মমতা সোচ্চার হলেন। বললেন, জোর করে জমি নেওয়া চলবে না। গাড়ি কারখানা করতে অত জায়গা লাগে নাকি? টাটারা যদি গাড়ি কারখানা করতে চায় তো, ছ’শো একরের মধ্যে করুক। কে বারণ করেছে? তার আগে অনিচ্ছুক কৃষকদের চারশো একর জমি ফেরত দিয়ে দিক।
২০০৮-এর ৭ সেপ্টেম্বর রাজভবনে প্রথমে বুদ্ধদেব, পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তারও পরে বুদ্ধ-মমতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন রাজ্যপাল। সেই বৈঠক চলে গভীর রাত অবধি। সমঝোতাপত্রে সই করেন নিরুপম সেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়। লিখিত বিবৃত পেশ করেন রাজ্যপাল।
পর দিনই সরকার জানিয়ে দেয়, ইচ্ছে থাকলেও প্রকল্পের ভিতর থেকে এক ইঞ্চি জমিও চাষিদের ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। আইনি সমস্যা আছে। তা ছাড়া কারখানা করার জন্য জমির চরিত্র যে ভাবে বদলানো হয়েছে, তাতে জমি ফেরত পেলেও সেখানে হাজার চেষ্টা কললেও একটা শষ্যদানাও ফলাতে পারবেন না কোনও চাষি।
কিন্তু মমতা অনড়। তিনি বললেন, দরকার হলে আইন বদলাতে হবে। জমির চরিত্র আবার নতুন করে পালটাতে হবে। যে করেই হোক, অনিচ্ছুক চাষিদের চারশো একর জমি ফেরত দিতেই হবে।
ইচ্ছে না থাকলেও অনিচ্ছুক চাষিদের কথা ভেবে ১২ সেপ্টেম্বর বুদ্ধদেব-গৌতম দেবের সঙ্গে নন্দনে বৈঠক করলেন মমতা। অনেক আলোচনার পরে প্রকল্প-চত্বরের ৪০ এবং অন্যত্র থেকে ৩০, মোট ৭০ একর জমি ছাড়তে রাজি হয় সরকার। জমি হারাদের জন্য ঘোষণা করে নতুন প্যাকেজ। কিন্তু মমতা বলেন, ৪০০ না হলেও অন্তত ৩০০ একর জমি সরকারকে ছাড়তেই হবে।
পর দিন মমতা জানালেন, ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি আঁধারগ্রামে জনসভা করবেন। তার পর ১৯ তারিখ পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করবেন। তখনও যদি সরকার তাঁর কথা না শোনে, তা হলে তিনি ফের আন্দোলন শুরু করবেন।
এই ঘটনার কুড়ি-বাইশ দিন আগেই, ২৪ আগস্ট পূর্ব ঘোষণা মতো টাটার কারখানার সামনে মমতা যখন ধরনা শুরু করলেন, সেখানে দেখা করতে এলেন অমর সিংহ থেকে শুরু করে মেধা পাটেকর। তখনই ২০০৮-এর ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লির মেলায় রতন টাটা উন্মোচন করলেন তাঁর ‘ন্যানো’ গাড়ি। সবাই জানতেন, টাটাদের গাড়ি কারখানা করা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে অশান্তি হচ্ছে। তাই গাড়ি কারখানা করার জন্য তাদের রাজ্যে টাটাকে প্রস্তাব দিয়েছিল পাঁচ-পাঁচটা রাজ্য। কারণ, তার ঠিক দু’দিন আগে ২২ আগস্ট টাটা বলেছিলেন, আমি এ রাজ্যে থাকতেই চাই। কিন্তু বাধা পেলে চলে যাব।
তাই মমতার ফের আন্দোলন করার শেষ তারিখ ১৯ সেপ্টেম্বরের আগের দিনই, অর্থাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী স্বাগত জানালেন টাটাদের। ২২ তারিখে কর্নাটকে জমি দেখতে গেলেন টাটারা। সে জমি তাদের মনঃপূত না হওয়ায় ২৫ তারিখে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী বিলাসরাও দেশমুখকে চিঠি দেন রতন টাটা এবং ৩ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রী-শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে মহাকরণে দীর্ঘ বৈঠক করে, তাজবেঙ্গলে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে তিনি জানিয়ে দেন, আঁধারগ্রামে তাঁরা ন্যানো কারখানা করছেন না।
