ধারাবাহিক উপন্যাস: উত্তাল পঞ্চম পর্ব

গোটা পৃথিবী জুড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জমি নিয়ে যত কেলেঙ্কারি ঘটেছে, তার সালতামামী দিয়ে একটি অসামান্য উপন্যাস ‘উত্তাল’

পঞ্চম পর্ব

ওদের জন্যই বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল ওকে। ও নয় ছিল না। কিন্তু ওর বউ তো ছিল। ওর বউ কি বিছানার তলা থেকে ওই প্লাস্টিক শিটটা বার করে দাওয়ার ওই তক্তপোশটার উপরে বিছিয়ে দিতে পারেনি! ওটা তো অনেক বড়। মাটি অবধি নামিয়ে দিলে কাঠকুটোগুলোও জলের ঝাপটার হাত থেকে বাঁচত!
সবে সন্ধে গড়িয়েছে এর মধ্যেই ঘুম! রান্নার দিকের দেওয়ালে বাঁশের কঞ্চি দেওয়া মাঝারি মাপের একটা জানালা। ও সেখান থেকে মুখ বাড়িয়ে ঘরের ভিতরে তাকাল।
খাটের উপরে মেয়েকে নিয়ে শুয়ে আছে বউ। ঘরের এক কোণে টিমটিম করছে হারিকেন। তেল বোধহয় নেই। দপদপ করছে। কালি পড়ে পড়ে চিমনিটা গেছে। একটু তলিয়ে দেখলে মনে হবে, হারিকেনটা বুঝি ওদের সংসারেরই দুরবস্থার প্রতীক।
জোরে ডাকা যাবে না। কে কোন আড়ালে কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে, কিচ্ছু বলা যায় না। ও ফিসফিস করে ডাকতে যাচ্ছিল, তার আগেই ও দেখল, ওর বউ আধো আলো-অন্ধকারের মধ্যে ধড়মড় করে খাট থেকে নামল। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে জানালার দিকে এক পলক তাকিয়েই, তড়িঘড়ি দরজার খিল খুলে দিল। স্বামী ঘরে ঢুকতেই ফের খিল তুলে দিল সে। – তুমি এলে কেন?
– কেন? কী হয়েছে? বলতে বলতে খাটের উপরে ঝুঁকে মেয়ের কপালে চুমু খেতে যাচ্ছিল ও। রে রে করে উঠল বউ। ওকে উঠিও না। অনেক কষ্ট করে ঘুম পাড়িয়েছি। এ দিকে এসো, এ দিকে এসো। আগে ভেজা জামাকাপড়গুলো ছাড়ো। তার পর… বলতে বলতে দড়িতে মেলা গামছাটা এগিয়ে দিয়ে, আলনায় ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখা জামা-কাপড়ের ভিতর থেকে হাতড়ে হাতড়ে বরের জন্য লুঙ্গি আর বহু বছর আগে পুজোয় কেনা, রংচটা নায়লনের একটা গেঞ্জি বার করে দিল সে। বলল, নাও, এটা পরে নাও। যা ভিজেছ… আবার ঠান্ডা-টান্ডা না লাগে!
জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে তেরো নম্বর বলল, আমি আসাতে তুমি বোধহয় খুব একটা খুশি হওনি, না?
– এ সব কথা বলছ কেন? আমি তোমার জন্যই বলছি। জানো, এখানে প্রত্যেক দিন কত গন্ডগোল হচ্ছে? একে মারছে, তাকে ধরছে। কোথা থেকে এক দল ছেলে যখন তখন বাইক ছুটিয়ে এসে গোটা গ্রাম চক্কর মারছে। কারও কারও বাইকের পিছনে তো পুলিশও বসে থাকে। এর মধ্যে এক দল লোক রাতের অন্ধকারে এসে সমীর কাকুদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে…
তেরো নম্বরের ঘরে কোনও চেয়ার-টেয়ার নেই। খাটে বসতে গেলে মেয়ের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তাই কথা বলতে বলতে মেঝের উপরে মাদুর পেতে দিল ওর বউ।
নীচে বসতে বসতে তেরো নম্বর বলল, তাই নাকি?
বউ বলল, বীজেশ, ওই যে, তেজেশ জেঠুর বড় ছেলে, ওকে তো পাওয়াই যাচ্ছে না।
