।।আট।।
দূর থেকেই তেরো নম্বর দেখল, পাকুড় গাছটার কাছে ভিড়ে-ভিড়াক্কা। গোটা গ্রাম যেন ভেঙে পড়েছে। পুলিশদের নিশ্চয়ই লাশ বার করতে অসুবিধে হচ্ছে, তাই মাঝে মাঝেই লাঠি উচিয়ে তেড়ে আসছে। ফলে লাশকে ঘিরে হুমড়ি খেয়ে পড়া ভিড় পিছু হটছে। পুলিশ আবার মৃতদেহের কাছে যেতেই যে কে সেই।
এখানে রাস্তাঘাট বলতে তেমন কিছু নেই। গ্রামের লোকেরা এর বাড়ির পিছন দিয়ে, তার পুকুরের পাড় দিয়ে, ওর বাগানের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে এক-একটা পায়ে চলা পথ তৈরি করে নিয়েছে। সব ক’টাই মেঠো পথ। ইট বিছানো রাস্তা রয়েছে খানিক দূরে। ভ্যানরিকশাই যাতায়াত করে বেশি। তবে মাঝেমধ্যে অসুস্থ লোক নিয়ে একটা দুটো অটো কিংবা বিয়ের মরশুমে বরযাত্রীদের নিয়ে ট্রেকার অথবা পাকাবাড়ি বানানোর জন্য ইট, সিমেন্ট, বালি, অ্যাসবেস্টস নিয়ে মিনি ম্যাটাডরও আসে-যায়।
সেই ইটরাস্তার দিকে চোখ পড়তেই ও দেখতে পেল, একটা পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে।
পুলিশ আছে। গ্রামের লোকজনও আছে। তার মানে ওরা নেই। ওরা মানে, খতম তালিকার তেরো নম্বরে ওর নাম যারা লিখে রেখেছে। বাইক ছুটিয়ে যখন তখন এসে গোটা গ্রাম দাপিয়ে বেড়ায়। মেয়ে-বউদের দিকে হাত বাড়ায়।
ওরা যখন নেই, ভয়েরও কিছু নেই। এটা ভাবতেই সকালের মিঠে রোদটা বড় মিষ্টি মনে হল তার। মনে হল, এই ফুরফুরে হাওয়াতেই তো বুক ভরে শ্বাস নিতে হয়। অনেক দিন পর অদ্ভুত একটা জংলা গন্ধ ওর নাকে ভেসে এল। যে গন্ধটা খুব ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে জঙ্গলে খেলতে খেলতে ও প্রায়ই পেত।
গ্রামের ও দিকের শেষ প্রান্তে একটা বিশাল বটগাছ ছিল। গাছটা কোন যুগের কে জানে! বাপ-ঠাকুরদা, কি তারও আগের আমলের হবে হয়তো। গাছটা থেকে অজস্র ঝুরি নেমে এসেছিল। কোনও-কোনওটা মাটি ভেদ করে, শেকড় চালিয়ে, এক-একটা কাণ্ড হয়ে গিয়েছিল। মনে হত, বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া গাছটাকে পিলারের মতো ঠেকনা দিয়ে রেখেছে ওগুলো। কোনও-কোনওটা ছিল মাটি ছুঁই ছুঁই। সে রকমই পাশাপাশি নেমে আসা লম্বা দুটো ঝুরি বেঁধে ওরা একটা দোলনা মতো বানিয়ে নিয়েছিল। সকাল দুপুর বিকেল যখনই ও দিকে যেত, দু’বন্ধু মিলে সেটায় দোল খেত। দু’বন্ধু মানে সে আর বীজেশ। যার দেহ এখন পড়ে আছে ওই জটলার মাঝখানে।
একবার দোল খেতে খেতে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সূর্য ঢলে পড়েছিল ওরা খেয়াল করেনি। আর এখানে সূর্য ঢলে পড়া মানেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসা। এসেওছিল তাই। যখন খেয়াল হয়েছিল, তখন চার দিকে বেশ অন্ধকার। আর সেটা দেখেই ভয়ে ওদের গা ভার হয়ে এসেছিল।
এখানে যেমন যত্রতত্র শিব মন্দির আছে, বাড়িতে বাড়িতে তুলসী মঞ্চ, সন্ধ্যা হলেই এ বাড়ি সে বাড়ি থেকে ভেসে আসে শঙ্খধ্বনী, তেমনি এ গাছ সে গাছ, এ পাড়া ও পাড়া নিয়ে শোনা যায় নানা কানাঘুষো। কেউ বলেন, সন্ধ্যা হলেই ওই পুকুরপাড়ে শাকচুন্নিরা এসে ভিড় করে। পাশ দিয়ে কেউ গেলেই মাছের মতো পেট টিপে হয় তাঁদের পাঁকের মধ্যে ঠেসে দেয়, নয়তো কাঁচা মাছের মতো কচকচ করে চিবিয়ে খায়।