শিল্পমন্ত্রী বললেন, এর সব দায় মমতার।
পর দিন ৪ অক্টোবর আঁধারগ্রামে ১০ ঘণ্টার বনধ ডাকল সি পি এম। রাস্তা কেটে, ট্রেন আটকে বিক্ষোভ দেখাল তারা। বিভিন্ন জায়গায় ঘটল বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ। মমতা-প্রভাস বললেন, টাটার প্রস্থান আমাদের আন্দোলনের উৎস। সি পি এম বলল, জমি ফেরত হবে না। ওখানে শিল্পই হবে।
পর দিন বুদ্ধদেব বললেন, শিল্পযুদ্ধে হারতে রাজি নই। আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চাই।
এক লাখ টাকায় গাড়ি পাওয়া যাবে দেখে পশ্চিমবঙ্গের এক কোম্পানির মালিক তাঁর কর্মচারীদের জন্য একসঙ্গে আগাম বুক করে ফেলেছিলেন এক হাজারটা ন্যানো। সেই গাড়ি অবশেষে তার কারখানার জন্য ৭ অক্টোবর জায়গা পেল গুজরাতের সানন্দয়।
এ সব হওয়ার আগেই মমতা সোচ্চার হয়েছিলেন। বলেছিলেন, সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে গত ১৪ নভেম্বর, রবিবার সমস্ত দৈনিক পত্রিকায় হিডকোর তরফ থেকে যে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন রাজ্যের আবাসন মন্ত্রী গৌতম দেব, তাতে জমিদাতাদের একগাদা নাম, ধাম, ছবি, মৌজা, এমনকী তার পাশে আলাদা আলাদা করে প্রত্যেকের দেওয়া জমির পরিমাণ উল্লেখ করে উনি যতই বলুন, এরা সবাই স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছেন। আসলে কী ঘটেছে আমরা জানি। স্পষ্ট মনে আছে, রাজারহাটের ঠাকুরবাড়ি মৌজার নে পাড়া এবং ঢালি পাড়া অঞ্চলে প্রায় চল্লিশ ঘর আদিবাসী বাস করতেন। হিডকোর জন্য জমি অধিগ্রহণের সময় তাঁদের জমির দিকে সি পি এমের লোকেরা হাত বাড়াতেই তাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
বাধা এলে কী ভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তা আগে থেকেই ছকা ছিল সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের। সেই মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। এদের মতো আর কোনও আদিবাসীরা যাতে বিরোধিতা তো দূরের কথা, সামান্য প্রতিবাদ করতে গেলেও তার পরিণাম কী হতে পারে, কতটা খেসারত দিতে হতে পারে, এটা দেখে যাতে কেউ আর টুঁ শব্দটিও করতে না পারে, চোখ তুলে তাকাবার আগেই অন্তত দশ বার ভাবে, সেই রকম ভয়াবহ পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য সি পি এমের ক্যাডার বাহিনী দিনে-দুপুরে এসে তাঁদের উপর শুধু তাণ্ডবই চালায়নি, তাঁদের মাটির ঘরগুলো পর্যন্ত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, তার সঙ্গে মারতে মারতে এমন ভাবে এলাকা থেকে তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছিল, যাতে আর কখনও ওখানে আসার কথা ওঁরা কল্পনাও করতে না পারেন। ওঁরা এখন কোথায় আছেন, কেউ জানে না।
