চর্যাপদের রচয়িতাদের ধর্মমত

চর্যাপদগুলির মাধ্যমে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা যে ধর্মমত প্রচার করতে চেয়েছিলেন, সেগুলির আলোচনা প্রসঙ্গে অতীতের বিভিন্ন ব্যাখ্যাতারা বৌদ্ধধর্মমতের বিভিন্ন ‘যান’ বা সাধন-পদ্ধতির সমন্বয়টাই যে সেইসব সিদ্ধাচার্যদের মূল লক্ষ্য ছিল — সেদিকেই বেশি করে জোর দিয়েছিলেন। ইতিহাস বলে যে, চর্যাপদের সমকালীন বাংলার ভাবলোকে আত্মবিস্মৃতি এবং আত্মস্বাতন্ত্র্যরক্ষার প্রেরণা যুগপৎ কার্যকরী হয়েছিল, এবং সেই বোধের স্বাক্ষর চর্যাপদের বিভিন্ন গীতগুলির মধ্যে পাওয়া যায়। চর্যাপদে একদিকে যেমন সেকালের আচারসর্বস্ব বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মাচরণের প্রতি বিদ্রূপ এবং অবিশ্বাস প্রকাশিত হয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি আবার হিন্দু ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক দেহবাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন এবং প্রকাশ্য আস্থাজ্ঞাপন করবার ক্ষেত্রেও কোনো বাধা দেওয়া হয়েছিল বলে দেখতে পাওয়া যায় না। এছাড়া তাতে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন যানের প্রতি কোনো না কোনোভাবে সমর্থন জানানো হয়েছিল বলে দেখা যায়। তবে একইসাথে একথাও বলা যেতে পারে যে, চর্যাপদ কোনোভাবেই আচারসর্বস্ব হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে পুরোপুরিভাবে স্বীকার করে নি। চর্যাপদের সিদ্ধাচার্যরা সকলেই মোটামুটিভাবে বৌদ্ধধর্ম প্রদর্শিত আচার আচরণ, পথ ও সাধনাকেই নিজেদের জীবনচর্যা হিসাবে গ্রহণ করবার জন্য, এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের জীবনকে পরিচালনা করবার জন্য স্থিরভাবে নিশ্চিত ছিলেন; তাঁদের মধ্যেকার তফাৎ শুধু ছিল যান নিয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হিন্দু তান্ত্রিক দেহবাদের যে পরিচয় চর্যাপদে দেখতে পাওয়া যায়, সেটা সামাজিক কারণে সেযুগের হিন্দু-বৌদ্ধ আদর্শের পারস্পরিক সমন্বয়ের ফলে এসেছিল বলে মনে হয়। তখন সিদ্ধাচার্যরা প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে নতুন করে হিন্দু তান্ত্রিক দেহবাদের প্রতি তাঁদের সমর্থন জানান নি; চর্যাপদ রচনার অনেক আগেই সেই সমন্বয় হয়ে গিয়েছিল, এবং সেই সমন্বয়ের ফলেই বৌদ্ধধর্মের মধ্যে একটা দেহবাদী আলাদা যানের সৃষ্টি ঘটেছিল। তাই চর্যাপদের ধর্মমতের নিজস্ব প্রকৃতিটা যে কি, সেকথা বোঝানোর জন্য বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন যানগুলি সম্বন্ধে খুব সাধারণ এবং সহজ একটি আলোচনা করবার দরকার রয়েছে।

বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে হিন্দুধর্মের কোন মিল না থাকলেও গৌতম বুদ্ধ প্রচারিত ধর্মমত এবং জীবনদর্শন কিন্তু সম্পূর্ণভাবে হিন্দুশাস্ত্রের প্রভাববর্জিত ছিল না। বুদ্ধদেব মানবজীবনের বিভিন্ন দুঃখ এবং সেগুলো থেকে মুক্তির পথকে নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন। মানব জীবনের দুঃখ এবং যন্ত্রণার কথা — ভারতবর্ষের প্রাচীন যুগের মুনিঋষিদের আগোচর ছিল না। উপনিষদে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে, এই পৃথিবীকে মায়াময় জেনে ব্রহ্মপদে প্রবেশ করতে পারলেই তবেই জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা এবং দুঃখভোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাঁরা জানিয়েছিলেন যে, অনিত্য জগৎ এবং অনিত্য জগৎ থেকে জাত মোহ এবং অবিদ্যাই মানুষের দুঃখভোগের কারণ, এবং সেই মোহ অবিদ্যা মিথ্যাকে ধ্বংস করতে পারলে তবেই মোক্ষলাভ করা সম্ভব। এই মোক্ষের ধারণার সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের নির্বাণতত্ত্বের কোনো অমিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে দুই পথের মধ্যে মূল অমিলটা হল — মোক্ষলাভ করবার রাস্তা নিয়ে। জপ-তপ, পূজো-আর্চা, যজ্ঞ-বলিদান — এইসব বাইরের আচরণ দিয়ে কি মোক্ষলাভ করা সম্ভব, নাকি যাগযজ্ঞ পূজার্চনা বাদ দিয়ে আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত হলে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, নাকি শৃঙ্খলার সঙ্গে কাম অর্থ ইত্যাদি সম্ভোগ করলে মোক্ষ পাওয়া যাবে — এসব কথা হিন্দু দার্শনিকেরা গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগেই আলোচনা করেছিলেন। বুদ্ধদেব অবশ্য হিন্দুদের ধারণা — পরমাত্মা থেকে মায়ার যোগে জীবাত্মার এবং নানারকম মোহের সৃষ্টি হয়, আর সেই মোহজালকে ছিন্ন করতে পারলে জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে মুক্তিলাভ করতে পারে — এই বিষয়টি স্বীকার করেননি। কারণ, তিনি পরমাত্মা বা জীবাত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু মানব জীবনে দুঃখের প্রধান কারণ যে অবিদ্যা বা মোহ — হিন্দুদের এই মতের সঙ্গে তিনিও একমত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, মানুষের ভবিষ্যৎ কর্মের দ্বারাই গঠিত হয়, কর্মসমষ্টিই পঞ্চস্কন্ধকে (রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান) অবলম্বন করে জন্মজন্মান্তরে রূপায়িত হয়ে উঠছে, আর এই কর্মের হেতু থেকেই প্রত্যয়ীভূত জগতের উদ্ভব ঘটেছে। এই যে কর্মবশ্যতা — সেটাই হল অবিদ্যা, এবং সেটা থেকেই আধ্যাত্মিক আধিভৌতিক এবং আধিদৈবিক দুঃখের সূত্রপাত ও বৃদ্ধি ঘটেছে। তাই মানুষ যদি অবিদ্যার বশীভূত না হয়, সে যদি জাগতিক — অর্থাৎ, মিথ্যা বাসনা-কামনাকে ত্যাগ করতে পারে, তাহলে সে দুঃখ নিরোধ করতে সক্ষম হবে এবং এভাবেই তাঁর নির্বাণ লাভ করা সম্ভব।

