।। পর্ব ২৬।।
দিনটা ছিল ২০০৬-এর ২৫ সেপ্টেম্বর। আঁধারগ্রামের মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উনি যেতেই আন্দোলনের চেহারা নতুন একটা মাত্রা পেল। ওখানে দাঁড়িয়ে মমতা প্রশ্ন তুললেন, ওঁরা কর্মসংস্থানের কথা বলছেন? মাত্র আট মাস আগে ৩১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা এন জি এম সি-কে তা হলে ওঁরা তুলে দিলেন কেন? চোদ্দো হাজার পাঁচশো শ্রমিকের হাতে জোর করে ভি আর এস তুলে দিলেন কেন? ওই কোম্পানির অধীনেই তো পাঁচশো আটষট্টি একর জমি আছে। টাটারা শিল্প করতে চাইলে ওখানে গিয়ে শিল্প করুন না। সরকার তো ইস্কোর কুলটি কারখানার আটশো পঞ্চাশ একর জমি বিক্রির অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। সেখানে শিল্প করুন। উত্তর চব্বিশ পরগনায় বত্রিশটি কারখানা বন্ধ। সেগুলোর জমির পরিমাণ কম করেও সাড়ে পাঁচ হাজার একর। ওখানে শিল্প করা যায় না?
শুধু নতুন নতুন জমি নেওয়া, না? কী চুক্তি হয়েছে টাটা-সেলিমদের সঙ্গে? কত টাকায় রফা হয়েছে? কোন কোন নেতা কত টাকা করে বখরা খেয়েছে আমরা জানি না?
ইতিমধ্যেই এই সরকার ছ’লাখ একর অত্যন্ত উর্বর কৃষিজমি বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে বাংলায় সব কিছু থাকা সত্ত্বেও বাইরে থেকে এখন খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে। আমি জানতে চাই, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী কি এ রাজ্যের মানুষদের ভাতের হাঁড়ি বন্ধ করে দিতে চান? এই সরকার শুধু পুলিশের লাঠি বা গুলি দিয়ে নয়, মানুষকে ভাতে মারারও চক্রান্ত করছে। যা আসলে এক ধরনের গণহত্যা। এই সরকারের আর্থিক সমীক্ষাই বলছে, এখানে খাদ্যের প্রয়োজন মাথা পিছু চারশো যাট গ্রাম। অথচ উনিশশো আটানব্বই সালে এ রাজ্যে মাথা পিছু দৈনিক খাদ্য উৎপাদন হত চারশো একান্ন গ্রাম। মানে ন’গ্রাম কম। তার পরেও প্রচুর চাষের জমি বিক্রি করে দিচ্ছে এই সরকার। পাশাপাশি জনসংখ্যাও বেড়েছে। ফলে দু’হাজার এক সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে চারশো তেরো গ্রামে। এখন তো আরও কম। যেখানে অলরেডি খাদ্যে ঘাটতি চলছে, সেখানে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে এই বাংলাকে আরও খাদ্য সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? ওঁরা কি এই রাজ্যটাকে শ্মশান বানাতে চাইছেন? আমরা তা হতে দেব না। কিছুতেই না।
এঁরা করবে শিল্প? ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে প্রায় ছাপ্পান্ন হাজারেরও বেশি কলকারখানায় ওঁরা তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। শুধু রেজিস্ট্রিকৃত বেকারের সংখ্যাই চুয়াত্তর লক্ষের উপরে। নথিভুক্তদের কথা না হয় বাদই দিলাম। সেই সঙ্গে রয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি সরকারি টাকার নয়-ছয়। এক-এক নেতার নামে কোটি কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ। কেউ কেউ তো জেরার মুখে সে সব স্বীকারও করে নিয়েছেন। কিন্তু দলের লোক বলে কিংবা তাঁদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বা সামান্যতমও কোনও ব্যবস্থা নিতে গেলে, তাঁরা বাকিদেরও কাছা খুলে দিতে পারেন, এই ভয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি কেউ। শুধু সতর্ক করে ছেড়ে দিয়েছে। আর কাউকে কাউকে শাস্তিস্বরূপ বলেছে, তছরুপের একটা অংশ পার্টি ফান্ডে দান করতে, ব্যস।