মহিষগোট মৌজার কেষ্টপুর খালের উপর যেখানে সল্টলেক-রাজারহাট ব্রিজ হয়েছে, সেখানে থাকতেন শচীন মণ্ডল। বড় একটা পুকুর আর ছ’কাঠা জমির ওপর ছিল তাঁর চার কামরার বাড়ি। জমি দিতে রাজি না হওয়ায় ওই এলাকার কাউন্সিলর দিলীপ দে-র নেতৃত্বে শাসক দলের গুন্ডা-বাহিনী তাঁর বাড়িতে চড়াও হয়। ঘরদোর ভেঙে তছনছ করে এবং শেষ পর্যন্ত জবরদস্তি ওই জমি কেড়ে নেয় তারা। না, শচীন মণ্ডল ওই জমির জন্য কোনও টাকা পাননি। কোথায় চলে গেছেন এখনও কেউ তাঁর হদিশ জানে না।
আকন্দকেশরী মৌজায় ছিল পঁচাত্তর বছরের নিশিকান্ত মণ্ডলের এগারো বিঘার ইটভাটা। রমরম করে চলছিল। আড়াইশো শ্রমিক কাজ করতেন সেখানে। তিনি জমি ছাড়তে না চাওয়ায় বিধায়ক রবীন মণ্ডলের তত্ত্বাবধানে বুলডোজার দিয়ে সে সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় সি পি এমের গুন্ডা, পুলিশ আর বিশাল র্যাফ বাহিনী।
২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে যখন বালিয়াড়ি মৌজার মাঠে মাঠে হলুদ সরষে ফুল ফুটেছে, ঠিক তখনই সেই জমি নেওয়ার জন্য এই সরকারকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে হামলে পড়েছিল রাজ্য সরকারের প্রধান শরিক দলের পোষা গুন্ডা-বাহিনী। অত্যাচারের ভয়েই হোক কিংবা না দিলে শেষ পর্যন্ত জমি তো কেড়ে নেবেই, তখন আর একটা পয়সাও পাওয়া যাবে না ভেবেই হোক, বা অন্য কোনও কারণেই হোক, যাঁরা জমি দিতে রাজি হলেন, তাঁরা বেঁচে গেলেন। কিন্তু যাঁরা জমি দিতে রাজি হলেন না, হলুদ সরষে ফুল খেলতে থাকা তাঁদের সেই জমির উপরে দিনে-রাতে ট্রাক ট্রাক মাটি এনে ফেলতে লাগল শাসক দলের ক্যাডার কাম মার্শাল-বাহিনী। মাত্র ক’দিনের মধ্যেই পুরো চাষটাই নষ্ট করে দিল। না, থানা- পুলিশ করে, একে-তাকে ধরেও কোনও লাভ হয়নি তাঁদের। বোঝা যাচ্ছিল, তলে তলে সবাই সাটে আছেন। কেউ কেউ নিজে থেকেই এগিয়ে এসে, তাঁদের দুঃখে বুক ভাসিয়ে ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু আদতে কেউই কোনও টাকা পাননি।
জমি কেড়ে নেওয়ার পরেও যাঁরা এলাকা ছেড়ে যাননি, ক্রমশ ঘোঁট পাকাচ্ছিলেন। জমি ফেরত পাওয়ার জন্য কোর্টের দরজায় খটখট করছিলেন, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে রাতের অন্ধকারে তাঁরা কর্পূরের মতো চিরতরে উবে গেলেন। যেমন নিশিকান্ত মণ্ডল। ২০০৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির পর থেকে তাঁকে আর দেখা যায়নি। গ্রামবাসীদের ধারণা, তাঁকে খুন করে তাঁর লাশ ওরা গায়েব করে দিয়েছে।
তাঁদের সঙ্গে কোনও কথাবার্তা না বলে, সরকার তার ইচ্ছে মতো ম্যাপ তৈরি করেছে। সেই ম্যাপ অনুযায়ী অধিগৃহীত অঞ্চলে তাঁদের জমি পড়েছে। এখন যে কোনও সময় সেই জমি সরকার কেড়ে নিতে পারে, বুঝতে পেরে ২০০৪ সালের ১১ জুন বেলা এগারোটা নাগাদ বালিগড়ি মৌজার বাগজোলা খালের পারে, লস্করআটিতে জমায়েত হয়েছিলেন বেশ কিছু স্থানীয় চাষি। তাঁরা এককাট্টা হয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন– আমরা চাষের জমি দিচ্ছি না। দেব না।