কেউ বলেন, সন্ধ্যা হলেই ওঁদের বাড়ি লাগোয়া বাঁশঝাড়ের বাঁশগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে টানটান হয়ে এলিয়ে শুয়ে থাকে। আচমকা দেখলে যে কোনও লোক ভাববেন, হয়তো গোড়ায় তেমন মাটি ছিল না, তাই দমকা বাতাসে বাঁশগুলো এ ভাবে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। ‘যাই, সাবধানে ডিঙিয়ে যাই’, এই ভেবে যেই ওটা ডিঙোতে যাবে, অমনি বাঁশগুলো লোকটাকে নিয়ে ঝট করে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুম করে উপরে উঠেই, হড়হড় করে পড়ে তার দফারফা হয়ে যাবে।
আবার কেউ বলেন, ওদিকটায় যে শিমুল গাছটা আছে, রাতে কী হয় জানি না, তবে ভরদুপুরে আমি নিজের চোখে দেখেছি, ওই গাছটার নীচের দিকের একটা মোটা ডালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে একটা ব্রহ্মদত্যি। নীচ দিয়ে কেউ গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ঘাড় মটকে দেয়।
কত লোক যে কত কী বলেন! ছোটবেলা থেকে লোকের মুখে এ সব শুনতে শুনতে বড় হয়েছে ওরা। তাই সন্ধেবেলায় খাটে বসে পড়তে পড়তে সামনের হারিকেনের আলোয় নিজের ছাঁয়া পিছনের দেওয়ালে বিশাল হয়ে পড়তে দেখে কত দিন যে আঁতকে উঠেছে। তার পরেই ভাল করে দেখেছে, কেউ কোত্থাও নেই। অথচ, কত দিন মনে হয়েছে, এই বুঝি কেউ সরে গেল। এই বুঝি জানালা দিয়ে কেউ হাত বাড়াল। রাতে হিসি পেলেও ওরা কেউ একা একা যেতে সাহস পেত না। অনেক বড় বয়স অবধি বাড়ির কাউকে না কাউকে সঙ্গে করে ডেকে নিয়ে যেত। যদি হিসি পেয়ে যায়! সেই ভয়ে রাতে খাওয়ার পর জল পর্যন্ত খেত না।
শুধু তেরো নম্বর বা বীজেশই নয়, গ্রামে গ্রামে যতই লাইট ঢুকুক, যতই বিজ্ঞান পড়ে পড়ে বাচ্চারা জেনে যাক ভূত বলে আসলে কিছু হয় না। তবু, তাদের গ্রাম, আশপাশের গ্রাম, এমনকী সারা পৃথিবীর সব ক’টা গ্রামের বাচ্চাই বুঝি মনে মনে ভূতের ভয় নিয়েই বড় হয়। সেই ভয়কে আরও উসকে দেয় দাদু-দিদা, ঠাকুমা- ঠাকুরদার কাছে রাতে শুয়ে শুয়ে শোনা নানান ভূতের গল্প। যে সব ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না, সে রকম অনেক ছোটখাটো ঘটনাও।
সে দিন সেই বটগাছটায় দোল খেতে খেতে চারদিকে অন্ধকার নেমে আসার পর ওরা দুই বন্ধু যখন ভয়ে জড়সড় হয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে, হঠাৎ নির্জন জঙ্গলের মধ্যে ওরা শুনতে পেল একটা বাচ্চার গোঙানি। এ রকম জনমানবশূন্য জঙ্গলের মধ্যে বাচ্চা আসবে কোথা থেকে! তাও এত কচিবাচ্চা! মনে হচ্ছে দুধের শিশু কাঁদছে! মাঝে মাঝেই চিল-চিৎকার দিয়ে উঠছে।
ওরা ইতিউতি দেখতে লাগল। যে ভাবে বাচ্চাটা বুক-বিদীর্ণ করে কাঁদছে, তাতে মনে হচ্ছে, বাচ্চাটার সঙ্গে তার মা-বাবা কিংবা বড় কেউ নেই! থাকলে নিশ্চয়ই এতক্ষণ ধরে তাকে কাঁদতে হত না। কেউ না-কেউ ঠিক তাকে চুপ করিয়ে দিতেন। যদি তার সঙ্গে কেউ না-ই থাকেন, তা হলে এই বাচ্চাটা এখানে একা একা এল কী করে! তা হলে কি ওকে কেউ এখানে ফেলে দিয়ে গেছে!
