ঐকমত্য কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রস্তাব দিয়েছে যে অধ্যাদেশ নয় সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমেই গণভোট আয়োজন করা হোক। তাদের মতে এতে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক স্থায়িত্ব আসবে। একই সঙ্গে প্রস্তাব এসেছে ব্যালটে দুটি প্রশ্ন রাখার একটি ঐকমত্য থাকা সংস্কার নিয়ে আরেকটি নোট অব ডিসেন্ট থাকা প্রস্তাব নিয়ে। প্রথম দেখায় এটি ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরে গেলে দেখা যায় এই প্রস্তাব গণতান্ত্রিক ঐকমত্যের পরিবর্তে নতুন বিভ্রান্তি ও আইনি অনিশ্চয়তার জন্ম দিতে পারে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে আদৌ সাংবিধানিক আদেশ জারির ক্ষমতা আছে কি না! সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে সরকারকে অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা দেওয়া হলেও সাংবিধানিক আদেশের সুযোগ নেই। এই সীমা অতিক্রম করা মানে হবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো অমান্য করা। বিএনপি ও অন্যান্য দল বলছে সাংবিধানিক আদেশ জারির ক্ষমতা নির্বাচিত সংসদের হাতে থাকা উচিত। এই অবস্থান অগ্রাহ্য করা হলে পুরো প্রক্রিয়া শুরুতেই বৈধতা হারাবে। গণতান্ত্রিক সংস্কারের নামে যদি সংবিধানই প্রশ্নবিদ্ধ হয় তবে সেটি সংস্কার নয় বরং আরেকটি সাংবিধানিক বিপর্যয়।
বিশেষজ্ঞ প্যানেল ব্যালটে দুটি প্রশ্ন রাখার যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটিও বাস্তবে জটিলতা তৈরি করতে পারে। সাধারণ ভোটার কি জানবেন কোন সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে আর কোনটিতে আপত্তি আছে। সংবিধান সংশোধনের মতো জটিল বিষয়ে জনগণকে হ্যাঁ বা না এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নয়। এতে জনমত পরিমাপের পরিবর্তে তৈরি হবে রাজনৈতিক ব্যাখ্যার সুযোগ। ভোটের ফলাফল যেভাবেই আসুক প্রতিটি দল সেটিকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করবে। এতে গণভোটের অর্থ দাঁড়াবে— জনমত নয়, বরং রাজনৈতিক অবস্থান বৈধ করার একটি কৌশল।
বিএনপি বলছে নোট অব ডিসেন্ট জুলাই সনদের অংশ জনগণ অনুমোদন দিলেও আপত্তি টিকে থাকবে। কমিশন বলছে জনগণ অনুমোদন দিলে আপত্তি টিকবে না। এই দুইয়ের অবস্থান পরস্পরের বিপরীত। অর্থাৎ গণভোটের আগেই ঐকমত্যের ভিত্তি নড়ে গেছে। ঐকমত্য কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে তোলা কিন্তু এখন সেটি যেন নিজেই রাজনৈতিক সালিশির মঞ্চে পরিণত হচ্ছে যেখানে জনগণ ভোট দেবে কিন্তু সিদ্ধান্তের মালিকানা থাকবে রাজনৈতিক দলের হাতে।
গণভোট যদি গণতন্ত্রের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়, তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ নিরপেক্ষ ও বৈধ প্রক্রিয়ায়। কিন্তু বর্তমান প্রস্তাব সেই স্বচ্ছতার পরিবর্তে আইনি অস্পষ্টতা ও রাজনৈতিক অনাস্থা বাড়াচ্ছে। প্রশ্ন একটাই এই গণভোট জনগণের রায় যাচাই করবে নাকি রাজনৈতিক কৌশলের বৈধতা দেবে। যদি লক্ষ্য হয় সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ঐকমত্য তবে আগে দরকার পরিষ্কার সংবিধানিক ভিত্তি ও সর্বদলীয় সমঝোতা। তা না হলে এই গণভোট ইতিহাসে জায়গা পাবে গণতন্ত্রের নয় বরং রাজনৈতিক কৌশলের ফাঁদ হিসেবে।#