একটু চোখ খুলে তাকালেই দেখতে পাবেন, এই সরকারের সমস্ত স্তরে দুর্নীতির পাহাড় জমা হয়েছে। শুধু মুখে বড় বড় কথা। আমরা এই করেছি, ওই করেছি, সেই করেছি। বামফ্রন্ট সরকারের এই ধাপ্পাবাজি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার আপামর সাধারণ মানুষ যখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছেন, ঠিক তখনই এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সমস্ত ব্যর্থতা, অপদার্থতা, অক্ষমতা আর স্বজনপোষণের নগ্ন ছবি ধামাচাপা দিতেই শিল্পায়নের নামে এই নতুন জিগির তুলছেন। আপনাদের উচ্ছেদ করতে চাইছেন। আপনারা ভয় পাবেন না। জানবেন, আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম, আছি, থাকব।
শুধু মুখের কথা নয়, সে দিন সারাক্ষণই ওখানকার স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে ছিলেন তিনি। কথা বলেছিলেন তাঁদের সঙ্গে। ধৈর্য ধরে শুনেছিলেন সব অভিযোগ, অনুযোগ। তার পরিপ্রেক্ষিতে নানা আলোচনাও করেছিলেন। আতঙ্কগ্রস্ত লোকগুলোকে নির্ভয়ও দিয়েছিলেন। আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে, তিনি তাঁদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকবেন।
দুপুর থেকে বিকেল। বিকেল থেকে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছিল। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, ক’টা নাগাদ ওখান থেকে উনি বেরোবেন। সেই হিসেব করে মাকেও কথা দিয়ে এসেছিলেন। ওরা যা শুরু করেছে, রাস্তাঘাটে যদি কোনও কারণে তাঁকে আটকায়ও, কোনও সমস্যায় ফেলার চেষ্টাও করে, তা হলেও, হয়তো একটু দেরি হবে ঠিকই, কিন্তু যত রাতই হোক, তিনি ঠিক ফিরে আসবেন। সেই মতো সব ব্যবস্থা পাকা করাই ছিল।
সঙ্গী ছিলেন মমতার বাড়ি হরিশ মুখার্জি রোড থেকে মাত্র মাইল খানেক দূরের, চেতলার বাসিন্দা ফিরহাদ হাকিম। ওরফে ববি। ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দোলা সেন, সুব্রত বক্সি-সহ আরও অনেক দলীয় কর্মী।
মমতাকে বাড়ি ফেরার কথা বারবার মনে করিয়ে দিলেও শেষ পর্যন্ত মমতা ঠিক করলেন, আজকের রাতটা তিনি ওখানকার লোকদের পাশেই থাকবেন। বি ডি ও অফিসের সামনে। অবরোধ-ধরনায়। ‘আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটি’র বড় ব্যানারের নীচে।
মমতা এসেছেন তাই আশপাশের সমস্ত গ্রামের মানুষ বুকে বল পেয়েছেন। বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, এ বার নিশ্চয়ই কাজের কাজ কিছু একটা হবে। ফলে তখনও পর্যন্ত যাঁরা বাড়িতে ছিলেন, তাঁরাও এসে হাজির হলেন ওই ব্যানারের নীচে।
হাজির হল বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। তৃণমূলের ছোট-বড় নেতারাও। দু’-একজন কংগ্রেসি নেতাও ছুটে এলেন নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য।
আরও পড়ুন: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শরৎচন্দ্র
সরকারি হিসেবেই ওখানে তখন জড়ো হয়ে গেছেন সাত হাজারেরও বেশি গ্রামবাসী। তার মধ্যে শুধু মহিলার সংখ্যাই প্রায় আড়াই হাজারের ওপর। বাচ্চাকাচ্চাও কম নয়।
