বাংলা সাহিত্যের গবেষকদের মতে, খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতকের বাংলা সাহিত্যে বৈচিত্র্য থাকলেও এতে প্রধানতঃ সপ্তদশ শতকের জের টানা হয়েছিল। এসময়ে ধর্মমঙ্গল, কৃষ্ণলীলা, রামায়ণ-কাহিনী, ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের কাহিনী প্রভৃতি বাঙালি কবিদের উপজীব্য হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া ভাগীরথী-তীরবর্তী বাঙালি নাগরিক সমাজে তখন বিদ্যাসুন্দরের প্রণয়-কাহিনী জনপ্রিয় ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, নবাবী আমলের বাংলার প্রধান তিনজন কবি ছিলেন—রামেশ্বর ভট্টাচার্য, ভারতচন্দ্র রায় এবং রামপ্রসাদ সেন। এঁদের রচনাগুলিকে মোটামুটিভাবে সমসাময়িক বলা চলে।
নবাবী আমলের বাংলার এই তিন কবির মধ্যে ‘শিব সঙ্কীর্তন’ বা ‘শিবায়ন’ কাব্যের রচয়িতা রামেশ্বর ভট্টাচার্য বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত ঘাটাল মহকুমার যদুপুর নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। (বিস্তারিত তথ্যের জন্য রামেশ্বরের শিবায়ন কাব্য, যোগিলাল হালদার কর্তৃক সম্পাদিত সংস্করণ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৭ সাল দ্রষ্টব্যঃ।) কিন্তু কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের মতোই তিনিও তাঁর জীবনের একসময়ে স্থানীয় প্রশাসনের অত্যাচারের ফলে স্বগ্রাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপরে তিনি বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত কর্ণগড়ের রাজা যশোমন্ত সিংহের আশ্রয় লাভ করেছিলেন, এবং তাঁর নির্দেশে কাব্য রচনা করতে শুরু করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি খুব সম্ভবতঃ ১৭৩৫ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে নিজের কাব্যগুলি রচনা করেছিলেন। তবে তিনি শৈব ছিলেন নাকি শাক্ত ছিলেন—এবিষয়ে ইতিহাস থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু তাঁর ধর্মমত যে উদার ছিল, একথার প্রমাণ তাঁর রচিত ‘সত্যপীরের কথা’ নামক কাব্য থেকে পাওয়া যায়, যাতে মুসলমান কলন্দর (Qalandar) রূপে বিষ্ণুর আবির্ভাব কল্পনা করা হয়েছে বলে দেখা যায়।
রামেশ্বর দাবি করেছিলেন যে, তাঁর কাব্যগুলি—‘ভবভাব্য ভদ্রকাব্য’, এবং তাঁর এই দাবি যে ভিত্তিহীন ছিল না, একোঁথ সাহিত্য সমালোচকরাও স্বীকার করে থাকেন। কেননা, ভারতচন্দ্রের রচনায় যে অশ্লীলতা দেখতে পাওয়া যায়, এরসঙ্গে তুলনা করলে রামেশ্বরের কাব্যকে মোটামুটিভাবে অশ্লীলতা দোষ থেকে মুক্ত বলা যেতে পারে। কিন্তু তাঁর কাব্যের প্রধান দোষ হল যে, এতে তিনি অনুপ্রাসের অতিরিক্ত ব্যবহার করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের গবেষকদের মতে, এটা সম্ভবতঃ তাঁর সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্যের ফল ছিল। কিন্তু সেকালের প্রচলিত ভাঁড়ামি তাঁর কোন রচনায় স্থান পায়নি; বরং নির্মল, শুভ্র ও সংযত হাস্যরসে তাঁর কাব্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে রয়েছে।
রামেশ্বরের জীবন সেযুগের কৃষিনির্ভর গ্রামে অতিবাহিত হয়েছিল বলে তিনি তাঁর রচিত কাব্যগুলিতে গ্রাম্য জীবনের একজন সফল চিত্রকর হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। সেযুগের কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর রচিত কাব্যে নানারকমের তথ্য পাওয়া যায়। এই কাব্যগুলি থেকে একথাও জানা যায় যে, সেকালে ব্রাহ্মণরাও স্বহস্তে কৃষিকাজ, গোপালন এবং গোচারণ করতেন। বাংলার এই কবি তাঁর কাব্যে শিবের কৃষিকাজ করবার বর্ণনা যেমন দিয়েছিলেন, তেমনি আবার এপ্রসঙ্গে তখনকার কৃষকদের দুঃখের কথাও বলেছিলেন। একটা উদাহরণ নিম্নরূপ—
“অনেক যতনে ক্ষেতে শষ্য উপস্থিত।
শুখা হাজা পড়িলে পশ্চাতে বিপরীত॥
গরীবের ভাগ্যে যদি শষ্য হয় তাজা।
বার কর্যা সকল আনয়ে (বিকিয়া?) লয় রাজা॥
ক্ষেতে দেখ্যা খন্দ যদি খাত্যে নাই পায়।
কুতকাতে কায়েত কিফাত করে তায়॥”
তাঁর কাব্য থেকে জানা যায় যে, সেকালে মধ্যবিত্তের গৃহে নগদ টাকার অভাবে গৃহিনীদের ‘শাঁখা পরার সাধ’ মেটানো কঠিন হলেও কৃষিজাত দ্রব্য উৎপন্ন করে ভোজনে প্রাচুর্যের ব্যবস্থা করা কিন্তু সম্ভব ছিল। অতীতে এপ্রসঙ্গে ডঃ সুকুমার সেন তাঁর ‘বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছিলেন—