ঠিক সেই মুহূর্তে দলেরই এক ক্যাডার মারফত খবর পেয়ে, হিডকোর তাবড় তাবড় অফিসার, হাজার হাজার পুলিশ, র্যাফ আর মাথায় লাল ফেট্টি বাঁধা প্রায় হাজার তিনেক মাস্তান নিয়ে সেখানে হাজির হন রাজারহাটের বিধায়ক রবীন মণ্ডল। কোনও কথা নয়, কোনও আলাপ-আলোচনা বা যোগ-জিজ্ঞাসা নয়, গিয়েই লাঠি চালানোর নির্দেশ দেন তিনি। লাঠির বেপরোয়া আঘাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান লোকজন। যে যে-দিকে পারলেন, পালালেন। যাঁরা পালাতে পারলেন না, একের পর এক মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ৩৭
রাজারহাট জমি বাঁচাও কমিটির নেতা রঞ্জিত নস্কর ও প্রহ্লাদ মণ্ডল-সহ মোট সাত জনকে বেধড়ক মারতে মারতে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল পুলিশ। উলটোপালটা কেস দিয়ে ২১ দিন জেলে পুরে রাখল। শুধু তা-ই নয়, সংবাদ মাধ্যম যাতে সেখানে ঢুকতে না পারে, সে জন্য ওখানে ঢোকার সব ক’টা প্রধান রাস্তার মুখে র্যাফ আর পুলিশ মোতায়েন করে রাখা হল। ফলে কেউ জানতেই পারলেন না, সে দিন ঠিক কত জন আহত হয়েছিলেন আর কত জন নিহত। কারণ কেউ মারা গেলেই তড়িঘড়ি করে তাঁদের দেহ পুঁতে দেওয়া হচ্ছিল মাটির তিন হাত গভীরে।
কেউ কেউ তো সন্তান হারানোর ভয়ে, মেয়ে-বউয়ের ইজ্জত খোয়ানোর আতঙ্কে বাধ্য হয়ে চোখের জলে নাকের জলে বুক ভাসিয়ে বংশপরম্পরা ধরে আগলে রাখা বড় আদরের, বড় ভালবাসার ধন, তাঁদের একমাত্র সম্বল– চাষের জমি তুলে দিয়েছিলেন সি পি এমের ঘাতক বাহিনীর হাতে। দগ্ধে দগ্ধে মারা গিয়েছিলেন জমি অন্তপ্রাণ আরও অজস্র মানুষ।
শুধু মারধর বা খুন কিংবা আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেই ক্ষান্ত হয়নি, জমি অধিগ্রহণের জন্য দাঙ্গা বাঁধাতেও পিছ পা হয়নি শাসক দল। ২০০৪ সালে ঘুনি মৌজায় অধিগ্রহণের জন্য আল কেটে চাষের জমি দখল করতে গেলে স্থানীয় চাষিদের কাছে বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়ায় তাঁরা। চাষিবউ-মা-বোনেরা বুলডোজারের সামনে শুয়ে পড়েন। বলেন, আমাদের জমিতে বুলডোজার নিয়ে ঢুকতে গেলে আমাদের বুকের উপর দিয়ে বুলডোজার নিয়ে যেতে হবে। এ সব দেখে পুলিশরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। ফলে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ওখানে র্যাফ নামানো হয়। প্রায় পাঁচ দিন ধরে চলে র্যাফদের অত্যাচার আর চাষিদের টিকে থাকার অসম লড়াই।
সি পি এমের জাঁদরেল নেতা রবীন দেব জানতেন, যে কোনও বড় গণআন্দোলনের স্তম্ভই হল মেয়েদের অংশগ্রহণ। প্যারি কমিউনে মেয়েদের মরণপণ লড়াইয়ে আতঙ্কিত হয়ে এক বুর্জোয়া সাংবাদিক ১৮৭১ সালের মে মাসে লিখেছিলেন, ফরাসি জাতি যদি শুধু মেয়েদের নিয়ে গঠিত হত, তা হলে সে জাতি যে কত ভয়ংকর হত, তা সহজেই অনুমেয়।
স্বয়ং লেনিন ওই উদ্ধৃতি তুলে লিখেছিলেন, প্যারি কমিউনে মহিলা ও কিশোর-কিশোরীরা পুরুষদের পাশে দাঁড়িয়ে যে ভাবে সমানে পাল্লা দিয়ে লড়েছিল, তার তুলনা মেলা ভার। এর পর পৃথিবীর যে কোনও দেশেই বুর্জোয়াদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যে সংগ্রামই হোক না কেন, সেখানে এর ব্যতিক্রম হবে না।
