ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ৩৬

।। পর্ব- ৩৬।।

অরণ্যের আনাচে কানাচে তির-ধনুক হাতে বেড়ে ওঠা ভূমিপুত্রদের অনেক কিছুই পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিছুই পাননি তাঁরা। যা পেয়েছেন, তা হল অবহেলা, বঞ্চনা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর নিদারুণ কষ্ট। অবশেষে নানা টালবাহানার পর ২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভারতের সংসদে ঐতিহাসিক ‘বনাধিকার আইন’ পাশ হয়। ‘বনবাসী তফসিলি জনজাতি এবং অন্য পারস্পরিক বনবাসীদের বনাধিকার স্বীকার আইন, ২০০৬’ নামের নতুন এই আইনটি নিয়মমাফিক বিজ্ঞাপিত হয় ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। জঙ্গলের উপর বনবাসীদের অনেক অধিকারের কথা বলা হয়েছে তাতে। ওই আইনের ৩-এর ‘গ’ ধারায় বলা হয়েছে, জঙ্গলের জ্বালানি কাঠ, বাঁশ, ঘাস, বনফুল, ভেষজ উদ্ভিদ এবং অন্যান্য লতাপাতা-সহ সব ধরনের বনজ সম্পদের একমাত্র মালিক বনবাসীরাই। এ ছাড়া ৩-এর ‘ঘ’ ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য-সহ সব রকমের জঙ্গলেই ওই সব বনজ সম্পদ সংগ্রহ, পশুচারণ ও মাছ ধরার অধিকারও স্থানীয় অরণ্যবাসীদেরই। তবে সেই অধিকার ভোগ করার জন্য সেই গ্রামের বয়স্ক মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা ‘গ্রামসভা’র কাছ থেকে শুধু অনুমতি নিয়ে নিতে হবে। গ্রামের যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে গেলে, ওই ‘গ্রামসভা’র অন্তত দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের মত থাকতে হবে। যে কোনও গ্রামসভার আওতাভুক্ত বনাধিকারভোগীরা যদি যৌথ বা ব্যক্তিগত ভাবে ওই সম্পদের মালিক হন, তা হলে বনবিভাগ বা সরকারের সেখানে আর কোনও কিছু বলার হক থাকবে না।
বনাধিকার আইনের ২-এর (৩) ধারার ৩ নম্বর উপধারায় হলা হয়েছে, সরকার গ্রাম বলে মানুক বা না মানুক, জঙ্গলের মানুষ যে এলাকাটিকে গ্রাম বলে মানেন, সেটাই গ্রাম। সেখানে রাজ্য সরকারের আইনে গ্রামের অন্য কোনও ব্যাখ্যা থাকলেও, সেটাই ‘একমাত্র’ ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য হবে না। অর্থাৎ ওই আইনে বনবাসীদের অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ওই আইনে আরও বলা হয়েছে, ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বনাঞ্চলে বসবাস করতে আসা, কৃষিকাজের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত মানুষদের পরিবার পিছু চার হেক্টর অবধি জমি থাকতে পারে।
অবশ্য এর পাশাপাশি আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, যে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তখনই অরণ্যের অধিকার ভোগ করতে পারবেন, যখন তাঁর কাছে থাকবে ভোটার পরিচয়পত্র, রেশনকার্ড, খাজনা দলিল বা অন্য যে কোনও সরকারি বা আধা-সরকারি দলিল বা দস্তাবেজ, অথবা কোনও মামলার কাগজপত্র কিংবা বিশিষ্ট কারও গবেষণাপত্রে তার উল্লেখ। যা থেকে বোঝা যাবে তাঁরা সত্যিই অরণ্যের বাসিন্দা।
এ সবের কোনওটাই না থাকলে, ব্যক্তি মালিকানার ক্ষেত্রে জমিতে বসবাস বা জমি ব্যবহারের অন্য প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখাতে হবে। যেমন, জমিতে ঘরবাড়ি, সেচ ব্যবস্থা, কুয়ো, আল, সমাধিস্থল বা শ্মশান কিংবা দেবস্থান। তাও না‌ থাকলে গ্রামের কোনও বয়স্ক মানুষ যদি বলেন, ‘এঁরা এখানে বসবাস করেন’ তা হলেও হবে।
গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে দেখাতে হবে, এলাকা ব্যবহারের যে কোনও প্রত্যক্ষ চিহ্ন। যেমন, নিয়মিত সংগৃহীত হয় এমন কোনও বনজ সম্পদ কিংবা গোচারণ ক্ষেত্র অথবা মাছ ধরার জায়গা। নিদেন পক্ষে দেবস্থান, সমাধিক্ষেত্র বা শ্মশান, সেচ ব্যবস্থা, বসতি কিংবা চাষবাসের লক্ষণ। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, উভয়ের ক্ষেত্রেই অন্তত দু’ধরনের প্রমাণ দেখাতে হবে।
আর যাঁরা তফসিলি জনজাতিভুক্ত নন, তাঁরা যে একটানা অন্তত পঁচাত্তর বছর কিংবা তিন পুরুষ ধরে বসবাস করছেন, তার প্রমাণ দিতে হবে। তা হলেই সরকার তাঁদের বসবাসের জমি এবং কৃষিজমির দখলাধিকার স্বীকার করে নিয়ে শংসাপত্র বা সার্টিফিকেট দিয়ে দেবে।
তবে না, ‘পাট্টা’ দিতে পারবে না। বনাধিকার আইনের ১১ এবং ১২ ধারায় বলা হয়েছে, যতক্ষণ না আনুষ্ঠানিক ভাবে জমা‌ পড়া সমস্ত দাবিগুলোকে গ্রামসভা খুঁটিয়ে দেখবে এবং দেখে সন্তুষ্ট হয়ে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের লিখিত সম্মতি-সহ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব মহকুমা স্তরের কমিটিকে জমা না দেবে, ততক্ষণ সেই দাবিগুলো সরকারি বিচার-বিবেচনার জন্য গৃহীতই হবে না। অথচ সে ভাবে কোনও দাবি জমা না পড়লেও রাজ্য সরকার কিন্তু জঙ্গলমহলের গ্রামবাসীদের বেআইনি ভাবে তড়িঘড়ি পাট্টা বিলি করতে লাগল। শুধুমাত্র তাঁদের মন জয় করার জন্য। যাতে মাওবাদীরা কে কোথায় আছে, কারা মাওবাদীদের খবরাখবর দিচ্ছে, কাদের কাদের সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগ আছে, সে সব তাঁরা অনায়াসে তাদের বলে দেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গে যৌথ বাহিনী এবং কোবরাদের জঙ্গলে ঢোকার সহজ ও নিষ্কণ্টক পথ বাতলে দেন।
সেই ভরসাতেই রাজ্য সরকার সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে। আর সেটা পেয়েই পীড়াকাটা থেকে ঝিটকার জঙ্গল বরাবর লালগড়ের দিকে এগোচ্ছে কোবরা বাহিনী। অত্যন্ত সন্তর্পণে। সরীসৃপের মতো। তাদের পিছু পিছু এগোচ্ছে গ্রেহাউন্ড আর তার পিছু পিছু যৌথ বাহিনী।
কিন্তু না, কোবরা বা যৌথ বাহিনী নয়, বনবাসীরা এক ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে। কারণ, মাস পাঁচেক আগেই তাঁদের এলাকা থেকে বাড়ি ছেড়ে সপরিবার পালিয়ে গিয়েছিলেন রথীন দণ্ডপাট। লালগড়ের নেতুড়া পঞ্চায়েতের নেতাই গ্রামের সেই বাড়িটা দখল করে নিয়েছিলেন সি পি এমের এক ডাকসাইডে নেতা অবনী সিংহ। তিনি এবং তাঁর দলের শুভেন মণ্ডল গ্রামের লোকজনদের নিয়ে একদিন বৈঠকও করেন। বলেন, মাওবাদীদের হাত থেকে বাঁচতে হলে নিজেদের একটা প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের পক্ষে তো এখনই সে সব করা সম্ভব নয়। আমি কয়েক জনকে চিনি। তাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্রও আছে। দরকার হলে চালাতেও পারবে। ওরা এলে আমাদের আর কোনও ভয় থাকবে না। ওরাই আমাদের রক্ষা করবে।
এই কথা শুনে গ্রামের কয়েক জন গাঁইগুঁই করেছিলেন ঠিকই, তখন অবনী সিংহ বলেছিলেন, কাছাকাছি গঞ্জ-বাজার বলতে এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে লালগড়ের এস আই চক। কাছেপিঠের যৌথ বাহিনীর ক্যাম্প বলতে সেখানেই। হঠাৎ যদি মাওবাদীরা রাতবিরেতে আমাদের উপর চড়াও হয় তখন আমরা কী করব! খবর পাঠালেও ওখান থেকে পুলিশ বা যৌথ বাহিনীর জওয়ানদের আসতে আসতে তো আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। তাই, আমাদের নিজস্ব একটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা দরকার।