“পার্শ্বতী রন্ধন করিয়া স্বামীপুত্রকে যেভাবে পরিতোষ সহকারে আহার করাইয়াছেন, সেইভাবে আহার করাইতে পারিলে বর্তমান কালের নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের মহিলারা আপনাদিগকে ভাগ্যবতী মনে করিতেন।”
তখনকার বাংলায় পারিবারিক উৎসবে শুধু আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের জন্য নয়, বরং অনাহৃত রবাহত সকলের জন্যও গৃহদ্বার সবসময় উন্মুক্ত থাকত। তবে সেযুগের হিন্দুদের মধ্যে কৌলিন্য প্রথার বাড়াবাড়ি ছিল। কারণ, রামেশ্বরের কাব্যে দেখা যায় যে, বিবাহিতা কন্যার পতিগৃহে যাত্রার সময় তাঁর মা জামাইকে বলছেন—
“কুলীনের পোকে আর কি বলিব আমি।
বাছার অশেষ দোষ ক্ষমা কৈর তুমি॥
আঁঠু ঢাক্যা বস্ত্র দিবা পেট ভর্যা ভাত।
প্রীত কৈর যেমন জানকী রঘুনাথ॥”
রামেশ্বরের কাব্যগুলিতে বিলাসিতার কোন নামগন্ধ পাওয়া যায় না, বুরং এতে সরল অনাড়ম্বর জীবনের ছবি অক্ষরে অক্ষরে ফুটে উঠেছে বলেই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাঁর কাব্যের এসব ছবি আবার অনেক ক্ষেত্রেই তখনকার বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত ছিল। কারণ, সেকালের বহুপত্নীক কুলীনের অধিকাংশ স্ত্রীর পক্ষে স্বামীসঙ্গ লাভ করাই আকস্মিক সৌভাগ্য ছিল; রামেশ্বরের কাব্যের জানকী-রঘুনাথের মত ‘প্রীত’ তো দূরের কথা, স্বামীর কাছ থেকে ‘আঠ ঢাক্যা বস্ত্র’ পাওয়ার সম্ভাবনাও তাঁদের ছিল না।
সাহিত্য সমালোচকদের মতে, রামেশ্বরের ব্যক্তিগত জীবনে বৈচিত্র্যের অভাব ছিল বলেই তাঁর অভিজ্ঞতা তৎকালীন বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের গ্রামাঞ্চলগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; তখনকার বৃহত্তর জগতের সঙ্গে পরিচয়ে এবং জীবনের বিভিন্ন সংঘাতে তাঁর চিত্ত কখনোই উদ্বেলিত হয়নি। অন্যদিকে ভারতচন্দ্রের জীবনে এবং অভিজ্ঞতায় বৈচিত্র্য থাকলেও তাঁর সুখ-দুঃখের অনুভূতি সেযুগের সীমাবদ্ধ ও সঙ্কীর্ণ সমাজে কখনো বিকশিত হতে পারেনি। তবে বংশগৌরব এবং অর্থ স্বাচ্ছল্যের দিক থেকে তিনি রামেশ্বরের থেকে অনেক উঁচুস্তরের মানুষ ছিলেন।
ঐতিহাসিকদের মতে, খুব সম্ভবতঃ ১৭১০ সালের কাছাকাছি কোন সময়ে গঙ্গার পশ্চিম তীরে, রাঢ় দেশের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ভুরশুট বা ভূরিশ্রেষ্ঠী অঞ্চলে ভারতচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল। তিনি নিজেই তাঁর কাব্যে আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন যে, তিনি ভরদ্বাজ বংশের মুখটি কুলের সন্তান ছিলেন। যদিও তাঁর পিতা পান্ডুয়া পেড়ো গ্রামের রাজা, অর্থাৎ—জমিদার ছিলেন, কিন্তু তবুও বর্ধমানরাজের ক্রোধে তিনি বাল্যকালেই রাজ্যহারা হয়েছিলেন। ফলে ভারতচন্দ্রের প্রথম জীবন দুঃখ-কষ্টের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছিল। এসময়ে তিনি কয়েক বছর ধরে মাতুলালয়ে বাস করেছিলেন, এবং সেসময়ে সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষা শিক্ষা করেছিলেন। এরপরে তাঁর অগ্রজ সহোদরেরা বর্ধমানরাজের অধীনে পৈত্রিক সম্পত্তির ইজারাদার হলে তিনি এই সম্পত্তির মোক্তার-রূপে বর্ধমানে গিয়েছিলেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই যথাসময়ে রাজস্বের টাকা না পেয়ে বর্ধমানরাজ এই ইজারা সম্পত্তি খাস করে দিয়েছিলেন, এবং তাঁর নির্দেশে মোক্তারকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। এর অল্পকাল পরে কারামুক্ত হয়ে ভারতচন্দ্র উড়িষ্যায় চলে গিয়েছিলেন। উড়িষ্যায় তখন নাগপুরের ভোঁসলে রাজার অধিকার স্থাপিত হয়েছিল বলে ভারতচন্দ্র সেখানকার মারাঠা সুবাদার শিবভট্টের কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণ করে শ্রীক্ষেত্রে বাস করতে শুরু করেছিলেন। এসময়ে পুরীতে থাকবার সময়ে যদিও গেরুয়া বসন গ্রহণ করেছিলেন, এবং ভজন-কীর্তনে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু তবুও বৈষ্ণবধর্মের প্রতি তাঁর প্রকৃত অনুরাগ তো সঞ্চারিত হয়ই নি, বরং তখনকার নীলাচলের বৈষ্ণবদের আচার সম্বন্ধে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ তাঁর রচনায় নিম্নলিখিতভাবে প্রকাশ পেয়েছিল—