আশপাশের সব ক’টা গ্রামের লোক যখন ঝেঁটিয়ে জড়ো হয়েছেন বি ডি ও অফিসের সামনে, গ্রামগুলো তখন জনমানবশূন্য। খাঁ খাঁ করছে। দু’-চারটে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল আর কুকুর-বেড়াল ছাড়া কেউ নেই। তখন স্থানীয় কিছু সি পি এম কর্মী-সমর্থক, যারা মাঠে গিয়ে কখনওই চাষ করে না। মাটির সঙ্গে আত্মিক কোনও যোগাযোগও নেই। জমির ক্ষতিপূরণের চেক নেওয়ার জন্য একেবারে হাঁকপাঁক করছে, তারা সুনসান গ্রামে ঢুকে পুলিশ, র্যাফ আর ঘাতক বাহিনীদের দেখিয়ে দিতে লাগল, কোন কোন বাড়ির লোকেরা জমি দিতে চাইছে না। কারা জমি আন্দোলনের নামে এখানকার লোকদের খেপিয়ে তুলছে। কারা বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। আর কারাই বা তাদের বাড়িতে রহিরাগতদের ঠাঁই দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে।
এই সব জেনে নিয়ে নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে আক্রমণের ছক সাজাতে লাগল তারা। ও দিকে বি ডি ও অফিস ঘেরাও করে ধরনায় বসা লোকজনদের রাত্রিবেলায় যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, সে জন্য চাঁদা তুলে ক’হাত দূরে দূরে লাগিয়ে দেওয়া হল হ্যালোজেন লাইট। ও দিকে দু’-চারটে ছোট-ছোট বাঁশ পুঁতে চট দিয়ে ঘিরে মহিলাদের জন্য বানিয়ে দেওয়া হল বাথরুম। কয়েক জনের উদ্যোগে গাছের পাতা, শুকনো ডালপালা জ্বালিয়ে তিন ইটের উনুনে ঘন ঘন বসানো হতে লাগল চা, র-চা।
রাত তখন অনেক। সারা দিনের ধকল আর ‘কী-হয় কী-হয়’ একটানা উদ্বেগে কাটানোর ফলে বেশির ভাগ লোকই গায়ে চাদর বা হালকা কাঁথা জড়িয়ে শরীরটা একটু মেলে দিতেই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ তো নাক ডাকতেও শুরু করে দিয়েছেন। যাঁদের পা কিংবা হাত চাদরের বাইরে বেরিয়ে পড়ছে, মাঝে মাঝেই তাঁরা মশার কামড় খেয়ে ঘুমের মধ্যেই নড়েচড়ে উঠছেন। হঠাৎ হঠাৎ কোনও বাচ্চা মায়ের কোলেই কঁকিয়ে কেঁদে উঠছে। প্রতিটা হ্যালোজেনের প্রখর আলোর সামনে এক ঝাঁক পোকা ক্রমাগত চক্কর মারছে। আর এই আলোর জন্যই অন্যান্য দিন আকাশের দিকে তাকালে ঝকঝকে আকাশের বুকে যে লক্ষ লক্ষ তারাকে ঝিকমিক করতে দেখা যায়, সেটা আর দেখা যাচ্ছে না। ও দিকে ডেকরেটর্সের কাছ থেকে ভাড়া করে আনা কিছু চেয়ার এ দিকে ও দিকে ইতস্তত পেতে গোল করে ছোট ও মাঝারি মাপের নেতারা গল্পগুজব করছেন। পর দিন কী করবেন তার পরিকল্পনা ছকছেন।
রাত তখন সওয়া একটা। হঠাৎ সব আলো দুম করে নিভে গেল। কেউ কেউ ভাবলেন নিশ্চয়ই লোডশেডিং হয়েছে। আলোর জন্য এতক্ষণ কেউ বুঝতেই পারেননি, এখন বুঝলেন, চারদিকে মিটমিট করে কত জোনাকি জ্বলছে আর নিভছে। মাথার উপরে তারা বা নক্ষত্র নয়, যেন অসংখ্য চুমকি বসানো ঝলমলে চাঁদোয়া টাঙানো। কিন্তু সত্যিই কি লোডশেডিং হয়েছে, নাকি কেবিল ফল্ট, নাকি অন্য কিছু? বুঝে ওঠার আগেই লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি আর আকাশ বিদীর্ণ করা আর্তনাদে স্পষ্ট হয়ে গেল কোনও একটা অঘটন ঘটেছে। কিন্তু অঘটনটা যে কী, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কারও কারও মনে হল, তা হলে কি শর্ট সার্কিট!
অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতেই ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় দেখা গেল, হঠাৎ কোথা থেকে বন্দুক, লাঠি আর ঢাল নিয়ে প্রচুর পুলিশ আর র্যাফ একসঙ্গে দল বেঁধে তাঁদের শান্তি অবস্থানের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে। এলোপাথাড়ি লাঠি চালাচ্ছে। বন্দুকের বাঁট দিয়ে যাকে পাচ্ছে মারছে। বাদ দিচ্ছে না লাথি, কিল, চড়, ঘুসিও। সামনে বাচ্চা, বুড়ো নাকি মধ্যবয়স্ক, কিচ্ছু দেখছে না। মেয়েদের চুলের মুঠি ধরে মাটির সঙ্গে ঠেসে ধরছে। অল্পবয়সি বউদের শাড়ি টেনে খুলে নিচ্ছে। ব্লাউজের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কোথাও কোথাও দু’-তিন জন মিলে কোনও বউকে চেষ্টা করছে টানতে টানতে ওদিককার নির্জন মাঠের দিকে নিয়ে যেতে। তেরো-চোদ্দো-পনেরো বছরের কিশোরীদের কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে যাওয়ার মতলব করছে কেউ কেউ। মধ্যবয়সি এবং বয়স্ক মহিলা, যাঁরা ওদের বাধা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ওদের পা আঁকড়ে ধরছেন, কিছুতেই ওই মেয়েগুলোকে নিয়ে যেতে দিচ্ছেন না। তখন হিঁচড়ে হিঁচড়েও ওরা আর এগোতে পারছে না দেখে, অন্য পুলিশ আর র্যাফরা ওই সব বয়স্ক মহিলাদের হাত ধরে, চুলের মুঠি ধরে, আবার কেউ কেউ তাঁদেরই শাড়ির আঁচল তাঁদের গলায় পেঁচিয়ে হ্যাঁচকা টান মারতে মারতে তুলে, ধাক্কা দিয়ে, লাথি মেরে দূরে হটিয়ে দিতে লাগল।
মুখে যা আসছে, ওই সব লুম্পেনরা তাই বলছে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। শুধু এলোপাথাড়ি মার বা অসভ্যতাই নয়, অল্পবয়সি মেয়ে দেখলেই হাত ধরে টানাটানি করছে। তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় খাবলাখাবলিও করছে।
তেরো নম্বর ছিল একদম সামনের দিকে। ওই অবস্থার মধ্যেও সে দেখল, যে পুলিশটি তার দিকে তেড়ে আসছে, তার পায়ে খুব সাধারণ একটা চটি। মুখের দিকে তাকাতেই সে অবাক। লোকটার বড় বড় দাড়ির একটা দিক খুলে ঝুলছে। আর তাতেই সে বুঝতে পারল, এই লোকটা পুলিশ নয়। তাদের গ্রামে মাঝে মাঝেই টহল দিতে আসা বাইক বাহিনীর সেই ছেলেটা, রতনদার কিশোরী মেয়েটা সে দিন যখন বিকেল বেলায় প্রতিদিনকার মতো টিউশুনি নিয়ে ফিরছিল, তখন রাস্তার মাঝখানে আচমকা উদয় হয়ে যে তার সালোয়ার কামিজের ওড়না ধরে টানাটানি করেছিল। কু-প্রস্তাব দিয়েছিল। এই ছেলেটা সে-ই।
আর একে চিনতে পেরেই তেরো নম্বর বুঝতে পারল, শুধু পুলিশ আর র্যাফ নয়, পুলিশের উর্দি পরে এই নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছে সি পি এমের বাছাই করা এই রকম বেশ কিছু খতরনাক ক্যাডার।
আকাশ বাতাস তখন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে ছেলে-মেয়ে-বুড়োবুড়িদের বুক ফাটা আর্তনাদে। কারও মাথা ফেটে গেছে। কারও হাত ভেঙে গেছে। কেউ পদপিষ্ট হয়ে মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। আহতদের সেই দলে শুধু যে গ্রামবাসীরাই আছেন, তাই-ই নয়, ওই হামলাকারীদের আক্রমণ থেকে রেহাই পেলেন না স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
উনি আর পাঁচ জনের সঙ্গে খোলা আকাশের নীচে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় কয়েক জনের প্রবল পীড়াপীড়িতে উনি আর না করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত একটু বেশি রাতের দিকে কয়েক জনের সঙ্গে বি ডি ও অফিসের ভিতরে ঢুকেছিলেন। ঢোকার মুখেই বি ডি ও অফিসে নানান কাজে যাওয়া সাধারণ লোকজনদের অপেক্ষা করার জন্য লম্বা মতো যে টুলটা পাতা থাকে, তার ওপরে বসে পড়েছিলেন তিনি। তাঁকে ঘিরে ছিলেন মিনা দেবী, অনন্ত বালি, আশি বছর বয়সি পাঁচুগোপাল ঘোষ, সুরজিৎ কামাল, মলিনা মালিক থেকে শুরু করে মহাদেব দাস পর্যন্ত।
