ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ শেষ পর্ব

।। শেষ পর্ব।।

বামপন্থী নেতারা আন্দাজ করলেন মার্চের প্রথম সপ্তাহেই বিধানসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হতে পারে। তাই ভোটের সময় তাঁদের যাতে কাজের কোনও অসুবিধে না হয়, সে জন্য ঝটপট করে ৩২২১টি নানা ধরনের পদ সৃষ্টি করল রাজ্য সরকার। সে কথা একগাদা সাংবাদিকের সামনে মহাকরণে বসে অকপটে জানালেন রাজ্যের তথ্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী সৌমেন্দ্রনাথ বেরা। অবশ্য তার আগেই মন্ত্রিসভার নানা বৈঠকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পুলিশ-সহ নানা দফতরে বহু নতুন পদ তৈরির অনুমোদন করে দিয়েছিল রাজ্য মন্ত্রিসভা।
ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার আগেই দরিদ্র শহরবাসীদের সম্পত্তি করের আওতা থেকে ছাড় দেওয়ার জন্য দুর্গাপুরের মেয়র রথীন রায়কে চেয়ারপার্সন এবং পুর দফতরের কর্তা কল্লোল মুখোপাধ্যায়কে সদস্য সচিব করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয় রাজ্য সরকার। তাঁরা তেরো দফা সুপারিশপত্র জমাও দেন। তাতে পুরসভার নাগরিকদের কাছ থেকে চলতি পুরকরের হার দশ থেকে ত্রিশ শতাংশ কমিয়ে কর নির্ধারণ কমিটি শতকরা ৬ থেকে ২১ করার সুপারিশ করেন।
রাজ্যের প্রায় আড়াই লক্ষ চা-শ্রমিকের মহার্ঘ ভাতা বাড়ানোর কথা শোনান শ্রমমন্ত্রী অনাদি সাহু। পাশাপাশি চা-বাগান মালিকদের কাছে তিনি সুপারিশ করেন শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো, তাঁদের বাসস্থানের সমস্যা মেটানো এবং সেখানে আলাদা বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়ার।
শুধু তা-ই নয়, রাজ্যের ২৭৮টি চা-বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের কী কী আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধে দেওয়া দরকার, তা পর্যালোচনা করতে জলপাইগুড়ির ডিভিশনাল কমিশনার অমরেন্দ্রনাথ সিংহকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করে দেয় রাজ্য সরকার।
নজর দেয় সৌন্দর্যায়নের দিকেও। বলা হয়, মহাকরণের সামনে লালদিঘির পাশে ভূগর্ভস্থ পার্কোম্যাটটি লম্বায় ২১২ মিটার ও চওড়ায় ৪৫ মিটার করা হবে। একতলায় মূলত ভি আই পি-দের একশোটি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা হবে। দোতলায় অন্য সব গাড়ি। এমন ভাবে জায়গাটা তৈরি করা হবে, যাতে কম করে সাতশো গাড়ি ঠিকঠাক মতো রাখা যায়। কোনও গাড়ি যদি হঠাৎ বিকল হয়ে পড়ে, সেই গাড়ি উপরে তুলে আনার জন্য থাকবে বিশেষ লিফটের ব্যবস্থা। ছাদটাকেও দৃষ্টিনন্দন করে তোলার জন্য ছাদের মাথায় হালকা মাটির ওপর মেক্সিকান ঘাস বসানো হবে।
রাজ্যের মুখ্য স্থপতি মনীষা রক্ষিত জানান, ছাদের উপর রেড কালার ডুরান্ড, রঙ্গন, লন্টনা, আলামোন্ডা, গার্ডেনিয়া চাইনিজ, সর্ট ব্যাম্বু ট্রিজ, ছোট দেওদার, ছোট আকারের পাম গাছ-সহ আঠারো রকমের গাছগাছালি, গুল্ম এবং দেশি-বিদেশি বাহারি গাছ লাগিয়ে লোকের নজর কাড়বে এই রাজ্য। পার্কটি করার সময় বিধান রায়, বিনয়, বাদল, দীনেশ, প্রফুল্ল চাকী-সহ যে ছ’জনের মূর্তি সরানো হয়েছিল, সেগুলিও বসানো হবে যথাযথ ভাবে। পার্কের চারপাশে থাকবে জগিং ট্র্যাক, হাঁটার রাস্তা।
পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী জানান, এর জন্য রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই বরাদ্দ করেছে চুয়াল্লিশ কোটি টাকা। দরকার হলে আরও করবে। তবু সৌন্দর্যায়নের কোনও কাজ টাকার জন্য এতটুকুও কাটছাঁট করা হবে না।
জনগণের চোখ রাজ্যের উন্নয়নের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনের সময় যাতে সমাজ-বিরোধীদের কাজে লাগানো যায়, তারও ছক কষতে শুরু করে দেয় সরকারের মদতেপুষ্ট সি পি এমের লোকেরা। কারাগারের দায়িত্ব রাতারাতি বদল করা হয় দলের প্রতি অত্যন্ত অনুগত্য বেশ কিছু বাছাই করা ব্যক্তিকে। সেই সব জেল-সুপারের মদতেই দাগি কয়েদিদের হাতে হাতে পৌঁছে যায় মোবাইল ফোন। সেই ফোন মারফত ওই কয়েদিরা যোগাযোগ শুরু করে দেয় বাইরের দুষ্কৃতীদের সঙ্গে।
এই নিয়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের সুপারের বিরুদ্ধে পাঁচ দফা অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে কারা দফতরের কর্তাদের কাছে পাঠিয়ে দেন ওই জেলেরই এক বন্দি– সুখদীপ সিংহ। সে জন্য ওই সুপার তাঁকে ‘পানিশমেন্ট সেল’-এ ঢুকিয়ে এমন ভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে যে, তিনি চিরকাল তা মনে রাখবেন। এই অত্যাচার চালানোর একমাত্র কারণ, তিনি একেবারে নামধাম দিয়ে অভিযোগ করেছিলেন, কার তত্ত্বাবধানে এই জেলের ভিতরে মদ, জুয়া, এমনকী মহিলাঘটিত নানা কারবার অবাধে চলছে।
দমদম সেন্ট্রাল জেলেও ঘটেছে এ রকম ঘটনা। মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই বাইরে যোগাযোগ করে আন্তর্জাতিক মাদককারবারি বইখা কিম-সহ বেশ কয়েক জন পালিয়েছিল। আর এটা যে সত্যি, তা গোয়েন্দাদের তদন্তে প্রমাণিতও হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের সব জেলেই যে মোবাইল ফোন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ, খাদিম-কর্তা অপহরণ মামলায় অভিযুক্ত, সবার নজরে থাকা প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি আফতাব আনসারির মতো কুখ্যাত কিডন্যাপারের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইল। অভিযোগে আরও বলা হয়, কয়েদিরা ওই সব ফোন ব্যবহার করার জন্য সুপারকে প্রচুর টাকা দেন। আর যে-সব ন্যক্কারজনক কাজকর্ম হয়, তার সঙ্গে যে শুধু প্রেসিডেন্সি জেলের বন্দিরাই জড়িত, তা নয়। কিছু দিন আগে হঠাৎই এক কারারক্ষীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৬৬ প্যাকেট গাঁজাও। এ থেকেই বোঝা যায়, জেলগুলোর আঁটঘাট কতটা নড়বড়ে।
উন্নয়নের দোহাই দিলেও রাজ্য সরকার যে আসলে প্রতারণা করছে, সিপি এম তার দলের পেটোয়া লোকজন এবং আমলাদের তোল্লাই দিচ্ছে, এটা বুঝতে পেরে সাঁওতালি ভাষার কবি-সাহিত্যিকরা মহাকরণে গিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে প্রশ্ন করেন, সরকারি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার স্কুলগুলোতে অলচিকি হরফে লেখাপড়া করানো হচ্ছে না কেন?
পশ্চিম মেদিনীপুরের নেকুড়সেনি গ্রামের সাঁওতাল কবি সুরেন্দ্রনাথ হেমব্রম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বলেন, আকাদেমি পরিচালন কমিটিতে নব্বই জন সদস্য থাকলেও, তাঁদের মধ্যে অন্তত একজন সাঁওতাল ভাষার কবি-সাহিত্যিক বা বিদ্বজ্জনের স্থান নেই কেন? শুধু রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের কাছের লোকজন আর আমলাদের নিকট আত্মীয়স্বজনদের বসিয়ে সদস্য পদগুলো আটকে রেখেছেন কেন?