“খাইয়া প্রসাদ ভাত মাথায় মুছিব হাত
নাচিব গাইব কুতূহলে।”
যাই হোক, এসময়েই কয়েকজন বৈষ্ণবের অনুরোধে তিনি বৃন্দাবন যাত্রায় তাঁদের সঙ্গী হয়েছিলেন। এরপরে এই যাত্রীরা খানাকুল কৃষ্ণনগরে উপস্থিত হলে সেখানকার অধিবাসী—তাঁর শ্যালিকাপতি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, এবং তাঁকে ঘরে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, কপট বৈষ্ণব ভারতচন্দ্রের পক্ষে তাঁর এই অনুরোধ রক্ষা করা কঠিন হয়নি। তাই এরপরে তিনি কিছুকাল নিজের শ্বশুরালয়ে বাস করবার পরে জীবিকা অর্জনের প্রচেষ্টায় ফরাসডাঙ্গা বা চন্দননগরের ফরাসিদের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর শরণাপন্ন হলে তাঁর পাণ্ডিত্য ও বিদ্যাবত্তার পরিচয় লাভ করে ইন্দ্রনারায়ণ তাঁকে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রয় লাভ করবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আর এরসাথেই ভারতচন্দ্রের ভ্রাম্যমান জীবনের অবসান ঘটেছিল।
এরপরে কৃষ্ণনগরে ভারতচন্দ্র মাসিক চল্লিশ টাকা বেতনে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবির পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন, এবং ক্রমে তাঁর উন্নতি হয়েছিল। এসময়েই রাজার কাছ থেকে তিনি ‘রায়গুণাকর’ উপাধিটি লাভ করেছিলেন, এবং গঙ্গাতীরে বসবাস করবার জন্য তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে মূলাজোড় গ্রামটি ইজারা দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই বর্গীর হাঙ্গামায় বিপর্যস্ত হয়ে বর্ধমানের রাজা ও তাঁর মা বর্ধমান ত্যাগ করে মুলাজোড়ের নিকটবর্তী কাউগাছি গ্রামে এসে নিজেদের বসতি স্থাপন করলে রাজমাতার অনুরোধে কৃষ্ণচন্দ্র মূলাজোড় গ্রামটি রামদেব নাগ নামক একজন ব্যক্তিকে ইজারা দিয়েছিলেন। এসময়ে পত্তনীদারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভারতচন্দ্র তাঁর ‘নাগাষ্টক’ কাব্যটি রচনা করলে কৃষ্ণচন্দ্র এটি পড়ে তাঁর উপরে নাগের অত্যাচার বন্ধ করবার ব্যবস্থা করেছিলেন। তারপরে দীর্ঘকাল রোগভোগ করবার পরে ১৭৬০ সালে ভারতচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছিল।
ভারতচন্দ্রের জীবনেতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তাঁর জীবন-নাটক এমন এক যুগে অভিনীত হয়েছিল, যখন বাংলার ইতিহাসের দ্রুত পট পরিবর্তন ঘটেছিল। এসময়ে মুর্শিদাবাদ-কৃষ্ণনগরের মুসলমানী আদব-কায়দা ও পরিবেশের মধ্যে অস্তাচলগামী মোঘল পাদশাহীর ক্ষীয়মান প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। যদিও ভারতচন্দ্রের সময়ে বাংলার নবাবী দরবারে এবং বিত্তশীল সম্প্রদায়ের বৈঠকে শিষ্টতার ভাষা ছিল ফার্সি, কিন্তু তবুও হিন্দু ভূম্যধিকারীদের আশ্রয়ে সংস্কৃত ভাষা এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রবাহ কখনও রুদ্ধ হয়ে যায়নি। একারণে ভারতচন্দ্রের জীবন ও সাহিত্যে এই উভয় ধারাই বহমান ছিল বলে লক্ষ্য করা যায়। তিনি তাঁর সময়কার বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন উড়িষ্যায় মারাঠা শাসকের অধীনে বাস করেছিলেন। তিনি বাংলায় বর্গীদের হাঙ্গামার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, এবং নিজের চোখের সামনেই তিনি ইংরেজদের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিবর্তিত হতে দেখেছিলেন। ফরাসি অধিকারে থাকা চন্দননগরে তিনি যেমন ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন, তেমনি আবার তাঁর জীবদ্দশাতেই বাংলায় ফরাসিদের প্রভাবের বিলোপ ঘটেছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যে, তখনকার এসব রাজনৈতিক পরিবর্তনের ছায়া তাঁর কাব্যে মোটেই লক্ষ্য করা যায় না। তবে বাংলায় বর্গীর হাঙ্গামা যে হিন্দুধর্মের উপরে আলিবর্দি খাঁর দৌরাত্ম্যের ফল, এমন ইঙ্গিত তাঁর কাব্যে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি আবার কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের সঙ্গে রাজা মানসিংহের কাল্পনিক কথোপকথনও তাঁর কাব্যে দেখা যায়। এসব থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, এই কবির দৃষ্টি শুধু পিছনের দিকে ছিল। প্রসঙ্গতঃ একথাও উল্লেখ্য যে, পলাশীর যুদ্ধের পরেও যদিও তিন বছর জীবিত ছিলেন, কিন্তু তবুও ‘নাগষ্টকের’ মত ‘ইংরেজাষ্টক’ রচনার কথা কখনো ভাবেন নি। আর সমসাময়িক অবস্থা সম্বন্ধে ভারতচন্দ্রের সচেতনতা শুধু হিন্দুধর্মের উপরে মুসলমানদের ‘দৌরাত্ম্যের’ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। এজন্যই দেখা যায় যে, তাঁর কাব্যে দেবী অন্নদা বলেছিলেন—