এই নির্বাণের স্বরূপটি কি? নির্বাণ কি দুঃখময়, নাকি তাতে অনন্ত সুখ রয়েছে? সেটাতে কি অভাব — স্বভাব ও অবাস্তব, কিংবা ভাবস্বভাব ও বাস্তব? সেটা কি জন্ম-মৃত্যুর অতীত শাশ্বত জীবন, নাকি শুধুই স্কুল দেহের নিশ্চিত বিনাশ? নির্বাণ কি শুধুই অহং-জ্ঞানের বিলোপ, নাকি সেটা একটি অবিমিশ্র সুখবাদ?

বোঝাই যাচ্ছে যে, নির্বাণতত্ত্ব নিয়েই যখন এত প্রশ্ন এবং তর্ক রয়েছে, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই নির্বাণ লাভ করবার পথ নিয়ে বৌদ্ধধর্মাচার্যদের মধ্যে বিরোধ এবং বিতর্ক দেখা দেওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। আর সেজন্যই রাজগৃহ, বৈশালী, পাটলিপুত্র এবং কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের সময়ে অনুষ্ঠিত মোট চারটি বৌদ্ধমহাসংগীতির অধিবেশনে বুদ্ধদেব প্রদত্ত ধর্মোপদেশের অত্থকথা বা ভাষ্য নিয়ে যে সমস্ত বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলো থেকেই বৌদ্ধধর্মাচরণের বিভিন্ন পদ্ধতি বা যানের সৃষ্টি হতে শুরু করেছিল। সেই যানগুলির মূল বক্তব্য কি ছিল? এবারে সেগুলি খুব সংক্ষেপে বোঝবার চেষ্টা করা যাক।

সেই যানগুলির মধ্যে প্রধান ছিল — মহাযান এবং হীনযান সাধনপন্থা। এই দু’দলের কিন্তু কিন্তু বুদ্ধদেব প্রদত্ত ধর্মোপদেশ নিয়ে কোনো ধরণের ঝগড়া বা মতবিরোধ ছিল না। তাঁদের মধ্যেকার কলহটা আসলে বুদ্ধের উপদেশগুলিকে পালন করে জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলবার সাধনপন্থা নিয়ে ছিল। চীনযানীরা তাঁদের সাধনার মূল উদ্দেশ্য হিসাবে নির্বাণলাভ করবার উপরে বিশ্বাস করতেন। সেই নির্বাণ বুদ্ধনির্দেশিত পথেই আসা সম্ভব, কিন্তু সেই পথটি হচ্ছে ধ্যান এবং অন্যান্য নৈতিক আচার-আচরণের অতি নিষ্ঠাপূর্ণ সাধনার পথ। সেখানে সাধককে শূন্যতার সাধনা করতে হবে, যে শূন্যতা অস্তিত্বকে অনস্তিত্বে মিলিয়ে দেওয়ায়, বিলুপ্ত করায় পাওয়া যাবে।

