কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। তখন তিনি অসুস্থ, বাকশক্তি রহিত। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার কয়েক মাস পর, ২৯ অগাস্ট তিনি ঢাকার পি.জি. হাসপাতালে মারা যান। নজরুলের পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার প্রতারণা করেছিল। ততদিনে শেখ মুজিব সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। জেনালের জিয়ার সামরিক সরকার গদিতে। নজরুলের মৃত্যু হলে তার ছেলেরা ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনকে অনুরোধ করেছিলেন যেন একটি বিমানের মাধ্যমে তাদের বাবার মরদেহ ভারতে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে তাদের মায়ের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে তার কবরের পাশে দাফন করা যায়। কবির পৈতৃক গ্রাম চুরুলিয়ায় তার দাফনের জন্য একটি জায়গা সংরক্ষিত ছিল। ছেলেরা ঢাকায় এসে দেখে যে, তাদের উপস্থিতি ছাড়াই পিতাকে দাফন করা হয়ে গেছে!
ইনকিলাব মঞ্চ নামের একটি উগ্রবাদী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান হাদী কয়েকদিন আগে আতাতায়ীর গুলিতে নিহত হন। তার কবর গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নজরুলের সমাধিতে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে ফেসবুকে বাংলাদেশ ও ভারতের নানারকম শ্রেণী-পেশার মানুষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে ঢাকায় নজরুলের কবর যেভাবে রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে আগামীতে নজরুলের কবরের ওপর হুমকি আসতে পারে। আবার কেউ মনে করেন যে নজরুলের কবর তার নামের সঙ্গে যে ইসলাম আছে সে কারণেই হয়তো সুরক্ষিত থাকবে। বর্তমানে উড়িষ্যায় বসবাসরত তুষার সেনগুপ্ত বাংলাদেশে সাস্প্রতিককালে ‘তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠীর আক্রমণের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন:”আমার সেই আশা নেই। ওরা অসংখ্য মাজার পুড়িয়েছে, ভেঙেছে। ওদের মতাদর্শে না মিললে ওরা হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ করে না। ওরা ধার্মিক নয়, ওরা ধর্মান্ধ।” সামাজিক মাধ্যমে এ বিষয়ে যেমন মন্তব্য আসছে, তেমনি নজরুলের ওপর ভারতীয়দের অধিকার যে বেশি এ বিষয়েও অনেকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। শুভ্র দেব নামে একজন লিখেছেন:”নজরুল ভারতের ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তিনি ভারতীয়। রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে….বোধশক্তিহীন কবিকে ওরা নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাকে হৃদয়ে ধারণ করার যোগ্যতা ওদের নেই।” কলকাতার রমা ঘোষ লিখেছেন:”নজরুল তো আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, তার জন্ম বর্ধমান জেলায়, তিনি তো আমাদেরই লোক।”
মানুষের বিচিত্র মন্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাদের মূল বক্তব্য নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-লালনের শরীর বিলীন হয়ে গেলেও তাদের শৈল্পিক সৃষ্টিগুলি বাংলাদেশে নিরাপদ নয়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কুৎসিত ক্যাম্পেইন চলেছে, মাঝে মাঝে আমরা কট্টর রবীন্দ্রবিরোধী বাংলা একাডেমি পুরুস্কারপ্রাপ্ত লেখক সলিমুল্লাহ খান সহ অন্যদের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অহরহ মিথ্যা কথা প্রচারণা করতে দেখি। মৌলবাদীরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে মিথ্যা প্রচারণা চালায় তা হলো রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। বাংলাদেশে ভাঙা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের-লালনের ভাস্কর্য-মাজার-মন্দির-দরগা শরিফ-গীর্জা-মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর। আক্রান্ত হয়েছে বাউলরা, রাষ্ট্রও নিপীড়ন কম চালাচ্ছে না–গ্রেফতার করা হয়েছে বিচার গানের লোকশিল্পীদের, সাংবাদিক-লেখক-অভিনেতা-স্বাধীনতা পক্ষের মানুষদের। সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ও পুলিশ হত্যা, বাড়িঘর ভাঙা, কুপিয়ে-পুড়িয়ে মারা, লুট, বুলডোজার থেরাপি সবকিছু চলেছে।
