।। পর্ব – ৩৯ ।।
মাওবাদীরা অবাক। পরিবর্তন! এই পরিবর্তনের কথা তো বহু দিন আগে থেকেই তাঁরা বলে আসছেন। পাননি দেখে বাধ্য হয়ে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন হাতে। যাঁদের জন্য ওঁদের আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসতে বাধা পাচ্ছিল, তাঁদের কাছে মিনতি করে, বারবার হাতে-পায়ে ধরে, বছরের পর বছর দরবার করেও তাঁরা যখন ওঁদের কথায় কান দিচ্ছিল না, তখন ওঁদের কথা শুনতে বাধ্য করার জন্য শুধু তাঁদের আপনজনকেই নয়, সরকারের উচ্চপদস্থ অফিসার থেকে শুরু করে নামী-দামি ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি অতিথি, এমনকী বিদেশি পর্যটকদের পর্যন্ত অপহরণ করছিলেন ওঁরা।
অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছিলেন। সেই টাকায় অস্ত্র কেনা থেকে শুরু করে আন্দোলনকারীদের ভরণপোষণ এবং আন্দোলনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যাবতীয় খোরাক জোগাচ্ছিলেন। এ জন্য সরকারের চক্ষুশূল হয়েছিলেন তাঁরা, আর সরকারের চক্ষুশূল যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে যদি তাঁরাও সরকারের বিরাগভাজন হন এবং তার ফলে যদি তাঁদের নিজেদের কোনও ক্ষতি হয়, তাই গ্রামের খেটে-খাওয়া সাধারণ দিনমজুর থেকে শুরু করে জমির একচেটিয়া মালিক, সকলেই সেই সব পরিবর্তনকামী মাওবাদীদের থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখাটাকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন। ফলে তাঁদের দাবি-দাওয়া যে অন্যায় নয়, উলটে সে সব দাবি যে অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত, সেটা জেনেও শুধুমাত্র সরকারি কোপে পড়ার ভয়ে সাধারণ গ্রামবাসীরা তাঁদের এড়িয়ে চলতেন। আর এ জন্যই একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল। মানুষের থেকে আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন তাঁরা।
তাঁরা ভেবেছিলেন, সাধারণ মানুষকে বোঝাবার দায় তাঁদের নেই। বোঝাতে গেলে যে সময় নষ্ট হবে, অত সময় তাঁদের হাতে নেই। তাই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট ভিক্ষে করে আসন দখল করে পরিবর্তন আনতে চাননি তাঁরা। কারণ আসন এমন একটা জিনিস, যে-কোনও লোককে আপাদমস্তক পালটে দেয়। গদি যদি তাঁদেরকেও পালটে দেয়! তাই ভোটের মাধ্যমে নয়, তাঁরা অস্ত্রের মাধ্যমে পরিবর্তন আনার কথা ভেবেছিলেন।
ভাবতে পারেননি, মানুষকে সঙ্গে নিয়েও পরিবর্তনের কথা ভাবা যায়। পরিবর্তন আনা যায়। তাই বুঝি, ছত্রধর মাহাত নিজে থেকে ছুটে গিয়েছিলেন বছরের পর বছর ধরে এক ভাবে চলতে থাকা, গতে বাঁধা, দুর্নীতিতে জর্জরিত এই রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য লড়তে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।
মমতা ওঁদের কথা শুনেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন, মার খেতে খেতে কোণঠাসা হতে হতে আর কোনও পথ পাননি দেখেই ওঁরা সন্ত্রাসের রাস্তায় পা বাড়িয়েছিলেন। ওঁদের যদি দু’বেলা খাবারের একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেওয়া যায়, ওঁদের ছেলেমেয়েদের আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার মতো বেড়ে ওঠার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, হাতের নাগালে এনে দেওয়া যায় চিকিৎসা পরিষেবা এবং ওঁদের যদি কোনও কর্মসংস্থানের একটা বন্দোবস্ত করে দেওয়া যায়, তা হলে ওঁরা নিশ্চয়ই আবার মূলস্রোতে ফিরে আসবেন।
