—কবিতা না লিখলে কী করতাম?
—আর পাঁচজন যা করে, সংসার, জীবিকার জন্য লড়াই, ধর্ম-কর্ম, কলহ-বিবাদ ইত্যাদি।
—যাঁরা কবিতা লিখছেন তাঁরা কি এসব করেন না?
—অবশ্যই করেন, তবু আমার মনে হয় তাঁদের এসব করার মধ্যেও একটা সৌন্দর্য বিরাজ করে। সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে একটা মানবিক আকাশ ঝলমল করে। একটা বিজ্ঞ পরিশীলিত আশ্চর্য জীবনআচারের মুগ্ধতা খেলা করে। অবশ্য আমার এসব মনে করা ভাবনা সত্য নাও হতে পারে।
—কতজন কবিকে খুব কাছ থেকে দেখেছি?
—খুব বেশি কবিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাইনি। কয়েকজন সাহিত্যিক এবং কয়েকজন কবিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দেখেছি সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এক আশ্চর্য আলোকিত জীবনধারা। দয়ামায়া, স্নেহপ্রেম, সহিষ্ণুতা ও ত্যাগের অদ্ভুত মহিমা। মানুষের দুঃখে কাঁদতে দেখেছি। মানুষের সুখে হাসতেও দেখেছি। কখনো সামাজিক সম্মানের দাবি করেননি। কোনো প্রতিষ্ঠানের দেওয়া পুরস্কার-সম্মানের জন্য হাহাকার করেননি। নিজের লেখা প্রচার করার জন্য বড় কাগজে লিখতেই হবে এবং তা বড় কোনো লেখককে দিয়ে সমালোচনা করাতেই হবে—এমন মানসিকতারও প্রকাশ দেখিনি। প্রকাশক একজন সাহিত্যিকের একটি গল্পের বই ‘প্রতিকূলে একজন’ প্রকাশ করে তাঁকে বললেন, “আপনার সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব ও কলিগদের বইটি এক কপি করে দেবেন না? কয়েক কপি নিয়ে যান।” তিনি কোনো সম্মতিই জানালেন না। উদাসীন তাচ্ছিল্যে খালি হাতে ফিরে এলেন। নিজের বই নিজ হাতে কাউকে এক কপি তুলে দিয়ে বললেন না ‘বইটি পাঠ করে দেখুন’। কিংবা কোনো পত্রিকার সম্পাদকের কাছে গিয়ে বললেন না, ‘বইটা আপনার পত্রিকায় রিভিউ করে দিন’। তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁর লেখা একটি বই চাইলে, বহু খোঁজাখুঁজির পর প্রথম এডিশনের পুরনো হয়ে যাওয়া এক কপি বই পেলেন। নিজের বইটি কোথাও যত্ন করেও রাখেননি। হায়রে যশ-খ্যাতি। রেডিও, টিভি-চ্যানেল, সংবাদপত্র নানা সময়ে সমস্ত মিডিয়া থেকেই তিনি নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। গ্রামের একটা টিনের চাল দেওয়া মাটির বাড়িতেই আজীবন কাটিয়ে গেছেন। সঙ্গিনী বলতে আটপৌরে একটি নারী যাকে বউ হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন। সেই বাড়িতেই বহু গবেষক, বহু পণ্ডিত ব্যক্তিও যাতায়াত করেছেন। সেরকম সাহিত্যিকের সান্নিধ্য পাওয়া আমার কাছে ছিল বড় প্রাপ্তি। আরও দুজন কবি-সাহিত্যিককে খুব কাছ থেকে দেখেছি। একজনের এলোমেলো জীবনযাত্রা। পরিপাটি সাজানো গোছানো গৃহসংসার বলতে যা বোঝায়, তা একেবারেই নেই। এলোমেলো বুকসেলফ। অগোছালো কতগুলি বই। বইয়ের ভিতরে ভিতরে বিড়ালের বাসা। ঘরে অসংখ্য কুকুর। বিড়াল-কুকুরের সঙ্গেই জীবন কাটান। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো, বিশ্রাম নেওয়াও। টেবিল-চেয়ারে বসে গম্ভীর হয়ে বই সাজিয়ে রেখে কবিতা লেখার আড়ম্বরের আয়োজন কিছুই নেই। যশ-খ্যাতি-সম্মানের কথা বললে গর্জে ওঠেন। ওসব যেন একজন শিশুর কাছে সামান্য খেলনাপাতির মতো। কবিতা লেখা কী এমন কাজ, যার জন্য তিনি যশ-খ্যাতি-অমরত্ব দাবি করবেন?