অন্যদিকে মহাযানীরা মনে করতেন যে, হীনযানীদের নির্বাণসাধনা বা অস্তিত্বকে অনস্তিত্বে মিলিয়ে দেওয়ার শূন্যতার সাধনা জিনিসটা সঠিক নয়, এমনকি সেই উদ্দেশ্যটাও সত্যি নয়। নির্বাণলাভ করবার সাধনার থেকে বুদ্ধত্বলাভ করবার সাধনাটাই তাঁদের কাছে বড় হয়ে উঠেছিল। বুদ্ধত্বলাভ বলতে তাঁরা বোধিচিত্তের অধিকার লাভ করাকে বুঝতেন। তাঁদের কাছে বুদ্ধত্বলাভ ছিল — শূন্যতা এবং করুণার একটা সমন্বয়। তাঁরা ভাবতেন যে, হীনযানীদের নিষ্ঠাপূর্ণ আচার-পরায়ণতাটা সঠিক ধর্মসাধনা নয়, যেমন — ব্রাহ্মণদের আচারসর্বস্ব যাগযজ্ঞ, মন্ত্রপাঠ, বলিদান, স্নান-ধ্যান-তর্পণও মোক্ষলাভের প্রকৃত উপায় নয়। তাঁদের অভিমত ছিল যে, ধর্মসাধনাটাকে এই পর্যায়ে রাখলে শেষে সেটা একটা শুষ্ক আচারপরায়ণতায় পর্যবসিত হয়ে যাবে। সেটাকে ব্যক্তিগত উপলব্ধি সাধনা এবং সিদ্ধির বস্তু করে তুলতে হবে। তাই সেখানে কোন গণ্ডীবদ্ধ নৈষ্টকতায় আবদ্ধ থাকলে চলবে না — সেখানে মনোময় ব্যক্তি-সাপেক্ষতার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এবং আচারনৈষ্ঠিকতাকে বর্জন করতে হবে। তাই মহাযানী ধর্ম-সাধনায় সাধকের নিয়মনিষ্ঠ বস্তুতান্ত্রিক কঠোর আচার পরায়ণতা থেকে মুক্তি পাওয়ার অবকাশ ছিল। আর সেই মুক্তির অবকাশ ছিল বলেই মহাযানী সাধন-পদ্ধতিতে সমসাময়িক বিভিন্ন অবৌদ্ধ ধর্মের নানা ধারার অনুপ্রবেশ ঘটবার সুযোগ বেশি পরিমাণে হয়েছিল। এবং সেই সুযোগেই, বিশেষ করে বঙ্গদেশে খৃষ্টীয় অষ্টম-নবম শতকে মহাযানপন্থী বৌদ্ধধর্মে নানারকমের তান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার ছোঁয়া এসে লেগেছিল। চর্যাপদের সমসাময়িক কালে বা সেটার সামান্য আগেই — গুহ্য সাধনতত্ত্ব পূজা আচার ও নীতিপদ্ধতির প্রয়োগ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।

অনেকে বলেন যে, সেই তান্ত্রিক আচার আচরণের, মন্ত্র তন্ত্র গুহ্য সাধনতত্ত্বের যে অনুপ্রবেশ মহাযানীপন্থায় ঘটেছিল, সেটার পিছনে একটা গূঢ় সমাজতাত্ত্বিক কারণ ছিল। সেই সময়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মেও তান্ত্রিকতা, রহস্যময় গুহ্য গূঢ়ার্থক মন্ত্র যন্ত্র ধারণী বীজ মণ্ডল — এসমস্ত কিছু অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল। এর পিছনে মূল কারণ ছিল যে, ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধধর্ম — উভয়েই সি সময়ে নিজেদের প্রভাবের সীমাকে আরেকটু বাড়িয়ে আদিম কৌম-সমাজের উপরে সর্বাত্মক প্রতিষ্ঠা বিস্তার করতে চেয়েছিল। পর্বতের গুহায় এবং অরণ্যের অন্তরালে যেসব আদিম অধিবাসীরা তখন বহু যুগ ধরে নিজেদেরকে ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধধর্মের প্রভাবের বাইরে রেখে স্বকীয় সহজ স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে পেরেছিলেন, তাঁদের নিজস্ব পূজাপদ্ধতি ধর্মাচরণ এবং অনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মে ভূত প্রেত ডাকিনী যোগিনী পিশাচ মায়া মন্ত্র যন্ত্র গূঢ়ার্থক অক্ষর — এক কথায় অলৌকিক অপ্রাকৃত জাদুশক্তির উপরে বিশ্বাস প্রধান ছিল। তাঁদেরকে নিজেদের প্রভাবের মধ্যে আনতে গিয়ে হয়ত সেই সময়কার ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধধর্মগুরুরা সহজ সমাজতাত্ত্বিক যুক্তিতে সেইসব আদিম কৌমসমাজের জাদুশক্তিতে বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন, এবং সেই কারণেই বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মে মন্ত্র-তন্ত্রের অনুপ্রবেশ হয়ে থাকতে পারে। এই প্রসঙ্গে এরকম কথাও প্রচলিত রয়েছে যে, বৌদ্ধ আচার্য অসঙ্গ নাকি সেইসব জিনিসকে মহাযানী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আবার, এরকমও হওয়া সম্ভব যে — সেযুগের আদিম কৌমসমাজের যাঁরা বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্যধর্মে স্বেচ্ছায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা নিজেদের জপ তপ ধ্যান ধারণা আচার অনুষ্ঠান ক্রিয়াপদ্ধতি ইত্যাদি সবকিছু নিয়েই নতুন ধর্মে যোগ দিয়েছিলেন। পরে হয়ত বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ ধর্মগুরুরা আদিম কৌমসমাজের ধর্মবিশ্বাসগুলিকে সংস্কার ও শোধন করে নিয়েছিলেন। এসমস্ত কারণের মধ্যে কোনটা তখন অধিকতর সম্ভব হয়েছিল, সেকথা এখন আর সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ওই ধরণের একটা সমন্বয় যে পূর্বভারতের বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মে খৃষ্টীয় অষ্টম-নবম শতক বা তার কিছু আগে থেকেই সম্ভব হয়েছিল — একথা জোর দিয়ে বলা চলে; শুধু — কি করে সেই তান্ত্রিক বিবর্তনটি ঘটেছিল — সেটার সঠিক কোন কারণ উল্লেখ করা সম্ভব নয়। নানা ঐতিহাসিকেরা নানাভাবে সেই কারণটি সম্পর্কে অনুমান করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে ডঃ নীহারঞ্জন রায়ের অনুমানটি নিম্নরূপ ছিল — “খ্রীস্টোত্তর সপ্তম শতকের মাঝামাঝি হইতেই হিমালয়-ক্রোড়স্থিত পার্বত্য-কান্তারময় দেশগুলির সঙ্গে গাঙ্গেয় প্রদেশের প্রথম ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হয়, এবং কাশ্মীর তিব্বত নেপাল ভোটান প্রভৃতি দেশগুলির সঙ্গে মধ্য ও পূর্ব-ভারতের আদান-প্রদান বাড়িয়া যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্রীয় দৌত্য বিনিময়, সমরাভিযান প্রভৃতি আশ্রয় করিয়া এইসব পার্বত্য দেশের আদিম সংস্কার ও সংস্কৃতির স্রোত বাংলা বিহারে প্রবাহিত হইতে আরম্ভ করে। তাহার কিছু কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণও বিদ্যমান। সপ্তম-শতকের পূর্ব-বাংলার খড়্গ-রাজবংশ বোধ হয় এই স্রোতেরই দান। ধর্মপাল ও দেবপালের কালে এই যোগাযোগ আরও বাড়িয়াই গিয়াছিল। পরবর্তীকালে আমরা যাহাকে বলিয়াছি তান্ত্রিক ধর্ম তাহার একটা দিক এই যোগাযোগের ফল হওয়া একেবারে অস্বাভাবিক হয় তো নয়। তন্ত্রধর্মের প্রসারের ভৌগোলিক লীলাক্ষেত্রের দিকে তাকাইলে এ-অনুমান একেবারে অযৌক্তিক বলিয়া মনে হয় না।” পরবর্তী সময়ের সিংহভাগ ঐতিহাসিকই এই অনুমানটিকে সর্বাপেক্ষা সঙ্গত এবং যুক্তি-সম্পন্ন বলে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন।