“যতেক বেদের মত সকলি করিল হত,
নাহি মানে আগম পুরাণ।
মিছা মালা ছিলি মিলি, মিহা জপে ইলি মিলি
মিছা পড়ে কলমা কোরাণ॥
যত দেবতার মঠ, ডাঙ্গি ফেলে করি হঠ,
নানা মতে করে অনাচার।
বামণ পণ্ডিত পায়, থুথু দেয় তার গায়,
পৈতা ছেঁড়ে খোঁটা মোছে আর॥”
আবার তাঁর কাব্যের অন্যত্র দেখা যায় যে, বাদশাহ জাহাঙ্গীর বলছেন—
“আমার বাসনা হয় যত হিন্দু পাই।
সুন্নত দেওয়াই আর কলমা পড়াই॥”
ভারতচন্দ্রের কাব্যের এসব উক্তি যে আসলে তাঁরই কল্পিত ছিল—এবিষয়ে গবেষকদের কোন সন্দেহ নেই; কিন্তু শিখগুরু অর্জনের প্রাণদণ্ড প্রসঙ্গে স্বয়ং জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী’তে বিধর্মীদের ইসলামে দীক্ষিত করা প্রসঙ্গে যেসব মন্তব্য করেছিলেন, সেসবের সঙ্গে এই উক্তির কোন নীতিগত প্রভেদ কিন্তু দেখা যায় না। (বিস্তারিত তথ্যের জন্য ‘A. C. Banerjee’ প্রণীত ‘The Sikh Gurus and the Sikh Religion’ গ্রন্থের ২০১-০২নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্যঃ।) বাস্তবে নবাব আলিবর্দির রাজত্বকালে তাঁর অধীনস্থ একজন জমিদারের সভাকবি কেন এসব কথা লিখেছিলেন, তা অবশ্যই গবেষণার বিষয় হতে পারে।
কবিকঙ্কন তাঁর স্বপ্নে চণ্ডীর নির্দেশ পেয়ে নিজের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ রচনা করলেও রামেশ্বর কিন্তু এবিষয়ে শিবের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা না করে নিজের অন্নদাতা রাজার আদেশেই কাব্য রচনা করেছিলেন। আর ভারতচন্দ্রের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তাঁর কাব্যে দেবী অন্নপূর্ণার নির্দেশের সঙ্গে অন্নদাতা রাজার আদেশের সংযোগ ঘটেছিল। ভারতচন্দ্র জানিয়েছিলেন যে, কৃষ্ণচন্দ্র যখন আলিবর্দির দাবি অনুযায়ী ১২ লক্ষ টাকা নজরানা দিতে না পারবার ফলে বন্দি হয়েছিলেন, তখন দেবী অন্নপূর্ণা তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি যেন তাঁর সভাকবি ভারতচন্দ্রকে তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনামূলক কাব্য রচনা করতে অনুরোধ করেন। আর এরপরেই অলৌকিকের সঙ্গে লৌকিকের সংমিশ্রণে খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতকের বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য অন্নদামঙ্গলের পটভূমিকা রচিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, খুব সম্ভবতঃ ১৭৫২-৫৩ সালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক অন্নপূর্ণা পূজা প্রবর্তন উপলক্ষ্যে ভারতচন্দ্র তাঁর এই কাব্যটি রচনা করেছিলেন।
ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ বা ‘অন্নপূর্ণামঙ্গল’ তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। এরমধ্যে প্রথম খণ্ডে অন্নদার মাহাত্ম্য এবং শিবের উপাখ্যান বর্ণনা করা হয়েছে। সাহিত্য সমালোচকদের মতে, কাব্যের এই অংশে দেবচরিত্রগুলি অনেকটা মানবতা গুণে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এরপরে কাব্যের দ্বিতীয় খণ্ডে বিদ্যাসুন্দরের উপাখ্যান বর্ণনা পাওয়া যায়। আর তৃতীয় খণ্ডে কৃষ্ণচন্দ্রের বংশপ্রশস্তি রচনা করবার উদ্দেশ্যে কবি মানসিংহ-প্রতাপাদিত্য-ভবানন্দ উপাখ্যান বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু কাব্যের এই অংশে তথ্যের সঙ্গে কল্পনার নির্বিচার সংমিশ্রণ ঘটেছে বলে লক্ষ্য করা যায়; আর এই তিনটি খণ্ডের মধ্যে শিল্পের দিক থেকেও কোন যোগসূত্র পাওয়া যায় না।