হতে পারে! ক’দিন আগে নাকি এই জঙ্গলের মধ্যেই কে যেন একটা বাচ্চাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল। কেন রেখে গিয়েছিল, বীজেশ জানে না। তবে বড়দের এ নিয়ে ফিসফাস করতে শুনেছিল। ওখানে যে একটা বাচ্চা পড়ে আছে, সেটা নাকি কেউই টের পেত না। কথায় আছে না– ঈশ্বর যাকে বাঁচায় তাকে মারবে কে? এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। মাঠে নাকি কয়েক জন কাঠ কাটতে যাচ্ছিল। হঠাৎ কতগুলোচিল-শকুনকে আকাশে চক্কর মারতে দেখে প্রথমে নাকি ওদের মনে হয়েছিল, কেউ হয়তো কুকুর-বেড়াল বা গরু মরা ফেলে গেছে। তাই খাওয়ার জন্য ওরা উপরে উড়ছে। তার পরেই নাকি তাদের কেমন একটা সন্দেহ হয়, তারা সেই শকুনগুলোকে লক্ষ্য করে করে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে দেখে, একটা বড় গাছের নীচে কাপড় দিয়ে জড়ানো একটা সদ্যোজাত। ওদের মধ্যে থেকে একজন তড়িঘড়ি বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়েছিল। যেই নিয়েছে, অমনি লাফিয়ে উঠে ‘ধর ধর’ বলে কোনও রকমে আর একজনের কোলে বাচ্চাটাকে দিয়েই ও হাত ডলতে লাগলেন। তার হাত নাকি জ্বলে যাচ্ছে। তখন বোঝা গেল, বাচ্চাটার সারা গা লাল কাঠপিঁপড়ে একেবারে ছেকে ধরেছে। তারই একটা কামড়েছে তাঁর হাতে। সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা হুমড়ি খেয়ে বাচ্চাটার শরীর থেকে একটা-একটা করে সব ক’টা পিঁপড়েকেই তুলে ফেলল।
এটা কী করে হল! বাচ্চাটা তো একটুও কাঁদছিল না। তা হলে কি এই বাচ্চাটাকে একটা পিঁপড়েও কামড়ায়নি! এটা হতে পারে! বাড়িতে নিয়ে আসতেই মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। কে আগে বাচ্চাটাকে নেবে।
কী ফুটফুটে দেখতে। চোখ পিটপিট করছে। আর শুধু হেসেই যাচ্ছে। এতক্ষণ মাটির মধ্যে পড়ে ছিল, হয়তো পোকামাকড় কামড়েছে কিংবা কী না কী গায়ে উঠেছে, কোনও ঠিক আছে! তাই তাকে ভাল করে পয়-পরিষ্কার করার পর, নিমপাতা সেদ্ধ করে, সেই জল ঠান্ডা করে তার সারা গা মুছিয়ে দেওয়া হল। তার পর কার কাছে ও থাকবে, এ নিয়ে যখন কথা হচ্ছিল, তখন কেউ বলেছিলেন, ও কোন না-কোন জাতের, আমরা জানি না। ওকে ঘরে তুলি কী করে? কেউ বলেছিলেন, কার না-কার পাপ, খামোকা আমরা কেন তার দায়িত্ব নিতে যাব? আবার কেউ বলেছিলেন, নিশ্চয়ই ভদ্রঘরের বাচ্চা নয়, যদি হত, তা হলে যত কষ্টই হোক, এ ভাবে ফেলে যেত না। কেমন মা কে জানে! নিজের সন্তানকে কেউ কি এ ভাবে নির্ঘাত মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে যেতে পারে!