এটা শুনে অনেক গ্রামবাসীই মাথা নেড়ে বলেছিলেন, ঠিক ঠিক ঠিক। ফলে দু’-চার জনের আপত্তি আর ধোপে টেকেনি। লালগড়ে সি পি এমের জনসভার দিন, অর্থাৎ ২০১০-এর ২৭ ডিসেম্বর অবনী সিংহের তৎপরতায় গ্রামবাসীদের রক্ষা করার অজুহাতে সি পি এমের প্রায় জনা তিরিশেক সশস্ত্র ক্যাডার ওই বাড়িতে ঘাঁটি গেড়ে বসে পড়ে। একদিন ছাড়া ছাড়া যে পুলিশ বা যৌথ বাহিনীর জওয়ানদের গ্রামে টহল দিতে দেখা যেত, অবনী সিংহের বাড়িতে ওই লোকগুলো আসার পর থেকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তারাও এ মুখো হওয়া বন্ধ করে দিল।
আর সি পি এমের ক্যাডাররা গ্রামে এসেই শুরু করে দেয় তাদের পূর্ব নির্ধারিত কার্যকলাপ। দল বেঁধে বেরিয়ে প্রথমে বোমা ফাটিয়ে এলাকায় একটা ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে থাকে। বাড়ি বাড়ি ঢুকে এঁর-তাঁর বুকে ওয়ান সাটারের নল ঠেকিয়ে, কথা না শুনলেই জানে মেরে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। দু’দিন পর থেকেই চলতে থাকে জোরজুলুম করে টাকাপয়সা আদায় করা। গ্রামবাসীরা ভয়ে ভয়ে মুখ বুজে সব মেনে নিচ্ছেন দেখে, তাদের ময়লা জামাকাপড় কেচে দেওয়ার জন্য, খাওয়ার জল তুলে দেবার জন্য, রান্না করে দেওয়ার জন্য তাঁদের বাড়ির মেয়ে-বউদের পাঠিয়ে দেওয়ার হুকুম দিতে থাকে।
অতিথি সেবা মানে নারায়ণ সেবা– এটা ভেবে গ্রাম্য মেয়ে-বউরা ওদের কথা মতো সে সব করে দিতে থাকেন। তখন সেই সব মেয়ে-বউকে ওরা বলে, রাত্রে আমাদের পাহারা দেওয়ার জন্য তোর বরকে পাঠিয়ে দিবি।
সেই কথা শুনে গ্রামের পুরুষরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে, পালা করে করে রাত-পাহারা দিতে থাকেন। কিন্তু ক’দিন পর ওই ক্যাডাররাই যখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে, আমরা আর কত দিন এখানে থাকব? এর পর তো চলে যাব। তখন তোমাদের রক্ষা করবে কে? তোমরা বরং গ্রামরক্ষার জন্য প্রত্যেক বাড়ি থেকে অন্তত একজন করে ছেলে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দাও। ট্রেনিং নেওয়ার জন্য। আমরা শিখিয়ে-পড়িয়ে তৈরি করে দেব।
এটা শুনে গ্রামবাসীরা এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকেন। কেউই তাঁদের বাড়ির ছেলেদের ওখানে পাঠাতে রাজি নন। এ কথা মিষ্টি মুখে হাবভাবে বোঝাতে যেতেই কেলেঙ্কারি কাণ্ড। রুখে ওঠে ক্যাডাররা। গ্রামবাসীদের উপর শুরু করে দেয় অকথ্য গালিগালাজ, মারধর, লুঠপাট।
শেষমেশ ওদের ওই অত্যাচার আর সহ্য করতে না‌ পেরে, এর একটা বিহিত করার জন্য বনবাসীরা এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। ঠিক করেন, প্রথমে ওদেরকে ভাল মুখে বলবেন। বোঝানোর চেষ্টা করবেন। তাতে যদি কাজ হয়, ভাল। না হলে তার পরের পদক্ষেপ কী হবে, সেটা তাঁরা সবাই মিলে পরের বৈঠকে ঠিক করবেন।
সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু সে খবর কী করে যেন পৌঁছে গিয়েছিল লালগড়ের সি পি এম নেতা, কাম বিনপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক অনুজ পান্ডের কাছে। তিনি ২০১১ সালের ৬ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার বিকেলে অবনী সিংহের দখল করা ওই বাড়িতে যান। গিয়ে তাঁর ক্যাডারদের সতর্ক করে দিয়ে আসেন। বলেন, আমি গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি, গ্রামবাসীরা নাকি তোদের কাছে আসবে। আমার অবশ্য মনে হয় না, ওরা তোদের কাছে আসার সাহস পাবে। তবু বলা তো যায় না, যা দিনকাল পড়েছে। তোরা কিন্তু তৈরি থাকিস। আর সত্যিই যদি কেউ তোদের কাছে আসে, একদম পাত্তা দিবি না। কিছু বলতে এলেই একদম কড়া ভাষায় জবাব দিয়ে দিবি। আর কেউ যদি চড়া গলায় কথা বলে, দেখিস, কেউ যেন প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারে। মনে রাখবি, ওদেরকে জুজুর ভয় দেখিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। বুঝেছিস?