সাহিত্য সমালোচকদের মতে, ভারতচন্দ্র তাঁর এই কাব্যে বাংলা মঙ্গলকাব্যের প্রাচীন ধারার প্রতি নিজের আনুগত্য রক্ষা করেও এক মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন। মুকুন্দরামের চণ্ডী যেখানে মানব সংসারের বাইরে অধিষ্ঠিতা একজন দেবী ছিলেন, অলৌকিক তাঁর রূপলাবণ্য ও চোখ-ধাঁধানো তাঁর দিব্য বিভা ছিল, ভারতচন্দ্রের অন্নপূর্ণা সেখানে সেযুগের বাংলার ‘কুলবধূর আড়ম্বরহীন, সাদা-মাঠা শাঁখা-শাড়ীর অন্তরালে’ তাঁর ‘সেই অপ্রাকৃত জ্যোতিকে আবৃত’ করে রেখেছিলেন। (ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদ, শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য, ভূমিকা অংশে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য দ্রষ্টব্যঃ) এরফলে স্বাভাবিকভাবেই এই কাব্যে ভক্তির ফল্গুধারা শুকিয়ে এসেছিল। অন্যদিকে চণ্ডীমঙ্গলে যেখানে—‘বিপত্তারণ, দুঃখহরণ ভগবানের প্রতি অনন্যসহায় দুর্বল মানবের আত্মসমর্পণ’ দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে ভারতচন্দ্রের—‘দেববন্দনা অনেকটা শ্রদ্ধার ব্যাপার, আত্মসমর্পণ ও আত্মনিবেদনের বালাই’—তাঁর কাব্যে পাওয়া যায় না। (ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদ, শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য, ৭০নং পৃষ্ঠায় ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য দ্রষ্টব্যঃ) তবে সাহিত্য সমালোচকদের মতে, উভয় মঙ্গলকাব্যের মধ্যেকার এই পার্থক্যকে যুগ পরিবর্তনের সূচক বলে মনে করা কঠিন। ভারতচন্দ্র আঠারো শতকের বাংলার নাগরিক জীবনের কবি ছিলেন। সেযুগের ইসলামী সংস্কৃতি প্রভাবিত, সংস্কৃতভিত্তিক শুষ্ক পাণ্ডিত্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র কৃষ্ণনগরের অর্ধবিকৃত সংস্কৃতিকে কাব্যের খাতে প্রবাহিত করাই তাঁর এই কাব্য রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। তবে সেযুগের সাধারণ বাঙালীর চিত্ত তখনও যে ভক্তিরসে সঙ্গীবিত ছিল, একথার ঐতিহাসিক প্রমাণ রামেশ্বরের কাব্য এবং রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীতে পাওয়া যায়।
ভারতচন্দ্রের কাব্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদা বলেছিলেন—
“রাজসভাকবি রায় গুণাকরের অন্নদামঙ্গল গান রাজকণ্ঠে মণিমালার মত, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য।”
আর এই ‘উজ্জ্বলতা’ এবং ‘কারুকার্য’ই যে ভারতচন্দ্রের সাহিত্যকর্মকে সেযুগের শিক্ষিত বাঙালি সমাজে আদৃত করে তুলেছিল, এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তিনি ‘শব্দকুশলী কবি’ ছিলেন, সেকালের পাঠকদের বৈচিত্র্যের আস্বাদ দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর কাব্যে ‘যাবনী মিশাল’ ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। একারণেই তাঁর সময়কার নবাবী আমলের মিশ্রিত সংস্কৃতির পরিবেশে এটা স্বাভাবিক হলেও এর প্রায় এক শতাব্দী পরে বাংলা ভাষা যখন সংস্কৃতের প্রভাবে নতুন একটা রূপ গ্রহণ করেছিল, তখন ১৮৫৬ সালে একজন সাহিত্য সমালোচক লিখেছিলেন—
“তিনি হিন্দী ও পারসিক ভাষা না শিখিলে মহত্তর কবি হইতেন। তিনি যত প্রবৃদ্ধ হইতেছিলেন ততই এইরূপ রচনায় অধিক পরিশ্রম স্বীকার করিতেছিলেন। … তিনি প্রচুর পরিমাণে অনুকরণ শব্দ ব্যবহার করেন, ইহাতে কেবল ভাবের অভাব মাত্র প্রতীত হয়; কেবল শব্দের উপর নির্ভর করা মহৎ কবির লক্ষণ নহে।” (রাখালদাস হালদারের সমালোচনা, ডঃ সুকুমার সেন কর্তৃক ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের অপরার্ধ অংশে উদ্ধৃত)
কিন্তু এসব সত্ত্বেও বলা চলে যে, ছন্দের ব্যবহারে ভারতচন্দ্রের কৃতিত্ব বর্তমানে সর্বজনস্বীকৃত। সমালোচকদের মতে, রামেশ্বরের কাব্যে ছন্দের কোন বৈচিত্র্য না থাকলেও, ভারতচন্দ্র কিন্তু বাংলায় প্রচলিত ছন্দ ছাড়া নানারকমের সংস্কৃত ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন। এবং তাঁর ছন্দের কারুকার্যে যদিও সেকালের নাগরিক জীবনের বিলাস ও আভিজাত্য প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু তবুও সাধারণ বাঙালির ঘরোয়া জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত হাসি ও কান্না প্রকাশিত হয়নি। বস্তুতঃ শব্দ বৈচিত্র্য এবং অর্থ বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে অলঙ্কার ব্যবহার করেছিলেন, আর অর্থালঙ্কারের থেকে শব্দালঙ্কারকেই তিনি বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। অর্থাৎ—ভারবির অর্থগৌরবের থেকে নৈষধের পদলালিত্যকেই তিনি বেশি অনুকরণীয় বলে মনে করেছিলেন। অতীতে এপ্রসঙ্গে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন—