তখনই উনি ঠিক করে নিলেন, যদি কোনও দিন তিনি ক্ষমতায় আসেন, সবার সব কথা শুধু মন নয়, হৃদয় দিয়ে শুনবেন। কার কোথায় কী সমস্যা হচ্ছে, কীসের জন্য কতটা অসুবিধে হচ্ছে, তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন এবং সেই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করবেন। সেটা জঙ্গলই হোক কিংবা পাহাড়। করবেনই। তা হলে কেউ আর সমাজের উপর অতিষ্ঠ হয়ে নিশ্চয়ই হাতে অস্ত্র তুলে নেবেন না।
শুধু মাওবাদীদের সঙ্গেই নয়, বাম সরকার যাঁদের কখনও মানুষ হিসেবেই গণ্য করেনি, মাওবাদীদের সেই স্ত্রীদের সঙ্গেও কথা বললেন তিনি। কথা বললেন, এই রাজ্যের মাওবাদী সংগঠনকে মজবুত করতে আসা ওড়িশা রাজ্যের সি পি আই (মাওবাদী) দলের সাংগঠনিক কমিটির সম্পাদক, ১৯৮৯ সালে ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টের সক্রিয় সদস্য হিসেবে অংশ নেওয়া এবং ২০০৪ সালে সি এম এ এস-এ যোগ দেওয়া শিবশঙ্কর পন্ডার বউ, লক্ষ্মী পন্ডার সঙ্গে। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৯৭ সালে।
চৌত্রিশ বছরের ওই মহিলা মমতাকে বললেন, তাঁর স্বামী দু’জন ইটালিয়ান নাগরিককে অপহরণ করেছিল। পরে মুক্তিপণ নিয়ে তাঁদের ছেড়েও দেয়। মুক্তিপণের দ্বিতীয় শর্ত ছিল, অপহরণকারীদের ছেড়ে দিলে পুলিশ আর তাঁদের পিছু নেবে না। কিন্তু পুলিশ সে শর্ত লঙ্ঘন করেছে। তাঁর স্বামী ওদের ছেড়ে দিতেই পুলিশ তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। তার নাম এখন ওড়িশা পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার ওপরের দিকে।
মমতা জানতে চেয়েছিলেন, ও এখন কোথায়?
লক্ষ্মী বলেছিলেন, জানি না। আমাকে কিচ্ছু বলে যায়নি। ২০০৯ সালে আমরা পুরীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। একদিন হঠাৎ হোটেল থেকে কাউকে কিছু না বলে সেই যে সে বেরোল, আর ফিরে এল না। চারিদিকে খোঁজাখুঁজি করলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। বুঝতে পারলাম, যে কোনও কারণেই হোক, ও উধাও হয়ে গেছে। সে-ই আমাদের শেষ দেখা। আমার মনে হয়, পুলিশের ভয়েই ও হয়তো আত্মগোপন করে আছে।
– পুলিশ কী বলছে?
– পুলিশ আর কী বলবে! প্রথম দিকে প্রায় রোজই, পরের দিকে মাঝে মাঝেই আচমকা বাড়িতে এসে হানা দিত। নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ করত। থানায় ডেকে পাঠাত। বলত, আমি নাকি সব জানি। ওর পালিয়ে যাওয়ার পিছনে নাকি আমারই হাত আছে।
মমতা বলেন, তাই?
– হ্যাঁ, এই অভিযোগে পুলিশ আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ভুবনেশ্বর আর গুনুপুর জেলে টানা দু’বছর বিনা বিচারে আটকেও রেখেছিল ওড়িশা সরকার।
– সে কী! কোনও বিচার হয়নি?
লক্ষ্মী বললেন, না।
– কেন?
– তা তো বলতে পারব না।
মমতা জানতে চাইলেন, তোমার কোনও ছেলেমেয়ে নেই?