সাঁওতাল ভাষার কবি ও গল্পকার পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা থানা এলাকার সীমানা গ্রামের অসিতবরণ অধিকারী বলেন, ১৯৭৯ সালে রাজ্য সরকার অলচিকি ভাষাকে স্বীকৃতি দিলেও, তাঁদের ছেলেমেয়েদের ওই ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না কেন?
বেঁকে বসে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনও। তারা আপত্তি জানায়, জঙ্গলমহল এলাকায় মাওবাদী মোকাবিলা করার জন্য বয়স্ক পুলিশদের পাঠানোর ক্ষেত্রে। অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বিজিতাশ্ব রাউত মহাকরণে গিয়ে বলেন, পঞ্চাশ বছরের বেশি বয়সি পুলিশ কর্মীদের পক্ষে দিন-রাত পরিশ্রম করে মাওবাদী মোকাবিলা করা অসম্ভব। জঙ্গলমহল এলাকায় তাঁদের পাঠানো চলবে না।
রাজ্য পুলিশের এ ডি জি (প্রশাসন) দুর্গাপ্রসাদ তারানিয়ার কাছে মহাকরণে গিয়ে দশ দফা দাবি পেশ করা হয়। বলা হয়, অবিলম্বে পুলিশের বারো হাজার শূন্য পদে কর্মী নিয়োগ করতে হবে। কারণ এই রাজ্যের পুলিশ কর্মীর সংখ্যা দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক কম। এই কম সংখ্যক পুলিশ দিয়েই এই সরকার জঙ্গলমহলে মাওবাদী, উত্তরবঙ্গে কে এল ও জঙ্গি এবং দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের আন্দোলনকে ঠেকাতে চাইছে। ফলে পুলিশের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। পুলিশরা তাঁদের নির্ধারিত ছুটি পর্যন্ত নিতে পারছেন না। অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কর্মরত অবস্থায় কোনও পুলিশ মারা গেলে, রাজ্য সরকার ক্ষতিপূরণ দেয় মাত্র দু’লক্ষ টাকা। সেটা দশ লক্ষ করারও আর্জি জানায় অ্যাসোসিয়েশন।
রাজ্য কারা দফতর আর্জি জানাল নির্বাচন কমিশনের কাছে। সেই আর্জি অনুযায়ী রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতম কারা অধিকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে মহাকরণে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, আপাতত রাজ্যের সব ক’টা সেন্ট্রাল জেলে কমপিউটার বসাবেন। তাতে জেলে আটক সব বন্দিদের আঙুলের ছাপ, ছবি-সহ জীবনপঞ্জী নথিভুক্ত করা থাকবে। থাকবে বন্দির জেল খাটার মেয়াদ, সংশ্লিষ্ট বন্দি সম্পর্কে আদালতের নির্দেশ, জেলে তার ব্যবহার, কাজকর্ম– সব কিছুই। তার সঙ্গে তাঁরা দাবি করলেন, না, সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের কথা আমরা বলছি না। বলছি, বিচারাধীন বন্দিদের ভোট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক।
রাজ্যের এ ডি জি (কারা) বংশীধর শর্মা বললেন, বছরের পর বছর সংশোধনাগারে আটক থেকেও ভোটে দাঁড়ানো যায়। অনেক বিচারাধীন বন্দি নির্বাচনে জিতে সাংসদ, বিধায়ক, এমনকী মন্ত্রীও হয়েছেন। আর আদালত যাঁদের এখনও দোষী সাব্যস্তই করতে পারেনি, সেই বিচারাধীন বন্দিদের ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়া হবে না কেন?
