মধ্যযুগীয় সম্রাট ও সাম্রাজ্যের অবসানের পরেও বহু ভাষাভাষী মানুষের স্বেচ্ছাপ্রদত্ত স্বীকৃতির উপরে গঠিত বহু-জাতির সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রসমূহ এযুগেও যে বিদ্যমান রয়েছে—সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, ভারত প্রভৃতি বৃহৎ রাষ্ট্র একথার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আবার এক ভাষাভাষী মানুষেরাও যে এযুগে আলাদা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করেছেন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং আরব জগৎ এর ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। এই উভয় শ্রেণীর রাষ্ট্র গঠনের পিছনেই লম্বা ইতিহাস রয়েছে। বহু-ভাষাভাষী মানুষের সমবায়ে গঠিত আধুনিক বহু-জাতির সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রমাত্রেই আগে সবলে গঠিত রাজ-রাজড়া শাসিত সাম্রাজ্য ছিল। বর্তমান সময়ে তার রূপরেখা, আঙ্গিক এবং চরিত্রের বদল ঘটলেও অতীতের ইতিহাস মুছে যায়নি, এবং মুছে ফেলা সম্ভবও নয়। এক্ষেত্রে অন্য যে বিষয়টি লক্ষ্য করবার মত, সেটা হল যে, বহু ভাষাভাষী মানুষের সমন্বয়ে গঠিত বহুজাতি বিশিষ্ট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রমাত্রেরই কাঠামো হল ফেডারেল। অন্যদিকে এক ভাষাভাষী মানুষের সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রের ফেডারেল কাঠামো হওয়ার কোন আবশ্যকতা নেই বলেই দেখতে পাওয়া যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনফেডারেল কাঠামোর ঐতিহাসিক কারণ অনেকেরই জানা রয়েছে বলে এখানে আলাদাভাবে এবিষয়ে কিছু উল্লেখ করবার দরকার নেই। বর্তমানের অধিকাংশ এক ভাষাভাষী রাষ্ট্রই এক ইউনিট বিশিষ্ট। এই প্রবন্ধের ভূমিকায় একথাগুলি বলবার উদ্দেশ্য হল যে, এক ভাষাভাষী মানুষেরা প্রকৃতপক্ষে যে এক জাতিরই মানুষ—একথা বুঝিয়ে দেওয়া। ভাষার থেকে দৃঢ়তর সামাজিক বন্ধন অন্য কিছুই নেই।
সুতরাং বর্তমানের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বাংলা ভাষার দান বললে ভুল কিছুই বলা হয় না। অতীতে যেসব তরুণ যুবক নিজের জীবন দিয়ে বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত করবার হীন যড়যন্ত্রকে বানচাল করে দিয়েছিলেন, পরবর্তীসময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মূলে তাঁরাই ছিলেন। সুতরাং বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করবার পরে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটি একটি অতিরিক্ত মর্যাদায় মহিমান্বিত হয়েছিল এবং আজও মহিমান্বিত রয়েছে। বস্তুতঃ একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু ভাষার সংগ্রামে শহীদদের স্মৃতি তর্পণ দিবস নয়; একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে যাঁরা স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের বিদেহী আত্মার প্রতি সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা নিবেদন করবারও পবিত্র দিবস।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য যাঁরা তখন জীবনপণ সংগ্রাম করেছিলেন, তাঁরা কি আদৌ জানতেন যে এই ভাষার সংগ্রাম প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠারও সংগ্রাম ছিল? এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর হল না। আসলে ইতিহাসে এমন বহু ঘটনা ঘটে যেটার ফলশ্রুতি বহুকাল পরে দেখতে পাওয়া যায়। তবে জ্ঞানী ব্যক্তিরা হয়ত এসব ঘটনার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য তখনই উপলব্ধি করতে পারেন। অতীত ইতিহাসও এব্যাপারে ইঙ্গিত দেয়। একইরকমভাবে ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা সংগ্রামের তাৎপর্যও হয়ত অনেকেই তখন উপলব্ধি করে থাকবেন, কিন্তু নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় তাঁরা মুখ খুলে এবিষয়ে কিছু বলেন নি। একইসাথে একথাও সত্যি যে, তখন যাঁরা এই ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যাঁরা এই সংগ্রামে শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের সকলে না হলেও অধিকাংশই কিন্তু মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন এবং এর আগে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যে বাঙালি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল না, সেই সংগ্রামের পঁচিশ বছর অতিবাহিত হওয়ার আগেই দ্বিতীয়বার মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার আবশ্যকতা এবং ফলশ্রুতিরূপে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা—একথার অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণ। মানুষমাত্রেরই ভুল হয়, এবং তরুণ মন অপেক্ষাকৃত ভাবপ্রবণ। সুতরাং তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করাটা কোন কৌশলী কুটনীতিকের পক্ষে কখনোই খুব কঠিন কোন কাজ নয়। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করবার কলাকৌশল খুব ভালোভাবেই জানতেন। বস্তুতঃ রাজনীতিতে চমকপ্রদ সাফল্য প্রধানতঃ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত ও সম্মোহিত করবার ওপরেই নির্ভরশীল। সুতরাং জিন্নাহ এবিষয়ে একা দোষী ছিলেন না। এমনকি যাঁরা তখন তাঁর দ্বারা বিভ্রান্ত ও সম্মোহিত হযেছিলেন, তাঁদেরও এবিষয়ে দোষ দেওয়া চলে না। ভুল হয় বলেই ভুলের সংশোধনও হয়। কিন্তু ভুল যত বড় হয়, সেটার সংশোধন করতে গিয়ে তত বড় ও বেশি খেসারতও দিতে হয়। ১৯৪৮ সালের প্রথমদিকে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করবার সংকল্প ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাহর প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যক্ত হয়ে পড়েছিল। তখন যাঁরা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁরা জিন্নাহর এহেন ঘোষণার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তাঁকে সোচ্চার না ধ্বনি দ্বারা বিদায় দিয়েছিলেন। ভাষার বিতর্ক সেদিন থেকেই প্রকাশ্যে শুরু হয়েছিল। কিন্তু এর আগেই নানা সূত্রে জিন্নাহ এবং তাঁর পারিষদবর্গের গোপন উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেকে জ্ঞাত হয়েছিলেন বা অনুমান করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের সম্মতি নেওয়া তো দূরের কথা, জিন্নাহর বংশবদ চেলাদের সংখ্যাধিক্যপূর্ণ পাকিস্তানী গণপরিষদের আনুষ্ঠানিক সম্মতি পর্যন্ত না নিয়ে সংখ্যালঘিষ্ঠ অঞ্চলের একটি মৎস্য বন্দরে রাজধানী স্থাপনের ঘটনাও তখনকার বুদ্ধিমান এবং দেশপ্রেমিক তরুণ বাঙালি ছাত্রদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। আর তাই তখন ভাষার বিষয়ে জিন্নাহকে না ধ্বনি দ্বারা বিরূপ অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের ঘটনাকে ভাবাবেগপ্রসূত একটি আকস্মিক ঘটনা বললে ভুল বলা হবে। বস্তুত এর নেপথ্যে তখন উপকরণ জমছিল এবং প্রস্তুতিও চলছিল। সেসবের কিছু কিছু বিবরণ বর্তমানে প্রকাশিত হয়েছে, এবং কালে হয়ত আরো প্রকাশ পাবে। তাই এখানে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, ভাষা সংগ্রামের সুদূর প্রসারী ভূমিকা যে কি হতে পারে—এবিষয়ে সংগ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে অন্ততঃ কিছু লোকের মোটামুটি ধারণা ছিল; কেননা জাতীয় জীবনে ভাষার অপরিসীম গুরুত্ব সম্বন্ধে তাঁরা অবগত ছিলেন। এবং তাঁরা দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস-সহ সাহিত্যও পাঠ করেছিলেন। তাঁদের সম্মুখে দৃষ্টান্তও ছিল। ইতিহাস বলে যে, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের প্রথম কাজই