই মা আমরা, প্রতিবাদ করতে জানি…
উনি জানেন, এ গানের বহু দশক আগেই এই একই কথা লিখে গেছেন চিনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও সে তুংও। সেই হিসেবে গোটা জঙ্গলমহলটাই কিন্তু আজ মাওবাদী।
এ রকমই এক সরলীকরণ ভাবনা থেকে মাওবাদী সন্ত্রাস প্রতিহত করার জন্য আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নির্দেশে সাধারণ গ্রামবাসীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যৌথ বাহিনী। শুরু করে দিল বাড়ি বাড়ি ঢুকে চিরুনি তল্লাশি। যে সব বাড়ির মেয়েদের দেখতে-শুনতে ভাল, সেই সব বাড়ির পুরুষদের নামে ভূরি ভূরি মিথ্যে মামলা রুজু করে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল পুলিশ। তার পর পুরুষ-শূন্য বাড়িতে গিয়ে ওই সব মেয়েদের উপর চালাতে থাকল পাশবিক অত্যাচার। কেউ বাধা দিতে এলেই তার হাড়গোড় ভেঙে মাংসের একটা পিণ্ডে পরিণত করে দিতে লাগল যৌথ বাহিনীর লুম্পেনরা। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে থাকল ঘরের আসবাব। ধান-চাল মিশিয়ে দিতে লাগল। ভাতের হাঁড়িতে ঢেলে দিতে থাকল কেরোসিন তেল। আগুন ধরিয়ে দিতে লাগল বাড়িতে বাড়িতে।
এর প্রতিবাদে নানা রকম দাবি নিয়ে ঝাড়খন্ড দিশম পার্টির ডাকে ২০০৮-এর ১৬ নভেম্বর পালিত হল বাংলা বনধ। সে দিনই ওই দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক-সহ তিয়াত্তর জন কর্মীকে মিথ্যে কেসে জড়িয়ে বাঁকুড়ার তালডাংরার দলীয় কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হল। এর ফলে আগুনে যেন ঘি পড়ল। আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ল আন্দোলন। লালগড়ের দলিলপুর থেকে ঝাড়গ্রাম, বিনপুর, দহিজুড়ি, জামবনি, বেলপাহাড়ি, নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, সাঁকরাইলে। বাঁকুড়ার সারেঙ্গা, সিমলাপাল, রানিবাঁধ, রাইপুরে। পুরুলিয়ার বান্দোয়ান, বলরামপুর, আড়ষা, বামমুন্ডি-সহ বর্ধমান, বীরভূম, হুগলি জেলার গ্রামে গ্রামে।
কয়েক জন আদিবাসী মিলে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে গোপনে শলা-পরামর্শ করার জন্য একদিন জড়ো হয়েছিলেন বেলপাহাড়ি থানার চাকাডোবা বাজারে। ভেবেছিলেন, বাজারে তো বহু লোকই যায়। সে ভাবেই ওঁরা যাবেন। কেউ টের পাবে না। কিন্তু সরষের মধ্যেই ভূত থাকে। সেই ভূতদের মারফতই যৌথ বাহিনীর কাছে কী করে যেন পৌঁছে গিয়েছিল এই গোপন বৈঠকের খবর। কালবিলম্ব করেনি তারা। খবর পাওয়া মাত্র বিশাল বাহিনী নিয়ে গোটা বাজারটাই ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল যৌথ বাহিনী।
বারবার বলা সত্ত্বেও পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে বামফ্রন্ট সরকার কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ায় আদিবাসীদের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর আকার নিতে শুরু করল। ঝাড়গ্রাম মহকুমা ছাড়িয়ে ভিন্ন জেলাতেও ছড়িয়ে পড়ল তার আঁচ। নিজের এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ঝাড়গ্রামের মহকুমা শাসক আর. এ. ইজরায়েল দু’পক্ষকে নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা চালিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্তারা ঠিকঠাক ভাবে এগিয়ে না আসায়, তিনি তেমন কিছু করে উঠতে পারলেন না।