মুখে এ কথা বললেও ওদের উপর ভরসা করতে পারলেন না তিনি। তাই বড়সড় কিছু ঘটলে তার মোকাবিলা করার জন্য রাতারাতি ঝাড়খন্ড থেকে কিছু সশস্ত্র দুষ্কৃতী আনিয়ে রাখলেন তিনি। ধরমপুর লোকাল কমিটির সম্পাদক ডালিম পান্ডে আর বেলকাটারি লোকাল কমিটির সম্পাদক চণ্ডী করণকেও বলে রাখলেন, তাদের পক্ষে যতটা সম্ভব আন্ডার গ্রাউন্ডের লোকজনকে জোগাড় করে রাখতে। সঙ্গে গোলা-বারুদ-আর্মস।

আরও পড়ুন: ভ্রমণকাহিনী ‘চটকপুর’ 

গ্রামের বুক চিরে সোজা চলে গেছে সরু লাল মাটির রাস্তা। তার পাশেই অবনী সিংহের বাড়ি। পর দিন শুক্রবার, ২০১১-র ৭ জানুয়ারি। আগের দিনের কথা মতো সকালবেলায় সেখানে গিয়ে জড়ো হলেন আদিবাসীরা। বহু বার ওই বাড়ির কড়া নাড়লেন। দরজা ধাক্কালেন। কিন্তু ভিতর থেকে কেউ কোনও সাড়াশব্দ করল না। অথচ বনবাসীরা বুঝতে পারলেন, বাড়ির ভিতরে ওরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। তাই ওই বাড়িটি ওরা ঘেরাও করে রাখলেন। ওরা বেরোলে ওদের সঙ্গে কথা বলবেন। এক ঘণ্টা কেটে গেল। দু’ঘন্টা কেটে গেল। কিন্তু কেউই বেরোচ্ছে না। তাই ওদের শোনানোর জন্য গ্রামবাসীরা চিৎকার করে দাবি জানাতে লাগলেন, ওদের এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। দাবি জানাতে লাগলেন, ক্যাম্প তুলে দেওয়ার জন্য।
এখানে আসার আগেই বনবাসীরা খবর দিয়ে এসেছিলেন থানায়। এমনকী সংবাদ মাধ্যমকেও। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেখানে না পৌঁছল কোনও পুলিশ, না পৌঁছল কোনও সংবাদ মাধ্যমের লোক। বাড়িটি ঘিরে থাকতে থাকতে এক সময় অধৈর্য হয়ে কয়েক জন বনবাসী উত্তেজিত হয়ে পড়েন। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে আচমকা দরজাটা খুলে যেতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েন ভিতরে। বেশ ক’দিন ধরে তাঁদের এক-এক জনের বাড়িতে ঢুকে ওরা যেমন ভাঙচুর করেছিল, তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাঁরাও ওদের ঘরদোর তছনছ করতে লাগলেন।
বেলা তখন প্রায় এগারোটা। এলাকার লোকেরা যা উত্তেজিত হয়ে আছেন, একবার ওঁদের হাতে ধরা পড়লে আর রক্ষে রাখবে না, বুঝতে পেরে দোতলার একটা ঘরে গিয়ে সবাই মিলে গাদাগাদি করে লুকিয়ে রইল। কিন্তু কতক্ষণ ওই ভাবে থাকা যায়! যে কোনও সময় নীচ থেকে গ্রামবাসীরা উপরে উঠে আসতে পারেন। তাই হঠাৎ কী মনে করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল ক্যাডাররা। এ দিকে ওই একই সময়ে আচমকা কংসাবতী নদী পেরিয়ে বেলাটিকরির দিক থেকে অন্তত শ’দেড়েক সশ্রস্ত্র দুষ্কৃতী গোলা ছুড়তে ছুড়তে, এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে চালাতে নেতাই গ্রামে ঢুকে পড়ল। বোঝা গেল, বনবাসীরা চড়াও হতেই সবার সঙ্গে সবার ফোনে ফোনে কথা হয়ে গেছে আগেই। তাই দু’দিক থেকে এই সাঁড়াশি আক্রমণ।
চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে গ্রামবাসীদের ওপরে ওরা গুলি চালাতে লাগল। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন বিক্ষোভকারীরা। ছোটাছুটি শুরু করে দিলেন তাঁরা। আর সেই ফাঁকে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা ক্যাডারদের আড়াল করে উধাও হয়ে গেল বেলাটিকরির দিক থেকে আসা বেশ কিছু দুষ্কৃতী।
ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা বুলেটের তোড়ে রক্তে ভিজে যেতে লাগল নেতাই গ্রামের মাটি। আধ ঘণ্টার মধ্যে কম করেও আড়াইশো থেকে তিনশো রাউন্ড গুলি চালাল ওরা। যখন নন স্টপ গুলি চলছিল, গ্রামবাসীরা বারবার ফোন করেছিল থানায়। কিন্তু ঘটনাস্থলে পুলিশ এল ঘটনা ঘটার প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা পরে। ততক্ষণে একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন সরস্বতী দলুই, ধীরেন সেন, শ্যামানন্দ ঘোতুই, ধ্রুবপ্রসাদ গোস্বামী, তাপস মণ্ডল, দিলীপ সেন, কল্পনা সেন, গণেশ আদক, রাধারানি মণ্ডল-সহ অরূপ পাত্র ওরফে ক্যাবলা।
তাঁদের তুলে নিয়ে কেউ যে হাসপাতালে যাবে, তারও উপায় নেই। সক্কালবেলায় ও রকম একটা ভয়াবহ কাণ্ড ঘটানোর পরেও গোটা এলাকা দাপিয়ে বেড়াতে লাগল বাকি দুষ্কৃতী ও ক্যাডার বাহিনী। গুলি খেয়ে যন্ত্রণায় গোঙাতে থাকা কাউকে কেউ তুলতে গেলেই তেড়ে যেতে লাগল ওরা। বলতে লাগল, কেউ যদি কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করিস, দেখতে পেলেই গুলি করব।
বনবাসীরা ফোন করেছিল অ্যাম্বুল্যান্সকে। অ্যাম্বুল্যান্স এসেওছিল। কিন্তু কোনও অ্যাম্বুল্যান্সকেই ঢুকতে দেয়নি ওরা। গ্রামে ঢোকার আগেই আটকে দিয়েছিল। কেউ যাতে বাঁশের চেলা দিয়ে কোনও রকমে ট্রেচার বানিয়ে কিংবা কোলপাজা করে কোনও আহতকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে না পারে, সে জন্য নদীর পশ্চিম পাড়ে বেলাটিকরিতে পঞ্চাশ-যাট জন সশস্ত্র ক্যাডার রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগল। নদী পেরোলেই লালগড়। কিন্তু ওদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাবেন কে! এত বড় বুকের পাটা কার আছে!