রবীন দেব আরও জানতেন, রাশিয়ার ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হয়েছিল মেয়েদের উদ্যোগেই। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চ-এর উৎপত্তি হয়েছিল ১৯১৭ সালে। পুরনো রুশ পঞ্জিকা ঘাঁটলে দেখা যাবে ওই দিনটি আসলে ফেব্রুয়ারি মাসেই।
ফেব্রুয়ারির সেই ধর্মঘটী রুশ মহিলা শ্রমিকরা কথা বলতে চেয়েছিলেন সরকারের ঊর্ধ্বতন না হোক, তার পরের, কিংবা তার পরের ধাপের কোনও কর্তার সঙ্গে। কিন্তু সরকার তাতে কোনও কর্ণপাত না করায় তাঁরা দলে দলে কথা বলতে শুরু করেন, যেন-তেন প্রকারেণ তাঁদের আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য আনা বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত, অত্যন্ত খতরনাক বাহিনী– কসাক সৈন্যদের সঙ্গে। বলতে থাকেন তাঁদের নানা দুঃখ-কষ্টের কথা। যন্ত্রণার কথা। অবহেলা, বঞ্চনা আর অমর্যাদার কথা।
তাঁদের কথা মন দিয়ে শুনলেও সৈন্যরা চেষ্টা করেছিলেন ওই মেয়েদের চোখের দিকে না তাকাতে। সত্যের মুখোমুখি হতে অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁদের। কারণ সৈন্যের পোশাক গায়ে চাপালেও তাঁরা আসলে ছিলেন কৃষক পরিবারেরই অত্যন্ত সাদামাঠা ছেলে। নৃশংস হওয়ার জন্য রুশ সরকার তাঁদের যতই তালিম দিক না কেন, তাঁদের বুকের ভিতরে নিশ্চয় নরম একটা জায়গা ছিল, তাই নিজেদের সামলে রাখার হাজার চেষ্টা করেও, তাঁরা সে ভাবে সফল হননি। শেষ পর্যন্ত তাঁরা যে ওই মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়েছিলেন, তাঁদের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা বুক দিয়ে অনুভব করেছিলেন, নিরেট পাথরও যে তাঁদের দুঃখে একটু একটু করে গলতে শুরু করেছিল, সে বর্ণনা তিনি পড়েছিলেন ট্রটস্কির লেখা রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে।
শুধু রুশ নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও প্রতিটি আন্দোলনে বারবার দেখা গেছে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত এগিয়ে আসা। সেটা তেভাগা আন্দোলনই হোক কিংবা আঁধারগ্রাম-নন্দীগ্রামের আন্দোলন। মেয়েরা এগিয়ে না এলে কবেই যে ঠান্ডা করে দেওয়া যেত গ্রামের সহজ সরল এই বোকা মানুষগুলোকে, স্তব্ধ করে দেওয়া যেত এই সব লম্ফঝম্প, তিনি তা জানতেন।
সি পি এমের যাবতীয় জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মেয়েদের এই একরোখা প্রতিবাদ দেখে সরকারের পোষা বুদ্ধিজীবীরা বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলেন। ভয় পেয়েছিলেন রবীন দেবও। তাই শত চেষ্টা করেও চাষিদের যখন কিছুতেই বাগে আনতে পারছেন না, তখন বাধ্য হয়ে তৃণমূল বিধায়ক তন্ময় মণ্ডলকে ফোন করলেন তিনি। বললেন, আপনি একটু আমাদের হয়ে ওদের বোঝান। আমরা আপনাকে দেখব। তন্ময় নাচতে শুরু করে দিলেন গৌতম দেবের ইশারায়। অবশ্য এ জন্য তন্ময়কে শেষ পর্যন্ত দল থেকে বহিষ্কার করেন তৃণমূলের সর্বময় কর্ত্রী।
