বাংলাদেশে কয়েকদিন ধরে চলছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অবরোধ কর্মসূচি হিসেবে গত ৭ জুলাই থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে। সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলনের তীব্রতা এবং সহিংসতায় রূপ নেয় এই আন্দোলন। সেই সাথে চলেছে ধ্বংসযজ্ঞ- বিভিন্ন স্থানে পুড়েছে যানবাহন, ব্যাহত হয়েছে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারী কোন কোন প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে শোনা গেছে বোমা বিস্ফোরণ, দেখা গেছে আগুনের ধোঁয়া। যানবাহনে অগ্নসংযোগ করা হয়েছে। ছাত্রদের হাতে দেখা গেছে দেশী অস্ত্র। শিক্ষার্থী বনাম পুলিশের ধাওয়া ও পালটা ধাওয়া। শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের ছুঁড়েছে শব্দ গ্রেনেড, রাবার বুলেট, ছররা গুলি। তাতে আহত হয়েছেন অনেকে। সবচেয়ে ভয়স্কর নৃশংস দৃশ্য ছিল, একদল ছাত্র তাদের বিরোধী ছাত্রদের বহুতল ভবন থেকে ছুঁড়ে ফেলেছে এরপরে মাটিতে আছড়ে পড়া আহত ছাত্রদের উপর শারীরিক নির্যাতনের বীভৎস চিত্র। এসব ঘটনায় গতকাল নিহতের সংখ্যা ছিল ৬জন। এরপরে ১৮জুলাই সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। আজ সহিংসতায় আরও ১৩জন নিহত হয়েছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। নিহত সকলের আত্নার চিরশান্তি কামনা করি: চির বিশ্রামে থাকুন। চির শান্তিতে থাকুন।
আমি চাই না আমাদের জীবন্ত সন্তান নিথর দেহে ঘরে ফিরে যাক। আর কোন সন্তানের লাশ দেখতে চাই না। আমাদের সন্তানেরা বেঁচে থাকুক আদর-স্নেহ ভালবাসায়।
আমাদের সন্তানদের আন্দোলন হতে পারতো প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে, ঘুষ দিয়ে চাকরীর বিরুদ্ধে এবং পরিবেশ রক্ষার। অথচ আমাদের সন্তানেরা সামাজিক সংস্কারের দাবী না করে তারা মাঠে নামল কোটা সংস্কারের নামে রাজনৈতিক আন্দোলনের দাবী নিয়ে। আমি নিজেও মনে করি কোটা সংস্কার হওয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সাথে সহমত এবং এই আন্দোলন হতে পারতো অহিংস ও শান্তিপূর্ণ। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সহিংসতা, সংঘর্ষ রক্তপাত, জীবননাশ… এমন আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে পারি না। আজ আমাদের সন্তানেরা যে কোটা সংস্কার হলে অথবা কোটা পুরোপুরি বাতিল হলে সাধারণ ছাত্ররা পাশ করলে বিনা উৎকোচে চাকরীর নিশ্চয়তা আছে কি? যারা আজ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে প্রশ্ন কিনে সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন এবং যারা উৎকোচ গ্রহণ করছেন তারাও কিন্তু আজকের শিক্ষার্থীদের কারও না কারও পিতামাতা। কোটা সংস্কার হোক না হোক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের কোন লাভ হবে না।
সরকারী চাকরী করতেই হবে কেন? সরকারী চাকরী সবাই পায় না। তাই বলে কি মানুষ বেকার থাকে? সরকারী চাকরী ছাড়াও মানুষ প্রতিষ্ঠিত হয়। বেসরকারী চাকরী করেও সুন্দর জীবন যাপন করা যায়। সরকারী চাকরী পেছনে না ছুটে কেউ কেউ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, পরিশ্রম করে নিজেরা উদ্যোক্তা হয়েছেন এবং তারা অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন- তাদেরকে কি আপনারা মেধাবী বলবেন না? তাদের মেধার প্রশংসা কি করবেন না?
সুতরাং শিক্ষার্থীদের ভেবে দেখা দরকার, আপনারা কার স্বার্থে আন্দোলন করছেন? সরকার আসে, সরকারের বদল হয়, নতুন সরকার গদীতে বসে- সাধারণ মানুষের জীবন কিন্তু একই থেকে যায়।
আমাদের সন্তানদের বিভ্রান্ত করে উস্কানী দিয়ে বিপথগামী করে আন্দোলন করতে উস্কানী দিচ্ছে তারা কারা? তাদের খুঁজে বের করে আইনের মুখোমুখি করা প্রয়োজন। সন্তানদের পিতামাতাদের বলতে চাই, আপনারা সন্তানদের মানসিক মনোবল দৃঢ় করার শিক্ষা দিন, যাতে সরকারী চাকুরী না পেলেও নিজ যোগ্যতায় নিজের ও অন্যের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে।
অকালে কারও চলে যাওয়া আমাদের কাম্য নয়। যারা নেই আজ, তাদের পরিবারই আজ মর্মাহত, শোকার্ত। এই হারানোর ব্যথা পূরণ হওয়ার নয়। শোকার্ত পরিবারের জন্য সমবেদনা।
শিক্ষার্থীদের কোন বিষয়ে দাবী নিয়ে আন্দোলন নতুন কোন বিষয় নয়। শত বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা করে আসছে। আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা স্মরণীয়। তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চেয়েছিল কিন্তু সরকার পতনের দাবী নিয়ে আন্দোলন করেন নাই। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের আন্দোলন কিভাবে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে এটা সচেতন মহলের ভেবে দেখা দরকার।
সন্তানের একজন মা হিসেবে শিক্ষার্থীদের বলছি, আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে বাবা-মা’কে অনেক ত্যাগস্বীকার করতে হয়। তারা নিজেদের চাওয়া-পাওয়া সরিয়ে রেখে আপনাদের প্রয়োজনটাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তারা আপনাদের নিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখেন। সন্তানের অসুস্থতা, সন্তানের কষ্টবাবা-মা সইতে পারেন না। সন্তান হারানোর বেদনার চেয়ে আর কোন ভারী যন্ত্রণা নেই এই পৃথিবীতে: অশ্রুসিক্ত চোখ আর পাহাড়সম বেদনা বুকে চেপে নিয়েই বাঁচেন তারা আমৃত্যু। তাদের কথা ভাবুন। আপনারা অন্যের স্বার্থের বলি হচ্ছেন কিনা ভাবুন। আন্দোলন করুন কিন্তু সহিংসতা নয়। সরকারের সাথে আলোচনায় বসুন। শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে আলোচনায় মাধ্যমে আপনাদের দাবী ও সমস্যার সমাধান করুন। কোটা সংস্কার বা পুরো কোটা বাতিল হলেই যে আন্দোলনকারীরা সকলেই সরকারী চাকরী পাবেন এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে কি!#