“ভারতচন্দ্রে যে ছন্দঃ কুশলতা এবং মার্জিত ভাষণ নৈপুণ্য আমাদিগকে মুগ্ধ করে তাহার প্রথম সূচনা মুকুন্দরামে; তফাৎ এই যে মুকুন্দরামের সরস কৌতুক ও সরল গ্রাম্যজীবনের স্বাভাবিকতা ভারতচন্দ্রে রাজসভার কৃত্রিম আবহাওয়ার শ্লেষ-প্রধান, আক্রমণশীল মনোভাবে পরিণত হইয়াছে।”
এছাড়া যদিও হাস্যরস সৃষ্টিতে ভারতচন্দ্র সার্থকতা লাভ করেছিলেন, কিন্তু তবুও চরিত্র সৃষ্টিতে তাঁর ব্যর্থতা সুস্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। সমালোচকদের মতে, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি ‘ছাঁচে ঢালা’ এবং ‘পাণ্ডিত্য ও শিল্প চাতুর্যের বাহন’; এগুলিতে কোন ব্যক্তিত্বসূচক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, বৈষ্ণব কবিরাই বাংলায় ভক্তিরসের সঙ্গে আদিরসের সংমিশ্রণ প্রবর্তন করেছিলেন, আর ক্রমে শাক্ত কবিদের রচনাতেও এর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। এরফলে একসময়ে বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্বের পরকীয়াবাদ ও তন্ত্রসাধনা পদ্ধতির পঞ্চ‘ম’কারের বিকৃত প্রয়োগে দেশবাসীর রুচি অনাবৃতপ্রায় ইন্দ্রিয় লালসার প্রতি উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। আর খুব সম্ভবতঃ ‘মুসলমানী কেচ্ছার কলুষ’ও তখন বাঙালি সমাজের এই বিকৃতিতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। একারণেই দেখা যায় যে, খৃষ্টীয় সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে রচিত ‘কালিকামঙ্গল’ শ্রেণীর কাব্যগুলিতে কালীর মাহাত্ম্য বর্ণনার সঙ্গে বিদ্যা ও সুন্দরের প্রেমকাহিনী সংযুক্ত হয়ে অশ্লীলতার উপাদান সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষতঃ সুবেদার শায়েস্তা খাঁর শাসনকালে রচিত কৃষ্ণরামের কালিকামঙ্গলে তো যথেষ্ট পরিমাণে অশ্লীলতা দোষ লক্ষ্য করা যায়। এমনকি সেকালের গ্রাম্য পরিবেশে রচিত রামেশ্বরের ‘ভদ্রকাব্য’ও এই দোষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ছিল না। অনুরূপভাবে সম্পূর্ণ নাগরিক পরিবেশে রচিত ভারতচন্দ্রের কাব্যের বিদ্যাসুন্দরের কাহিনীর ‘বিপরীত বিহার’ প্রভৃতি অংশেও এই দোষ অতি বিকৃতরূপে প্রকাশিত হয়েছিল বলে লক্ষ্য করা যায়। এরফলে শ্যামাভক্ত রামপ্রসাদের বিদ্যাসুন্দরও ভদ্ররুচিবিগর্হিত অশ্লীলতায় কলঙ্কিত হয়ে উঠেছিল।
যদিও অতীত থেকেই সাহিত্যে শ্লীলতা ও অশ্লীলতার সীমারেখা নিয়ে বিতর্ক বর্তমান রয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা প্রায় সকলেই স্বীকার করেন যে, সবসময় শিল্পসৃষ্টির মানদণ্ডেই এই সীমারেখা নির্ধারণ করা উচিত। যদিও অতীতে এপ্রসঙ্গে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন—
“এই অশ্লীল দেহসম্ভোগের চিত্রকে যতদূর কাব্যগুণোপেত করা যায়, ইহার স্থূল ও রুচিবিগর্হিত বস্তু ও ঘটনাগত উপাদানসমূহকে যতদূর বস্তুর অতীত একটি ভাবরসে পরিণত করা সম্ভব, ভারতচন্দ্র সেই দুরূহ কার্যে চরম সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন।”
কিন্তু তবুও অন্যান্যদের মতে, ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সংযত প্রশংসাকে ভারতচন্দ্রের যথার্থ মূল্যায়ন রূপে গ্রহণ করা কঠিন। কারণ, ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যের ‘বিপরীত বিহার’ অংশে—‘ঘটনাগত উপাদানসমূহকে বস্তুর অতীত একটি ভাবরসে পরিণত করার’—কোন চেষ্টাই করেননি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কাব্যের এই অংশটিকে অন্যান্য সমালোচকরা একটি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ বলেই মনে করে থাকেন; এবং তাঁদের পরিষ্কার বক্তব্য হল যে, এটি না থাকলেও ঘটনা বর্ণনা, চরিত্রসৃষ্টি বা শিল্পকৌশল প্রদর্শনের দিক থেকে এই কাব্যে কোনরকমের অসম্পূর্ণতা ঘটত না। সম্ভোগ বর্ণনাকে কিভাবে শিল্পভূষণে ভূষিত করে অশ্লীলতার পঙ্ক থেকে উদ্ধার করে ‘কাব্যগুণোপেত’ করা যে সম্ভব, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে পাওয়া যায়।