সারা দেশ যখন উত্তাল, কবে ভোট হবে? কবে ভোট হবে? ঠিক তখনই ২০১১ সালের ১ মার্চ, বাজেট পর্বের রেশ মিটতে না মিটতেই প্রতিটি রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি, নির্বাচনে হানাহানি হওয়ার আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে মুখ্য ইলেকশন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি ঘোষণা করলেন, পশ্চিমবঙ্গের ছ’দফা ভোটের দিনক্ষণ।
ঠিক হয়, ভোট হবে ১৮ এপ্রিল। প্রথম দফায় দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দুই দিনাজপুর ও মালদহের মোট ৫৪টি আসনে। ২২ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় ভোট হবে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বীরভূম-এর ৫০টি আসনে। ২৭ এপ্রিল তৃতীয় দফায় দুই চব্বিশ পরগনা ও কলকাতার ৭৫টি আসনে। ৩ মে চতুর্থ দফায় ভোট হবে হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর এবং বর্ধমান জেলার বর্ধমান ও কাটোয়া মহকুমার ৬৩টি আসনে। ৭ মে পঞ্চম দফায় ভোট হবে পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া– এই তিন জেলার কিছু কিছু অংশ এবং বর্ধমানের বাকি অংশের মোট ৩৮টি আসনে। এবং ১০ মে হবে শেষ দফা মানে ষষ্ঠ দফার ভোট। পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার বাকি অংশের ১৪টি আসনে।
ভোটের তারিখ ঘোষণা হওয়ার দিন সাধারণ লোকজন সেটা নিয়ে এতটাই মেতে উঠলেন যে গুরুত্বই পেল না, ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাতের গোধরা স্টেশনে সবরমতী এক্সপ্রেসের এস-৬ কামরায় আগুন লাগিয়ে ৫৯ জন করসেবককে পুড়িয়ে মারার সেই নারকীয় ঘটনার রায়। যখন দিল্লিতে এস ওয়াই কুরেশি ভোটের দিন ঘোষণা করছেন, ঠিক তখনই সবরমতী কেন্দ্রীয় কারাগারে গোধরা-মামলার জন্য গঠিত বিশেষ আদালতের বিচারপতি পি আর পটেল ২০ জনের যাবজ্জীবন এবং ১১ জনের ফাঁসির সাজা ঘোষণা করেন। একসঙ্গে এত জনের ফাঁসির আদেশ সম্ভবত এই দেশে এই প্রথম। তবু সাধারণ মানুষকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারল না সেই নির্দেশ।
লোকে মাথা ঘামাল না এ দিনই এরিনা অ্যানিমেশনের শিক্ষক তিলজলার রিজওয়ানুর রহমানের হত্যা মামলার রায়। বিখ্যাত ব্যবসায়ী অশোক টোডির একমাত্র মেয়ে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে প্রণয়ঘটিত কারণে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২১ তারিখে পাতিপুকুরের রেল লাইনের ধারে পাওয়া যায় রিজওয়ানুরের মৃতদেহ। সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রুজু হয় খুনের মামলা। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে সিবিআইয়ের হস্তক্ষেপ। সেই মামলা বহু টালবাহানার পর, মামলা করার প্রায় সাড়ে তিন বছর বাদে এ দিনই শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয়, সি বি আইকে দিয়ে নতুন ভাবে আর তদন্ত করার দরকার নেই।
সারা দেশে যে ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী বারবার ছুটে গিয়েছিলেন যাঁর বাড়ি, তৈরি হয়েছিল বিশাল এক জনমত, চ্যানেলে চ্যানেলে বসেছিল বিতর্ক সভা, ইলেকশন হলে তাঁর ভাই রূপবানকে ভোটে দাঁড় করাবেন বলে আগাম ঘোষণাও করে দিয়েছিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই কেসে এমন জল ঢেলে দেওয়া রায়েও এতটুকু বিচলিত হল না পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।
বছরখানেকের ওপর গোটা রাজ্য জুড়ে যে ভাবে রাজনৈতিক হানাহানি শুরু হয়েছে, তাতে রাজ্যে আসন্ন নির্বাচন ‘কঠিনতম’ হবে বলে আগেই আখ্যা দিয়েছিল কমিশন। ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করতে গিয়ে সেই সূত্র ধরেই, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, নির্বিঘ্নে ভোট সম্পন্ন করতে কমিশন বদ্ধ পরিকর। তাই ছ’দফায় ভোট করানোর পরিকল্পনা নিয়েছি।