শরীরে বুলেট নিয়ে তখনও আহতরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। একটু জলের জন্য হাহাকার করছিলেন সৌরভ ঘোডুই। বৃদ্ধ বংশীরানা তাঁকে বাটি করে জল দিতে যাচ্ছিলেন, তখন এক ক্যাডার চিৎকার করে বলে উঠল, অ্যাই, ওকে একদম জল দিবি না। ওদের মেরেছি মরার জন্য। যা এখান থেকে, যা। না হলে তোকেও ওর মতো দানা ভরে দেব।
যাঁরা পড়ে আছেন, তাঁদের কারও গুলি লেগেছে পিঠে। কারও মাথায়। কারও ঊরু এ ফোঁড় ও ফোঁড়। পুলিশ আসার পর আহতদের প্রথমে লালগড় ব্লক হাসপাতালে, তার পরে মেদিনীপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দেখা যায়, ওটা শুধু নামেই হাসপাতাল। কোথাও একটা স্ট্রেচার পর্যন্ত নেই। চিকিৎসকেরা প্রায় সকলেই বেপাত্তা।
কেন নেই? নবীন মাস্টার আর তেরো নম্বর খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, কেউ যাতে চিকিৎসা না‌ পায়, সে জন্য নাকি ডাক্তার আর নার্সদের উপর মহল থেকে ফোন করে আগেই বলে দেওয়া হয়েছে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। চিকিৎসার ন্যূনতম পরিষেবা পাচ্ছে না বুঝতে পেরেও, যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তাপস মণ্ডল বললেন, আমার সামনেই একের পর এক দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল। আমি দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম কই?
ক্যাডার বাহিনীর গুলিতে আহত ওই গ্রামেরই একনিষ্ঠ সি পি এম কর্মী চিত্ত দাসও বললেন, নেতাদের নির্দেশে বেশ কয়েক দিন ধরেই ওই হার্মাদদের চাল-ডাল, আনাজ, মুরগি ভেট দিতাম। গ্রামের মেয়েদের ক্যাম্পে ডেকে পাঠাত ওরা। মুখে বলত, রান্না করার জন্য। ময়লা জামাপ্যান্ট কাচার জন্য কিংবা খাওয়ার জল তুলে দেওয়ার জন্য ডাকছে। কিন্তু মহিলারা গেলে ওরা যে কী করত, সেটা জানতে হলে, যারা যেত, সেই সব মেয়েদের সঙ্গে কথা বলুন, সব জানতে পারবেন। আমি জানি, এটা অন্যায়। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমি আগে মানুষ। তার পরে সি পি এম কর্মী। সে কথা আকারে-ঈঙ্গিতে বলেছিলাম বলেই হয়তো…
যাঁরা যেতেন সেই মহিলারা বললেন, ওই হার্মাদরা তাঁদের কী ধরনের কু-প্রস্তাব দিত। রাজি না হলে তাঁদের স্বামী বা ছেলেকে খতম করার ভয় দেখাত। কারও বাড়িতে কিশোরী মেয়ে থাকলে বলত, রাত্রিবেলায় তাকে তুলে নিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ৩৫

এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত গুলিতে মারা যান সাত জন গ্রামবাসী। গুরুতর জখম হন সতেরো জন। তার মধ্যে সাত জনকে নিয়ে যাওয়া হয় এস এস কে এম হাসপাতালে। খবর পেয়ে এ দিনই মেদিনীপুরে ছুটে যান বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন বিকেলের দিকে অত্যাচারের আঁতুরঘর অভিশপ্ত ওই দোতলা বাড়িতে ঢুকে দেখা যায়, নীচের তলায় তিনটে ঘর। উপর তলাতেও তিনটে। শোওয়া-থাকার সে কী এলাহি ব্যবস্থা। ছাদের উপর হ্যালোজেন লাইট লাগানো। প্রতি তলাতেই একটি করে টিভি। ফ্রিজও আছে। এই বাড়ির লাগোয়া এক কামরার একটি ঘরে ক্যাডারদের জন্য বড় কড়াইয়ে ডাঁই করা ভাত। আধসেদ্ধ তরকারি। দেখে মনে হয়, এটা বুঝি পুরোদস্তুর একটি হার্মাদ-হোটেল। এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে থালা-বাসন। তারই মধ্যে মুড়ি-মুড়কির মতো গড়াগড়ি খাচ্ছে অজস্র কার্তুজ। পড়ে আছে বন্দুক, পিস্তল, হ্যান্ড গ্রেনেড থেকে শুরু করে ল্যান্ডমাইন্ড, বোমা– সবই।
এই ঘটনা নিয়ে বামফ্রন্টের বৈঠকেই সি পি এমকে একঘরে করে দিল ছোট থেকে বড়, সব বাম শরিকরাই। প্রকাশ্যে না হলেও, এই ঘটনার সমস্ত দায় চাপিয়ে দিল সি পি এমের ঘাড়ে। রীতিমত তোলপাড় শুরু হয়ে গেল গোটা দেশ জুড়ে। এই ঘটনার প্রতিবাদে, পর দিন শনিবার, কলকাতার কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের নীরব প্রতিবাদ মিছিল বেরোল। দাবি উঠল, রাষ্ট্রীয় মদতে এই সন্ত্রাস বন্ধ হোক। অবিলম্বে উৎখাত হোক গণতন্ত্র হত্যাকারী এই হার্মাদ সরকার।