এবারে রামপ্রসাদের প্রসঙ্গে আসা যাক। ঐতিহাসিকদের মতে, খুব সম্ভবতঃ ১৭২০-৩০ সালের মধ্যে বাংলার এক ‘শুদ্ধমূল’ বৈদ্যবংশে রামপ্রসাদ সেনের জন্ম হয়েছিল। তাঁর জন্মস্থান ছিল কুমারহট্ট গ্রাম। তিনি ভারতচন্দ্রের কিঞ্চিৎ বয়ঃকনিষ্ঠ ছিলেন। আর ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পরে, খুব সম্ভবতঃ ১৭৬০-৭০ সালের মধ্যেই তিনি তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যটি রচনা করেছিলেন। রামপ্রসাদ বাংলা, ফারসি, সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষায় শিক্ষালাভ করেছিলেন। যদিও অল্প বয়সেই তাঁর চিত্তে আধ্যাত্মিক চেতনা অঙ্কুরিত হয়েছিল, কিন্তু তবুও দারিদ্রের জ্বালায় জর্জরিত হয়ে তিনি কলকাতার এসে এক ধনীর গৃহে মুহুরীর কাজ গ্রহণ করেছিলেন। প্রবাদ রয়েছে যে, তিনি নাকি হিসাবের খাতায় তাঁর ইষ্ট দেবতার নাম লিখতেন। এরফলে তাঁর ধর্মভীরু প্রভু তাঁকে একসময়ে চাকরি থেকে মুক্তি দিয়ে তাঁর জন্য মাসিক ত্রিশ টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এরপরে তিনি স্বগ্রামে ফিরে গিয়ে সেখানেই পঞ্চমুণ্ডের আসন প্রতিষ্ঠা করে শক্তিসাধনা এবং শ্যামাসঙ্গীত রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। আর তারপরে কোন একসময়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র খুব সম্ভবতঃ কুমারহট্ট অঞ্চল ভ্রমণ উপলক্ষ্যে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, এবং তাঁকে ১০০ বিঘা নিষ্কর জমি ও ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি প্রদান করেছিলেন।
ভারতচন্দ্রের মত রামপ্রসাদ রাজদরবার এবং তৎকালীন নাগরিক জীবনের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন না; এমনকি ভারতচন্দ্রের মত পান্ডিত্য, শাণিত বুদ্ধি এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও তাঁর ছিল না। বস্তুতঃ গ্রাম্য পরিবেশে তান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে ভক্তিধর্মকে অবলম্বন করেই তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। যদিও তৎকালীন সমাজে প্রচলিত থাকা বৈষম্য ও দুর্নীতি তাঁর দৃষ্টি এড়াতে পারেনি, কিন্তু তবুও ভারতচন্দ্রের মত তিনি এই কলুষিত জীবনকে নিজের সাহিত্যের মাধ্যমে কখনো বিদ্রূপ করেন নি। খুব সম্ভবতঃ তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমেই সমাজের উচ্চস্তরে উন্নীত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়।
বাংলা সাহিত্যের গবেষকদের মতে, রামপ্রসাদের ‘বিদ্যাসুন্দর’ নিঃসন্দেহে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের পরে, এবং তাঁর অনুকরণেই রচিত হয়েছিল। আর একই নামের এই দুই কাব্যের মধ্যে তুলনা করলে রামপ্রসাদের কবিত্বশক্তির দুর্বলতা সহজেই ধরা পড়ে। এমনকি কাব্যে অশ্লীলতার দিক থেকে রামপ্রসাদও ভারতচন্দ্রের সঙ্গে তুলনায় সমান অপরাধী বলেই গণ্য হতে পারেন; কারণ, তিনিও তাঁর কাব্যে ‘বিপরীত বিহারের’ বর্ণনা দিয়েছিলেন বলে লক্ষ্য করা যায়। তবে রামপ্রসাদের কাব্যের প্রধান গুণ হল ঘরোয়া ভাবের প্রকাশ, যেটিকে আসলে তাঁর নাগরিক সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকবার ফলরূপেই গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু বিদ্যাসুন্দরে কবি রামপ্রসাদের যে রুচির পরিচয় পাওয়া যায়, সেটাকে কোনভাবেই সিদ্ধভক্ত রামপ্রসাদের রুচি বলা চলে না। নবাবী আমলের বাংলার একজন ভক্তকবি কেন গতানুগতিক রীতিতে এই কাব্য রচনা করেছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তরে গবেষকরা দু’রকম ব্যাখ্যা করে থাকেন বলে দেখা যায়।
প্রথমতঃ, রামপ্রসাদ যখন বিদ্যাসুন্দর রচনা করেছিলেন, তখনও অধ্যাত্ম-সাধনার স্পর্শ তাঁর জীবনে লাগেনি, এবং তখনও তিনি কালের প্রভাবেই প্রভাবান্বিত ছিলেন। তাই শৃঙ্গার রসাত্মক বিদ্যাসুন্দর কাব্যকে তাঁর সাধকজীবনের আগের অবস্থার রচনা বলে ধরাই যুক্তি ও মনোবিজ্ঞানসম্মত বলে মনে হয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যা আবার তাঁর প্রথম জীবন সম্বন্ধে প্রচলিত কাহিনীর বিরোধী বলেই দেখা যায়। কারণ, যদি অল্প বয়সেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিক আকুতি জাগ্রত হয়ে থাকে, আর এসময়ে যদি তাঁর কলকাতার মনিব তাঁকে মাসিক বৃত্তি দিয়ে থাকেন, তাহলে বিদ্যাসুন্দর রচনা করবার আগেই অধ্যাত্মসাধনার স্পর্শ তাঁর জীবনধারাকে পরিবর্তিত করে দিয়েছিল বলতে হয়।
