গ্রীষ্মের দুপুরবেলা। বুনিয়াদপুর।
পল্লববাবু একা খোলা জানলার ধারে বসে কাঁদছিলেন।
তার স্ত্রী বাড়িতে নেই— বাবার বাড়ি বেড়াতে গেছেন।
স্ত্রীকে তিনি খুব ভালোবাসেন।
চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন অনেকদিন, এখন তার বয়স পঁয়ষট্টি।
চোখ দিয়ে টুপটাপ জল পড়ছে, যেন অনেকদিন জমে থাকা কান্না আজ বেরিয়ে আসছে।
দরজা খোলা ছিল। সপ্তক ঘরে ঢুকল।
বাবাকে কাঁদতে দেখে সে অবাক হয়ে গেল।
নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
“বাবা, তুমি কাঁদছ কেন?”
পল্লববাবু কোনও উত্তর দিলেন না।
সপ্তক আবার বলল,
“বাবা, আমার স্ত্রী কি কিছু বলেছে তোমাকে?”
চুপচাপ বসে রইলেন পল্লববাবু।
“তাহলে কি মা-কে দেখতে না পেয়ে কাঁদছ?”
এইবারও কোনও উত্তর এল না, কেবল চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
তেত্রিশ বছর আগে—
পল্লববাবু ছিলেন পাথরঘাটা সুদর্শননগর জি.এস.এফ.পি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
সপ্তক তখন ছোট, এখন তার বয়স তিরিশ।
বাবা তাকে খুব ভালোবাসেন।
একদিন চতুর্থ শ্রেণির অঙ্কের ক্লাস নিচ্ছিলেন পল্লববাবু।
চক ও ডাস্টার হাতে নিয়ে বোর্ডে ছাত্রছাত্রীদের বয়সের যোগ-বিয়োগ বোঝাচ্ছিলেন।
বড় স্কুল, ষাটজন ছাত্রছাত্রী সেই ক্লাসে।
সেদিন সবাই উপস্থিত ছিল।
তিনি বলছিলেন—
“দেখো, সাধারণত লম্বায় বড় হলে বয়সও বেশি হয়, আর লম্বায় ছোট হলে বয়স কম হয়।
যেমন আমি তোমাদের চেয়ে লম্বা, তাই আমার বয়সও বেশি। তোমরা ছোট, তাই বয়সও কম। বুঝলে তো?”
তখন শুভ নামের এক ছাত্র উঠে দাঁড়াল।
পড়াশোনায় সে খুব ভালো, রোল নম্বর দুই।
সে শান্ত গলায় বলল,
“স্যার, লম্বায় বড় বা ছোট হলেই বয়স আলাদা হয় না।
আমাদের হাতের পাঁচটা আঙুল দেখুন— বৃদ্ধাঙ্গুলি, তর্জনী, মধ্যমা, অনামিকা আর কনিষ্ঠা।
সব আঙুল বড়-ছোট হলেও তাদের বয়স কিন্তু সমান।”
পল্লববাবু অনেক ছাত্রছাত্রীর সামনে নিজেকে যেন পরাজিত বোধ করলেন।
রাগে, লজ্জায়, অজান্তে তিনি শুভকে ডেকে এনে বেত দিয়ে মারতে শুরু করলেন।
বললেন,
“দুষ্টু ছেলে! পড়ানোর সময় কথা বলিস? ক্লাসে বিশৃঙ্খলা করছিস?”
একটার পর একটা আঘাতে বেত ভেঙে গেল,
তবু শুভ কাঁদল না— তার চোখে এক ফোঁটাও জল এল না।
চুপচাপ গিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়ল সে।
পল্লববাবু ক্লাস শেষ করে অফিসরুমে গিয়ে কাজে ডুবে গেলেন।
বর্তমানে ফিরে এল সপ্তক।
চুপচাপ বসে থাকা পল্লববাবুর দিকে তাকিয়ে ভাবল— বয়স বাড়লে মানুষ ভেতর থেকে ভেঙে পড়ে,
এই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার ভাবনা মানুষকে নরম করে দেয়।
সে জিজ্ঞেস করল,
“বাবা, অনেক বয়স হয়ে যাওয়ায় কি মন খারাপ তোমার?”
পল্লববাবু নিশ্চুপ।
সপ্তক আবার বলল,
“আমার কোনো আচরণে কি তুমি কষ্ট পেয়েছ? আমি কি তোমাকে আঘাত করেছি?”
এইবার পল্লববাবু হঠাৎ জোরে জোরে কেঁদে উঠলেন।
কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“তিরিশ বছর আগে শুভ নামে এক ছাত্রকে আমি একদিন খুব মেরেছিলাম।
মারতে মারতে বেত ভেঙে ফেলেছিলাম।
কিন্তু শুভ কাঁদেনি, তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও জল পড়েনি।
আজ এত বছর পরে মনে হয়, ওর সেই কান্না ওর হয়ে আমাকেই কাঁদতে হচ্ছে।
সেদিনের শুভর কান্না, আজ আমি কাঁদছি।”