ঝামেলা শুরু হতেই মুহূর্তের মধ্যে কয়েক জন দুষ্কৃতী বি ডি ও অফিসের ভিতরে ঢুকে মমতার মাথা লক্ষ করে সপাটে বাঁশ চালাতে গিয়েছিল। প্রথমটায় ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও সঙ্গে সঙ্গে লাফ মেরে ঝাঁপিয়ে পরে সেই বাঁশটাকে ধরে ফেলেছিল রাজকুমার। তাতে মাথায় না লাগলেও কাঁধের ওপরে সামান্য লেগেছিল মমতার।
আরও মারতে পারে ভেবে রাজকুমারের সঙ্গে যারা ছিল, তারাও, গায়ে যত জোর ছিল দুষ্কৃতীদের ধাক্কা দিয়ে দিয়ে একেবারে গেটের বাইরে বার করে দিয়েছিল। ওদের বার করতে গিয়ে উত্তেজনার বশে রাজকুমার নিজেও বাইরে বেরিয়ে পড়েছিল। আর তখনই ওদের মধ্যে থেকেই কে যেন বি ডি ও অফিসের মূল প্রবেশ পথের কোলাপসিবল গেটটা ঝপাঝপ করে টেনে ভিতর থেকে একটা তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। কী যে হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! তাই বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন মমতা। কিন্তু স্থানীয় লোকজন তাঁকে আগলে দাঁড়ালেন। যেতে দিলেন না।
কোলাপসিবল গেটের বাইরে তখন তুমুল হইহট্টগোল। থেকে থেকেই ছুটে আসছে লোকজন। কে যে কী বলতে চাইছে হাজার কোলাহলে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তার আগেই আক্রমণকারীরা তাঁদের পায়ে, গায়ে, বিশেষ করে মাথা লক্ষ করে, যেখানে পেরেছে বেধড়ক লাঠি পেটা করেছে। তারই মধ্যে হঠাৎ শোনা গেল এক বৃদ্ধের গলা। তার একটা পা বহু দিন ধরেই প্যারালাইসিস। ঠিক মতো হাঁটাচলা করতে পারেন না। লাঠি নিয়ে হাঁটলেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। চলাফেরা করতে ভীষণ কষ্ট হয়। তিনি কোলাপসিবল গেটটা ধরে ‘রাজকুমার, রাজকুমার’, বলে চিৎকার করতে লাগলেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশ থেকে কে যেন তাদের মধ্যেরই কাকে বলল, ওই দ্যাখ, দ্বারিকখুড়ো। ও বোধহয় ওর পোলাটারে খুঁজতাছে।
বিজন দাস এ দিক ও দিকে তাকিয়ে বলল, রাজকুমার তো এখানে নাই। খুড়ো এখনও এখানে কী করতাছে? ওরে বাড়ি চলে যাইতে কও।
– উনি বাড়ি যাওয়ার লোক? হাঁটতে চলতে পারেন না। তবু তাঁর আসা চাই। সেই সক্কাল থিকা এসে বসে আছেন। দরজাটা কি খুলে দেব নাকি? মৃত্যুঞ্জয় পাত্র জিজ্ঞেস করতেই, তাপস দাস বললেন, না না, ওরা তো এটাই চাইছে। আমরা একবার দরজা খুলি আর ওরা হইহই করে দল বেঁধে সব ভিতরে ঢুকে আসুক। একদম দরজা খুলবি না। এখানে দিদি আছেন।
শশীরাম দাস বললেন, ওর মাথায় যদি কেউ একটা বাঁশের বাড়ি দেয় ও থাকবে?
দেবেন্দ্রনাথ বললেন, খুলে, দরজাটা একটু ফাঁক করে ওঁকে ভিতরে টেনে নিয়ে দরজাটা আবার দিয়ে দিলে হয় না?
– দাঁড়া, তোরা দাঁড়া। আমি দেখছি। বলেই, কোলাপসিবল গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন ভূদেবচন্দ্র। তাঁকে এগোতে দেখে সঞ্জয় দাস বললেন, যাচ্ছ কোথায়? চাবিটা নিয়ে যাও।
ভূদেবচন্দ্র এগিয়ে আসার আগেই সঞ্জয়ের কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে শশীরাম এগিয়ে গেলেন। দরজার কাছে গিয়ে চাবি বার করে কোলাপসিবলের দরজাটা খোলার আগেই, দ্বারিক বললেন, তাড়াতাড়ি চলো, তাড়াতাড়ি।
থমকে দাঁড়ালেন ভূদেবচন্দ্র। বললেন, কোথায়?
