উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও বাংলা শিশুসাহিত্য

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে যাঁরা তাঁর জীবদ্দশায় প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেরই স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় যে, বিভিন্ন জায়গায় তাঁর উপস্থিতির মধ্যে এমন একটা কর্তৃত্বের ভাব থাকত যে, অন্যরা তাঁকে গুরুত্ব না দিয়ে পারতেন না। তবে এত গুরুত্ব পাওয়া সত্ত্বেও তাঁর আচরণ অবশ্য খুবই অমায়িক ছিল, এবং তিনি সহজেই অন্য কারো বন্ধু হয়ে যেতে পারতেন। তিনি দেখতে বেশ লম্বা ও সুন্দর চেহারার অধিকারী ছিলেন; তাঁর গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল আর মুখে ছিল পরিপাটি করা দাড়ি। কিন্তু নিজের অন্য চার ভাইয়ের মত তিনি কখনোই খেলাধূলায় তেমন কোন আগ্রহ দেখান নি। বরং শৈশব থেকেই অন্য ভাইদের থেকে আলাদা হয়ে মানুষ হওয়ার কারণে নিজের দাদা সারদারঞ্জনের, যিনি বাংলার ক্রিকেটের জনক হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত, তাঁর কোন প্রভাবই উপেন্দ্রকিশোরের উপরে পড়েনি। আর খুব সম্ভবতঃ একারণেই তাঁর মস্তিষ্ক সর্বদা সক্রিয় থাকলেও দৈনন্দিন জীবন কমবেশি অলসতাময় ছিল। তিনি নিজের মধ্যবয়সেই বহুমূত্র রোগের শিকার হয়েছিলেন, এবং শেষপর্যন্ত মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়স পেরোনোর পরেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই স্বল্পায়ু জীবনে তিনি তাঁর যেসব দুঃসাধ্য লক্ষ্য ছিল, সেসবের প্রায় সবগুলিই পূর্ণ করে যেতে পেরেছিলেন। আর আজও বাংলার মুদ্রণশিল্প ও শিশুসাহিত্য এসবের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে এগিয়ে চলেছে।

উপেন্দ্রকিশোরের শিশুসাহিত্যের কথা বলতে গেলে এখানে সর্বপ্রথমে যাঁর নাম অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার, তিনি হচ্ছেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার। ইনি বয়সের দিক থেকে উপেন্দ্রকিশোরের থেকে দু’বছরের ছোট হলেও শিশুসাহিত্য প্রকাশনার জগতে উপেন্দ্রকিশোরের বেশ কয়েকবছর আগেই উপস্থিত হয়েছিলেন। আর যোগীন্দ্রনাথ এবিষয়ে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন বললেই সবথেকে ভালো কথা বলা হয়। বস্তুতঃ শিশুদের জন্য বই-ই তাঁর জীবন ছিল। আর একারণেই যদিও নিজের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, কিন্তু তবুও এর বাইরে তিনি তাঁর সমস্ত সময় ও যা কিছু সঞ্চয়—সবই বই প্রকাশনার জন্যই ব্যয় করতেন। এসময়ে ছোট হলেও তিনি ‘সিটি বুক সোসাইটি’ নামে নিজের একটা প্রকাশনী খুলেছিলেন। আর এখান থেকেই বাংলা শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘হাসি ও খেলা’ প্রথম ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এসময়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই বইটিকে ভারতে শিশুগ্রন্থের নতুন যুগের অগ্রদূত বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এর আগে শিশুদের জন্য বই বলতে তথ্যমূলক ও নীতিকথার বইগুলিকেই বোঝানো হত, যেগুলি খুব একটা মৌলিক কিছু ছিল না, এবং এগুলি মূলতঃ পাঠ্যবই হিসেবেই লেখা হত। কিন্তু যোগীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত বইটি এক্ষেত্রে একেবারে অন্যরকমের ছিল। সেযুগের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দদান ও শিক্ষামূলক কিছু খুঁজে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি মূলতঃ এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। এরফলে নতুন বাংলা শিশুসাহিত্যের প্রধান কথাটি এই বইটি থেকে প্রকাশ পেয়েছিল, সেটা হল আনন্দদানের মধ্যে দিয়ে শিক্ষা। তাছাড়া এই গ্রন্থটিই সেযুগের স্কুল পাঠ্য বই ও খেলার বইয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরির প্রথম চেষ্টাও ছিল বলা চলে।