এ দিনের মিছিলে বুদ্ধিজীবীদের পাশপাশি পা মেলাল ছাত্র-শিক্ষক-আইনজীবী-সহ শ্রমিকদের একাধিক সংগঠন। পথ-চলতি বহু সাধারণ মানুষও নিজে থেকেই এগিয়ে এলেন। কোনও স্লোগান নয়, হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন-ব্যানারে ফুটে উঠল– ‘আমি চাই লালগড়ে আর শুনবে না কেউ গুলির শব্দ / আমি চাই মানুষের হাতে হার্মাদ হবে ভীষণ জব্দ’।
এই দিনই বুদ্ধিজীবীদের একটি দল মহাকরণ অভিযান করেন। বলেন, আমরা এর পরিবর্তন চাই। এই পরিবর্তনকামী বুদ্ধিজীবীদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে তাঁদের নতুন নামকরণ করা হয়– সুশীল সমাজ। তাঁদের সেই ‘পরিবর্তন’-এর দাবি ছড়িয়ে পড়ে জেলায় জেলায়। সারা রাজ্যে। পরিবর্তন চেয়ে মুখর হয়ে ওঠেন দলমত নির্বিশেষে রাজ্যের প্রায় সমস্ত মানুষ।
মিছিলে হাঁটতে থাকা চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন বললেন, আমরা কাপুরুষ নই। গণতান্ত্রিক ভাবে ব্যালেটের মাধ্যমে এই সন্ত্রাসবাদী সরকারকে হত্যা করব। গায়ক নচিকেতা বললেন, সি পি এমকে উৎখাত করা ছাড়া আর কোনও পথ নেই। শিল্পী যোগেন চৌধুরী বললেন, লালগড়ের ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগের বর্বরতাকে মনে করিয়ে দেয়। সাংস্কৃতিক কর্মী মীরাতুন নাহার বললেন, শাসক মারণব্রত গ্রহণ করেছে। কবি তরুণ সান্যাল বললেন, এক্ষুনি এই সরকার বাতিল করে খুনি সম্রাটদের বিচার হোক। নাট্যকার ব্রাত্য বসু বললেন, পুলিশ এবং সি পি এম ক্যাডারদের মধ্যে আর কোনও তফাত নেই। অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বললেন, সি পি এম আরও একবার গণতন্ত্রের মুখে পদাঘাত করল। পুলিশ খুব ভাল ভাবেই জানত যে, হার্মাদ ক্যাম্পে প্রচুর অস্ত্র আছে। তা সত্ত্বেও উদ্ধার করার চেষ্টা করেনি। উপরন্তু নিরীহ গ্রামবাসীদের উপরে গুলি চলার খবর পেয়েও তারা ঠিক সময়ে যায়নি।
লালগড়ের প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে শিল্পী সমীর আইচ টানলেন, বামফ্রন্ট জমানায় বিজন সেতুতে ১৪ জনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনাও। মিছিলে গান ধরলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়, পল্লব কীর্তনীয়ারা।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা করেছিলেন, ‘ডু ইট নাও’। এ দিনের মিছিল থেকে আওয়াজ উঠল, ‘কুইট নাউ’। এই মিছিলে অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশ নিয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ। সঙ্গে ছিলেন শাঁওলি মিত্র, বিভাস চক্রবর্তী, দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্পিতা ঘোষ, অসীম গিরি, অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, বোলান গঙ্গোপাধ্যায়, মানিক মণ্ডল, তেলুগু কবি ভারভারা রাও, শিল্পী দিলীপ চক্রবর্তী, মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। মিছিলের মাঝপথে যোগ দেয় মানবাধিকার সংগঠন– সি পি ডি আর।
মিছিল শেষে তাঁরা যখন ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলের সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখছিলেন, তখন আগে থেকে খবর পেয়ে ওখানে জমায়েত হওয়া সি পি এম অনুমোদিত একটি সংগঠন তারস্বরে মাইক বাজিয়ে দেয়। সি পি এমের এই অসভ্যতা দেখে পথ-চলতি সাধারণ মানুষও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশিও লালগড় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বলেন, নির্বাচন করতে যত দেরি হবে, ততই সি পি এম ক্যাডারদের সশস্ত্র তাণ্ডব বাড়বে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে প্রাণহানির ঘটনাও।

যারা গুলি চালিয়েছে, তারা যে সি পি এমের লোক নয়, এটা দেখানোর জন্য উপর মহলের নির্দেশে দু’জন নিচুতলার গোবেচারা সি পি এম সমর্থককে গ্রেফতার‌ করে পুলিশ। এ ডি জি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ মহাধুমধাম করে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করেন, দু’জন কালপ্রিটকে আমরা অ্যারেস্ট করেছি।
স্টার আনন্দের এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ওখানে যে এত ব্যাপক গুলিবৃষ্টি হল, এত গুলি এল কোথা থেকে? আপনারা কি আগে জানতে পারেননি, ওই বাড়িতে এত গোলা-বারুদ মজুত করা আছে?
