ফ্রিদা কাহলো (Frida Kahlo) ছিলেন ২০শ শতকের অন্যতম বিশিষ্ট একজন চিত্রশিল্পী, যিনি তার ব্যতিক্রমী শিল্পশৈলীতে বেদনাবোধ এবং আত্ম-অনুভূতির মধ্য দিয়ে চিত্রকলাকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন। ১৯০৭ সালের ৬ জুলাই মেক্সিকোর কায়োকান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ফ্রিদার জীবন ছিল সংগ্রামের, যন্ত্রণার এবং একই সঙ্গে ছিল আত্মপ্রকাশ করার অসীম সাহস ও শিল্পের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় পূর্ণ।
ফ্রিদার শৈশব খুব স্বাভাবিক ছিল না। অল্প বয়সেই তিনি পোলিওতে আক্রান্ত হন। তবে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসে ১৮ বছর বয়সে, একটি সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হন। কাহলোর পাঁজর, পা এবং ঘাড়ের উভয়পাশের হাড় ভেঙে যায় এবং আজীবনের জন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে কাটানোর সময়েই ফ্রিদা মূলত নিজের শিল্পী প্রতিভাকে প্রকাশ করতে শুরু করেন।

ফ্রিদার শিল্পকর্মে তার জীবনের যন্ত্রণা, দেহগত দুর্বলতা, ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং নারীত্বের অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে। তার অধিকাংশ চিত্রই আত্মপ্রতিকৃতি, যেগুলোর মাধ্যমে তিনি নিজের ভেতরের কষ্ট, দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলতেন, “আমি নিজেকে আঁকি কারণ আমি নিজেকে সবচেয়ে ভালো জানি।”
তার চিত্রে মেক্সিকান লোকশিল্প, প্রতীক, রং এবং সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। তার অনেক ছবিতে ফুল, প্রাণী, রক্ত, কান্না কিংবা অস্তিত্বগত প্রশ্নবোধকতা রয়েছে। ফ্রিদার শিল্পধারা ছিল একধরনের “সুররিয়ালিজম”, যদিও তিনি নিজেকে কখনও সেই ধারায় ফেলতে চাননি।
ফ্রিদার ব্যক্তিগত জীবন ছিল নানা দ্বন্দ্ব ও সংবেদনশীলতার ছায়ায় ঘেরা এক অধ্যায়। তিনি বিয়ে করেছিলেন খ্যাতিমান মেক্সিকান চিত্রশিল্পী দিয়েগো রিভেরাকে। তাদের দাম্পত্য ছিল ভালোবাসা, সংঘর্ষ ও পুনর্মিলনের দোলাচলে ভরপুর। দিয়েগোর সঙ্গে তার সম্পর্ক যেমন তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, তেমনি তার ছবির বিষয়বস্তুকেও আচ্ছন্ন করেছিল।

নারীবাদী তত্ত্ব অনুসারে শিল্প কেবল সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি নয়, বরং এক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবাদও হতে পারে। ফ্রিদা কাহলো সেই বিরল শিল্পীদের একজন, যিনি নারীর অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম, শরীরের ভাষা, যৌনতা এবং আত্মপরিচয়কে শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তাঁর চিত্রকর্ম ও জীবনচর্চা নারীবাদী দৃষ্টিকোণে অনুধাবন করলে, বোঝা যায় তিনি কেবল শিল্পী নন, বরং এক দর্শনের নাম।
সিমোন দ্য বোভোয়ার (Simone de Beauvoir) তার বিখ্যাত বই The Second Sex-এ লিখেছিলেন, “One is not born, but rather becomes, a woman.” নারীর পরিচয় তৈরি হয় সমাজ, সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। ফ্রিদা কাহলো নিজেকে সমাজনির্ধারিত সৌন্দর্য বা লিঙ্গ-আচরণের ছকে বাঁধেন নি, বরং তিনি তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিগুলোর মাধ্যমে নারী হিসেবে নিজেকে সৃষ্টি করেছেন।
জুডিথ বাটলার (Judith Butler) আবার লিঙ্গ পরিচয়কে দেখেছেন একটি ‘পারফরমেটিভ’ প্রক্রিয়া হিসেবে- অর্থাৎ, লিঙ্গ কেবল শারীরিক নয়, সামাজিকভাবে গঠিত। ফ্রিদা তার দেহ ও পরিচয় নিয়ে যেভাবে শিল্প নির্মাণ করেছেন, তা এই ধারণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।
ফ্রিদার আঁকা ৫৫টিরও বেশি আত্মপ্রতিকৃতি- নারীর শরীর, মানসিক অবস্থা ও সামাজিক চাপের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম “The Broken Column” (১৯৪৪)-এ তিনি নিজেকে একটি খোলা দেহের রূপে চিত্রিত করেছেন, যেখানে ভাঙা মেরুদণ্ড লোহার স্তম্ভে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এতে তার শারীরিক যন্ত্রণার সঙ্গে এক নারীর অস্তিত্বগত দুর্বলতাকেও প্রকাশ পেয়েছে। তার বুকের ভেতর লোহার পিলার বসানো, সারা শরীরে পেরেক বিদ্ধ- এই চিত্রটি নারীশরীরকে শক্তির ও যন্ত্রণার এক দ্বৈত প্রকাশ বলা যায়।

