।। পর্ব – ৩০।।
কলকাতার রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারলেন, এই আন্দোলনটাকে দমন করার জন্য রাজ্য সরকারের দমনপীড়ন নীতির পাশাপাশি অর্ধসত্য ও অসত্যের পথ ধরেছে সরকারের প্রধান শরিক দল সি পি এম। যে কোনও দেশের যে কোনও সরকারের পিঠ যখন একদম দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন তারা কোনও রাস্তা না পেয়ে, মরিয়া হয়ে এই পথ নেয়। এটাকে বলা হয়– অস্বীকারবাদের রাজনীতি।
এর তিনটে ধারা। প্রথম ধারা হল– সরাসরি অস্বীকার। মানে, যে কোনও অভিযোগকেই নস্যাৎ করে দেওয়া। এমন ভান করা, যেন কিছুই ঘটেনি। দ্বিতীয় কৌশল হল– ব্যাখ্যাত্মক অস্বীকার। মানে, যা ঘটেছে বলে আঙুল তোলা হচ্ছে, তাকে অন্য রকম ব্যাখ্যা করে ভিন্ন কিছু বোঝানো। আর তৃতীয় পন্থা হল– ইঙ্গিতবহ অস্বীকার। অর্থাৎ যা বলা হচ্ছে, সেটা হয়তো যুক্তিসঙ্গত, হয়তো ঠিকও। তবে মনে হয় না, এ রকম কিছু ঘটেছে। ব্যাপারটা ভাল করে খতিয়ে দেখতে হবে। এ জাতীয় কিছু একটা বলে, অভিযোগটাকে আসলে অস্বীকার করা।
গোটা ইউরোপ জুড়ে গণহত্যা-সহ অন্যান্য হত্যাকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়ার জন্যই নাৎসিবাহিনীর মাথা থেকে এই ‘অস্বীকারবাদের রাজনীতি’র উদ্ভব হয়েছিল। পরে তা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। নোয়াম চমস্কি এবং কলিন টাটজ-এর মতে, এই ধরনের অস্বীকারবাদ আসলে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশে প্রণোদিত। খুব সতর্ক ভাবে, সচেতন হয়ে, বিশেষ কোনও উদ্দেশ্যেই কেবল এই ধরনের কৌশল নিয়ে থাকে রাষ্ট্র।
সি আই ডি-র লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদের কুৎসিত ধরন এবং পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দেখে কারও কারও মনে সংশয় হতে শুরু করল, তা হলে কি আমাদের রাজ্যও ওই জঘন্য কৌশল নিতে শুরু করেছে! না, আর নয়। এ বার একটা কিছু করতে হবে। করতেই হবে। আর কোনও মেয়েকে যেন এ ভাবে প্রাণ দিতে না হয়। ফুঁসে উঠলেন মহিলারা।
আকাশে দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই তাপসী মালিকের মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছল ধর্মতলার অনশন মঞ্চে। সেটা শুনে বেশ কিছুক্ষণ গুমরে রইলেন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টানা পনেরো দিনের অনশনে তিনি তখন বেশ কাহিল। উঠে বসার মতো ক্ষমতা নেই। তবু তারই মধ্যে তিনি বললেন, আজ এই মঞ্চেই সারা দিন ধরে শোকসভা হবে। পূর্ণেন্দু বসুকে সেই শোকসভা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে, এ দিনই আঁধারগ্রাম আন্দোলনকে ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর আন্দোলন বলে তিনি ঘোষণা করলেন।
বেলা গড়াতে না গড়াতেই নেত্রীর ডাকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাতারে কাতারে মা-বোনেরা ধর্মতলায় এসে জমায়েত হলেন। রাস্তার মধ্যে শুয়ে বুক চাপড়ে তাঁরা তাঁদের শোক-ক্ষোভ, দুঃখ-যন্ত্রণা উজাড় করে দিলেন। সেটা দেখে, অনশন মঞ্চে বসেই শোকে বিহ্বল মমতা লিখে ফেললেন তাপসী মালিক স্মরণে একটি সাড়া জাগানো কবিতা–