এ সপ্তাহে আল্লাহু আকবর-নারায়ে তকবীর ধ্বনি দিয়ে ময়মনসিংহে দীপু দাস নামের এক শ্রমিককে ধর্ম অবমাননার দায়ে পুড়িয়ে মারা হলো। যেসব ফেসবুক পেজ থেকে সেসব ভিডিও লাইভ টেলিকাস্ট হলো সেসব পেজে আবার নজরুলের গান-কবিতা ব্যবহার করা হয়েছে জিহাদী কবিতা-সঙ্গীত হিসেবে। সেসব পেইজে অনেক জেহাদী ভিডিও রয়েছে যা দেখলে বোঝা যায় কিভাবে নজরুলের গান ও কবিতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে উগ্র জঙ্গিবাদের দিকে বাংলাদেশে তরুণদের আহ্বানের হাতিয়ার হিসেবে।
প্রশ্ন হোলো যে কবি কোনো কালেই কট্টর মুসলিম ছিলেন না, আজীবন অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, হিন্দু নারীকে বিয়ে করেছিলেন, ছেলেদের আরবী নাম দেননি, শ্যামাসংগীত লিখেছেন, তাকে কি মৌলবাদীরা যথেষ্ট মুসলিম বলে মানবে? আজকে যারা বাংলাদেশে ক্ষমতায় (উগ্র মুসলিম সমর্থিত সরকার) তাদের পূর্বসূরীরা নজরুলকে কাফের বা অকৃতজ্ঞ বলতো। বাংলাদেশে নজরুল নিয়ে লেখালিখি হয়, গবেষণা হয় একটি সীমিত বুদ্ধিজীবী পরিমণ্ডলে, যারা তার লেখা তাদের রাজনীতির জন্য ব্যবহার করেন, তাদের নজরুলের আসল জ্ঞান সাম্যবাদকে ধারণ করতে দেখা যায় না।
উগ্রবাদী মতাদর্শের ছাত্রনেতা হাদী ছিলেন প্রচণ্ড ভারত-বিদ্বেষী। ভারত বিরোধিতা ছিল তার করে খাওয়ার বিষয়। অথচ নজরুলের জন্ম ভারতে। কী বৈপরীত্য এই দু’জনার পাশাপাশি সমাধি। এ নিয়ে কাল রাতে তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়েছেন কবি পরিবার। নজরুলের পরিবারের সদস্য সোনালি কাজী ও স্বরূপ কাজীর বক্তব্য, যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা অনৈতিক। এত জায়গা থাকতে নজরুলের সমাধির পাশে হাদীকে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্তের নেপথ্যে রাজনীতি রয়েছে। ‘আমাদের প্রাণের কবি বাংলাদেশে শেষ জীবন কাটিয়েছেন। এত দিন বাংলাদেশে আমরাও (পরিবারের অন্যেরা) ভাল ছিলাম। কিন্তু এখন যা হচ্ছে…। ছায়ানট ভাঙচুর করা, রবীন্দ্রনাথের বই পুড়িয়ে দেওয়া বাংলাদেশিদের উগ্রবাদীরা হাদীকে সমাধিস্থ করলেন কবির সমাধির পাশে! এটা হল কেন? নজরুল যেখানে সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে গিয়েছেন, জাতের নামে বজ্জাতির কথা বলেছেন, তখন তার সমাধির পাশে এমন এক জনকে সমাধিস্থ করা হল সরকারেরই নির্দেশে! আগামী দিনে হয়তো কবির সমাধিও ওখানে থাকবে না। পৃথিবীতে ভাল মানুষের জায়গা কি হারিয়ে যাচ্ছে? রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে কি পরবর্তী প্রজন্ম অস্বীকার করবে? আমাদের আর্জি, নজরুলকে যেন অসম্মান করা না-হয়। তবে এই সরকারের (বাংলাদেশের অন্তর্বতী সরকার) দায়বদ্ধতা নেই। আমরা ভীষণ মনোকষ্টে রয়েছি। আমরা মর্মাহত।’’
কেউ লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলামকে গ্রহণ করার মতন যোগ্যতা বর্তমান বাংলাদেশের নেই। শুধু নজরুল কেনো বাংলাদেশের ধর্মান্ধদের কোনো কবি, কোনো গায়ক কারো উপর এদের অধিকার নেই। দেশটার নামটাই শুধু আছে, আত্মাটা মোল্লারা খেয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের কিছু প্রতিক্রিয়াও ধীরে আসতে শুরু করেছে। ধীরে এ কারণে যে এখন সে দেশে কথা বলা দুষ্কর–কথা বললে খুন-গ্রেফতার-মামলা, আস্ত বাড়ি ফিরবেন কিনা সন্দেহ কিংবা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবে। লিটলম্যাগের লেখক শাফি সমুদ্রও