এর মধ্যেই ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারির শুরুতেই সি পি এম নেতা নন্দলাল পালের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় রামগড়ের খাসজঙ্গলে। পাশে পাওয়া যায় ছড়ানো-ছেটানো অনেকগুলো মাওবাদী লিফলেট। যে ভাবে নকশাল আন্দোলনের সময় সাধারণ মানুষকে নকশালদের উপরে খেপিয়ে তোলার জন্য কংগ্রেসরাই মুখে কাপড় বেঁধে বাজারে বা হাটে এসে কিংবা প্রকাশ্য রাজপথে নিচুস্তরের কংগ্রেস-কর্মীদের আচমকা খুন করে ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’ বলতে বলতে চলে যেত অথবা গুমখুন করে পাশে ছড়িয়ে রেখে যেত ‘চারু মজুমদার জিন্দাবাদ, নকশালবাড়ি জিন্দাবাদ’ লেখা লিফলেট। সেই একই ছকে এখনও সিপি এমের হাইকম্যান্ডরা এগোচ্ছে বুঝতে পেরেও, নবীন মাস্টার কোনও সি পি এম-কর্মীকেই সে কথা বিশ্বাস করাতে পারলেন না।
এ দিকে নন্দলাল পালের মৃতদেহ মুড়ার গ্রামে নিয়ে যাওয়ার সময় আগাম পরিকল্পনা মতো মিছিলের মধ্যে মিশে থাকা পুলিশ আর সি পি এমের ঘোষকার বাহিনীর কয়েক জন আচমকা গুলি ছুড়তে শুরু করে। পর পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন জনসাধারণের কমিটির তিন জন একনিষ্ঠ কর্মী। খবর ছড়িয়ে পড়তেই পুরো জঙ্গলমহল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সরজমিনে দেখতে ৪ ফেব্রুয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছুটে যান সেখানে। আদিবাসীরা সিদ্ধান্ত নেন, আসন্ন নির্বাচনে তাঁরা ভোট বয়কট করবেন।
ইতিমধ্যে ঝাড়গ্রামের দু’টি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণের বিরুদ্ধে সরব হয় কমিটি। তারা দাবি করে, এই নির্মল বাতাস কলুষিত করা চলবে না। এই মাটিতে কারখানার বর্জ্য ফেলে জমিকে বন্ধ্যা করা চলবে না। এখানকার গাছপালাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া চলবে না। শুরু হয় আন্দোলন। সেই আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে দূষণবিরোধী আন্দোলনের মুখ্যনেতা উমাকান্ত মাহাতকে জিতুশোল থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। উমাকান্তের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন বানাকাটা জঙ্গলে। সেই জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে তেমন বাহিনী না থাকায় পুলিশকে পিছু হটতে হয় এই প্রথম।
এটা ছিল গ্রামবাসীদের কাছে একটা বিরাট জয়। এই জয় তাঁদের মনোবল অনেকখানি বাড়িয়ে দিল। বাড়িয়ে দিল আত্মবিশ্বাস। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারলেন, দেশপ্রেমিকরা কেন বলেছিলেন, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। ওঁরা ঠিক করলেন, এ বার মার খেলে মার দিতে হবে। লালগড়ে শুরু হয়ে গেল সি পি এমের সঙ্গে গ্রামবাসীদের সংঘর্ষ। ১৫ জুন ধরমপুরে ক্ষুব্ধ হাজার হাজার জনতা সি পি এমের পার্টি অফিস ভাঙচুর করল। আগুন ধরিয়ে দিল। তছনছ করল সি পি এম নেতা অনুজ পান্ডের বাড়িও। তার পর একের পর এক বিনপুর, বেলটিকারি, দহিজুড়ি, ঝাড়গ্রামের পার্টি অফিস মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে লাগল। আক্রমণ করল সি পি এমের ছোটখাটো নেতাদের বাড়িতেও।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল (পর্ব-৩৪)

অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল লালগড়, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। সেটাকে ঠান্ডা করার জন্য মোটা মোটা ডান্ডা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল যৌথ বাহিনী। তাদের লাঠির আঘাতে আহত হলেন কমপক্ষে পাঁচশো জন গ্রামবাসী। কত গর্ভবতী-প্রসূতি মহিলা যে র‍্যানডম পুলিশের লাথি খেল, তার হিসেব নেই। সেই লাথির আঘাতে নষ্ট হয়ে গেল গর্ভে থাকা কত সন্তান। কত মহিলাকে বিবস্ত্র করে মাটিতে ফেলে লাঠি পেটা করা হল, কত মেয়ে যে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের শিকার হল, কেউ তা বলতে পারবে না।
সবচেয়ে সহজ যে পথ, সেটাকেই বেছে নিল পুলিশ-প্রশাসন। মাওবাদী আখ্যা দিয়ে জনসাধারণের কমিটির লোকজনদের ভরে দেওয়া হতে লাগল জেলে। শুধু জনসাধারণের কমিটির লোকজনদেরই নয়, তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয়স্বজনদেরও বাদ দিল না। সাধারণ গ্রামবাসী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, স্কুলশিক্ষক থেকে মজুর, যাঁকেই পেল, তাঁকেই তুলে নিয়ে গেল থানায়। হাত পিছমোড়া করে বেঁধে লাঠিপেটা করল। কেউ প্রতিবাদ করলেই গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে ঝাড়গ্রাম-বাঁকুড়া যাওয়ার ন’নম্বর রাজ্য সড়কের গরম পাথরের উপরে ওই অবস্থায় নিলডাউন করে রাখল। রেহাই পেল না স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক রূপক মণ্ডলও।
১৫ এপ্রিল ঝাড়গ্রামের বৃন্দাবনপুরে বিয়ের পিঁড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল রামসাঁই হাঁসদাকে। বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার, গ্রেফতার করার পর মেমো না দেওয়া, বিনা সার্চ ওয়ারেন্টে যে কোনও বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি করা, পুলিশের ভয়ে যাঁরা গ্রাম ছাড়া, তাঁদের বাড়িতে দিনের আলোয় অকাতরে লুঠপাট চালানো। চলতে লাগল প্রতিদিন। কেউ কিছু বলতে গেলেই হয় চোর, নয় মাওবাদী কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী বলে গ্রেফতার করা হতে লাগল। কোর্টে না তুলে দিনের পর দিন বেআইনি ভাবে বিনা বিচারে থানায় আটক করে রাখা চলতেই থাকল।
থানার মধ্যে কারও মলদ্বারে পেট্রোল ঢেলে দেওয়া হল। কারও পিছনে ঢুকিয়ে দেওয়া হল লাঠি। কারও কারও পুরুষাঙ্গ দড়ি দিয়ে বেঁধে টান মারা হল। পুলিশের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে যাঁরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন, তাঁদের পুঁতে দেওয়া হল কাঁসাই নদীর চরে। সবার সামনে দিয়ে পুলিশ যাঁকে টানতে টানতে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল, তিন দিন পর সেই পুলিশই বলল, ও নাকি এ ক’দিন ধরে জঙ্গলে বসে রাষ্ট্রদ্রোহিতার ছক কষছিল।
এক-একজনের নামে এ রকম ভূরি ভূরি মিথ্যে মামলা রুজু হতে থাকল। সেই মামলা লড়তে গিয়ে যাঁর যেটুকু সম্বল ছিল খোয়াতে লাগল। আর এই সব অমানবিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের খবর যাতে কেউ জানতে না পারে, সে জন্য ১৭ জুন থেকে লাগাতার অনির্দিষ্টকালের জন্য গোটা জঙ্গলমহল জুড়ে জারি করা হল ১৪৪ ধারা।