উনি বলেন, হ্যাঁ, আমরা খবর পেয়েছি ওখানে প্রচুর গুলি বিনিময় হয়েছে। তবে ক’রাউন্ড গুলি চলেছে, এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। ঘটনাস্থল থেকে আমরা শুধু আটখানা আট মিলিমিটার ফাঁকা কার্তুজ পেয়েছি।
শুধু স্টার আনন্দের ওই সাংবাদিকই নন, অবাক হয়ে নিজেদের মধ্যেই এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন বাকি সাংবাদিকেরাও।
তবুও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না দেখে, অবশেষে বিরোধীদের চাপে পড়ে নেতাই গ্রামের ঘটনার সি বি আই তদন্তের দাবি মেনে নেয় সি পি এম নেতৃত্ব। দুপুরের মধ্যে এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই নড়েচড়ে বসে দিল্লিও। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালানিয়াপ্পন চিদাম্বরম বিকেলেই একটি কড়া চিঠি পাঠান মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদের ভট্টাচার্যকে। তাতে আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যের ভূমিকার সমালোচনা করে, এক প্রকার প্রায় ভর্ৎসনাই করেন তিনি। বলেন, অন্য সব কাজ ফেলে অবিলম্বে দিল্লি আসুন।
গভীর ভাবে বিচলিত রাজ্যপাল কেলাথ নারায়ণন মায়ানকোটে বলেন, এটা রাজ্যের পক্ষে এক গভীর দুঃখ ও লজ্জার দিন। যে বা যারাই দোষী হোক না কেন, তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে। এ ব্যাপারে আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোমবার দুই মেদিনীপুরে বারো ঘণ্টার বনধ ডাকে কংগ্রেস। জঙ্গলমহলে বনধ ডাকে এস ইউ সি।
এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পরে গোটা জঙ্গলমহল জুড়ে চরম সতর্কতা জারি করা হয়। বিকেলের পর থেকে টহল দিতে থাকে যৌথ বাহিনী। আশপাশের থানা এবং পুলিশ ক্যাম্পগুলোকেও সতর্ক করে দেওয়া হয়। আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে পর দিন শনিবার বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী-সহ বেশ কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছে যান নেতাই গ্রামে।
তিনি আসতেই পিলপিল করে রাস্তায় নেমে আসেন ওই গ্রামের মানুষ জন। অমিত গড়াই, মন্টু রায়, শিবশঙ্কর রায়, পবিত্র গড়াই-সহ আরও অনেক গ্রামবাসী দলবদ্ধ হয়ে তাঁকে বলেন, আমরা নিজেরাই ঠিক মতো খেতে পাই না। তবু ওদের জোর জুলুমের জন্য আমরা এক-একটি বাড়ি থেকে রোজ প্রায় আড়াই কেজি করে আটা দিতাম। ওরা বলত, পঁয়ষট্টি-সত্তরটা রুটি করে দিতে। তাও করে দিতাম। কিন্তু কোনও দিন কোনও রুটি একটু-আধটু পুড়ে গেলেই ওরা আমাদের মেয়ে-বউদের যা তা ভাষায় গালিগালাজ করত। আমরা ওদের এত কাজ করে দিতাম। অথচ ওরা আমাদের একটুও বিশ্বাস করত না। ভাবত, আমরা বুঝি ওদের রুটিতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছি। তাই রুটি নিয়ে গেলে ওই রুটির মধ্যে থেকে ওরা যে কোনও একটা রুটি তুলে দিত। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের খেতে হত। সকাল থেকে মাঠে হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও ওরা বলত, রাতে ওদের পাহারা দিতে।
পদ্মাবতী রায়ের মতো বেশ কয়েক জন মহিলা বললেন, ওদের ওখানে গেলে ওরা এমন এমন সব কু-প্রস্তাব দিত দিদি, আমরা আপনার সামনে মুখেও আনতে পারব না। অনেককে তো রাস্তায় ধরেও আজেবাজে প্রস্তাব দিত।
মন্টুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের আরও অনেকে গলা মিলিয়ে বললেন, আমাদের‌ গ্রামে আঠারো থেকে চব্বিশ বছর বয়সি ছেলেদের বেছে বেছে ওরা তাদের ক্যাম্পে যেতে বলত। অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য। যাতে হাতে-কলমে শিখিয়ে সামনের ভোটে সি পি এমের হয়ে ওদের মাঠে নামানো যায়।