যখন নানা জন নানা কথা বলছেন, তখন বাচ্চাটির মাথা কখন যে কাত হয়ে গেছে, বুকের ধুকপুকুনি থেমে গেছে, গোটা শরীর ঠান্ডা হতে শুরু করেছে, কেউ টেরই পাননি। যখন টের পেলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। ওইটুকু একটা বাচ্চা, তাকে তো আর পোড়ানো যায় না। যারা জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছিল, তারাই তাকে কোলে করে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে কোথায় যেন পুঁতে দিয়ে এসেছিল। ফেরার পথে কে যেন বলেছিল, কেউ রাখতে চাইছিল না দেখে, অভিমান করে ও নিজেই চলে গেল!
তা হলে কি এটাও সে রকম কোনও কেস! বাচ্চাটা অবৈধ, তাই ফেলে রেখে গেছে! নাকি তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধ হওয়ার জন্য কোনও তান্ত্রিক কোনও শিশুসন্তানকে তুলে নিয়ে এসেছে কোথাও থেকে। এখানে লুকিয়ে রেখে গেছে। রাতে এসে যজ্ঞটজ্ঞ করে, এই শিশুটিকে আহুতি দেবে! কিংবা কোনও প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার পরে তার সামনে তাকে বলি দেবে! কী যে হবে কে জানে! নাকি কোনও জংলি জানোয়ার ধরার জন্য দূরের অন্য কোনও গ্রাম থেকে চোরাশিকারিরা এই বাচ্চাটিকে এখানে রেখে গেছে টোপ হিসেবে। যাতে মানুষের গন্ধ পেয়ে ছুটে এলেই, তাদের পাতা ফাঁদে ধরা পড়ে যায় কোনও হিংস্র জন্তু।
নাকি ওই বাচ্চাটাকে এখানেই কবর দিয়ে গিয়েছিল ওরা! সে এখন ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা তার কান্না নয় তো! আরও একটু কান পেতে শুনল তারা। হ্যাঁ, কান্নাটা কেমন যেন নাকি সুরে মনে হচ্ছে! তা হলে এটা নির্ঘাত সেই বাচ্চা-ভূতের কান্না! আর এক মুহূর্ত এখানে নয়, চল, পালাই। বলেই, ছুট লাগিয়েছিল বীজেশ। পিছু পিছু ও-ও। কিন্তু কোথায় পালাবে। ওদের দু’জনের পা-ই যে আর সরছে না। মনে হচ্ছে পাগুলো যেন ওদের নয়। পায়ে কোনও সার নেই। মাটি যেন ওদের চারটে পা-কেই আঁকড়ে ধরে আছে।
চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল ওদের। কিন্তু চিৎকার করতে পারলে তো! ওদের গলা দিয়ে যে আওয়াজই বেরোচ্ছে না। ঠিক তখনই ওরা দেখল, মাথার উপর দিয়ে ইয়া বড় বড় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে কী যেন একটা উড়ে গেল। একটা, না দুটো, নাকি একটাই দু’বার চক্কর মেরে গেল, ওরা বুঝতে পারল না। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে গেল।
যখন জ্ঞান ফিরল, তখন বীজেশের বাড়িতে বীজেশ। তেরো নম্বরের বাড়িতে তেরো নম্বর। খাটের উপরে চিত হয়ে শুয়ে আছে। কখন সকাল হয়েছে, পাশের গ্রাম থেকে সুজন বদ্যি এসে তাদের দেখে গেছে, ওরা টেরও পায়নি।
পরে শুনেছিল, রাত হয়ে গেছে, অথচ ছেলে বাড়ি ফিরছে না দেখে দু’জনের বাড়ির লোকেরাই খুব চিন্তা করছিলেন। ওরা তো কোনও দিন এ রকম করে না। নিশ্চয়ই কোনও বিপদ-আপদ হয়েছে! এটা মনে করেই, উভয় বাড়ির লোকেরা তাদের ছেলেদের খোঁজ করার জন্য ওদের বিভিন্ন বন্ধুদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানেই ওদের বন্ধুদের কাছে জানতে পেরেছিলেন, জঙ্গলের মধ্যে বটগাছের ঝুরি বেঁধে ওদের মাঝে মাঝেই দোল খেতে যাওয়ার কথা। শোনামাত্র জঙ্গলের দিকে হাঁটা দিয়েছিলেন তাঁরা। তখন বেশ অন্ধকার। কখন কোথা থেকে সাপখোপ বেরোয় কোনও ঠিক আছে! তাই হাতে হাতে লন্ঠন, টর্চ আর লম্বা লম্বা লাঠি নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে ওঁরা হঠাৎ দেখেন জঙ্গলের মধ্যে দুই বন্ধু পাশাপাশি পড়ে আছে। দু’জনেই অজ্ঞান।