তন্ময় যখন গ্রামবাসীদের আন্দোলন বানচাল করে দেওয়ার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই নতুন একটা চাল চাললেন গৌতমবাবু। গ্রামের কয়েক জন একরোখা, তেজি বেকার যুবককে বেছে বেছে দৈনিক আশি টাকার চুক্তিতে জমির আল কাটার কাজ দিলেন তিনি। যাঁরা কাজ পেলেন, মন সায় না দিলেও, এটা ঠিক হচ্ছে না বুঝেও, শুধুমাত্র রুজি-রোজগারের জন্য তাঁরা খানিকটা সি পি এমের দিকে ঝুঁকলেন। আর যাঁরা কাজ পেলেন না, তাঁরা আল কাটার বিরোধিতা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। দুটো দলে ভাগ হয়ে গেলেন গ্রামের লোকেরা।
গ্রামের সমস্ত লোক মিলে একযোগে জমি আটকাবার যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, গৌতমবাবুর এক চালে তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। বিরোধীদের দিকে বেশির ভাগ লোক থাকলেও, এত দিন ধরে বিপক্ষে থাকা বেশ কিছু মানুষ তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। ফলে, আরও জোর পেয়ে গেলেন তিনি। জোর পেয়ে গেল আশি টাকা রোজে কাজ করতে আসা লোকগুলিও। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের এক-একটা কেউকেটা ভাবতে শুরু করলেন। সি পি এমের ক্যাডারদের সঙ্গে নিয়ে তাঁরা আল কাটার জন্য মাঠে যেতেই, বাধা দেওয়া শুরু করল ওই সব জমির কৃষকেরা। কৃষকরা তখন সঙ্ঘবদ্ধ হলেও এ ভাবছে, ওর জমি দখল করছে তো আমার কী? ও ভাবছে, আমি কেন শুধু শুধু ঝামেলায় জড়াতে যাব? আমার গায়ে তো কোনও আঁচড় পড়ছে না। ফলে যেখানেই ওরা গেল, কৃষকদের তুলনায় দলে তাঁরা বেশি থাকায় এবং শাসক দলের ক্যাডাররা সঙ্গে থাকায়, তাঁদের সাহস যেন আকাশ ছুঁল। তাঁরা বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। বাধা পেতেই কোনও কিছু না ভেবে মুহূর্তের মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁরা। শুরু হয়ে গেল কথা-কাটাকাটি। ধাক্কাধাক্কি। মারপিট।
একটি মুসলমান ছেলেকে, ‘ওরে নেড়ের পো, তোর এত বড় সাহস, হিন্দুদের চোখ রাঙাস?’, বলে এমন ভাবে পেটাল যে, রক্তে ভেসে যেতে লাগল সে। সেই দৃশ্য দেখে মুসলমানরাও লাফিয়ে পড়ল। ‘হিন্দুরা মুসলমানদের মারছে’ রটে যেতেই অন্যান্য গ্রাম থেকে টাঙ্গি, হেঁসো, দা নিয়ে দলে দলে ছুটে আসতে লাগলেন মুসলমানেরা। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হল। ফলে জমির জন্য এককাট্টা হওয়া চাষিদের মধ্যে জাত নিয়ে বিবাদ শুরু হতেই অনেকটাই শিথিল হয়ে গেল জমির আন্দোলন। আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আল কেটে, মাটি কেটে জমির পর জমি দখল করে, সরকারকে জমি অধিগ্রহণ করার সুবর্ণ সুযোগ করে দিল পুলিশ, র্যাফ আর ক্যাডার-বাহিনী।
শুধু রাজারহাটেই নয়, দলীয় নির্দেশে সর্বত্র এই একই ছকে এগিয়েছে সি পি এমের উপর মহলের নেতা-নেত্রীরা। নিচু তলার ক্যাডারদের বলেছেন, দিই, না দিই, সেটা পরে দেখা যাবে। আগে ওদের টাকার লোভ দেখাও। চাকরির টোপ দাও। তাতেও রাজি না হলে ভয় দেখাও। ছেলেকে গুম করে দাও। মেয়ে-বউকে রেপ করো। তাতেও জমি ছাড়তে না চাইলে এক-একজনের নামে পাঁচটা, দশটা, বিশটা, যে ক’টা দিতে পারো, পারলে নন বেলেবেল কেস দিয়ে থানায় তুলে আনো। মারতে মারতে হালুয়া টাইট করে দাও। তার পরেও যদি বেঁচে থাকে