হল অধিকৃত দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির বিলোপ সাধন। একাজে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হলে অধিকৃত দেশের মানুষ জাতীয় চেতনাহীন হয়ে পড়েন। তাঁরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ভুলে যান, আর দাসত্বও তাঁদের কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত দিলে হয়ত বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে। যদিও পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শ্রমিক সমাজ শিল্পপতিদের কাছে দাসতুল্য, কিন্তু তবুও এক ভাষাভাষী এবং একই ভৌগোলিক পরিবেশে বসবাসকারী হওয়ার জন্য তাঁরা নিজেদেরকে দাস বলে মনে করেন না। যেমন—অতীতের ভারতবর্ষীয় এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান সমাজ খাঁটি ইংরেজের কাছে দেশীয়দের থেকেও বেশি ঘৃণ্য ছিল, কিন্তু এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান সমাজ মনে করত যে তাঁরাও রাজার জাত। বিপক্ষ অর্থাৎ পাকিস্তানী শাসকেরাও ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য ঠিকই বুঝেছিলেন। ইংরেজ সরকারের কাজগুলো তখন তাঁদের সম্মুখে ছিল। সাম্রাজ্যবাদী সরকারের ঔপনিবেশিক নীতি তাঁদের কাছে অপরিজ্ঞাত ছিল না। ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষাকে সরকারি ভাষারূপে প্রবর্তন করবার ফলেই একটাসময়ে এদেশে যে ইঙ্গ-ভারতীয় সমাজ গড়ে উঠেছিল, তাঁরাই প্রায় দেড়শো বছর ধরে ইংরেজ শাসনের স্তম্ভরূপে কাজ করেছিল। অতীতের একসময়ে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে বৃটিশ শাসনের সুফল সম্বন্ধে বড় বড় নিবন্ধ থাকত। এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মনোনীত ইতিহাস গ্রন্থেও বৃটিশ শাসনের সুফল এবং ইংরেজি ভাষার মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে আলাদা অধ্যায় থাকত। এগুলো কিন্তু সেকালের ইংরেজ লেখকরা লিখতেন না, বরং ডক্টরেট ডিগ্রিধারী এদেশীয় বড় বড় পণ্ডিতেরাই তখন এসব গ্রন্থ রচনা করতেন। এখনও যে সেসব গ্রন্থ আদৌ পঠিত হয় না—এমন কিন্তু নয়। বাস্তবে ইংরেজি ভাষাকে চাপিয়ে দিয়ে এবং এদেশের কিছুসংখ্যক মানুষকে উচ্চশিক্ষার নামে বিলেতে চালান করে দিয়ে তাঁদের মন থেকে দেশীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার সমস্ত ছাপ ধুয়ে মুছে ফেলবার যে যুগপৎ অভিযান ইংরেজরা এদেশে তাঁদের রাজত্ব স্বাপনের প্রথম থেকেই শুরু করেছিলেন, সেটার যথেষ্ট সুফল তাঁরা পেয়েছিলেন। এবং এর কিছু কিছু কুফল এখনও পর্যন্ত অবশিষ্ট রয়েছে। আজও ইউরোপ-আমেরিকা ফেরৎ দেশীয় প্রশাসক এবং বিশেষজ্ঞরা দেশের সাধারণ সমাজ-জীবনের সঙ্গে সংশ্রবহীন হয়ে থাকেন, এবং তাঁরা বাঙালি হয়েও নিজেকে যেন ভিন্ন জাতের মানুষ বলে মনে করেন। আসলে সব শাসনেরই কিছু না কিছু সুফল ও কুফল থাকে। সেইমত বিদেশী শাসনের সবকিছুকে আবার বিয়োগ চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা যেতে পারে না। তবে বিদেশী শাসনের সবথেকে মারাত্মক অভিশাপ হল, পরাধীন জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির বিলুপ্তি বা আংশিক বিলুপ্তি। ইতিহাস বলে যে, অতীতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইউরোপীয় শাসনাধীনে না এসে এবং ইউরোপীয় ভাষা গ্রহণ না করেও একাধিক জাতি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করেছিল এবং শিল্প-বিপ্লব ঘটিয়েছিল। ভারতবর্ষ একটি আস্ত উপমহাদেশ। এখানকার সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং বিভিন্ন ভাষা প্রাচীনতার ন্যায্য দাবি রাখে। এদেশে ইংরেজদের প্রথম প্রবেশকালীন ইউরোপীয় সভ্যতা সংস্কৃতি ও ভাষার থেকে তৎকালীন ভারতবর্ষীয় সভ্যতা সংস্কৃতি ও ভাষা যে উন্নততর ছিল, একথা বললে খুব সম্ভবতঃ ভুল