যাই হোক, মহাযানী সাধন-পদ্ধতিতে আদিম কৌমসমাজের বা এখনও পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত অন্য কোনো সূত্র থেকে আগত সেই মন্ত্র তন্ত্র এবং নতুন ধ্যান কল্পনার প্রতিষ্ঠার ফলে মহাযানী ধর্মাচরণের মধ্যে নানা বিবর্তনের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই বিবর্তনের প্রথম ধাপ ছিল মন্ত্রযান — যেটার মূল প্রেরণা ছিল মন্ত্র, এবং সেই মন্ত্র থেকে ধারণী ও বীজ। সেই নতুন ধারণা যে বৌদ্ধাচার্যরা প্রবর্তন করেছিলেন, তাঁদের মন্ত্রযানী সম্প্রদায় বলা হয়েছিল। সেই সম্প্রদায়টি প্রাচীন মহাযানী ধারণার মূল আশ্রয় — শূন্যবাদ, বিজ্ঞানবাদ, যোগাচার, মাধ্যমিকবাদ ইত্যাদি কিছুই বুঝতেন না; কিংবা বুঝলেও সেসব নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাতেন না। হয়ত তাঁদের কাছে নতুনতর ধারণাটিই অধিকতর সহজ ও সত্যি বলে মনে হয়েছিল।

এভাবেই আরেকটি শাখার সৃষ্টি হয়েছিল, সেটার নাম ছিল — বজ্রযান। বজ্রযানীরা মনে করতেন যে, নির্বাণের পরের তিনটি অবস্থা হল — শূন্য, বিজ্ঞান ও মহাসুখ। শূন্যতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা নাগার্জুন বলেছিলেন যে, মানুষের সমস্ত দুঃখ, কর্ম, কর্মফল, চারিদিকের সংসার এবং সংসারের সমস্ত মোহ আকর্ষণ ও আকাঙ্ক্ষা — সবই শূন্য; এই শূন্যতার পরম জ্ঞানই হচ্ছে নির্বাণ। এই যে শূন্যতার পরমজ্ঞান, সেটাকে বলা হয়েছিল নিরাত্মা, এবং তিনি দেবীরূপে কল্পিত হয়েছিলেন বলে তাঁর নামকরণ করা হয়েছিল — নৈরাত্মা দেবী। সাধকের বোধিচিত্ত যখন নিরাত্মায় বিলীন হয়ে যায়, তখন মহাসুখের জন্ম হয়। নরনারীর দৈহিক মিলনের ফলে যে পরম আনন্দ, যে এককেন্দ্রিক উপলব্ধিময় ধ্যান — সেটাকেই বজ্রযানীরা বোধিচিত্ত বলেছিলেন। সাধক যদি তাঁর ইন্দ্রিয়শক্তিকে সম্পূর্ণ দমন করতে পারেন, তাহলে সেই বোধিচিত্ত বজ্রের মত কঠিন এবং দৃঢ় হবে। বোধিচিত্ত সেই বজ্রভাব পেলে তবেই বোধিজ্ঞানের উন্মেষ হওয়া সম্ভব। চঞ্চল চিত্তকে সেই বজ্রভাবে নিয়ে যাওয়ার যে সাধনা — সেটাকেই বলা হয় বজ্রযান। বজ্রযানে নরনারীর দেহমিলনের কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি আবার ইন্দ্রিয়শক্তিকে দমনের কথাও বলা হয়েছে — সেক্ষেত্রে এই জিনিসটা একটু গোলমেলে ঠেকতে পারে। সেই সংশয়কে দূর করবার জন্য সিদ্ধাচার্যরা জানিয়েছিলেন যে, ইন্দ্রিয়কে দমন করতে হলে আগে সেই ইন্দ্রিয়কে জাগিয়ে তুলতে হবে, মৈথুন হল সেই জাগরণের উপায়। মৈথুনজাত আনন্দ বা সাধকের বোধিচিত্তকে মন্ত্রশক্তির সাহায্যে স্থায়ী করা সম্ভব; আর সেই মন্ত্র সাধনার শক্তিতে মৈথুনজাত আনন্দ থেকে বিভিন্ন দেবদেবীরা জন্ম নেবেন, এবং তাঁরা সাধকের ধ্যানচক্ষুর সামনে এক একটি মণ্ডলে অধিষ্ঠিত হবেন। সাধক যদি সেই মণ্ডলগুলির সম্যক ধ্যান করতে থাকেন, তাহলেই তাঁর বোধিচিত্ত স্থায়ী স্থির দৃঢ় এবং কঠিন হয়ে ধীরে ধীরে বোধিজ্ঞানে বিলীন হয়ে যাবে। যখন সমস্ত ইন্দ্রিয় দমিত হয়ে যাবে, এবং সমস্ত কামনাবাসনা অন্তর্হিত হয়ে যাবে — তখন সাধক পরমজ্ঞান লাভ করতে পেরেছেন বলা হবে। বলা বাহুল্য যে, এই সাধনপদ্ধতি অত্যন্ত গুহ্য ও কঠিন; আর সেটার থেকেও কঠিন হল — যে ভাষায় এবং যে শব্দে এই সাধনপদ্ধতিকে বোঝানো হয়েছিল। উপযুক্ত গুরু ছাড়া অন্য কেউ এই সাধন পদ্ধতিকে বোঝাতে পারেন না, আর প্রকৃত গুরুর কাছে দীক্ষা না পেলে কোনো শিষ্যের পক্ষেই এই সাধন পদ্ধতি বুঝতে পারা সম্ভব নয়। গুরুই এই সাধনপদ্ধতিকে বুঝিয়ে না দিলে কেউ সেটাকে অনুসরণ করতে পারবে না — তাই, বজ্রযানে গুরু ছাড়া কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়, গুরুকৃপা না থাকলে সাধকের পক্ষে সিদ্ধিলাভ করা অসম্ভব।