যারা বাধ্য হয়ে ক্যাম্পে যেত, তাদের ফাঁকা মাঠের মধ্যে দৌড় করাত। হাঁপিয়ে গেলে পিঠে বাঁশের ছড়ি মারত। মাঠের মধ্যে বন্দুক ঘাড়ে নিয়ে হাঁটু মুড়ে হাঁটাত। কাঁধে তুলে দিত বালির বস্তা। কেউ না পারলেই বলত, কাঁসাইয়ের জলে কেটে ভাসিয়ে দেব। পুঁতে দেব নদীর চড়ায়।
গ্রামের যে ছেলেরা ওদের হুমকির ভয়ে ট্রেনিং নিত, তাদের তো দু’বেলা খাওয়ার জন্য মাঠেও কাজ করতে হত। ওদের শরীর অত ধকল নিতে পারত না। একে একে অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল। আমরা তখন সবাই মিলে একদিন ঠিক করলাম, ওই হার্মাদদের বলব, তোমাদের সব কথা আমরা শুনব। যা বলবে, তা-ই করব। শুধু ওই ছেলেগুলোকে তোমরা রেহাই দাও। সেটা বলার জন্যই আমরা অবনী সিংহের বাড়ির সামনে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা জানানোর আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে এল।
গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ বেশ জোর দিয়েই বললেন, যারা এসে অবনী সিংহের বাড়িতে থাকত, তারা কেউ কিন্তু এখানকার লোক নয়, সব বাইরের লোক। গড়বেতা-কেশপুরের দিকের। সবার হাতে দামি দামি অস্ত্র। কারও কারও কাছে হাত-কামানও ছিল। সেগুলো নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে ওরা ভয় দেখাত।
নিহত সৌরভ গড়াইয়ের বাবা শক্তিপদ গড়াইয়ের বয়স সত্তরের ওপর। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, হার্মাদদের জুলুমে অস্ত্র-প্রশিক্ষণ নিতে যায়নি বলেই কি প্রাণ দিতে হল আমার বাছাকে? আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব?
‘দিন আনি দিন খাই’ পরিবারের ছেলের বউ ফুলমণির মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তাঁর শাশুড়ি সন্ধ্যা মাইতি। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, অন্যের জমিতে গতর খাটিয়ে আমরা খাই। বাস করি কুঁড়েঘরে। আমাদের কাছ থেকেও ওরা জোর করে টাকা নিত। ওরাই আমার বউমাকে গুলি করে মেরে দিল।
গুলি খেয়ে অকালে ঝরে যাওয়া কুড়ি বছরের অরূপের মা গায়ত্রী পাত্র আর বুল্টিদেবী বললেন, স্বামী-ছেলেকে খোয়ানোর ভয়ে ওদের জন্য আমরা কী না করেছি? অবনী বলেছিল, ওরা আমাদের বাঁচাবে। তা হলে ওরা গুলি করল কেন অরূপের বুকে?
এক যুবক এগিয়ে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বললেন, দিদি, আমরা আর পারছি না। আমাদের হাতে বন্দুক তুলে দিন। আমরা ওদের বুঝে নেব।
মমতা বললেন, অপেক্ষা করুন। ধৈর্য ধরুন। শান্ত হোন। সব ঠিক হয়ে যাবে। গণতন্ত্রই একমাত্র পথ। সেই পথে যে-লড়াই আপনার শুরু করেছেন, সেটা আগামী দিনের একটা ইতিহাস। মানুষের উপর বিচারের ভার ছেড়ে দিন। বুলেটের জবাব বুলেটে নয়, ব্যালটে দিতে হবে। আমরা অশান্তি চাই না। যে ভাবেই হোক শান্তি বজায় রাখতেই হবে। আপনারা শুধু জোটবদ্ধ হয়ে থাকুন। ওরা সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।
ফেরার আগে, যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের শেষকৃত্যর জন্য পরিবার পিছু কুড়ি হাজার টাকা এবং আহতদের চিকিৎসার ভার নেওয়ার পাশাপাশি, পরিবারের লোকের হাতে পাঁচ হাজার করে টাকা তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মমতা।
সেই ভিড়ের মধ্যে সুভাষগ্রামের নবীন মাস্টার আর তেরো নম্বরও আছে, সেটা কিন্তু কারও চোখেই পড়ল না।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!