– সে কী গো?
বউ বলল, তা হলে আর বলছি কী?
– এটা তোমাকে কে বলল?
– সবাই তো বলাবলি করছে। তাদের মুখেই শুনছি। কেন, তুমি কিছু জানো না?
তেরো নম্বর বলল, কই না তো! কেন? কী হয়েছে?
– কেন, এ সব খবর কাগজে বেরোয় না?
– নাহ্। অবশ্য আমি কাগজ দেখিই বা কোথায়!
হতাশ সুরে বউ বলল, আমাদের এই জায়গাটা বোধহয় পৃথিবী থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, না?
– বিচ্ছিন্ন হয়ে নেই। বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে।
– তা হলে কী হবে?
– সব ঠিক হয়ে যাবে, দাঁড়াও।
– কবে আর ঠিক হবে? মরে গেলে?
তেরো নম্বর বলল, এ সব আজেবাজে কথা বলছ কেন? হবে, সবই ঠিক হয়ে যাবে। তবে একটু সময় লাগবে। মনে রাখবে, সবুরে মেওয়া ফলে।
– সে হয়তো ফলবে। কিন্তু সেটা কি আমরা দেখে যেতে পারব!
– পারবে পারবে। খুব পারবে। এই, কিছু খাবার আছে? খুব খিদে পেয়েছে।
– দাঁড়াও দিচ্ছি। এই রে… বলেই, জিভ কাটল তার বউ। তার পর বলল, ভুলেই গিয়েছিলাম, আজ তো রান্নাই করিনি। আসলে একার জন্য আর রান্না করতে ইচ্ছে করে না। কালকের একটু পান্তা ছিল। দুপুরে সেটাই খেয়েছি। ভেবেছিলাম, রাতে মুড়ি খেয়েই কাটিয়ে দেব। একটু অপেক্ষা করো। এক্ষুনি আলু সেদ্ধ ভাত বসিয়ে দিচ্ছি।
– আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। অত খিদে পায়নি। মুড়ি আছে?
– হ্যাঁ আছে। মুড়ি খাবে?
– দাও।
কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মুড়ি খেতে খেতে তেরো নম্বর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, তোমাকে তো আমি ডাকিনি। তুমি বুঝলে কী করে আমি এসেছি?
– তোমার গন্ধে।
– যাঃ। তুমি যা বলো না!
– সত্যি বলছি। আমার হঠাৎ কেন জানি মনে হল, তুমি এসেছ। এক্ষুনি ডাকবে। তাই তোমার ডাকার আগেই আমি উঠে পড়লাম।
– ও ঘুমোচ্ছে, না?
– তোমার মেয়ে যা… অত সহজে ঘুমোয়। সেই সন্ধে থেকে নিয়ে শুয়ে আছি। শুয়ে থাকতে থাকতে আমারই চোখ লেগে আসছে, তবু ওর চোখে ঘুম নেই। এই তো সবে শুল।
– আমার কথা বলে?
– ওর মুখে কি বুলি ফুটেছে যে বলবে। তবে তুমি যে দিন চলে গেলে সে দিন থেকে বেশ কয়েকটা দিন এ দিক ও দিক তাকিয়ে তাকিয়ে ও তোমাকে খুব খুঁজত। আমি বুঝতে পারতাম।
– সত্যি, কী থেকে কী হয়ে গেল, না! শ্যামলরা যে বলেছিল, যারা জমি দিতে চায় না, তারা সবাই মিলে একটা প্রতিরক্ষা কমিটি গড়ে তুলবে। সেটার কী হল?
বউ বলল, হয়েছে তো। বীজেশই তো ওটার মাথা।
– তাই? তা, এখানে যে এ রকম একটা কমিটি তৈরি হয়েছে, ওরা খবর পায়নি? কোনও ঝামেলা-টামেলা করেনি?
– না, ওই কমিটি হওয়ার পর কিন্তু ওরা আর এ দিকে খুব একটা আসে না। বাইক নিয়ে যে ছেলেগুলো চক্কর মারত, ওদেরও ক’দিন দেখিনি।
– তা হলে ওই কমিটি করে একটা কাজের কাজ হয়েছে বলো… এটা আরও আগে করতে পারলে ভাল হত।
– তাও তো বীজেশ ছিল বলে, না হলে হত?
এখানকার লোকগুলো যা…
– দেখি, কাল সকালে তা হলে বীজেশের কাছে একবার যাব।