কিছু বলা হবে না। বাংলার অতিরিক্ত সৌভাগ্য হল যে, ইউরোপীয়দের প্রবেশের পরেও এখানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এবং কাজী নজরুল ইসলামের মত প্রতিভাবান এবং দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে ভাষা ও সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি ও উন্নতি সাধন করেছিলেন। তাই সংকর ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও বাঙালির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি হরণ করা ইংরেজদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বস্তুতঃ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা বাংলাতে পরাজিত হয়েছিলেন। একইসাথে একথা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, এই বাংলাতেই একসময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। এদেশে ইংরেজদের প্রতিষ্ঠালাভের কারণ যেমন ছলে বলে কৌশলে ভারতবর্ষীয় ভাষা ও সংস্কতির উন্নয়ন রোধ এবং সে দুর্বলতার সুযোগে বিজাতীয় ভাব, ভাষা ও সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ছিল, তেমনি এদেশ থেকে ইংরেজ বিতাড়নের মূলেও আবার দেশীয় ভাষা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির পুনর্বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা ছিল।
তবে এদিক থেকে ইরানের ইতিহাস ভারতবর্ষের ইতিহাসের থেকেও বেশি চমকপ্রদ। অতীতের একটাসময়ে আরব জাতি ইরান জয় করে সেখানে সর্বত্র আরবি ভাষা প্রবর্তনের চেষ্টাও করেছিল। তাঁরা আরবিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভাষা বলেও ঘোষণা করেছিলেন। ইরানের মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেও ইরানের আত্মাকে জয় করা আরবদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরিণামে ফারসি ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি ইরানকে জয়ী করেছিল এবং আরব সভ্যতার উপরে ইরানী সভ্যতা নিজের স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিল। ফিরদৌসী মুসলমান হয়েও প্রাচীন ইরানের বীরত্বগাথা গেয়ে ইরানী জাতীয়তাকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। অবশেষে ইরান আরব অধিকার থেকে মুক্তিলাভও করেছিল। এই ইতিহাসও আলোচ্য সময়ের বাঙালি তরুণ সমাজের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। আর পাকিস্তানী শাসকশ্রেণীর কাছেও অবশ্যই জ্ঞাত ছিল। কিন্তু তবু তাঁদের আশা ছিল যে, বাঙালি মুসলমানের অনগ্রসরতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা হয়ত দেশটাকে বোবা বানাতে, অর্থাৎ—এখানকার ভাব ভাষা এবং সংস্কৃতিকে হরণ করতে পারবেন। এবিষয়ে তাঁদের কাছে তখন একটি অতিরিক্ত সুযোগও ছিল। তখনকার বাংলাদেশে ইসলাম প্রধানতঃ উর্দুভাষী মধ্যভারতীয় আলেমদের দ্বারা প্রচারিত হত। ওয়াহাবী আন্দোলনের উৎসও ছিল মধ্যভারত। বাদশাহী আমলের নিদর্শনসমূহও ছিল মধ্য ও পশ্চিম-ভারতে। কোরান কেতাবও তখন ঐ অঞ্চল থেকেই ছাপা হয়ে আসত। এমনকি মসলা-মাসায়েল সম্পর্কিত ধর্মীয় গ্রন্থাদিও তখন উর্দু ভাষাতেই প্রকাশিত হত। এসব কারণে পশ্চিমা মুসলমানের প্রতি, আরো সংক্ষেপে বললে—নিছক পশ্চিম দিকটির প্রতি তৎকালীন বাঙালি মুসলমানের বিশেষ দুর্বলতা ছিল। তবে এই পশ্চিম প্রীতি তখন শুধু সাধারণ অশিক্ষিত মুসলমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে এ দুর্বলতা অধিক পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, বিংশ শতাব্দীর বিশ তিরিশের দশকেও বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা উর্দু’ না বাংলা—এমন অদ্ভুত প্রশ্ন রীতিমতো আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। তৎকালীন ফরিদপুর জেলার এক গণ্ড গ্রামের সন্তান নবাব আবদুল লতিফ বাঙালি মুসলিম