তাপসী
তাপসী তুমি তপস্যার তপোবন
তুমি আজ সুদূর নীহারিকা
তুমি চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা
হয়তো আকাশের তারকা।
তোমার স্বপ্ন মাটির পৃথিবী
নও তো তুমি কন্যা, তুমি বিদ্রোহিনী
মাটির আন্দোলনে, জমির লড়াইয়ে
তুমি ছিলে অগ্রগণ্যা, তুমি বিজয়িনী।
তোমার মাংসে যাদের নৃত্য
জানে না তারা পাশবিকতার অভিশাপ
তোমার আত্মত্যাগ মানব সমাজে দর্পণ
তোমার জ্বলন্ত চিতা শাসকের মহাপাপ।
তোমার আর্তনাদ আমাদের বুকে
করছে শুধু পদাঘাত আর পদাঘাত
আজ তোমার রক্তে যাদের আনন্দ
তাদের জন্য রইল সবার ধিক্কার কষাঘাত।
তুমি তো নও সিঙ্গুরে একা
স্বপ্নের সিঙ্গুরে আর হবে না দেখা
তোমাকে যারা এ পৃথিবী থেকে করেছে নিশ্চিহ্ন
তারা জানে না তোমাকে ছাড়া সিঙ্গুর বিষণ্ণ।
খুব মনে পড়ছে দেখা হয়েছিল
তোমার সাথে আমার উজ্জ্বল সংঘের ধারে
দেখেছিলাম তোমাদের অদম্য সাহস
সবুজ খেতগুলোকে সব ঘিরে।
আন্দোলনেও তুমি ছিলে নির্ভীক সহকর্মী অত্যাচারীদের বুটের আঘাতে বিদ্ধ
তাপসী, তুমি চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলে
পাষণ্ডরা তোমাকে করে দিল নিথর স্তব্ধ।
মুখটা নাকি তোমার বেঁধে রেখেছিল
নীরবে সইলে অমানবিক যন্ত্রণা
তারপরেও তোমার প্রাণ চলছিল
অগ্নিগর্ভে হল জীবন্ত বেদনা।
অনেক কষ্টে গিয়েছে তোমার জীবন
পাষণ্ডরা আজ করছে শাসন
তুমি বেঁচে থাকবে সিঙ্গুরের ধানে
বাঁচবে তুমি শহিদ ইতিহাসের মনে।
তাপসীরা কখনও মরে না
তারা বেঁচে থাকে আন্দোলনের অন্তরে
তোমার জীবন স্বপ্ন বেঁচে থাকবে
সিঙ্গুরের জমির ফসলের প্রান্তরে।
সব আন্দোলনেই থাকে শহিদের ইতিহাস
তোমার আত্মত্যাগ সিঙ্গুরের নিঃশ্বাস
কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলনে তুমি সোনার ধান শস্যরাঙা সবুজ ধানে থাকবে তোমার প্রাণ।
তোমার তরে কাঁদে মোদের প্রাণ
শিহরিয়া ওঠে সবুজ ধান
কেঁদে উঠছে মা-মাটি-মানুষ
তুমি সিঙ্গুরের সূর্যোদয়, তুমি প্রত্যুষ।
রইলো প্রণাম রইলো সালাম
তুমি বীরঙ্গনা তুমি মহান।
এ দিকে তাপসীকে নিয়ে যখন তরুণ সান্যাল-সহ আরও অনেক তরুণ কবি কবিতা লিখছেন, শোকে ভেঙে পড়ছেন, রাগে ফুঁসছেন, ও দিকে তাপসী মালিক হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী অফিসার রজত তখন হাজার রকমের ভয়, লোভ, প্রতিশ্রুতি এবং নানা রকম টোপ এক-এক করে তুলে ধরছে অপর্ণার সামনে। উদ্দেশ্য একটাই, সে যাতে তার কথা মতো বয়ানে সই করে দেয়। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত তার যাবতীয় চেষ্টায় অপর্ণা জল ঢেলে দেওয়ায়, রজত যোগাযোগ করল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মগরা থানায়। সেখানকার পুলিশ দিয়ে মগরার বাড়ি থেকে অপর্ণার বাবা, মানে তাপসীর জামাইবাবুকে তুলিয়ে নিয়ে এল সে।