– আছে তো। বারো বছরের একটা মেয়ে।
– সে তখন কার কাছে থাকত?
প্রতিবেশীদের কাছে। তারাই দেখাশোনা করত। খাবারদাবার দিত। জামাকাপড় কেচে দিত।
– ওর অসুবিধে হত না?
লক্ষ্মী বললেন, হত তো। বিশেষ করে পড়াশোনার খুব অসুবিধে হত। আসলে ও তো আমার কাছেই পড়াশোনা করে অভ্যস্ত। তাই অন্যের কাছে ঠিক সে ভাবে…
– তা, ওড়িশা ছেড়ে হঠাৎ এখানে চলে এলে কেন?
– কারণ আমার স্বামীকে পুলিশ এখনও ধরতে পারেনি। আর আমাদের ওখানে দেখেছি তো… কাউকে ধরতে না পারলে পুলিশ তার বউ, মা-বাবা, ভাই-বোন কিংবা তার ছেলেমেয়েদের তুলে নিয়ে যায়। তাদের উপর এমন অকথ্য অত্যাচার করে এবং সে খবর এমন ভাবে বাতাসে ছড়িয়ে দেয় যে, যে-পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আপন জনদের অসহনীয় অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে সে নিজে থেকেই ধরা দিতে বাধ্য হয়। আমার আশঙ্কা, অনেক দিন তো হয়ে গেল ওকে পাচ্ছে না। এ বার হয়তো আমাকে ধরবে। আর আমাকে ধরলে আমার মেয়ের কী হবে! ও তো বড় হয়েছে। বয়স্কা মেয়েই বলা যায়। এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে খাবারদাবার, জামাকাপড় দিলেও, দিনের বেলায় কোনও অসুবিধে না হলেও, রাতে থাকবে কোথায়? পুলিশকে তো আর বিশ্বাস করা যায় না। ওরা রক্ষক নয়, ভক্ষক। আমার মেয়েকে বাড়িতে একা পেয়ে ওরা যদি কিছু করে দেয়! তখন? আমি যখন এ সব ভাবছি, ঠিক তখনই আমার স্বামীর দলেরই একজন আমাকে বলল, এখানে চলে আসার কথা। ও-ই আমাকে ওদের সংগঠনের এখানকার সদস্যদের নাম, ঠিকানা, কী ভাবে আসতে হবে, একেবারে ছবির মতো বুঝিয়ে দিয়েছিল। লোক মারফত টাকাও পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমি তার কথা মতোই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে চুপিচুপি এখানে পালিয়ে এসেছি।
– তা হলে কি তোমার স্বামী এখানে?
একটু ভেবে নিয়ে লক্ষ্মী বললেন, আমার তো তাই মনে হয়। না হলে ওর বন্ধুরা আমাকে এখানে আসতে বলবে কেন?
– এখানে কত দিন হল এসেছ?
– তা, সাত-আট মাস হবে।
–এখনও তোমার স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়নি?
– না।
মমতা জিজ্ঞেস করলেন, কোনও খোঁজ পেয়েছ?
এ দিক ও দিক তাকিয়ে, ভাল করে চারপাশ দেখে নিয়ে লক্ষ্মী বললেন, কাউকে বলবেন না। গত পরশু আমাকে একজন বলল, ও নাকি এখানকার সংগঠনটাকে চাঙ্গা করার জন্য এখানেই আছে।
– তা হলে দেখা করেনি কেন?
লক্ষ্মী বললেন, নিশ্চয়ই কোনও অসুবিধে আছে।
– যে তোমাকে এ কথা বলেছে, তাকে তুমি এটা জিজ্ঞেস করোনি?
– না।
– কেন?