বৈপরীত্যের উল্লেখ করেছেন::”ভারতের উপহার দেয়া এ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে যায় এবং ভারতীয় নাগরিক তার চিকিৎসা করে।” তিনি এখানে সিঙ্গাপুরে হাদীর গুলিবিদ্ধ মাথায় ব্যর্থ অপারেশনের কথা বলেছেন। হাদীর আবৃত্তি করা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ভিডিও দেখে আঁতকে উঠেছি। শব্দ ভুল বলেছে, বাংলাদেশীরা তাতেই মুগ্ধ হয়ে তাকে কাজী নজরুলের সমকক্ষ বানিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশী লেখক ও প্রকাশক কবির য়াহমাদ লিখেছেন:”শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, জাতীয় পতাকার নকশাকার কামরুল হাসানসহ অন্যদের কবর থাকাকালে নজরুল সমাধিসৌধকে বিবর্ণ মনে হয়নি। সমাধিসৌধই কেবল নয়, এবার নজরুল-ই বিবর্ণ।” কবি রমন রসিকের মন্তব্য আক্ষেপে ভরা:”বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বর (স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবের) বাড়িটি ভেঙে ফেলাই হচ্ছে মব সেনাপতি ওসমান হাদির বৃহৎ সাফল্য। এই অসামান্য অবদানের জন্যই কিনা তার মৃত্যুতে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়েছে এবং তাকে দাফন করা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে। হায় নজরুল! আমরা জানি না, কবর বাস কতটা অস্বস্তিদায়ক হতে পারে আপনার জন্য।”
কবি ঋজুরেখ চক্রবর্তী যিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা প্রাক্তন আধিকারিক, তিনি লিখেছেন:”নজরুলের প্রয়াণের এটা পঞ্চাশতম বর্ষ চলছে। এই পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে এতজন অগ্রগণ্য কবি কথাসাহিত্যিক বা মুক্তিযোদ্ধার ইন্তেকাল হয়েছে, অথচ তাদের মধ্যে কাউকেই নজরুলের পাশে সমাধিস্থ করতে পারার উপযুক্ত মনে হয়নি তাদের, আজকের এই দিনটার অপেক্ষায় তারা ছিল? চমৎকার! প্রমীলা দেবী (নজরুলের স্ত্রী) সেই ১৯৬২ সাল থেকে বর্ধমানের চুরুলিয়ায় একাকিনীই সমাধিস্থ থেকে গেলেন; তার কথা নাহয় বাদই দিলাম।”
নজরুলের জীবনীভিত্তিক উপন্যাস লিখেছেন সাহিত্যিক বিনোদ ঘোষাল, তিনি তার আর্জি রেখেছেন এভাবে:”বাংলাদেশ নামক দেশটির জাতীয় কবি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি কীভাবে, কোন রাজনৈতিক কারণে ওই দেশের জাতীয় কবি হয়েছেন সেই আলোচনাতে যাচ্ছি না, কিন্তু যে কবি আজীবন সঙ্গীতের সাধনা করলেন, যে কবি চিরকাল হিন্দু-মুসলিম প্রীতি, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বললেন, যখন দেখি সেই দেশেরই মানুষ সঙ্গীতকেই শেষ করে দিতে চাইছে, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে তখন মনে হচ্ছে আর খুব বেশিদিন নেই যে নজরুলের কবরস্থানটিও ওই দেশের উন্মাদ জনগণের হাতে ছায়ানটের মতই অবস্থা হবে। কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি অফিশিয়ালি ঘোষণার মাত্র বছর খানেকের মধ্যেই সঙ্গীত আর ধর্মীয় এমন আঘাত নজরুলের আদর্শকেই পদদলিত করা। হে নব্য বাংলাদেশের ধ্বজাধারীগন আপনারা দয়া করে আপনাদের দেশ থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে মুক্তি দিন। উনি আপনাদের যোগ্য নন।”
যাহোক, এবার উগ্রবাদী হাদীকে নজরুলের সমাধিতে কবর দিয়ে দ্বিতীয়বার কবি-পরিবারের সঙ্গে প্রতারণা করা হলো। কিছুদিন আগেও চট্টগ্রাম কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত জাপানি সৈনিকদের দেহাবশেষ উত্তোলনের পর জাপানে পাঠানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষও চায় তাদের ঘরের ছেলে নজরুল এতো বছর পর হলেও নিজ গ্রামে ফিরুন। হয়তো একদিন নজরুল সত্যি বাংলাদেশী উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িক জঙ্গীগোষ্ঠীর লাশের রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত হয়ে নিজ মাটিতে ফিরে যেতে পারবেন।#