হাজত বাস করাও। বাড়িঘর ভেঙে দাও। গুঁড়িয়ে দাও। লুঠ করো। আগুন ধরিয়ে দাও। এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করো, যাতে ওরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ সব সহ্য করেও যদি ওরা মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে, তখন আর কোনও কথা নয়, সোজা গুলি করো। গলার নলি কেটে মাটিতে পুঁতে দাও বা আশপাশে খাল, বিল, নদী থাকলে তাতে ভাসিয়ে দাও, ব্যস। আমাদের মাশলম্যান তো কম নেই। পুলিশ-প্রশাসনও আমাদের হাতে। কোনও ভয় নেই। দরকার হলে অন্য জেলা থেকে, এমনকী ভিন রাজ্য থেকেও, হাজার হাজার দাগি আসামি এনে দেব। যত রকমের আর্মস লাগে সাপ্লাই দেব। আমার শুধু একটাই কথা, যে ভাবে পারো গ্রাম খালি করো। আমি জমি চাই। তার জন্য যা যা করার তোমরা করো।
হাইকম্যান্ডের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েই মাসিক ভাতা পাওয়া সি পি এমের হোলটাইমাররা মাঠে নেমে পড়ল। আর এই ভাবেই একের পর এক গ্রামের জমি ওরা খালি করতে শুরু করল। অধিগ্রহণ করতে লাগল। এটাকে যদি ওরা স্বেচ্ছায় জমি দেওয়া বলে, তা হলে সত্যিই সবাই স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছে। দিচ্ছে এবং দেবে। আপনারা কি এটাকে স্বেচ্ছায় জমি দেওয়া বলবেন? মমতা প্রশ্ন করতেই পাহাড় থেকে জঙ্গল, নিকষ কালো গণ্ডগ্রাম থেকে আলো ঝলমল কলকাতা একবাক্যে বলে উঠল– না।
– তা হলে আপনারা কী চান?
সবাই বলে উঠলেন, পরিবর্তন। এই অবস্থার পরিবর্তন।
– কোন অবস্থার?
গ্রামের মানুষ একসঙ্গে বলে উঠলেন, খাদ্যে মাথা পিছু মোট উৎপাদনের ক্ষেত্রে পিছোতে পিছোতে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান এখন আঠারোয় নেমে এসেছে। এটার পরিবর্তন চাই।
প্রাথমিক শিক্ষকেরা কলকাতার মেট্রোর উলটো দিকে জমায়েত হয়ে বললেন, প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের রাজ্য পঁয়ত্রিশের মধ্যে নামতে নামতে তেত্রিশে এসে ঠেকেছে। এর পরিবর্তন চাই।
মায়েরা কান্না মেশানো গলায় প্রশ্ন তুললেন, শিশুমৃত্যুর হারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান প্রথম সারিতে কেন? এর পরিবর্তন চাই।
জনগণ চিৎকার করে বলল, এ রাজ্যে মাত্র ২৯.৯ শতাংশ মানুষ পরিশ্রুত পানীয় জল পায়। যে সরকার রাজ্যবাসীকে খাওয়ার মতো এক গ্লাস জল দিতে পারে না, সে সরকারের গদি আগলে বসে থাকার কোনও অধিকার নেই। এই অবস্থার পরিবর্তন চাই।
শ্রমিকরা বলে উঠলেন, পি এফ এবং ই এস আইয়ের টাকা মেরে দেওয়ার দৌড়ে এ রাজ্য এখন সবার উপরে। এক্ষুনি এর পরিবর্তন চাই।
কর্মহীন শ্রমিকেরা বললেন, এ রাজ্যে অন্তত পঞ্চান্ন হাজার কলকারখানা বন্ধ। যার ফলে প্রায় পনেরো লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন, এর পরিবর্তন চাই।
নিত্যযাত্রীরা বললেন, সারা ভারতের সমস্ত মহানগরীর মধ্যে কলকাতাতেই কেন ন্যূনতম বাস ভাড়া সবচেয়ে বেশি? এর পরিবর্তন চাই।
মা-বোনেরা চিৎকার করে বললেন, ভারতের যে দু’টি জেলায় সবচেয়ে বেশি নারী ধর্ষণ এবং নারী পাচার হয়, সেই দু’টি জেলাই কেন এই রাজ্যে?