তবে এই গ্রন্থটি ছাড়াও যোগীন্দ্রনাথ গদ্যে ও পদ্যে বেশ কিছু মৌলিক কাহিনীও রচনা করেছিলেন; তবে এসব সত্ত্বেও তিনি মূলতঃ একজন অনুপ্রাণিত সম্পাদক হিসেবেই বাংলা শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে বেশি স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। সেসময়ে তাঁকে ঘিরে একদল প্রতিভাশালী লেখকেরা ছিলেন, যাঁদের শিশুদের প্রয়োজনমত গ্রন্থ রচনা করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। তবে সেযুগে কিন্তু অনেকসময়েই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থে প্রকাশিত গল্প ও কবিতার সঙ্গে লেখকের নাম থাকত না। এমনকি এই ‘হাসি ও খেলা’ বইটিও আদতে বিভিন্ন লেখকের রচনার একটি সংকলন ছিল। এছাড়া যোগীন্দ্রনাথের ‘খুকুমনির ছড়া’ বইটিতেও পুরোনো ও নতুন অনেক অমূল্য ছড়ার সংগ্রহ পাওয়া যায়। কিন্তু ছড়ার মধ্যে দিয়ে শিশুদের অক্ষর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বই ‘হাসিখুসি’—যোগীন্দ্রনাথের নিজের রচনা ছিল; আর এমন বই এখনো পর্যন্ত দ্বিতীয়টি লেখা হয়নি। এমনকি রবীন্দ্রনাথও এধরণের আরেকটি বই রচনা করবার কোন চেষ্টা করেননি। বরং তিনি তাঁর অসাধারণ শিশুগ্রন্থ ‘সহজ পাঠ’–এর প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের শুরুতেই স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলেন যে, শিশুরা অক্ষর পরিচয়ের পরেই এই বই পড়বে। তবে যোগীন্দ্রনাথের প্রকাশিত বইগুলির অলঙ্করণ মৌলিক কিছু ছিল না, এগুলির সাজসজ্জা সাধারণ ছিল, আর এতে থাকা ব্লকের কাজ খুব একটা সূক্ষ্ম ছিল না বলে দামও কম ছিল; কেননা, তিনি জানতেন যে, বইয়ের দাম কম থাকলেই বেশি মানুষ এগুলি কিনতে পারবেন। আসলে সেযুগের অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানের শিক্ষার জন্য বেশি অর্থ খরচ করতে রাজি হতেন না। এর থেকে তাঁরা বরং চিরস্থায়ী সম্পদ সোনার বালা কিনতেই বেশি আগ্রহ বোধ করতেন।

যাই হোক, এসব সত্ত্বেও সেযুগে যোগীন্দ্রনাথ নির্ভয়ে তাঁর প্রকাশনার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। তবে তাঁর আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্খীরা অবশ্য তাঁকে তাঁর বড়ভাই ও সেযুগের বিশিষ্ট চিকিৎসক স্যার নীলরতন সরকারের সঙ্গে তুলনা করে ছোট করতেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল যে, অলাভজনক কাজ করে যৌীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন অপচয় করছেন। লক্ষ্য করবার বিষয় হল যে, এখন কিন্তু নীলরতনের থেকে যোগীন্দ্রনাথের নাম বেশি স্মরণ করা হয়; কারণ, প্রত্যেকটি বাংলাভাষী শিশুই যোগীন্দ্রনাথের নামের সাথে পরিচিত।

বাংলায় শিশুসাহিত্যের উদ্‌দ্গাতা হিসেবে সাধারণত উপেন্দ্রকিশোর ও যোগীন্দ্রনাথের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। কিন্তু সত্যি কথা হলো, উপেন্দ্রকিশোরের মেধা, মৌলিকতা ও নানামুখী প্রতিভা যোগীন্দ্রনাথের না থাকলেও বাংলা শিশুসাহিত্যের পথ তাঁর কাছ থেকেই শুরু তাতে সন্দেহ নেই।

উপেন্দ্রকিশোরে প্রথম বই দুটি ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ যোগীন্দ্রনাথের সিটি বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এবং আগ্রহী পাঠকেরা বইদুটিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ছোটদের উপযোগী করে অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী এই বই দুটিতে বলা হয়েছে। উপেন্দ্রকিশোরের কিন্তু মন খারাপ হয়ে গেল তাঁর দারুণ দারুণ ছবি গুলির মুদ্রণ দেখে। তিনি অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন যে, যোগীন্দ্রনাথের মুদ্রক ও ব্লকমেকারদের দিয়ে এর চেয়ে ভালো করা সম্ভব নয়। তাই এরপরে তিনি তাঁর আর কোন বই অন্য প্রকাশকের কছে থেকে ছাপেননি। তিনি নিজেই সেগুলি প্রকাশ করেছিলেন। নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিলেন আর তাঁর কাজের ফলে বাংলায় মুদ্রণ ও ফটো এনগ্রেভিং-এর কাহিনীতে নতুন পরিচ্ছেদের সূচনা হয়েছিল।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!