বজ্রযানে মন্ত্র, গুরু, দেবদেবী এবং তাঁদের ধ্যান দেখতে পাওয়া যায়। এই সাধনার বিবর্তিত সূক্ষ্মতর স্তরের নাম হল — সহজযান। সহজযানীরা আবার দেবদেবী, মন্ত্রতন্ত্র, আচার অনুষ্ঠান, ধ্যান, জপতপ — কোনো কিছুকেই স্বীকার করেন না। শুধু সেটাই নয়, বৌদ্ধধর্মের কৃচ্ছ-সাধনা, পূজার্চনা, প্রব্রজ্যা — এসবও তাঁরা স্বীকার করতেন না। তাঁরা এককথায় বলে দিয়েছিলেন — “দেহহি বুদ্ধ বসন্ত ন জাণই”; অর্থাৎ — মূর্খ তুমি জান না যে দেহের মধ্যেই বুদ্ধ বা পরমজ্ঞান অবস্থান করছেন। তাঁরা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে, শূন্যতা হল প্রকৃতি আর করুণা হল পুরুষ। এই শূন্যতা এবং করুণা, বা নারী ও নরের মিলনে যে মহাসুখ — সেটাই হল ধ্রুবসত্য। এই মহাসুখে উপনীত হতে পারলে বা ধ্রুবসত্যকে বুঝতে পারা গেলে, সমস্ত ইন্দ্রিয়কামনা নষ্ট হয়ে যাবে। সংসারের ভালো-মন্দের ধ্যানধারণা, আত্ম-পর ভেদবুদ্ধি ইত্যাদি সমস্ত সংস্কার বিলুপ্ত হয়ে যাবে — সেটাই হচ্ছে সহজ অবস্থা। এর জন্য কোন মূর্তি লাগে না, কোন তন্ত্র লাগে না, কোন মন্ত্র লাগে না; এক্ষেত্রে জপ তপ ধ্যান নৈবেদ্য দীপ ধূপ — সমস্ত কিছুই অপ্রয়োজনীয় ও অবান্তর; সমস্ত শাস্ত্রজ্ঞান ও শাস্ত্রীয় আচার নিরর্থক। সহজ সাধকেরা শূন্যবাদ বিজ্ঞানবাদ ইত্যাদি সমস্ত কিছুকে বর্জন একমাত্র দেহবাদ বা কায়াসাধনের পথকে আঁকড়ে ধরেছিলেন।

সহজ সাধকদের ধর্মমতে ব্রাহ্মণদের আচার-অনুষ্ঠান এবং বৈদিক সংস্কার-প্রণোদিত ধর্মসাধনার ব্যাপারে সর্বপ্রধান আপত্তি ছিল। বজ্রযানের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য ছিল যে — বজ্রযানে মন্ত্রের মূর্তিরূপের অজস্রতা, মন্ত্র-তন্ত্র আচার-অনুষ্ঠান-পুজা এসব নিয়েই বজ্রযানের সাধনপথ জটিল ও বহুধাবিস্তৃত। সহজ সাধকরা কাঠ মাটি পাথরের যেকোন ধরণের দেবমূর্তির সামনে প্রণত হওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন, তাঁরা ব্রাহ্মণদের ঘোরতর শত্রু ছিলেন; এমনকি যেসব বৌদ্ধরা মন্ত্র-তন্ত্র, ধ্যান-ধারণা, কৃচ্ছসাধন প্রব্রজ্যা ইত্যাদিকে মুক্তিলাভের উপায় বলে মনে করতেন, এঁরা তাঁদেরকেও কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছিলেন। সহজযানীরা স্পষ্টই বলেছিলেন, “বোধি বা পরমজ্ঞান লাভের খবর অন্য সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, বৃদ্ধদেবও জানিতেন না — বুদ্ধোহপি ন তথা বেত্তি যথায়মিতরো নরঃ। ঐতিহাসিক বা লৌকিক বুদ্ধের স্থানই বা কোথায়! সকলেই তো বুদ্ধত্ব লাভের অধিকারী এবং এই বৃদ্ধত্বের অধিষ্ঠান দেহের মধ্যে।”