– কারণ আমি তো আমার স্বামীকে জানি। ওখানেও দেখেছি। সংগঠনের কাজ নিয়ে ও ভীষণ ব্যস্ত থাকে। ও হয়তো ব্যস্ত আছে। তাই সময় পাচ্ছে না। দেখা করার হলে ও নিশ্চয়ই দেখা করত। আমি জানি, যখন সময় হবে, তখন ও নিজে থেকেই আমার কাছে আসবে। আমাকে বলতেও হবে না।
অবাক হয়ে গিয়েছিলেন মমতা। এত দুঃখ-কষ্ট, অভাব, পুলিশি জুলুম এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও একজন আদিবাসী মহিলার এমন দৃঢ় মনোবল দেখে।
কথায় কথায় লক্ষ্মী সে দিন জোর দিয়েই বলেছিলেন, মাওবাদী হওয়া তো দূরের কথা, মাওবাদীর পত্নী হওয়াও অত সহজ কাজ নয়। বলেছিলেন, তাঁরই এক বান্ধবী শিউলি হলকার কথা– সে কোরাপুট নারায়ণপটনার বাসনাপুট গ্রামে থাকে। মেরেকেটে বছর বত্রিশেক বয়স। তার স্বামী সিংঘানাও মাওবাদী দলের নেতা। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে সে। অতিকষ্টে সাপখোপ, হিংস্র বন্যপশুর নজর এড়িয়ে, পশুর চেয়েও ভয়ংকর, যুবতী মেয়ে দেখলেই লোল ঝড়তে থাকা, এ দিকে ও দিকে ওত পেতে অপেক্ষা করা পুরুষদের থাবা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে জঙ্গলে যায় সে। বন থেকে কাঠকুটো এনে লোকালয়ে বিক্রি করে। ওই সব করে যে সামান্য ক’টা টাকা পায়, তা দিয়েই চার মেয়ে আর এক ছেলের মুখে কোনও রকমে দুটো ভাত তুলে দেয়। এত কষ্টের মধ্যেও যখন তখন পুলিশ এসে হুমকি দিয়ে যায় তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার। জেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার।
লক্ষ্মীই বলেছিলেন, শুধু শিউলির স্বামীই নয়, ওই গ্রামের বেশির ভাগ পুরুষই মাওবাদী। তাই কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের তরফ থেকে যে সব সুযোগ-সুবিধে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে কিংবা আদিবাসীদের কল্যাণের জন্য গ্রামে গ্রামে যা দান করা হয়, ওদের গ্রামকে শায়েস্তা করার জন্য ওদের গ্রামের নামটা তালিকা থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। শিউলি তো সব সময় বলে, আমাদের সরকার আমাদের পশুর চেয়েও অধম বলে মনে করে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে নানা রকম দমন-পীড়ন চালায়। চরম অত্যাচার করে। যাতে কেউ ভুল করেও কোনও মাওবাদীদের সঙ্গে মেলামেশা না করে। দলে নাম লেখানো তো দূরের কথা।
আর পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ৩৮
শিউলিই নাকি লক্ষ্মীকে বলেছিল, তাদের বাড়ি থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে বালিয়াপাট গ্রামের কথা। সেখানে থাকে তার বন্ধু চুনি ওয়াদেকা। তারও বয়স ওই বত্রিশ-চৌত্রিশের মতো। বিয়ে হয়েছে ওই গ্রামেরই দিব্য ওয়াদেকারের সঙ্গে। সে মাওবাদী দলের ফ্রনটাল অরগানাইজেশন-এর চাষি মুলিয়া আদিবাসী সঙ্ঘের প্রথম সারির নেতা।
আগে জঙ্গল থেকে বুনো ফলমূল, মহুয়া, মধু পেড়ে এনে হাটে বিক্রি করত। কিন্তু দিনকে দিন তার মতো আরও অনেক লোক বেড়ে যাওয়ায় ও সব পাড়ার জন্য সবাই রাত থাকতে উঠে বনে চলে যেত। ও-ও বাদ দিত না। কিন্তু আগের মতো অত সহজে আর ও সব সংগ্রহ করা যাচ্ছিল না। ফল পুরুষ্টু হওয়ার আগেই, মধুর চাক সে ভাবে তৈরি হওয়ার আগেই, যে যার মতো পেড়ে নিচ্ছিল। ফলে ও-ও ও সব পেড়েপুড়ে নিয়ে গেলেও, পুরুষ্টু না হওয়ার দরুন শুধু পরিশ্রমটাই হচ্ছিল, বাজারে