এর আগেই বিহারে ছ’দফায় ভোট করিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল, তা সত্ত্বেও বিহারে ভোট মেটার কয়েক মাসের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গেও সেই একই রীতি বজায় রাখল কমিশনের কর্তারা। কারণ তাঁদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ক্রমশ বেড়ে চলা। ভোটের সময় যা আরও বাড়বে বলে নির্বাচন দফতরের আশঙ্কা।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বললেন, আমরা মনে করি, যত বেশি দফায় নির্বাচন হবে, তত বেশি সংখ্যক নিরাপত্তা কর্মী নির্বাচনী এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। তাতে বুথ প্রতি নজরদারি যেমন বাড়বে, তেমনি ভোটের কাজ মসৃণ ভাবে করাও সম্ভব হবে।
ইতিমধ্যে রাজ্যে কয়েকশো কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। নির্বাচন সুষ্ঠু ভাবে শেষ করতে আরও কত নিরাপত্তা কর্মী প্রয়োজন, তা সরাসরি না বললেও কুরেশি বলেন, কত কেন্দ্রীয় বাহিনী দরকার তা নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাই না। তবে এটা বলতে পারি, নির্বাচনের সময় আমাদের কাছে পর্যাপ্ত বাহিনী থাকবে।
এ রাজ্যের নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় বাহিনী যাতে যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়, সে জন্য ১৩ এপ্রিলের মধ্যে বাকি রাজ্যগুলোর নির্বাচন শেষ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। কারণ এর আগে পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ দফায় নির্বাচন হলেও এ বারের পরিস্থিতি অন্যান্য বারের চেয়ে আলাদা। ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়ার অনেক আগে থেকেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে ভাবে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে, তা সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোনও দিন হয়নি।
বিরোধী দলগুলোর কাছ থেকে বারবার অভিযোগ গেল কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে, এ রাজ্যে চৌত্রিশ বছর ধরে একচ্ছত্র ক্ষমতা দখল করে রাখা সি পি এম প্রতিবারের মতোই এ বারও গুন্ডা-বাহিনী নামিয়ে, জোর করে, জুলুম করে ছাপ্পা ভোট দিয়ে ফের দখল করবে ক্ষমতা। পাশাপাশি হাস্যকর করে তুলবে ভোট পর্বকে। যে ভাবে হোক এটাকে আটকাতে হবে। এই অভিযোগ পেয়ে জানুয়ারি মাসে নির্বাচন কমিশনের ছয় সদস্যের একটি দল রাজ্যের এগারোটি জেলা ঘুরে দেখেন। তাঁদের রিপোর্ট এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া নানা সূত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, কথাটা মিথ্যে নয়। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় বেআইনি অস্ত্রের অবাধ মজুদ রয়েছে। যা শাসক এবং বিরোধী দল, উভয় পক্ষই নির্বাচনের সময় ব্যবহার করতে পারে বলে গোপন সূত্রের খবর। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সন্ত্রাস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে মাওবাদী হামলা, তীব্র হতে পারে পাহাড় সমস্যাও। উনি আরও বলেন, সুষ্ঠু ভাবে পর্যাপ্ত পুলিশ দিয়ে নির্বিঘ্নে নির্বাচন করার জন্যই দু’-তিন দিন বাদ দিয়ে দিয়ে এই পৃথক পৃথক তারিখে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা।
পশ্চিমবঙ্গ চিফ ইলেকট্রোকাল অফিসার সুশীল গুপ্ত জানান, পশ্চিমবঙ্গের মোট বুথের প্রায় ৮ শতাংশ মানে প্রায় চল্লিশ হাজার বুথ অত্যন্ত সংবেদনশীল। আমরা এই ধরনের প্রায় প্রতিটি বুথেই ওয়েব কাস্ট টেকনোলজি প্রয়োগ করে ভি ডি ও ফিল্মিং করে রাখব। যাতে পরবর্তী কালে কোনও সমস্যা দেখা দিলে ওগুলো চালিয়ে প্রমাণ দেওয়া যায়, ঠিক কী ঘটেছিল। শুধু তাই-ই নয়, ওই সব অঞ্চলের সমাজ বিরোধীদের উপরেও প্রশাসনের তরফে বিশেষ নজরদারি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের দিন প্রতিটি স্পর্শকাতর বুথে চারটি বলয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জারি করা হবে। মোতায়েন করা হবে পঞ্চাশটা কুইক রেসপন্স টিম। এই টিম তৈরি করা হয়েছে মূলত আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ান ও অফিসারদের নিয়ে। এদের পাশাপাশি মজুত রাখা হবে প্রচুর হাই রেডিও ফ্লাইং স্কোয়ার্ড। যাকে সংক্ষেপে বলা হয় এইচ আর এফ সি।