সমাজকে শরিফ এবং সাধারণ—এই দুটি জাতিতে বিভক্ত করেছিলেন। তিনি হান্টার শিক্ষা কমিশনকে জানিয়েছিলেন যে, শরিফ জাতির মাতৃভাষা হল উর্দু এবং সাধারণ জাতির মাতৃভাষা হল বাংলা। এশ্রেণীর লোকেরাই তখন বাঙালি মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রকৃত বাঙালি নেতৃত্ব বহু দেরিতে, অর্থাৎ—পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। ফজলুল হকের মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের পক্ষে জিন্নাহ ও লিয়াকত আলীর নেতৃত্বকে মেনে নেওয়ার কোন সংগত কারণ ছিল না। কিন্তু পশ্চিমের প্রতি দুর্বলতাই হয়ত তাঁর জীবনের সবথেকে মারাত্মক ভুলের কারণ হয়েছিল। বলাই বাহুল্য যে, তাঁর এই ভুলের খেসারত শুধু তিনি নিজে দেননি, সমগ্র বাঙালি জাতিকেও দিতে হয়েছিল।
তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী বাঙালি মুসলমানের এই পশ্চিম প্রীতির সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন বলেও হয়ত ভরসা করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম তথা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শক্তি সম্বন্ধে সম্যকভাবে অবগত ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম সেকালের বাঙালি মুসলিম তরুণ সমাজের মনে স্বাজাত্যবোধের যে বীজ বপন করে দিয়েছিলেন, সেটা ইতিমধ্যে শাখা প্রশাখায় পল্লবিত ও দৃঢ়মূল হয়ে গিয়েছিল। এরফলে সমকালীন তরুণ ছাত্রসমাজ পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী বাংলাদেশকে চিরকালের জন্য নিজেদের কলোনী বানাতে চান। এবং চিরকালের জন্যে কলোনী বানাবার উদ্দেশ্যেই তাঁরা বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির উপরে আঘাত হানতে বধ্যপরিকর। বিতাড়িত বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং পাকিস্তানী শাসনের মধ্যে যে কোন ধরণের গুণগত পার্থক্য নেই, বরং বৃটিশ শাসনের থেকেও পাকিস্তানী শাসন জাতির জন্য অধিক অনিষ্টকর— একথাও তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, গাত্রবর্ণের পার্থক্যের জন্য ইংরেজরা কখনও ভারতীয় হতে পারেন নি, অন্যদিকে অভিন্ন গাত্রবর্ণ এবং অভিন্ন ধর্ম পাকিস্তানী শাসকদের হীন উদ্দেশ্যে সিদ্ধির সহায়ক হয়েছিল এবং তাঁরা এসুযোগের সদ্ব্যবহারও করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সামগ্রিক ইতিহাস নিয়ে বর্তমানে সকলেই অবগত রয়েছেন বলে এখানে এবিষয়ে বিস্তারিত কিছু লেখবার প্রয়োজন নেই। একইসাথে ইতিহাস এই সাক্ষ্যও দেয় যে, স্বাধীনতার আগে এবং পরে বাংলাদেশের উপর দিয়ে শত ঝড় বয়ে গেলেও ভাষা দিবস উদযাপন কিন্তু কখনো স্তব্ধ হয়ে যায়নি। বরং তখন প্রতিটি পরের বছর প্রতিটি আগের বছরের থেকেও অধিক নিষ্ঠা এবং আনুগত্যের সাথেই এই দিনটি তখন পালিত হয়েছে। আর ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান তো ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। আসলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সফলভাবে এই পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল যে, বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষের চেতনায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধের বীজ উপ্ত ছিল, এবং সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে শাখা-প্রশাখা ও পল্লবে বিস্তার লাভ করবার ফলেই ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে বাংলাদেশের মানুষেরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছিলেন। তবে সেই বিজয়ের বীজ কিন্তু ১৯৪৮ সালেই রোপিত হয়ে গিয়েছিল এবং ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে সালাম বরকত প্রমুখ তরুণদের পূত পবিত্র রক্তে সিঞ্চিত হয়ে প্রথম অঙ্কুরিত হয়েছিল।#