কোনও দামই পাওয়া যাচ্ছিল না। কোনও কোনও দিন জলের দরে দিলেও বিকোচ্ছিল না। সে জন্য বছর দুয়েক আগে অন্যের জমিতে প্রথম কাজ করতে যায় সে। সরকার যতই দৈনিক মজুরির নির্দিষ্ট একটা রেট বেঁধে দিক না কেন, কাজ যখন কম, অথচ কাজ করার লোক বেশি, তখন কে কত কমে করবে, মালিকপক্ষ দর কষাকষি করে। এবং শেষ পর্যন্ত মালিক যা দেয়, তাতেই রাজি হতে হয়। নইলে যেটুকু পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তার জায়গায় অন্য কেউ কাজে লেগে গেলে সেটুকুও হাতছাড়া হওয়ার ভয় থাকে। সেই ভয় থেকেই দৈনিক তিরিশ টাকা রোজে কাজ করা শুরু করে সে।
তখনই তার সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ মাঠে দেখা করতে আসত দু’-চার জন ভিন গাঁয়ের লোক। আর তার থেকেই কানাঘুষোয় রটে যায় দিব্য মাওবাদী। পুলিশের কানে সে কথা পৌঁছতে দেরি হয়নি। আর মাওবাদী হিসেবে চিহ্নিত হওয়া মাত্র পুলিশের কু-নজরে পড়ে যায় সে।
ওকে কাজ দিলে, পুলিশ যদি পরে বলে, ও মাওবাদী জেনেও ওকে কাজ দিয়েছিলে কেন? তখন কী বলবে তারা? চোর-ডাকাত-গুন্ডা হলে না হয় লড়া যায়। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে! পুলিশ যে সরকারি গুন্ডা! একবার ছুঁলেই ছত্রিশ ঘা। অন্যের জন্য ফালতু ফালতু পুলিশের ঝামেলায় জড়াতে যাব কেন! এটা ভেবে জমির মালিকেরা তাকে কাজ দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
দিব্যকে ধরার জন্য শুধু দিনেরবেলাতেই নয়, রাতে, মাঝরাতেও পুলিশেরা হানা দিতে থাকে তার বাড়িতে। ফলে সে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। কোনও দিন বাড়ি আসে, কোনও দিন আসে না। তবে মাঝে মাঝেই পুলিশের চোখ এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এসে দাওয়ায় বসে কোনও রকমে একটু খেয়ে যায়। খাওয়া তো নয়, মুখের মধ্যে ঠেসেঠুসে ভাত ঢোকানো। কখন কোথা থেকে খবর পেয়ে পুলিশ চলে আসে কিছু বলা যায় না। বলা যায় না, হয়তো আশপাশেই ওত পেতে আছে। সব সময় একটা আতঙ্ক, এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম। এই বুঝি গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলল পুলিশ…
যখন আসে বাচ্চাদের আদর করে। কোলে নেয়। চুমু খায়। সংসার খরচের জন্য যখন যতটা পারে, টাকাপয়সা দিয়ে যায়। ওদের তিনটে মেয়ে। বড়টার বয়স ছয়। মেজোটার তিন। আর ছোটটার এক বছর। বাচ্চাগুলোকে বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে বেরোতে দেয় না চুনি। তার ভয়, ওরা বেরোলেই পুলিশ বা পুলিশের চররা বাবার হদিশ বার করার জন্য ওদের ধরে নিয়ে যাবে। বাচ্চাগুলোর হার জিরজিরে চেহারা। পুষ্টিকর খাবার দিতে পারে না চুনি। এ দিক ও দিক থেকে শাক-সবজি তুলে আনে। সেগুলোই সেদ্ধ করে ভাত দিয়ে মেখে বড় একটা জামবাটি করে ওদের সামনে দিলেই, খিদের জ্বালায় তিন জনই একসঙ্গে কাড়াকাড়ি করে ওগুলো হাপুসহুপুস করে খায়।
বড় দুঃখে নিজের মনেই বিড়বিড় করে চুনি বলে, কবে স্বামী আসবে, এলেও কত টাকা দেবে কিংবা আদৌ দিতে পারবে কি না, তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। আর ও যদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়, তা হলে তো হয়েই গেল। আমাদের না খেয়েই মরতে হবে। ও বুঝতে পারে না, দরিদ্র, নিরীহ, আদিবাসী পরিবারগুলোর উপরেই পুলিশের এত আক্রোশ কেন!