– সে কি আছে নাকি?
তেরো নম্বর জানতে চাইল, কেন? কোথায় গেছে?
– তোমাকে বললাম না… গত পরশু থেকে ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।
– পাওয়া যাচ্ছে না মানে? ও কি হারিয়ে গেছে নাকি? অত বড় দামড়া একটা ছেলে। বাড়িতে বলে যায়নি?
– সে রকমই তো শুনলাম। একটু আসছি বলে সেই যে বেরিয়েছে; আর নাকি ফেরেনি।
– এ আবার কী কথা!
হঠাৎ মেয়ের কান্না শুনে তেরো নম্বর ঝট করে উঠে গেল। খাটের উপরে হুমড়ি খেয়ে দু’হাত দিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল তার গাল, কপাল, হাত, পা, মাথা। দু’মিনিটও লাগল না, মেয়ে একদম শান্ত হয়ে গেল।
– তুমি এত জোরে জোরে কথা বলো না… দিলে তো মেয়েটার ঘুম ভাঙিয়ে… এখন সারা রাত জ্বালাবে…
বউয়ের কথা শুনে ও বলল, জ্বালাক। জ্বালালে আমাকে জ্বালাবে। তোমার কী?
– দেখব, কতক্ষণ রাখতে পারো।
– পারব রে বাবা, পারব। বলতে বলতে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে দু’-চারটে থাবড়া দিতেই ফের ঘুমে ঢলে পড়ল মেয়ে। তবু তাকে বিছানায় না শুইয়ে কোলে নিয়েই মাদুরের উপরে বসে পড়ল। মুড়ি খেতে খেতে হঠাৎ কী মনে পড়তেই সে বলল, এই রে, একদম ভুলে গেছি, শুকনো লঙ্কা আছে?
অবাক হয়ে ভ্রু কোঁচকালো বউ। শুকনো লঙ্কা?
– একটু পোড়াবে?
– এই রাতদুপুরে শুকনো লঙ্কা পোড়া খাবে? মুড়ি তো শেষ হয়ে গেছে। আরও দেব?
– না না, খাবার জন্য বলছি না। এমনিই পোড়াও না…
– কিন্তু পোড়াতে গেলে তো লঙ্কার ঝাঁঝে মেয়ের ঘুম ভেঙে যাবে!
– ওঃ হো। তাও তো… তা হলে একটা কাজ করো। মোমবাতি আছে?
– মোমবাতি!
তেরো নম্বর বলল, কুপি হলেও চলবে।
– তুমি কী চাইছ ঠিক করে বলো তো।
– না গো, আসলে হয়েছে কি জানো, আসার সময় কতগুলো ছায়া ছায়া মতো কী যেন দেখলাম। ভূত-টুত কি না কে জানে!
বউ বলল, সেটা আগে বলবে তো। ঘরে ঢোকার আগে ওগুলো করতে হয়।
– বলার আর সুযোগ পেলাম কোথায়!
– দাও, মেয়েকে দাও। খাটে শুইয়ে দিই।
স্বামীর কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিয়ে ও একটা কুপি ধরিয়ে নিয়ে এল। সেই কুপির শিখাটাকে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে একবার এ দিক একবার ও দিক করে তিন বার কাটল সে। তার পর বউয়ের এগিয়ে দেওয়া দা’টাকে ছুঁল। ওদের বিশ্বাস, ভূত-পেতনি পিছু নিলেও আগুন আর লোহা ছুঁলেই নাকি সেটা কেটে যায়!
দা আর কুপিটাকে নিয়ে খাটের তলায় বউ রাখতে যেতেই, নিজের মনেই স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করে তেরো নম্বর বলল, কী সুন্দর, লোহা আর আগুন ছুঁলেই ভূতের কবল থেকে কেমন রেহাই পাওয়া যায়! আহা, এ রকম যদি কোনও কিছু থাকত, যেটা ছুঁলেই ওই লোকগুলোর থাবা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে, তা হলে কত ভাল হত, না!#

চলবে…

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস: উত্তাল চতুর্থ পর্ব

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!