আর ভুয়ো ভোটাররা যাতে ফলস ভোট দিতে না পারে, সে জন্য প্রত্যেক ভোটারের পরিচয়পত্র খুঁটিয়ে এবং খতিয়ে দেখার জন্য বিশেষ ভাবে নির্দেশ দিয়েছে আমাদের নির্বাচন দফতর। মোতায়েন করা হবে আর্মস প্যারামিলিটারি-সহ প্যারামিলিটারি ফোর্স।
এই রাজ্যের ভোট নিয়ে যখন সারা দেশ মেতে উঠেছে। অন্য রাজ্যগুলো পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকিয়ে আছে কী হয় কী হয়। তখন এই রাজ্যের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলই প্রচারে মুখর হয়ে উঠল। স্বনামধন্য যে সব কবি, শিল্পী, গায়ক, অভিনেতা বামফ্রন্ট সরকারের নানা কার্যকালাপ আর নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন, মিটিং-মিছিল করেছিলেন, তাঁদের মুখচ্ছবি দিয়ে বিশাল বিশাল হোর্ডিং করে সারা পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিল তৃণমূল কংগ্রেস। উপরে লিখে দিল– এরা পরিবর্তনের পক্ষে।
সেখানে মমতা শঙ্করেরও ছবি ছিল। ওই ব্যানার টাঙানোর দিনই সি পি এমের সদর দফতর থেকে এক প্রভাবশালী নেতার ফোন গেল মমতা শঙ্করের কাছে। কী কথা হল কে জানে! পর দিন মমতা শঙ্কর পুরো একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বললেন, পরিবর্তনকামীদের সঙ্গে আমার যে ছবি তৃণমূল কংগ্রেস তাদের নির্বাচনী ব্যানারে ব্যবহার করেছে, সে জন্য আমার কাছ থেকে ওরা কোনও অনুমতি নেয়নি।
পরিবর্তনপন্থীরা অবাক। এ কী বলছেন উনি! উনি তো নিজেই বেছে দিয়েছিলেন এই ছবিটা!
সে নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হল। চাপানউতোর চলল। অগত্যা পরের ব্যানার থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হল মমতা শঙ্করের ছবি।
এই ঘটনাটাকে সাধারণ লোকজন ভাল চোখে নিলেন না। নানান নিউজ চ্যানেলে, বিশেষ করে চব্বিশ ঘণ্টা চ্যানেলে গৌতম দেব যতই বলুন‌ না কেন, জনগণ আমাদেরই ফিরিয়ে আনবে, ফলাফল ঘোষণার অনেক আগেই কিন্তু শুধু বিরোধী দলনেত্রীই নয়, এই রাজ্যের আপামর জনতা বুঝতে পেরেছিলেন, কী হতে চলেছে। সেটা যে বামফ্রন্টের চেয়ার আগলে বসে থাকা নেতারাও টের পেয়েছিলেন, তার প্রমাণ রাজ্য চতুর্দশ বিধানসভার শেষ অধিবেশনের দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম বক্তা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন স্পিকারের উদ্দেশে বলছেন, ‘ঝঞ্ঝা বিধ্বস্ত সমুদ্রের মধ্যে আপনি দক্ষ নাবিকের মতো জাহাজ চালিয়েছেন। আমরা যে লক্ষ্যে পৌঁছতে চেয়েছি, সেই গন্তব্যে আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন। আপনি গণতন্ত্রকে বাঁচিয়েছেন…’ ঠিক তখনই বামফ্রন্টের মুখ্যসচেতক মহম্মদ মসীহ বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বলে ফেললেন, ‘পরবর্তী বিধানসভায় আপনিও আর আসবেন না। আমরাও আর আসব না…’
তাঁর কথায় বাম বিধায়কেরা হেসে ফেললেও মসীহের সেই কথায় কী অবচেতন ভাবে তাঁদের আসন্ন ভরাডুবির ইঙ্গিত ছিল না! ছিল। তাই স্টার আনন্দ থেকে চ্যানেল টেন ভাবী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতার সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করল। মমতাও আগাম বলে দিলেন, নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেবে ১৮ তারিখে। তবে আমাদের নীতি হবে বদলা নয়, বদল। এবং আমাদের মূল সুর হবে– সুশাসন। গণতন্ত্র আর উন্নয়ন।
অবশেষে ১৩ মে ঘোষণা করা হল ভোটের ফলাফল।
পাঁচ বছর আগে ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বলেছিলেন, আমরা ২৩৫। ওরা ৩০। আমাদের কে রুখবে?