জ্ঞান ফেরার পর ওদের ঘিরে শুধু পরিবারের লোকজনরাই নয়, আশপাশের বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত এসে ভিড় করেছিলেন। কী দেখে ওরা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, তা শোনার জন্য প্রচণ্ড উদ্গ্রীব হয়ে ছিলেন ওঁরা। চোখ খুলে একটু ধাতস্ত হয়ে, গরম দুধের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বীজেশ ওর বাবা-মামা, কাকা-কাকি, জ্যাঠা-জেঠিকে বলেছিল, কিছু দিন আগে সেই যে তাঁরা একটা বাচ্চাকে জঙ্গলের মধ্যে কবর দিয়ে এসেছিলেন, সে এখন ভূত হয়ে গেছে। ওরা তার কান্না শুনেছে। আর সেটা শুনেই ওরা নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। কথাগুলো বলার সময় বীজেশের চোখ-মুখ যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল। ভয়ে একদম কুঁকড়ে যাচ্ছিল।
বীজেশের কথা শুনে ওর জেঠু বলেছিলেন, কান্নাটা কোনও বাচ্চার গোঙানির মতো কি?
– হ্যাঁ হ্যাঁ, বলেই আরও জড়সড় হয়ে মায়ের কোলের মধ্যে মুখ গুঁজেছিল সে।
ওর জেঠু বলেছিলেন, ধুর বোকা। ওটা তো আমরাও শুনেছি। ওই গোঙানিটা শুনেছিলাম বলেই তো আমাদের বেশি খুঁজতে হয়নি। অত সহজে তোদের দেখতে পেয়ে গিয়েছিলাম। না-হলে যে কী হত!
মায়ের কোলের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে বীজেশ বলেছিল, ভূতের গোঙানি শুনে আমাদের দেখতে পেয়েছিলে, মানে? বুঝলাম না।
– আরে গাধা, ওটা তোর ভূতের গোঙানি বলে মনে হল? আগে ভাল করে শুনবি তো। মানুষের বাচ্চা বললেও না-হয় একটা মানে হত। তুই না দিনকে দিন একেবারে… কী আর বলব। ওর জেঠু বলেছিল।
– তা হলে ওটা কীসের গোঙানি?
–ওটা কোনও গোঙানিই নয়। সন্ধ্যার পরেও মা ঘরে না-ফিরলে শকুনের বাচ্চাগুলো একেবারে মানুষের বাচ্চার মতো কাঁদে।
বীজেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল। – তাই?
ও দিকে তেরো নম্বর তখন ভুলভাল বকছে। কী বলতে কী বলছে ও নিজেও বুঝতে পারছে না। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে জঙ্গলের সেই ভয়ের রেশ তখনও তার ঘাড় থেকে নামেনি। মাঝে মাঝেই এ দিকে ও দিকে তাকাচ্ছে। ভয়ানক এক ভয়ে থেকে থেকেই আঁতকে উঠছে। দরজার দিকে তাকিয়ে বলছে, ওখানে কে গো?
বাড়ির বড়দের মুখ শুকিয়ে কাঠ। ছেলের যে কী হল! রান্নাবান্নাও হচ্ছে না। এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে যে যা দিয়ে যাচ্ছেন, সেগুলোও ধরা পড়ে থাকছে। খাবার মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না কারও। তেরো নম্বরের দাদু তো বারবার করে বলছিলেন, শোনো দাদুভাই, তুমি তো আমার কথা বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে বলছি, ভূতটুত বলে কিছু নেই। ও সব বাজে কথা। শোনো, ভূত বলে যদি কিছু থাকত, তা হলে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত লোক মারা গেছে, তারা সবাই-ই ভূত হত। শুধু মানুষ কেন? বাঘ-ভালুক, হাতি-ঘোড়া, কুকুর-বিড়াল, সাপ-ব্যাঙ– সবাই, সবাই, সবাই-ই ভূত হত। একবার ভেবে দ্যাখো তো, অত ভূত যদি পৃথিবীতে থাকত, তা হলে কি আমরা এখানে থাকতে পারতাম? না– আমাদের থাকার জায়গা হত?
চলবে…
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ৭