উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হ্যান্ডমাইকে বিপন্ন কূটনীতি!

উসকানিমূলক বক্তব্য ও উগ্রপন্থী তরুণ নেতারা বাংলাদেশের কূটনীতি অস্থিতিশীল করছে!

রাষ্ট্রের কূটনীতি কোনো মিছিলের স্লোগানে চলে না, আর প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারিত হয় না উঠান বৈঠকের উত্তেজনায়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখলে মনে হয়, বাংলাদেশে এখন মাইকের সামনে দাঁড়ালেই যে কেউ রাষ্ট্রীয় পররাষ্ট্রনীতির মুখপাত্র হয়ে উঠতে পারে, আবার দায় নেওয়ার বেলায় সবাই হাত গুটিয়ে নেয়।

১৫ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য ছিল অশালীন এবং কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিপজ্জনক। ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ বিচ্ছিন্ন করার হুমকি কিংবা ‘ভারতীয় হাইকমিশনারকে লাথি দিয়ে বের করে দেওয়া’র মতো মন্তব্য কোনটিই রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এরপর ‘জুলাই ঐক্য’ ব্যানারে হাইকমিশন ঘেরাও, ডাকসু নেতার ইট খুলে নেওয়ার হুমকি, সব মিলিয়ে একটি স্পষ্ট বার্তা গেছে দিল্লিতে: বাংলাদেশে এখন ভারত-বিরোধী বক্তব্য নিয়ন্ত্রণে কেউ নেই।

ভারত যে এটাকে হালকাভাবে নেবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করা হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটেই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন, “হাসনাত সরকারের অংশ নন।” প্রশ্ন হলো, সমস্যা কি শুধু তিনি সরকারে নেই, নাকি সমস্যা হলো যে যা বলছে তা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না?

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যক্তি আর রাষ্ট্রের মাঝে এই বিভাজন কার্যকর হয় না। একটি দেশে বারবার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হলে সেটি রাষ্ট্রীয় পরিবেশের প্রতিফলন হিসেবেই দেখা হয়। দায় এড়ানোর কৌশল বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করছে।

কুমিল্লায় উঠান বৈঠকে বক্তব্য দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত

এখানে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া যায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের “সেভেন সিস্টার্স” সংক্রান্ত মন্তব্য প্রথমে আসে ৬ আগস্ট ২০২৪-এ, যখন তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “If you destabilise Bangladesh, it will spill over… including Myanmar and seven sisters”, অর্থাৎ বাংলাদেশের অস্থিতিশীলতার প্রভাব ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন এটি তুলনামূলকভাবে সতর্কতামূলক বক্তব্য হলেও, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে চীন সফরে তার বক্তব্য কূটনৈতিক সীমা অতিক্রম করে। তিনি সেখানে বলেন, “The Seven Sisters are landlocked… we are the only guardian of the ocean… this could be an extension of the Chinese economy.” একজন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মুখে এমন ভাষা শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়, ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক সংবেদনশীলতা উপেক্ষা করার সমান।

দুটি বক্তব্য মিলিয়ে ধারাবাহিকভাবে স্পষ্ট যে প্রথমে আঞ্চলিক অস্থিরতার ইঙ্গিত, পরে সরাসরি ভূরাজনৈতিক সুবিধা তুলে ধরা। এই প্রবণতা পরবর্তীতে বাংলাদেশের তরুণ রাজনৈতিক নেতাদের দায়বদ্ধতা ছাড়া ভারত-বিরোধী বক্তব্যকে পরোক্ষভাবে বৈধতা দিয়েছে। ফলে কূটনীতি হারিয়ে গেছে।

ভারতের হাইকমিশনের ইট খুলে নেওয়ার হুঁশিয়ারি ডাকসু নেতা মোসাদ্দেক আলী। ছবি: সংগৃহীত।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, তরুণ রাজনৈতিক মুখগুলোকে এখন বাফার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা উসকানিমূলক কথা বলছে, পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছে, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে, আর মূল নেতৃত্ব নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলছে, “ওরা আমাদের কেউ না।” কিন্তু ক্ষতি যখন হয়, সেটা ব্যক্তির নয়, রাষ্ট্রের হয়।

এই দায়িত্বজ্ঞানহীন, উসকানিমূলক বক্তব্যের ফল ভোগ করতে হবে সাধারণ মানুষকে: সীমান্তে অশান্তি, বাণিজ্যে ঝুঁকি, ভিসা ও কূটনৈতিক যোগাযোগে অস্থিতিশীলতা চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছাবে। কিন্তু এসবের দায় কোনো হাসনাত বা মোসাদ্দেক নেবে না।

রাজনীতি মানে দায়িত্বশীলতা। প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে গালি দিয়ে দেশপ্রেম প্রমাণ করা যায় না। নতুন রাজনৈতিক দলের অল্প বয়সী ছেলেরা যদি রাষ্ট্রের ওজন না বুঝে মাইক দখল করে নেয়, আর সরকার যদি তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তাহলে ক্ষতির ফল ভুগতে হবে বহু বছর ধরে।

রাষ্ট্র চালাতে স্লোগান নয়, লাগে সংযম। সংযম হারালে কূটনীতি হারায়, ঝুঁকি ও সংঘাত বাড়ে এবং সংকট জন্ম নেয়।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!