সে বার সি পি এম একাই পেয়েছিল ১৭৬টি আসন। মানুষ তখন সি পি এমের সঙ্গে ছিল। কিন্তু ওই ঔদ্ধত্যের কারণেই বুঝি মানুষ সরতে শুরু করেছিল। তাই তখন থেকেই সম্ভবত সি পি এমের পতন শুরু। ফলে তৃণমূল জোট যেখানে পেল ২২৭টি আসন, সেখানে বামফ্রন্ট পেল মাত্র ৬২টি। অবসান হল টানা চৌত্রিশ বছরের বাম জমানার। যে মেয়েটিকে একদিন চুলের মুঠি ধরে মহাকরণ থেকে বার করে দিয়েছিল বামফ্রন্ট জমানার পুলিশ, তাঁর হাতেই এল মহাকরণের সর্বময় কর্তৃত্ব। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। একটা ঐতিহাসিক জয়।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ৪০

তার আগেই অবশ্য ফলাফল আঁচ করে সম্পূর্ণ ফল ঘোষণার জন্য অপেক্ষা না করে বেলা একটা নাগাদ রাজভবনে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আসেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টালির ছাউনি দেওয়া বাড়ির সামনে তখন শিশুর মতো কাঁদছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মুকুল রায়, সুব্রত বক্সি, ডেরেক ও’ব্রায়ানরা। উচ্ছ্বসিত লোকজন যাতে হুড়মুড় করে বাড়ির ভিতরে ঢুকে না পড়ে, সে জন্য ইতিমধ্যেই ব্যারিকেট দিয়ে একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে ফেলেছে পুলিশ। সেই ব্যারিকেটের ও পারে হাজার হাজার উল্লসিত মানুষ একে অন্যকে উন্মাদের মতো আবির মাখাচ্ছেন। ক্রমশ সবুজ হয়ে উঠছেন তাঁরা।
ভিতরে তখন মমতার কাছে একের পর এক অভিনন্দন জানিয়ে ফোন। ফোন আফগানিস্তান সফররত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের। দিল্লির ১০, জনপথ থেকে সনিয়া গাঁধীর। ঢাকা থেকে ও পার বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কার নয়? প্রণব মুখোপাধ্যায়ের তরফ থেকে ফুলের তোড়া নিয়ে সোজা তাঁর বাড়িতে হাজির এ আই সি সি-র সদস্য সমীর চক্রবর্তী, প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক শুভ্রা ঘোষ। শুধু ফুল পাঠিয়েই ক্ষান্ত হলেন না প্রণববাবু। ফোন করে অভিনন্দনও জানালেন।
কাঁহাতক আর ফোনে কথা বলা যায়। এ দিকে বাড়ির সামনে তখন জনজোয়ার। তাই শেষ পর্যন্ত অসুস্থ মা গায়ত্রী দেবীকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মমতা। বাড়ির সামনে কাতারে কাতারে লোক। যত দূর চোখ যায় শুধু কালো মাথা।
তিনি সামনে আসতেই সে কী উল্লাস। বাঁধ ভাঙা ঢেউ। সবাই তাঁকে দেখার জন্য হাঁকপাঁক করছেন। কিন্তু পিছনের লোকেরা বেশির ভাগই তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন না। তাই সুব্রত বক্সি ভিতর থেকে একটি টুল নিয়ে এলেন। তার উপরে উঠে পড়লেন মমতা। বললেন, এ জয় মা মাটি মানুষের জয়। এই জয় গণতন্ত্রের জয়। এই জয় আমি মানুষকে উৎসর্গ করলাম। আমি আমার দলের নেতা-কর্মীদের কাছে আবেদন করছি, কেউ কোথাও উৎসাহের আতিশয্যে কিছু করবেন না। সর্বত্র শান্তি বজায় রাখবেন। মনে রাখবেন, এখন আমাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে। দয়া করে কেউ প্রতিশোধের রাজনীতি করবেন না।