এই প্রসঙ্গে সহজযানীদের মূল বক্তব্য — কঠিন সংযম পালন করা — আসলে একধরণের নেতিমূলক অস্বাভাবিকতা ছিল, এবং সেই অন্যায় অস্বাভাবিকতা ক্রমে মানুষের মনের মধ্যে একটি অস্বাস্থ্যকর বিকৃতির জন্ম দিয়েছিল। মানব দেহ ও মন সহজ স্বাভাবিক মানবোচিত সমস্ত সুখ ভোগ করতে চায়, যেটা তাঁকে অনাবিল তৃপ্তি ও আনন্দ দেবে। কিন্তু শাস্ত্রের নামে, পুণ্যের নামে, আচারের নামে, ঈশ্বর সাধনার অজুহাতে মানুষ সেই সহজ স্বাভাবিক স্বাস্থ্যকর কামনা-বাসনাকে অবদমিত করে ফেলেছে, ফলে মানুষ দুরারোগ্য মানসিক রোগে কাতর হয়ে পড়েছে। সেজন্যেই সহজিয়াদের দাবী ছিল যে, মানবিক বৃত্তির উপরেই ধর্মসাধনার সমস্ত পথকে নির্দিষ্ট করতে হবে; কারণ — মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। সংস্কারের বন্ধনের মধ্যে মুক্তি-পিয়াসী মানব-মনকে শৃঙ্খলিত করাটা কখনোই ধর্মসাধনার পথ হতে পারে না, চরম মুক্তির পথ তো নয়ই। অতএব দেহকে স্বীকার করতে হবে, দেহজ কামনা-বাসনাকে অস্বাভাবিকভাবে দমন বা ধ্বংস না করে সেটার সহজ স্বাভাবিক রূপান্তর বা উন্নতির (Sublimation) কথা চিন্তা করতে হবে। সহজ সাধনা মানে কিন্তু ইন্দ্রিয়-সুখে অহরহ ডুবে থাকা নয়, বা অনৈতিক দেহসম্ভোগ বা ব্যভিচারের জোয়ারে ভেসে যাওয়া নয়, অর্থাৎ — এককথায় সহজ সাধনা নেতিমূলক নয়। সহজ সাধনায় মানবচিত্তের পূর্ণতা ও মুক্তির পথে অনৈসর্গিক ও কৃত্রিম সংযমের প্রতি প্রতিবাদই প্রবলভাবে ধ্বনিত হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে এখানে আরেকটি যান বা সাধনপদ্ধতি নিয়েও কিছু বলা যেতে পারে। সেটি হল — কালচক্রযান। এই যানের সাধকেরা শূন্যতা এবং কালচক্রকে এক এবং অভিন্ন বলে মনে করতেন। এই সবদর্শী এবং সর্বজ্ঞ কালচক্র ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘূর্ণায়মান এবং এই কালচক্রই আদিবুদ্ধ ও সমস্ত বুদ্ধের জন্মদাতা। এই কালচক্রকে নিরস্ত করা কিংবা নিজেদেরকে কালের প্রভাবের উপরে নিয়ে যাওয়ার কঠিন সাধনাই হচ্ছে — কালচক্রযান সাধনাপদ্ধতি। সেটা কিভাবে সম্ভব? কালচক্রযানীরা বলেছিলেন যে, কার্যপরম্পরা বা গতির বিবর্তন দেখেই মানুষ কালের ধারণায় পৌঁছাতে পারে। কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই কার্যপরম্পরা অন্য কিছুই নয়, প্রাণক্রিয়ার পরম্পরা মাত্র। যোগের দ্বারা যদি এই প্রাণক্রিয়াকে রুদ্ধ করে রাখা হয়, দেহের মধ্যে থাকা নাড়ী এবং নাড়ীকেন্দ্রগুলিকে যদি নিশ্চল করে দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলেই কাল নিরস্ত হতে পারবে। কালের সঙ্গে সম্বন্ধ আছে বলে কালচক্রযানীদের সাধনায় তিথি, বার, গ্রহনক্ষত্র — এককথায় গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যার প্রচলন খুব বেশী ছিল। পণ্ডিতেরা বলেন যে, কালচক্রযানের উৎপত্তি ভারতবর্ষের বাইরে তিব্বতে হয়েছিল, এবং পালরাজাদের আমলে এই মতবাদকে বাঙলায় নিয়ে আসা হয়েছিল।

বজ্রযান সাধনপদ্ধতির অপরিহার্য অঙ্গ ছিল গুরু বা সাধনপথ-নির্দেশক ও পরিচালক। গুরুরা সাধনমার্গের কোন পথে শিষ্যের স্বভাবগত প্রবণতা রয়েছে, সেটা গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে তবেই সেই সম্বন্ধে কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসতেন। সেই বিচার-পদ্ধতিকে কুলনির্ণয় পদ্ধতি বলা হত। ডোম্বী, নটী, রজকী, চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণী — এই পাঁচ রকমের কুল প্রজ্ঞার পাঁচটি রূপ। ভৌতিক মানবদেহ আবার পাঁচটি স্কন্ধ — রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, বিজ্ঞান ও সংস্কার — এগুলির সারোত্তম দ্বারা গঠিত। যে সাধকের মধ্যে যে স্কন্ধটি বেশি শক্তিশালী বা সক্রিয় — সেই অনুযায়ী তাঁর কুল নির্ণয় করা হত, এবং তাঁর সাধনপন্থাও সেই অনুসারে ঠিক করা হত। গুরুই সেসব ঠিক করে দিতেন বলে গুরু ছাড়া বজ্রযান সাধনা অচল ছিল।