অপর্ণা যেহেতু তার তালে তাল মেলায়নি, তাই তার বাবাকে, ‘এই জিজ্ঞেস করছি’, ‘আপনার কেসটা যে ড্রিল করছে, সে একটু রাউন্ডে বেরিয়েছে, এক্ষুনি এসে পড়বে, একটু অপেক্ষা করুন’, ‘আর একটু অপেক্ষা করুন’, করতে করতে অনেক রাত পর্যন্ত তাঁকে থানায় বসিয়ে রাখে রজতের স্নেহধন্য পুলিশরা। এমনকী ‘এত রাতে আর কোথায় যাবেন…’ বলে তাঁকে একদিন হাজতবাসও করায়।
শুধু তাঁকেই নয়, জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাপসীর অন্যান্য আত্মীয়দের বাড়িতেও দিন নেই, রাত নেই, যখন তখন হানা দিতে শুরু করে পুলিশ এবং সি আই ডি-র লোকেরা। জেরার নামে থানায় টানাটানি করতে থাকে। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নানা রকম ভয় দেখানো শুরু করে।
এটা জানাজানি হতেই এর প্রতিবাদে ২০ ডিসেম্বর জেলায় জেলায় সারা দিন ধরে অবস্থান বিক্ষোভ চলতে থাকে। তাতে শুধু গ্রামবাসীরাই নয়, রাজনৈতিক লোকেরাই নয়, অনেক সাধারণ মানুষও তাতে সামিল হন। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ নেন চুঁচুড়ার জেলাশাসকও। তাপসীর মৃত্যুর পিছনে কাদের হাত, তা জানার জন্য স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়ে, সি বি আইয়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেন তাঁরা। অসংখ্য লোকের স্বাক্ষর সংবলিত চিঠি পাঠানো হয় মুখ্যমন্ত্রীকে।
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ (ঊনত্রিশ)
আঁধারগ্রামবাসীদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালে জমি রক্ষা আন্দোলনের গতি আরও এক ধাপ বেড়ে যাবে, অন্য একটা মাত্রা যোগ হবে ভেবে, কোনও নিষেধাজ্ঞা না থাকা সত্ত্বেও নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের যে নেত্রীকে একদিন একা, পায়ে হেঁটেও আঁধারগ্রামে ঢুকতে দেয়নি প্রশাসন, যে কোনও সময় গ্রেফতার হতে পারেন জেনেও, সেই মেধা পাটেকরই ১৪৪ ধারার মধ্যেই আঁধারগ্রামের বাজেমেলিয়ায় গিয়ে হাজির হলেন। তাপসী মালিকের বাড়িতে। সদ্য সন্তান-হারা এক মায়ের কাছে।
না, তাঁকে বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। কারণ, সরকার যতই অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, তাপসী-খুনের অপরাধের সঙ্গে তারাই যে জড়িত, এই সন্দেহ চাউর হতেই পুলিশি উপদ্রব ও সরকারের ভাড়া করা পাহারাদারদের হম্বিতম্বি অনেকটাই শিথিল হয়ে গিয়েছিল। আসলে গ্রামবাসীদের হাতে আক্রান্ত হলে ফোর্স আসার আগেই যে তাদের ইহলীলা সাঙ্গ হবে, সেটা বুঝতে পেরেই কেউ কেউ নিজে থেকেই ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছিল। কেউ কেউ তো পাহারাদারের চাকরিই ছেড়ে দিয়েছিল। আর পুলিশরা? তারা উপর তলার বিভিন্ন দাদাদের ধরাধরি করছিল, যে কোনও উপায়ে অন্য কোথাও পোস্টিং পাওয়ার জন্য।
এই সব দেখে প্রশাসনও একটু থমকে দাঁড়িয়েছিল। বোধহয় একটু ভয়ই পেয়েছিল তারা। তাদের সেই ভয় আরও জেঁকে বসল মেধা পাটেকর আঁধারগ্রামে ঢুকতে না ঢুকতেই।
চলবে…