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত শুধু নয়, পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশ থেকে আসা নানান ভাষাভাষীর অজস্র টিভি চ্যানেলের ঝাঁক ঝাঁক বুম তাঁকে ঘিরে ধরল। ঘিরে ধরল প্রিন্ট মিডিয়াও। রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল জোড়া ফুলের সবুজ পতাকা নিয়ে শত শত বাইকের মিছিল। উচ্ছ্বসিত সারা রাজ্য। মমতা জেতার সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন রেকর্ড তৈরি হয়ে গেল রাজ্যে। এই রাজ্যে এই প্রথম কোনও মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হলেন। প্রেসিডেন্সির মতো স্বনামধন্য কোনও কলেজ নয়, এই প্রথম হাজরা মোড়ের আশুতোষ কলেজের মতো অত্যন্ত সাধারণ মানের, খুব সাদামাঠা একটি কলেজ থেকে পাশ করা একটি মেয়ে মুখ্যমন্ত্রী হলেন।
উচ্ছ্বসিত মমতার ভাই অজিত, কালী, অমিত, কার্তিক, গণেশ, বাবুন এবং ভাইয়ের বউ চন্দনা, লতা, কাজরী, রিনা আর কল্পনারাও। জয় যে হবেই, আগাম টের পেয়ে মমতার বাড়ির সামনে চলে এসেছিলেন সুভাষগ্রামের নবীন মাস্টার। সঙ্গে তেরো নম্বরও। বাদ যায়নি আঁধারগ্রামের গণেশ, শিবু, রতন, কার্তিক, হাবলুরাও। তাঁদের সঙ্গে এসেছেন গ্রামের নাম না জানা মেয়ে-বউরাও। এই ঘটনার সাক্ষী থাকতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন তাঁদের মতো আরও অনেক মার খাওয়া মানুষ। যাঁরা এই আন্দোলনের আসল কাণ্ডারী। এই জয়ের আসল হকদার। যাঁরা মনে করেন; এ জয় কোনও দলের নয়, একক কোনও নেতা বা নেত্রীরও নয়, এ জয় তাঁদের জয়। এ জয় এই রাজ্যের অবহেলিত, শোষিত, অত্যাচারিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত, ব্রাত্য মানুষের জয়। যাঁদের কোনও নাম নেই, গোত্র নেই। এই জয়ে তাঁরা আনন্দ করবেন কী, আনন্দের চোটে তাঁদের চোখ দিয়ে তখন টপটপ করে জল পড়ছে।
মমতার তখন বারবার মনে পড়ছে রাজীব গাঁধীর কথা। বাড়ির লাগোয়া অফিসঘরে বসে দীর্ঘ দিনের সঙ্গী, সহযোদ্ধাদের কাছে বললেন, খুব মিস করছি ওঁকে। ১৯৮৯ সালে জিতেন্দ্রপ্রসাদ আমাকে বলেছিলেন, উনি আমাকে প্রদেশ কংগ্রেসের সভানেত্রী করতে চান। কিন্তু তখনও আমার বয়স হয়নি।
সেই সব দিনের কথা যত বলছেন, ভাবছেন তার বেশি। ভাবছেন আর দরদর করে ঘামছেন। মধ্য মে মাসের এই প্রচণ্ড দাবদাহের দিনে চড়া রোদ্দুরের মধ্যেও তখন হাজার হাজার মানুষ তাঁকে এক ঝলক দেখার জন্য দাঁড়িয়ে। যেন মানুষ নয়, একটা উত্তাল সমুদ্র।
সে দিকে তাকানোর মতো ফুরসত নেই তাঁর। এত দিনের এই যুদ্ধে উনি যেন আজ ক্লান্ত। তাই উনি বললেন, আমি এ বার একটু স্নান করতে যাই। বলেই, আটপৌরে শাড়িটা কোমরে গুঁজে অফিসঘর থেকে বেরিয়ে আবার টালির চালের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন তৃণমূল নেত্রী। না না, তৃণমূল নেত্রী নয়, ভারতের রেলমন্ত্রী। নাহ্, তাও আর বলা যায় কী? কারণ ইতিমধ্যেই তো মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে উনি এখন এই রাজ্যের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী। মানুষের চোখের মণি।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!