বেকাররা বলে উঠলেন, ভারতের সবচেয়ে বেশি বেকার এখন পশ্চিমবঙ্গে। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যাই এখন ৭৭.২ লক্ষ! এর পরিবর্তন চাই।
একই সঙ্গে গোটা রাজ্য থেকে বয়স্ক মানুষেরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বললেন, এই রাজ্যে মূল্যবোধের সার্বিক অবক্ষয় আমাদের মাথা নিচু করে দিচ্ছে। আমরা এর পরিবর্তন চাই।
এক-একজন বলতে শুরু করলেন, আমরা চাই না আর কোথাও ঘটুক আঁধারগ্রাম, লালগড়, নন্দীগ্রাম, জঙ্গলমহল। চাই না রাজারহাট, মারিচঝাঁপি, নানুর, হলদিয়া, বাসন্তী, ছোট আঙারিয়া বা কেশপুর। চাই না বানতলা, বিজনসেতু। চাই না গণহত্যা, গণনির্যাতন, ধর্ষণ, নারী লাঞ্ছনা, তাপসী মালিকের খুন। চাই না রিজওয়ানুর, কালুয়া ডোম, অরবিন্দু মান্নাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া। আমরা চাই না, শিল্পায়নের নামে ধাপ্পা। কৃষকদের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। খুন, অপহরণ, মিথ্যাচার, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, বিশ্বাসঘাতকতা। চাই না পুলিশি নির্যাতন, সন্ত্রাস, হার্মাদগিরি। জনশুনানির নামে প্রহসন। আদিবাসী সমাজকে পিষে মারা। চাই না বাধ্য হয়ে লোককে করতে হোক ফের আর একটা রেশন বিদ্রোহ। চাই না স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খেলা নিয়ে নোংরা রাজনীতি। উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ। খাল-বিল ভরাট করে টাউন গড়ে তোলা। অরাজকতা। বাকস্বাধীনতায় লাগাম। চাই না টাটা-সালিম কিংবা হিডকো-ডোলদের পদলেহন করুক আমাদের এই সরকার।
তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হল, তা হলে আপনারা কী চান?
গোটা রাজ্যবাসী চিৎকার বলে উঠল, পরিবর্তন। এই অবস্থার পরিবর্তন।
মমতা বললেন, ঠিক আছে, আপনারা চাইলে তা-ই হবে। এ রাজ্যে এ বার পরিবর্তন আসবে। তৈরি হবে মা-মাটি-মানুষের সরকার। আপনারা শুধু আমার পাশে থাকুন। আমাকে আশীর্বাদ করুন। দোয়া করুন। যাতে আমি আপনাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। আপনাদের একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দিতে পারি। সরকারের ছিনিয়ে নেওয়া আপনাদের জমি যাতে আপনাদের ফেরত দিতে পারি। আমি কথা দিচ্ছি, আপনারা সঙ্গে থাকলে আঁধারগ্রামের অনিচ্ছুক কৃষকদের চারশো একর জমি যে ভাবেই হোক, আমি ঠিক ফিরিয়ে দেব। দেবই। কথা দিলাম।
তাঁর কথা শুনে গোটা রাজ্য ধন্য ধন্য করে উঠল।#
চলবে….