চুনি নাকি একবার শিউলিকে বলেছিল, তাদের জীবনের কোনও দাম নেই। নিরাপত্তা নেই। না-আছে খাদ্য। না-আছে বস্ত্র। না-আছে শিক্ষার ব্যবস্থা। না-আছে তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কোনও চিকিৎসার সুযোগ। বলেছিল, এই তো গত বছর, যখন তার মেয়েটার কলেরা হয়েছিল, ওর বাবা তো তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মেয়ের অসুখের কথা পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে বলতেই, তারাই একটা দড়ির খটিয়ায় মেয়েটাকে শুইয়ে, ওই গরমের মধ্যে চড়া রোদ মাথায় নিয়ে পায়ে হেঁটে সবাই মিলে পড়ি কি মড়ি করে আট কিলোমিটার দূরের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে সে দিন ডাক্তার ছিল না। ছিল না কোনও নার্সও। তাই আমার চোখের সামনেই পায়খানা-বমি করতে করতে ক্রমশ নেতিয়ে পড়ল আমার মেয়ে। আমার কোলের উপরেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। এটা কি হওয়ার কথা ছিল?
সে নাকি আরও বলেছিল, সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, বন্যা হোক, খরা হোক আর মড়ক লাগুক, আমাদের যা-ই হোক না কেন, সরকার আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। উলটে যারা আমাদের জমি কেড়ে নিতে চায়, তাদের মদত দেয়। বাধা দিতে গেলে মাওবাদী বলে তুলে নিয়ে যায়। কী চায় সরকার? আমাদের সদলবলে মেরে ফেলে দিতে? আমি এখন মনেপ্রাণে চাই, সরকার দয়া করে আমাদের সপরিবার জেলে পুরে দিক। তা হলে অন্তত বাচ্চাকাচ্চাগুলো দু’বেলা পেট পুরে একটু খেতে পারবে।
শুধু মমতা নন, তাঁর সঙ্গে আসা অর্পিতা ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারী, কুণাল ঘোষ, ববি হাকিম-সহ প্রায় সকলেই অবাক হয়ে গেলেন, যখন জানলেন, এত কষ্টের পরেও এই বউরা তাঁদের স্বামীদের ছেড়ে তো যানই না, উপরন্তু তাঁদের দোষও দেখেন না। উলটে স্বামীদের জন্য তাঁরা গর্ববোধ করেন। বুঝে হোক কিংবা না বুঝেই হোক, তাঁরা কিন্তু স্বামীদের আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের স্বামীরা একটা বড় কাজ করছেন। এই ঘুণধরা সমাজটাকে তাঁরা বদলে দিতে চান। তাঁদের লড়াই সফল হলে চিরবঞ্চিত এই বিশাল আদিবাসী সমাজের লোকজনেরা ‘মানুষের মর্যাদা’ পাবেন। একটা বড় যজ্ঞে অনেক কিছু আহুতি দিতে হয়। লক্ষ্মী, শিউলি, চুনির মতো মাওবাদীদের বউরা মনে করেন, এই যজ্ঞে তাঁরা তাঁদের জীবনটা উৎসর্গ করেছেন।
তাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের স্বামীদের কোনও দোষ নেই। জমি ও লিকার মাফিয়ারা তাঁদের মতো নিরীহ আদিবাসী পরিবারগুলোকে তাঁদের জোতজমি থেকে উৎখাত করে নিজেরা কবজা করতে চাইছে। সরকার তাঁদের কিচ্ছু বলছে না। অথচ যাঁরা জমির প্রকৃত মালিক, যাঁরা ভূমিপুত্র, যাঁরা আদিম কাল থেকে বংশপরম্পরায় এখানে আছেন, তাঁরা একটু প্রতিবাদ করতে গেলেই সরকার তাঁদের মাওবাদী বলে জেলে পুরে দিচ্ছে। উলটে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কলকারখানা করার জন্য অধিগ্রহণের নামে তাঁদের উচ্ছেদ করে জমি দখল করে নিচ্ছে। এটা কেমন সরকারি নীতি! গুটিকতক রাজনীতিবিদ আর ক’টা বই পড়া মানুষ, এক-একটা মারণ আইন চালু করে দিলেই হল! তাঁরা পড়াশোনা জানেন না, ঠিক মতো প্যাঁচপয়জার কষে কথা বলতে পারেন না বলে, তাঁদের কথা কেউ ভাববেন না! এটা কেমন কথা!
তাঁদের স্বামীরা তো যাবতীয় সুখ-আহ্লাদ ভুলে নিজের এবং অন্যান্য আদিবাসী পরিবারের লুঠ হয়ে যাওয়া জমির মালিকানা ফেরত পাওয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই সব জমি-মাফিয়াদের সঙ্গে লড়ছেন। যে কাজ সরকারের করার কথা, সে কাজ তাঁদের স্বামীরা করছেন। তা হলে তাঁদের কেন সংসার ছেড়ে বনজঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকতে হবে!
লক্ষ্মীর কথা শুনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাম সরকারের হর্তাকর্তাদের বললেন, আপনারা ওদের জঙ্গল ছেড়ে মূলস্রোতে ফিরে আসার ব্যবস্থা করুন। যাঁরা আসবেন, তাঁদের দায়িত্ব নিন। আর যাঁরা আসবেন না, তাঁদের উপরেও যাতে কোনও পুলিশি জুলুম না হয়, সে দিকটা দেখুন। অসহায় পরিবারগুলোকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দিন। ওঁদের বাচ্চাগুলোর মুখে একটু অন্নের ব্যবস্থা করে দিন। না হলে এই ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে যারা বড় হবে, তারা কিন্তু বড় হলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সমাজের শত্রু হয়ে উঠবে এবং শুধু মাওবাদীই নয়, সত্যিকারের এক-একটা মানববোমা হয়ে উঠবে। তখন সামলাতে পারবেন তো? আপনারা কি সেটাই চান?