আরেকটি বিখ্যাত চিত্র “Henry Ford Hospital” (১৯৩২)-এ তিনি গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা, রক্তাপাত, মাতৃত্বের কষ্ট ও হেরে যাওয়া মাতৃত্বের অনুভূতিকে চিত্রিত করেন। এ চিত্রে, বিছানায় শুয়ে থাকা নগ্ন ফ্রিদার চারপাশে ছয়টি জিনিস ঝুলছে- ভ্রূণ, ফুল, পেটের অংশ, হাড়, যোনির প্রতীক- যা এক নারীর মাতৃত্বহীনতার বেদনাকে প্রকাশ করে।
ফ্রিদার অনেক শিল্পে তার উভলিঙ্গতাকে প্রতিফলিত করেছেন। চিত্রকর্ম “Self-Portrait with Cropped Hair” (১৯৪০)-এ তিনি চুল কেটে শার্ট-প্যান্ট পরে পুরুষের রূপ ধারণ করেছেন। “Look, if I loved you, it was because of your hair. Now that you are without it, I no longer love you.”- এই পঙ্ক্তিটি একটি প্রখ্যাত মেক্সিকান লোকগানের অংশ, যা ফ্রিদা কাহলো ১৯৪০ সালে তাঁর ‘Self-Portrait with Cropped Hair’ চিত্রকর্মটি ও এই গানের কথা একসঙ্গে মিলিয়ে হৃদয়ভঙ্গ, আত্মনির্ভরতা এবং নারীর ঐতিহ্যগত সৌন্দর্য ধারণার প্রতি প্রত্যাখ্যানের থিম প্রকাশ করে, বিশেষ করে দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে কাহলোর বিবাহবিচ্ছেদের প্রেক্ষাপটে। এই ছবির মাধ্যমে ফ্রিদা নারীর চুল ও সৌন্দর্য নিয়ে সমাজের প্রচলিত সংস্কার ভেঙে দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন- শুধুমাত্র বাহ্যিক রূপে নয়, নারীকে নারী করে তোলে তার চিন্তা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।
ফ্রিদা কাহলো তাঁর চিত্রে মেক্সিকোর লোকশিল্প, ঐতিহ্য ও প্রতীক ব্যবহার করেছেন। “The Two Fridas” (১৯৩৯) চিত্রে দেখা যায় দুই ফ্রিদা- একজন পশ্চিমা পোশাকে, অপরজন মেক্সিকান পোশাকে। এই ছবিটি যেন মেক্সিকান নারীর দ্বৈত অস্তিত্বের চিত্র: একদিকে ঐতিহ্য, আরেকদিকে আধুনিকতা ও ভাঙন। দুই নারীর হাতে ধরা আছে একে অপরের ধমনী, যা রক্ত দিয়ে যুক্ত- এ যেন এক নারীর ভেতরের আত্মসংঘাত ও সম্পর্কচ্যুতির প্রতিচ্ছবি।

ফ্রিদা কাহলোর রাজনৈতিক জীবন তার শিল্প ও ব্যক্তিজীবনের মতোই গভীর ও বহুমাত্রিক। তিনি ১৯২৭ সালে মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে দেশের নিম্নবর্গের মানুষের অধিকার ও মুক্তির কথা ভাবতে শুরু করেন। তিনি বলেছিলেন, “I paint my own reality. The only thing I know is that I paint because I need to, and I paint whatever passes through my head without any other consideration.” (Kahlo, as quoted in Herrera)
তার ছবিতে মার্ক্সবাদী চেতনার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় যেমন “Marxism Will Give Health to the Sick” (১৯৫৪) চিত্রে, যেখানে ফ্রিদা মার্ক্সকে নিজের মুক্তিদাতা হিসেবে উপস্থাপন করেন। মৃত্যুর এক বছর আগে, কাহলো লিখেছিলেন, “I am more and more convinced it is only through Marxism that we can save this world.” (A Biography of Frida Kahlo: Herrera)
১৯৩৭ সালে ফ্রিদা ও দিয়েগো তাদের বাড়িতে সোভিয়েত বিপ্লবী লিওন ট্রটস্কিকে (Leon Trotsky) আশ্রয় দেন, যিনি সেসময়ে স্তালিনের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে নির্বাসিত হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও তিনি হুইলচেয়ারে বসে মেক্সিকো সিটিতে এক মার্ক্সবাদী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন, যেখানে তার হাতে ছিল, “Paz, Pan y Tierra” (Peace, Bread and Land)- এই বার্তা-সংবলিত একটি পতাকা। তার কাছে রাজনীতি ছিল ব্যক্তিগত জীবনে শিল্পচর্চার এক গভীর অনুষঙ্গ।

ফ্রিদা কাহলো নারীবাদী শিল্পচর্চার এক অপরিহার্য নাম। তাঁর চিত্রকর্মগুলি নারীর ব্যক্তিগত যন্ত্রণাকে রাজনৈতিক ভাষায় পরিণত করেছে। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, নারীর শরীর, আবেগ, ভালোবাসা, হ্রাস কিংবা যন্ত্রণা কোনোভাবেই গোপন নয়, বরং শিল্প ও প্রতিবাদের মাধ্যম হতে পারে।
আজকের বিশ্বে, যখন নারীরা এখনও তাদের অভিজ্ঞতা ও শরীর নিয়ে কথা বলার জন্য লড়াই করে চলেছে, তখন ফ্রিদার জীবন ও শিল্প নারীর শক্তি, প্রতিবাদ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অনন্ত অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।#