দ্বারিক বললেন, রাজকুমাররে ওরা মারতাছে। ওরে বাঁচাও।
হঠাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশ থেকে তড়িঘড়ি ওদের কাছে ছুটে গেলেন মৃত্যুঞ্জয়। বললেন, কী হচ্ছে কী? একদম দরজা খুলবে না। দাও, চাবিটা দাও। মরবে নাকি? মনে রেখো, এখানে দিদি আছেন। একদম রিস্ক নিয়ো না। ওদের একটুও বিশ্বাস নেই। ওরা সব পারে। যা হবে, পরে দেখা যাবে।
ভূদেবচন্দ্র বললেন, দ্বারিকখুড়ো কী বলছে দ্যাখো।
– কী বলছে?
– বলছে ওর ছেলেকে নাকি ওরা মাটিতে ফেলে মারছে।
– মারছে তো কী করব? এখন দরজা খোলা যাবে না।
ভূদেবচন্দ্র বললেন, তা হলে?
মৃত্যুঞ্জয় বললেন, তা হলে আবার কী? চলে এসো। এখানে ভিড় কোরো না। এ দিকে এসো। বলেই, ভিতর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, দিদিকে দোতলায় নিয়ে চলো। নিরাপদ জায়গায়।
ওরা কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু কে যে কী বলছে, চিৎকার-চেঁচামেচি আর হইহট্টগোলে কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। আন্দাজে যে যা বুঝতে পারছে, সে তার মতো করে উত্তর দিচ্ছে। হ্যাঁ-তে হ্যাঁ, তো না-তে না।
কোলাপসিবল গেট থেকে ওরা আবার ভিতর দিকে চলে গেল। বাইরে দাঁড়িয়ে কোলাপসিবলের গেট ধরে তখনও জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছেন দ্বারিকখুড়ো। আর বলছেন, তোরা একবার চল বাবা, তোরা একবার চল। নাইলে আমার পোলাটারে ওরা মাইরা ফেলাইব। তোগো পায়ে পড়ি। একবার চল।
কিন্তু তাঁর কথা হইহট্টগোলের ভিড়ে একদম চাপা পড়ে গেল।
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ২৫
পর দিন সকালে আলো ফোটার পর দেখা গেল সব শান্ত। সামনের ফাঁকা জায়গাটা জুড়ে শুধু শ্মশানের চেহারা। এ দিকে সে দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে প্রচুর চটি-জুতো। ভাঙাচোরা চেয়ার। পড়ে আছে শাড়ি ছেঁড়া। ব্লাউজ ছেঁড়া। ছেঁড়াখোঁড়া চাদর, কাঁথা। কয়েকটা বাচ্চা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
ও রকম মার খেয়েও তখনও যাঁরা ধরনা ছেড়ে যাননি, সে রকম তিয়াত্তর জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তাদের সঙ্গে রয়েছে র্যাফ এবং পুলিশের ছদ্মবেশে সি পি এমের ঘাতক বাহিনী।
ওরা চলে যেতেই দেখা গেল বহু মানুষ আহত। রক্তাক্ত। সংজ্ঞাহীন। তাঁদের সবাইকে এক সময় টেনে টেনে তুলে চোখে-মুখে জলের ছিটে দিয়ে দাঁড় করানো হল। কিন্তু শত চেষ্টা করেও যার ঘুম ভাঙানো গেল না, গত কাল রাতেও বি ডি ও অফিসের ভিতরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে ঘুরঘুর করছিল যে, মমতার মাথায় সপাটে আসা দুষ্কৃতীদের চালানো বাঁশের বাড়ি হাত দিয়ে আটকে দিয়েছিল যে, মমতাকে যারা মারতে এসেছিল, তাদের ধাক্কা মেরে মেরে গেটের বাইরে বার করতে গিয়ে যে নিজেই বি ডি ও অফিসের প্রধান ফটকের বাইরে বেরিয়ে পড়েছিল, যার বাবা অত রাতে কোলাপসিবল গেট ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বারবার বলছিলেন, তোরা একবার চল বাবা, তোরা একবার চল। নাইলে আমার পোলাটারে ওরা মাইরা ফেলাইব। তোগো পায়ে পড়ি। একবার চল। আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির সক্রিয় সদস্য, মাত্র চব্বিশ বছর বয়সের লড়াকু ওই ছেলেটির নাম– রাজকুমার। রাজকুমার ভুল।
চলবে…