আলিমুদ্দিন স্ট্রিট নিশ্চুপ। মহাকরণ থেকেও কোনও উত্তর ভেসে এল না। সি পি এমের কট্টর নেতারা হাসাহাসি করলেন। বললেন, মমতা এখন মাওবাদী দলে নাম লিখিয়েছে। মনে হয়, এ বার ওদের সঙ্গেই গাঁটছড়া বেঁধে ইলেকশনে লড়বে। আর যাই হোক, এ ভাবে জনগণকে পাশে পাওয়া যায় না। ভোটেও জেতা যায় না।
আর যিনি সারা জীবনে কখনও এ পার্টি কখনও ও পার্টি এবং সময় সুযোগ পেলেই দোপার্টি, থুড়ি দোপাটি ফুলে বসে দু’কুলেরই মধু খেয়েছেন, শুধু এ দেশে নয়, গোটা পৃথিবীতেই যার নজির আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, একই রাজ্যের দুটো প্রধান রাজনৈতিক দল– তৃণমূল-এর মেয়র এবং কংগ্রেস-এর আই এন টি ইউ সি-র রাজ্য সভাপতি-র মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ একই সঙ্গে আগলে বসে ছিলেন, সেই সুব্রত মুখোপাধ্যায় শুধু স্টার আনন্দেই নয়, আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, বিরোধীদের রাজনীতিই হল বিরোধিতা করা। এর মধ্যে তো কোনও লুকোছাপা নেই। আমরা রাজনীতি করতে এসেছি। সকলেই জানেন, রাজনীতি কোনও স্বাধীনতার যুদ্ধ নয়। এ হল যাকে বলে, পাওয়ার গেম। যেন-তেন প্রকারেণ নিজের শক্তি বাড়িয়ে নিয়ে প্রতিপক্ষকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টাটাই এখানে মূল মন্ত্র। শক্তি মানে জনসমর্থনের ভিত্তি। তা সে আঁধারগ্রামের কারখানাকে কেন্দ্র করেই হোক বা ইডেনের ক্রিকেট ম্যাচ। যেখানে যেমন সুযোগ পাওয়া যাবে, সেখানে তেমন করে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করাটাই রাজনীতি। বিরোধীরা শাসক দলকে বেকায়দায় ফেলার ন্যূনতম মওকাই বা ছাড়বে কেন? আঁধারগ্রামও তার ব্যতিক্রম নয়।
সোজা কথা হল, ভোট ব্যাঙ্ক। যখন যেখানে যে-পথে গেলে, যে কথা বললে ভোট বাড়তে পারে, সেটাই করতে হবে। উন্নয়ন, শিল্পায়ন, গাড়ি কারখানা সব বুঝলাম। কিন্তু তার চেয়েও আগে তো নিজেদের রাজনীতিটা বুঝে নিতে হবে। শাসকদল উন্নয়নের রথে চড়ে ড্যাং ড্যাং করে এগোবে আর বিরোধীরা পথের ধারে দাঁড়িয়ে আঙুল চুষে জয়ধ্বনি দেবে এটা আশা করা কি মুর্খামি নয়? আমরা দাতব্য চিকিৎসালয় খুলতে এসেছি নাকি? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত টাটা করছেন। বিরোধী হিসেবে আমরা তার ফায়দা তুলবই। ছিদ্র পেলেই ধরব।
তাই বিরোধীরা যদি দেখে, জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কৃষকদের হয়ে কথা বললে তাদের ভোট বাড়তে পারে, তারা সেটাই করবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে তো দেখাই গেল, কাদের পক্ষে সমর্থনের ঢেউ। তা হলে হঠাৎ কীসের দুঃখে, কোন অঙ্কে তারা সেই পথ ছাড়তে যাবে? সি পি এম যখন বর্গাদার আন্দোলন করেছিল, তার সঙ্গে আজকের জমি অধিগ্রহণে মত্ত সি পি এমের চরিত্রের নৈতিক সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় কি না, সেই বিতর্কে যেতে চাই না। কিন্তু এটা তো ঘটনা যে, তারাও একদিন বর্গাদার আন্দোলন করেছিল ভোটের বাক্সে তার ফায়দা পাবে বলেই। তা পেয়েওছিল। গ্রামে বড় চাষি ও সম্পন্নদের সঙ্গে খেতমজুরদের সম্পর্ক কার্যত বিষিয়ে তুলে সি পি এম সে দিন তার রাজনৈতিক লাভ ওঠাতে পেরেছিল। আজ আমরা যারা বিরোধী রাজনীতি করি, আমরা চাইব আমাদের মতো করে কৌশল নিতে।
সুব্রত সব সময়ই তা নিতেন। কিন্তু মমতা তো সে ভাবে ব্যাপারটাকে দেখেননি। উনি কী বলতে চাইছেন, তাঁর বক্তব্য কার দিকের পাল্লা ভারী করবে বুঝতে পেরেও মমতা মুখে কিছু বললেন না। সব শুনলেন। শুধু মনে মনে বললেন, এর জবাব জনগণই দেবে। এবং সেটা খুব শিগগিরিই।#
চলবে….