বজ্রযানের দেবদেবীর সংখ্যাও আবার কম কিছু নয়। আগেই বলা হয়েছে যে, বজ্রযোগে সাধক স্থিতনিষ্ঠ হলে তাঁর ধ্যানচক্ষুতে এক-একটি দেবদেবী জন্ম নেন এবং তাঁদের জন্য নির্ধারিত মণ্ডলে তাঁরা আশ্রয় নেন বলে বজ্রযানীরা বিশ্বাস করতেন। সেইসব দেবদেবীর মধ্যে — হেবজ্র, বজ্রসত্ত্ব, হেরূক, মহামায়া, বজ্রযোগিনী, সিদ্ধবজ্রযোগিনী, বজ্রধর, বজ্রভৈরব — ইত্যাদির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। বাঙালী বৌদ্ধ পণ্ডিত এবং সিদ্ধাচার্যরা সেইসব দেবদেবীর স্তুতিগান করে অসংখ্য গ্রন্থ খৃষ্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচনা করেছিলেন। তবে সেগুলোর অধিকাংশই হয় বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, কিংবা আজও অপরিজ্ঞাত কোন জায়গায় আত্মগোপন করে রয়েছে; সেগুলির মধ্যে সামান্য কিছুমাত্র বর্তমান সময়ের গবেষকদের হাতে এসেছে।

চর্যাপদের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মমতের মহাযানীশাখার এই নানা বিবর্তিতরূপের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ বলেই চর্যাপদের ধর্মমতের আলোচনার ব্যাপারে এগুলোর গুরুত্ব রয়েছে। তবে চর্যাচর্য-বিনিশ্চয়ের মধ্যে সহজ বা মন্ত্র বা বজ্রযান কিংবা কালচক্রযানের কোনো একটি যানের কথাই প্রধান নয়। বৌদ্ধধর্মের সব যানেরই কিছু কিছু কথা চর্যাগীতিগুলিতে রয়েছে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অবশ্য বলেছিলেন যে, চর্যাগীতিগুলি বৌদ্ধ সহজিয়ামতের বাঙলা গান। সেই অনুযায়ী অধ্যাপক মণীন্দ্রমোহন বসু সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে — ৩, ৯, ১৯, ২৮, ৩০, ৩৭ ৩৯, ৪২, ৪৩ ইত্যাদি সংখ্যক চর্যাগীতিগুলি স্পষ্টতঃই সহজিয়া মতের বাহক। তবে কোনো কোনো চর্যায় বজ্রযানের কথা যে নেই — এমনটা কিন্তু নয়। লুইপাদ, কুক্কুরীপাদ, কাহ্নপাদ, বিরূবার চর্যায় যেভাবে ধ্যান, ধমন-চমণ পিঁড়ি, আটকামরা ঘর, বজ্রসাধনা, অবধূত এবং গুরুপ্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে — সেগুলো থেকে একথা অনুমান করা স্বাভাবিক যে, তাঁরা বজ্রযানসাধনার দিকেই বেশি জোর দিয়েছিলেন। চর্যাপদে যে সমস্ত লৌকিক জগতের বস্তুকে ধর্মীয় প্রতীক হিসাবে সিদ্ধাচার্যরা গ্রহণ করেছিলেন, এবং চর্যাপদের ভাববস্তুর মধ্যে যে গুহ্য গূঢ়ার্থক সংকেত রয়েছে — সেগুলো থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সিদ্ধাচার্যরা বজ্রযানের প্রতিই বেশি পক্ষপাতী ছিলেন। আবার একই চর্যায় সহজযান এবং বজ্রযানের পাশাপাশি অবস্থিতির বা ইঙ্গিতের অভাব রয়েছে — এমনটাও কিন্তু নয়। সেজন্যই চর্যাপদ নিয়ে সম্ভবতঃ একথা বলা সবথেকে নিরাপদ এবং যুক্তিসংগত যে, — চর্যাপদে কোনো একটা বিশেষ যানের সাধনপদ্ধতিকে বড় করে দেখানো হয় নি; মহাযানী সাধনার বিবর্তিত বিভিন্ন যানের সমন্বয়ই সেখানে প্রকাশিত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোনো কোনো চর্যায় দেহবাদ এবং দেহ-সাধনার কথা যেমন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, তেমনি কোনো কোনো পদাবলীতে মন্ত্রসাধনা এবং বজ্রযোগের কথা বলা হয়েছে বলেই নিঃসংশয়িতভাবে সেগুলিকে এক-একটা যানের অন্তর্ভুক্ত করা হবে বা করা উচিত — এই ধরণের কোন সংস্কার মনের মধ্যে না রাখাই ভালো।
আসলে চর্যার মাধ্যমে যে ধর্মসাধনার কথা সিদ্ধাচার্যরা বলতে চেয়েছিলেন, সেটা মনোময় অনুভূতিপ্রধান একটা মহৎ উপলব্ধি। আর সেজন্যই সেটা রহস্যময়, কাব্যময়, সাধারণবুদ্ধির অতীত — দিগন্তের আধো-আলো-অন্ধকারের অচেনা দীপ্তিতে অস্পষ্ট। এই ধরণের জিনিস তখনই জন্ম নিতে পারে যখন ধর্মগুরুরা ধর্মের লৌকিক আচার অনুষ্ঠান ক্রিয়াপদ্ধতি থেকে নিজেদের চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ধর্মের মনোময় উপাদানের উপরে নিজেদের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করেন। ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত দেখিয়েছিলেন যে, উপনিষদের ধর্মসাধনার সম্পূর্ণ আত্মলীন মনোময় স্বভাবের ধারা পরবর্তীকালের যোগীদের ধর্মসাধনায় এবং আরো পরে মধ্যযুগের সন্ত সাধকদের ধর্মচর্চার মধ্যেও অব্যাহত ছিল। চর্যাপদও সেই ঐতিহ্যের বাইরে নেই, সেই প্রবাহকে অস্বীকার করবার উদ্বেগ-ব্যাকুল চঞ্চলতাও চর্যাপদের মধ্যে দেখা যায় না। এই ‘Subjectivity’–র দিকে সাধক যখন যান, তখন তিনি কোন বাঁধা রাস্তায় চলেন না, তিনি আশেপাশের দিকে তাকান, আর সেই চারপাশের চিন্তার জগতে যদি তিনি এমন কোনো উপাদান দেখেন যা তাঁর নিজের ভাবনার সঙ্গে মিলে যেতে পারে, তাহলে তখন তিনি পরম আদরে সেটাকে নিজের মনে স্থান দিয়ে জীবনসাধনায় রূপায়িত করে ফেলেন। এটাই হচ্ছে জীবন্ত ধর্মের লক্ষণ, সেটা নানা সাধনা নানা ভাবনা বহুতর উপলব্ধি এবং বিচিত্র কল্পনার সমন্বয়ে ক্রমবর্ধিত হয়। হিন্দুধর্মে, বৌদ্ধধর্মে, জৈনধর্মে — আবার হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাখায় — শৈবধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, শাক্তধর্ম, সহজিয়াধর্ম থেকে শুরু করে আধুনিক কালের ব্রাহ্মধর্মে পর্যন্ত এই সমন্বয় ও মিলনের সুর অব্যাহত রয়েছে; আর সেটা অব্যাহত রয়েছে বলেই সবগুলি আজও কমবেশি স্বীকৃত এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে চর্চিত হয়ে আসছে। অতীতের যেসব ধর্ম শেষপর্যন্ত আচার-অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হয়েছিল, মনোময়তার স্থান যেখানে অবজ্ঞাত এবং অস্বীকৃত, সেগুলো ধীরে ধীরে কালের গর্ভে মিলিয়ে গিয়েছে। হিন্দুধর্মে এই মনোময়তার স্থান যেমন সর্বোচ্চ, বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রেও সেটাই। তাই একদিন এই ধর্ম দুটো মিলে মিশে যেতে পেরেছিল, কিংবা দুটোর থেকেই সংঘর্ষজাত একটি তৃতীয় ধারা জন্ম নিয়ে দুটোরই গুরুত্বকে বুঝবার অবকাশ সৃষ্টি করেছিল।