আর একজন সাহিত্যিক ও কবির স্নেহ ও সান্নিধ্যের প্রাপ্তি আমার মন ভরিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিন সাহিত্যের পথে অবস্থান করে জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছেও কখনো মোহের দ্বারা আক্রান্ত হননি।নিজের মতোই লিখতে ভালোবাসেন। প্রকাশ করার তাড়া নেই। তাঁর কথাসাহিত্য জীবনবীক্ষার আশ্চর্য আবিষ্কার। আমাদের লালিত অন্ধকারগুলি যা আদিম প্রবৃত্তির ধারক, তিনি তাঁর লেখায় রূপ দিয়েছেন। গ্রাম্যজীবনের সাদামাটা পরিবেশেই বসবাস করতে ভালোবাসেন। তথাকথিত কৃত্রিম আভিজাত্যের তোয়াক্কা করেন না। অনেক দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকেরাও তাঁর লেখার গূঢ়ার্থ অনুধাবন করতে পারেন না। তাই নানা সময়ে তাঁর লেখার ধরনকে ব্যঙ্গ করেন। তবুও তিনি লেখা প্রকাশের জন্য তাঁদের কাছে মাথা নোয়াতে পারেন না। দীর্ঘদিন নির্বাসিতের মতোই নিজেকে গোপন রাখেন। তাঁর লেখা উপন্যাসগুলি অনেক ডিগ্রিধারী অধ্যাপকীয় আলোচকেরাও পাশ কাটিয়ে যান, কিন্তু মর্ম উদ্ধার করতে পারেন না।
সমকালে এঁদের যে সম্মান নেই তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু আমি যতটা বুঝেছি, এঁরা মানুষ হিসেবে যেমন যাবতীয় কপটতার ঊর্ধ্বে, তেমনি দার্শনিক হিসেবেও চূড়ান্ত প্রজ্ঞার অধিকারী। পার্থিব আকাঙ্ক্ষাকে সহজেই ত্যাগ করতে পারেন। কোনো অপার্থিব সম্পদ যেন তাঁদের মধ্যে মজুদ আছে, যার কোনো শেষ নেই, সীমা নেই। তাই কোনো প্রতিষ্ঠান, কোনো ব্যক্তি তাঁদের দোষারোপের বিষয় নয়। অনেক না পাওয়ার মধ্যেও তাঁদের কোনো দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় না। বরং না পাওয়া, না আলোকিত হওয়াই তাঁদের কাম্য বলেই তাঁরা মনে করেন। নিজেকে বদলে ফেলার জন্য আমার জীবনে এঁদের আদর্শই যথেষ্ট বলে আমি মনে করেছি। সুতরাং কবিতা না লিখলে, কিংবা সাহিত্যের পথে না থাকলে এঁদেরকে বুঝবার ক্ষমতা হয়তো আমার তৈরি হত না। রবীন্দ্রনাথ ‘পরশমণি’ কবিতায় লিখেছিলেন:
‘যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মান না মণি
তাহারই খানিক
মাগি আমি নতশিরে।’ এত বলি নদীনীরে
ফেলিল মানিক।’
এঁদের কথাই ভাবতে থাকি, কোন ধনে ধনী হলে মণিকেও তুচ্ছ করা যায়। সেই ধন আহরণ করাই একজন প্রকৃত কবির লক্ষ্য বলেই আমার মনে হয়েছে।
তাহলে কবিতা লেখা কীসের জন্য?
নিজের জীবন-যাপন, আর প্রতিদিনের কত উপলব্ধিময় মুহূর্ত এগুলিকে মুদ্রিত করার বা শব্দায়িত করার এক খেলা। অমানবিক কাণ্ডকারখানা, মানবহন্তারকের প্রকাশ্য আস্ফালন, মোহান্ধ জীবনযাত্রা, দর্শনহীন প্রজ্ঞা, পশ্বাচারের পুনরুত্থান এসবের বিরুদ্ধেই সাহিত্য বা কবিতা এক ধরনের মেধাবী শব্দাস্ত্র। মানুষের পাশে দাঁড়ানো বিবেককে জাগ্রত করার প্রয়াস। তাতে খুব বেশি কাজ না হলেও একটা বাউল-ক্ষমতা লাভ করা যায়। লোভ-রিরংসা থেকে নিজেকে দূরে রাখার শিক্ষা পাওয়া যায়। নিষ্ঠুর হওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করা যায়। গ্রাম্য জীবনের ছায়া-অন্ধকারে, আড়ালে ও আবডালে যাঁরা প্রতিভাকে লুকিয়ে রেখে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, শিল্প সাহিত্যের পথে থেকেও যাঁরা প্রচার পায়নি, বা প্রচার বিমুখ হয়ে উদাসীন থেকে গেছে; তাঁরাও যে মূল্যবান ছিল তা বুঝিয়ে দিয়েছেন ইংরেজ কবি, লেখক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন রোনাল্ড রিউএল টলকিন সিবিই এফআরএসএল (১৮৯২-১৯৭৩),যিনি ধ্রুপদী উচ্চ-ফ্যান্টাসিধর্মী দ্য হবিট, দ্য লর্ড অব দ্য রিংস ও দ্য সিলমারিওন বইয়ের জন্য বিখ্যাত। তিনি একটি কবিতায় লিখেছেন:
‘All that is gold does not glitter,
Not all those who wander are lost;
The old that is strong does not wither,
Deep roots are not reached by the frost.