তারই সঙ্গে ভাঙচুর করা হতে লাগল আদিবাসীদের ঘরবাড়ি, যাবতীয় জিনিসপত্র। তার সঙ্গে সঙ্গে যেখানে পানীয় জলের জন্য লোক হাহাকার করে, সেখানে পানীয় জলের কুয়োয় শুধু নোংরা-আবর্জনা ফেলেই তারা ক্ষান্ত হল না, যাতে ওখানকার জল কোনও কাজেই কেউ ব্যবহার করতে না পারে, উলটে ওই জল ধরতে ঘেন্না পায়, সে জন্য তার মধ্যে পায়খানা করে ফেলে দিতে লাগল তারা। তাতেও আদিবাসীরা এতটুকুও না দমায় ওই ১৭ জুনই শুরু হল– মিশন লালগড়। একেবারে সামরিক কায়দায়। চাওয়া হল কেন্দ্রীয় বাহিনী। পীড়াকাটা ফাঁড়িতে রাতারাতি এসে জড়ো হতে লাগল সি আর পি, আই আর বি, এস এ পি, বম্ব স্কোয়াড, মাইন নিরোধক গাড়ি। এমনকী হেলিকপ্টার পর্যন্ত। যেন স্থানীয় কোনও সমস্যা নয়, কোনও দেশের সঙ্গে কোনও দেশ যুদ্ধ করতে চলেছে।
এটা দেখে তেরো নম্বর অবাক। ওর মনে হল, রাষ্ট্র তো পিতা। নাগরিকরা তার সন্তান। কোনও সন্তান যদি অন্যায়ও করে, কোনও বাবা কি তার সন্তানকে গুলি করে মারে? কিন্তু কাকে বলবেন এ কথা! সি পি এমের লোকেরা তার কথা শুনলে তো! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একান্ত অনুরোধে কেন্দ্রীয় ফৌজ পাঠিয়ে দিলেন স্বয়ং চিদম্বরম। এসে হাজির হল কোবরা বাহিনী। যার পুরো নাম– কমব্যাট ব্যাটেলিয়ন ফর রেজলিউট অ্যাকশন। পরনে জলপাই রঙের প্যান্ট। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। পিঠে ঝোলানো একটা চাপা ব্যাগ। তার মধ্যে কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ, জল, শুকনো খাবার, সাপের বিষ নিরোধক ইনজেকশনের অ্যাম্পেল ও সিরিঞ্জ। বিভিন্ন আকারের ছ’রকমের ছোট ছোট ছোরা। কোমরে গোঁজা অটোমেটিক রিভলভার। এক হাতে ড্রাগনফ রাইফেল আর অন্য হাতে হেকলার কফ (এম পি-৩)-সহ এ কে ফর্টিসেভেন এবং ইনসাসের মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। যে অস্ত্র কেবলমাত্র কাশ্মীর আর নাগাল্যান্ডে জঙ্গি দমনে সেনাবাহিনীরা ব্যবহার করে থাকে।
বনের মধ্যে অ্যাডভান্স প্লেটুন হিসেবে এদের নাকি ব্যবহার করে হবে। কাছাকাছি শত্রুকে খতম করে অন্য শত্রুর অবস্থান চিহ্নিত করে পিছনের বাহিনীকে জানানোই হবে এদের প্রধান কাজ। কেবল বনে নয়, পাহাড়ে কোনও সমস্যা হলে সেখানেও ব্যবহার করা হবে এদের। সেই ট্রেনিংয়ের জন্য অবশ্য এখনও জায়গা চিহ্নিতকরণ হয়নি।
এদের প্রত্যেকেরই বয়স আঠেরো থেকে চব্বিশের মধ্যে। সাপের মতো ক্ষিপ্র পদক্ষেপ। সব সময় মাথা ঘুরছে ১৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে। এরা কখনওই এক দৃষ্টিতে এক জায়গায় তাকিয়ে থাকে না। সব সময় দৃষ্টি ঘুরছে। এরা কথা বলে কম। ভাষার আদান-প্রদান করে আকার-ইঙ্গিতে। এই প্রথম এদের নিয়ে আসা হল পশ্চিমবঙ্গের লালগড়ে। এই বাহিনীকে সেনাবাহিনীর ভাষায় বলা হয়– অ্যাডভান্স ফোর্স। ঘনজঙ্গলে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় সরকার এই ফোর্স তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
নিয়েছিল সি আর পি এফের সব থেকে কমবয়সি বাছাই করা ছটফটে চৌখস জওয়ানদের। প্রশিক্ষণের সময়সীমা দু’বছর। ট্রেনিং চলছে দু’জায়গায়। শিলচরের কোরাপুটের সি আর পি ক্যাম্পে। আর মিজোরামের সেনাবাহিনীর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড জঙ্গল ওয়ার্কার স্কুলে। উদ্দেশ্য একটাই– টু ফাইট দ্য গেরিলা লাইক আ গেরিলা। এদের ট্রেনিং এখনও শেষ হয়নি বলে প্রাথমিক ভাবে কোবরা নামাতে সি আর পি এফ কর্তাদের ঘোর আপত্তি ছিল। এদের কী পোশাক হবে, তাও ঠিক হয়নি। ফলে গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি চাপিয়ে এরা চলে এসেছে লালগড়ে।
কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে দশ ব্যাটেলিয়ন কোবরা তৈরি করা হচ্ছে। সাধারণত এক-একটি ব্যাটেলিয়নে থাকে ৯০০ থেকে ১১০০ জওয়ান। কিন্তু কোবরা ব্যাটেলিয়ন সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ জনের মধ্যে। এদের হাতে-কলমে শেখানো হচ্ছে কী ভাবে দিনের পর দিন জঙ্গলে কাটাতে হয়। সেখানে ঝড়-জল, হিংস্রপশু, বিষাক্ত সাপের সঙ্গে কী করে মোকাবিলা করতে হয়। বিকল্প খাদ্য হিসেবে কোন কোন গাছের শিকড়, কী কী ধরনের সাপ অথবা জংলি ইঁদুরকে কী ভাবে ব্যবহার করা যায়। পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে বুনো ফলমূলের সঙ্গেও।
এরা জঙ্গলে কখনও পায়ে হাঁটে না। উপুড় হয়ে শুয়ে সরীসৃপের মতো বুক আর কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে হাঁটে। খুব প্রয়োজন না হলে গুলি চালায় না। কারণ, সাইলেন্সার লাগিয়ে নিঃশব্দে গুলি চালালেও, লুটিয়ে পড়া সেই দেহ অত দূরে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে লোপাট করা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। ফলে পিছন থেকে আসা শত্রুরা সেই মৃতদেহ দেখে সজাগ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই শত্রুকে এরা খতম করে সাধারণত পিছন থেকে খপ করে ধরে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝট করে তার গলার নলি কেটে কিংবা ঘাড় মটকে। তার পর মুহূর্তের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে সেই দেহ।
এরা প্রত্যেকে শার্প শ্যুটার। ট্রেনিংয়ের সময় তিনশো ফুট দূর থেকে গুলি চালাতে হয়। বোর্ডে বুলস আই থাকে না। ঘন জঙ্গলের মধ্যে বুনো নারকেলের গায়ে লাল রঙের বিন্দু এঁকে সেটাকে গাছের ডালে দুটো দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে, দুলিয়ে দেওয়া হয়। যাতে নারকেলটি সামনে থেকে পিছনে দুলতে থাকে। সেটাকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। পারফেক্ট শ্যুটার হতে এক-একজন জওয়ানের প্রশিক্ষণের দু’বছরের প্রায় আট মাসই খরচ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু লালগড়ে যে কোবরা ব্যাটেলিয়ন এসেছে, তারা প্রশিক্ষণ পেয়েছে মাত্র তিন মাস। তাতেই সেনাবাহিনী যে কোনও জওয়ানের থেকে লক্ষ্যভেদের ক্ষেত্রে এরা দু’কদম এগিয়ে।
এত আয়োজন, তবু প্রশাসন চিন্তিত। কারণ, লালগড়ের জঙ্গল স্থানীয় পুলিশদেরও অচেনা। কেন্দ্রীয় বাহিনীও এই এলাকায় নতুন। উলটো দিকে জঙ্গলের আদিবাসী এবং মাওবাদীরা হাতের তালুর মতো জঙ্গলকে চেনেন। এই জঙ্গলই তাঁদের ঘরবাড়ি, ছোটবেলার চোর চোর খেলার জায়গা। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কী ভাবে তার মোকাবিলা করতে হয়, তা তাঁরা বংশপরম্পরায়, পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানেন। তার ওপর সামনে বর্ষা। মাওবাদীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আদিবাসীরা যে কী ধরনের ফাঁদ পেতে রেখেছে, সরকারের ইনফর্মাররা তা জানে না। জানে না যৌথবাহিনীও। তাই অপরিচিত জঙ্গলে যৌথ বাহিনীকে ‘কভার’ দিয়ে না পাঠালে, অনেক বেশি জওয়ানের প্রাণহানি ঘটার আশঙ্কা।