চর্যাপদেও এই ধর্মসমন্বয়ের আদর্শ অব্যাহত রয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। কারণ, চর্যাপদের সাধকেরা মনোময়তার উপরে বা ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্তের কথানুসারে — ধর্মের ‘Subjective element’–এর উপরেই বেশি জোর দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে অন্য যে বিষয়টা লক্ষ্যণীয়, সেটা হল যে, চর্যাপদের সিদ্ধাচার্যদের অধিকাংশই বাঙালী ছিলেন, এবং বাঙালী স্বভাবের চিরন্তন ঐতিহ্য অনুযায়ী সব জিনিসেরই ‘Subjectivity’–র দিকে আকৃষ্ট হওয়ার মহৎ প্রবণতা থেকে তাঁরা কেউই মুক্ত ছিলেন না। আবার বাঙালী চরিত্রের অন্যতম প্রধান বিশেষত্ব — সংস্কারমুক্ত হওয়া, গোঁড়ামি বর্জন করা, — এসবও সিদ্ধাচার্যদের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিল না। এই দ্বিবিধ গুণের জন্যই তাঁরা যেমন প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে চর্যাপদের মানবতাবোধজাত সমন্বয়ের দিকে কখনও সোজাসুজি বা কখনও আবার সবার অলক্ষ্যে পদক্ষেপ করেছিলেন, তেমনি কখনও বা মন্ত্রতন্ত্র ধ্যান জপ তপ আচার ও অনুষ্ঠানের মরুবালুরাশিতে শুষ্কপ্রায় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অসারতার দিকে সাধকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও দ্বিধা করেন নি। চর্যাপদের মধ্যে দিয়ে যে ধর্মমত সিদ্ধাচার্যরা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, সেটা মূলতঃ মনোময় অনুভূতি-প্রধান ও উপলব্ধিসর্বস্ব ছিল, — তাই সেটা সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন হতে পেরেছিল। যে গুণের জন্য উপনিষদ ধর্মব্যাখ্যা হয়েও দর্শন ও কাব্যের সামগ্রী, চর্যাপদের সঙ্গে উপনিষদের গুণগত বিরাট পার্থক্য থাকলেও — চর্যাপদও সেই একই গুণের জন্য একটি ধর্মগ্রন্থ হয়েও কাব্যগীতি। এই ধর্ম এবং কাব্যের দুর্লভ সমন্বয় বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের মাধ্যমেই প্রথম ঘটেছিল, এবং সেজন্যই বাংলা কাব্যের উষালগ্নে সৃষ্ট চর্যাপদ আজও একটি উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!