From the ashes a fire shall be woken,
A light from the shadows shall spring;
Renewed shall be blade that was broken,
The crownless again shall be king.’ (J.R.R. Tolkien, The Fellowship of the Ring :The Lord of the Rings)
অর্থাৎ সোনা যা আছে
সব চকচক করে না, যারা ঘুরে বেড়ায় তারা সবাই হারিয়ে যায় না;
পুরাতন যা শক্তিশালী তা শুকিয়ে
যায় না, হিম দ্বারা গভীর শিকড় পৌঁছায় না।
ছাই থেকে একটি আগুন জাগ্রত হবে,
ছায়া থেকে একটি আলো বসন্ত হবে;
ভাঙা ব্লেডকে নতুন করে দেওয়া হবে,
মুকুটহীন আবার রাজা হবে।
সোনা সব সময় যে চকচক করবে তা কিন্তু নয়। তেমনি যাঁরা মূল স্রোতের বাইরে আছে, কিংবা পাঠক এখনও যাঁদের কাছে পৌঁছায়নি, তাঁরা যে সব সময় হারিয়ে যাবে—একথাও ঠিক নয়। যা পুরনো, যা শক্তিশালী তা সব সময় শুকিয়ে যায় না। হিমের কারণে গভীরে হয়তো শিকড় পৌছায় না। হয়তো এমন একটা সময় আসবে, ছাই-এর ভেতর থেকেই আগুন জেগে উঠবে। যা ছায়ার আড়ালে ছিল হয়তো তা থেকেই বসন্তের আলো ফুটবে। ভাঙা ব্লেডও তার ধার নিয়ে কার্যক্ষম হবে। মুকুটহীনও একদিন মুকুটযুক্ত হতে পারে। সুতরাং সাহিত্যচর্চা সেই উত্থানেরই একটা ক্ষেত্রে বিরাজ করে। সাময়িকভাবে বা সমকালে তাঁর মূল্যায়ন করার মতো মানুষ থাকে না। অথবা সুযোগও আসে না। কিন্তু প্রবহমান মানব সভ্যতায় এক সময় হয়তো তাঁর দিকে মানুষ ফিরে তাকায়। তখন হয়তো সে জীবিত থাকে না, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি থাকে, সৃষ্টি থেকে যায়। যাঁরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁরা তীব্রভাবে আত্মজাগরণের টের পান, যাঁরা আত্মঅন্বেষণ করেন, যাঁরা জীবনবাদ নিয়ে ভাবতে চান, যারা মানবরসভ্যতার উত্থান-পতনকে অনুধাবন করেন, যাঁরা অন্যায় ও ব্যভিচারের বিপক্ষে কথা বলেন, যাঁরা মানবিক হৃদয়ের ধারক ও বাহক, তাঁদের কাছেই আমেরিকান বিখ্যাত কবি জাতীয় বই পুরস্কার এবং পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী মেরি জেন অলিভার (১৯৩৫-২০১৯) প্রশ্ন করেছেন:
‘Tell me, what is it you plan to do
with your one wild and precious life?’
অর্থাৎ আমাকে বলুন,
আপনার একটি বন্য এবং মূল্যবান জীবন নিয়ে আপনি কী করার পরিকল্পনা করছেন?
এর উত্তর দেওয়ার জন্যই যে আমার কবিতা লেখা তা জোর দিয়েই বলা যায়। একটি বন্য ও মূল্যবান জীবন নিয়ে আমি মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমার আত্মস্বর কবিতা হয়ে আসুক। সাহিত্য হয়ে কথা বলুক। আত্মসন্ধানের কথা, মানবসভ্যতার কথা। যে কথার মধ্যে ভাষার প্রতি প্রেম থাকবে। ভালোবাসা থাকবে। যে কথার মধ্যে মানুষের প্রতি বিশ্বাস থাকবে। যে কথার মধ্যে সহিষ্ণুতার শিক্ষা থাকবে। যে কথার মধ্যে আত্মউপলব্ধির প্রজ্ঞা থাকবে। যে কথার মধ্যে আমার নিজস্ব ঈশ্বরের দেখা পাব। যে কথার মধ্যে আমার বিস্তৃত আকাশ থাকবে। আমার উপলব্ধির গান, পাখি, নক্ষত্র, জ্যোৎস্না, অন্ধকার, পুনর্জন্ম, বিস্ময়, চৈতন্য, শিহরন প্রকাশ পাবে। সুতরাং জীবন নিয়ে আমি কবিতা লিখব। এই জীবনকে আমি ভাষা শেখাব।♣