ফলে সামনের সারিতে ভয়ংকর কোবরা বাহিনী আর গ্রেহাউন্ড জওয়ানদের পাঠানো হল। তাদের পিছন সারিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী। তারও পিছনের সারিতে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশ, কলকাতা পুলিশ এবং কমব্যাট ফোর্স। সঙ্গে বম্ব স্কোয়াড, অ্যান্টি ল্যান্ড মাইন গাড়ি, অ্যাম্বুল্যান্স যেমন রয়েছে, তেমনি আকাশপথে রয়েছে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারও।
সারি সারি শাল-পিয়ালে ঘেরা পীড়াকাটা থেকে ঝিটকার জঙ্গল বরাবর লাল মাটির মেঠো পথ দিয়ে লালগড়ের দিকে যেতে, জঙ্গলের ডাইনে-বাঁয়ে প্রায় দু’ব্যাটেলিয়ন কোবরাকে ছড়িয়ে দেওয়া হল। উদ্দেশ্য একটাই, যে ভাবেই হোক, জঙ্গলের অন্তত ৫ কিলোমিটার পিছনে মাওবাদীদের ঠেলে দেওয়া।
আর মাওবাদীরা যদি হামলা না করে, তা হলে একটু একটু করে এগিয়ে, একটা একটা করে গ্রামের দখল নেওয়া। আর তাদের এই প্রচেষ্টায় যাতে সাধারণ গ্রামবাসীরাও এগিয়ে আসেন, সে জন্য জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের মন জয় করতে তৎপর হয়ে উঠল প্রশাসন। তারা গ্রামবাসীদের মধ্যে ৩ কিলো, জায়গা বিশেষে ৬ কিলো করে চাল বিলি করা শুরু করল। এত দিন ধরে পেট পুরে খেতে না পাওয়া হাড়-জিরজিরে গ্রামবাসীরা সেই চাল নিতে পিলপিল করে বেরিয়ে এল। তাঁদের দীর্ঘ লাইন দেখে প্রশাসন খুব বেশি। খুশি হয়ে বিলোতে লাগল চাল-ডালের সঙ্গে তেল-ত্রিপল, হাঁস-মুরগির ছানা। হিড়িক পড়ে গেল শ্মশান-গোরস্থানের পাট্টা বিলি করার।
চাল নেওয়ার লম্বা লাইনের সামনে নবীন মাস্টার আর তেরো নম্বরকে ঘুরঘুর করতে দেখে একদিন বড়পেলিয়ার লবু কিসকু অত্যন্ত রাগত স্বরেই বললেন, এখানে কি কোনও দুর্যোগ হয়েছে যে সরকার ত্রাণ নিয়ে এসেছে। এখানে যা হয়েছে, তা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ক্ষত তৈরি করে এখন মলম লাগাতে এসেছে! চাই না আমরা এ সব। ওরা জানে না, পিঁপড়ের ডিম আর ইঁদুরের মাংস খেয়ে কোনও রকমে বেঁচে থাকা আদিবাসীরা যে আন্দোলন করতে পারে, সারা ভারতবর্ষ তা ভাবতেও পারবে না। পারলে, এখানকার ইতিহাস একবার পড়ে দেখুন। তা হলেই বুঝতে পারবেন। আমরা তো এখন ভাবছি, সিধু-কানুর সময়ে যে ‘সারজন গিরা’ দেওয়া হয়েছিল, এ বার আমরা তা-ই দেব। ‘সারজন গিরা’ মানে কি সেটা জানেন তো? কোনও অশুভ ছায়া থেকে গ্রামকে বাঁচাতে কিংবা কোনও মঙ্গলের জন্য গ্রামের মোড়লকে নিজের জীবন উৎসর্গ করাকে বলে– সারজন গিরা। এ বার শুধু মোড়ল নয়, আমরা লোধা, সাঁওতাল, রাভারা মিলে অনেকেই এখন সেটা করতে চাই। উদেশ্য একটাই, এই সরকারের পতন। বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি আমাদের কোনও আস্থা নেই। কোনও বিশ্বাসযোগ্যতাও নেই। আমরা চাইছি, সম্মানের সঙ্গে মান-ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে। আমরা চাই আমাদের মানুষ হিসেবে গণ্য করা হোক।
এই একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল লালমোহন টুডু, ছত্রধর মাহাত, সন্ধ্যা মাহাতর গলাতেও। তেরো নম্বর নির্বাক হয়ে গেল। এত মার খাওয়ার পরেও এদের এত সামান্য চাওয়া! শুধু একজন মানুষ হিসেবে একটু স্বীকৃতি পাওয়া! অবাক হয়ে গেলেন নবীন মাস্টারও। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, যে ভাবেই হোক, উনি ওঁদের সেটা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু সেটা যে কী ভাবে করবেন, উনি নিজেও তা জানেন না। তবে করবেন। যে ভাবেই হোক করবেন। করবেনই।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!