দ্বিতীয়তঃ, ডঃ সুকুমার সেনের ভাষায়, কৃষ্ণচন্দ্র সমসাময়িক—
“মলিন প্রবাহে রামপ্রসাদকে অবগাহন করাইয়া তাঁহার কালী নামাবলীর উজ্জ্বলতা কথঞ্চিৎ ম্লান হইবার হেতু হইয়াছেন।”
ইতিহাস বলে যে, কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে ১৭৫৯ সালে নিষ্কর ভূমি দান করেছিলেন, আর এর পরের দশ বছরের মধ্যেই তিনি বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু নিজের অন্নদাতার নির্দেশে ‘শৃঙ্গার রসাত্মক’ একটি কাব্য রচনা করবার কাজটি আদতে একজন ভক্ত সাধকের চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বলেই মনে হয়।
তাই রামপ্রসাদের বিদ্যাসুন্দর নিয়ে বাংলা সাহিত্যের গবেষকদের এই দুই ব্যাখ্যার মধ্যে সঙ্গতি রাখতে হলে একথাই বলতে হয় যে, রামপ্রসাদের অধ্যাত্মসাধনা আরম্ভ হয়েছিল তাঁর পরিণত বয়সে। তাঁর আনুমানিক মৃত্যুকাল হল ১৭৮১ সাল, এবং তাঁর নামে প্রচলিত থাকা শাক্তপদাবলী তাঁর মধ্য বয়সে বা পরিণত বয়সে রচিত হয়েছিল। তবে রামপ্রসাদের এই শাক্তপদাবলী সম্পর্কে অতীতে ডঃ সুকুমার সেন আবার জানিয়েছিলেন যে, রামপ্রসাদের নামে প্রচলিত থাকা—
“গানগুলি—সব অথবা একটিও—কবিরঞ্জন রামপ্রসাদের রচনা বলিয়া মনে করা যায় না। মনে হয় গানগুলি একাধিক কবির রচনা, এখন একত্র হইয়াছে রামপ্রসাদ সেনের নামে।”
বস্তুতঃ বাংলা শাক্তপদাবলীর ইতিহাসে এই একাধিক রামপ্রসাদের অস্তিত্ব ঈশ্বর গুপ্তের সময় থেকেই গবেষকমহলে স্বীকৃত হলেও বর্তমানে এই স্বীকৃতি শুধুমাত্র গান রচনা সম্বন্ধেই প্রযুক্ত করা হচ্ছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুগ্রহধন্য কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সাধক ছিলেন না, তিনি কোন শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেন নি, এবং শুধুমাত্র বিদ্যাসুন্দর কাব্যই লিখেছিলেন— এহেন অনুমানের সম্ভাব্যতা শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের গবেষকদের পক্ষেই বিচার করা সম্ভব।
যাই হোক, রামপ্রসাদ ছিলেন নবাবী আমলের বাংলার শেষ কবি। তাঁর পরে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের বাংলায় কবিওয়ালাদের ছড়া, হাফ-আখড়া, দাঁড় আখড়া, তরজা, ঝুমুর, খেমটা প্রভৃতি কুরুচিপূর্ণ গানের প্রচলন ঘটেছিল। এছাড়া সমকালে পর্তুগিজ পাদ্রীদের আওতার বাইরে বৈষ্ণব সাধকেরা খুব সম্ভবতঃ নাথ যোগীদের কড়চার অনুকরণে ছোট ছোট গদ্যবাক্য রচনা করেছিলেন। এসবের মধ্যে রূপ গোস্বামীর রচনা বলে পরিচিত একটি কারিকার অতি সরল ভাষার নমুনা এরকম ছিল—
“আগে তারে সেবা। তার ইঙ্গিতে তৎপর হইয়া কার্য’ করিবে। আপনাকে সাধক অভিমান ত্যাগ করিবে।”
এর আগে খুব সম্ভবতঃ সপ্তদশ শতকের শেষভাগে রচিত ‘জ্ঞানাদি সাধনা’ নামক সহজিয়া সম্প্রদায়ের একটি গ্রন্থে যে বাংলা গদ্যের নমুনা পাওয়া যায়, তা এরকম—
“পরে সেই সাধু কৃপা করিয়া সেই অজ্ঞান জনকে চৈতন্য করিয়া তাহার শরীরের মধ্যে জীবাত্মাকে প্রত্যক্ষ দেখাইয়া পরে সেই চৈতন্য মন্ত্রের অর্থ জানাইয়া পরে সেই জীব দ্বারাএ দশ ইন্দ্রিয় আদি যুক্ত নিত্য শরীর দেখাইয়া পরে সাধক অভিমানে শ্রীকৃষ্ণাদির রূপ আরোপ চিন্তাতে দেখাইয়া পরে সিদ্ধি অভিমান শ্রীকৃষ্ণাদির মুক্তি পৃথক দেখাইয়া প্রেম লক্ষণার সমাধি ভক্তিতে সংস্থাপন করিলেন।”
এরপরে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে জয়নাথ মুন্সীর কোচবিহারের ‘রাজোপাখ্যান’ গ্রন্থে ব্যবহৃত জটিল বাংলা গদ্যের নমুনা এরকম—
“শ্রীশ্রীমহারাজা ভূপ বাহাদুরের বাল্যকাল অতীত হইয়া কিশোরকাল হইয়াই পার্শী বাঙ্গলাতে স্বচছন্ন আর খোশখত অক্ষর হইল সকলেই দেখিয়া ব্যাখ্যা করেন বরং পার্শীতে এমন খোষনবিশ লিখক সন্নিকট নাহি চিত্রেতে অদ্বিতীয় লোক সকলের এবং পদ্ম পক্ষী বৃক্ষ লতা পুষ্প তৎস্বরূপ চিত্র কারতেন অশ্বারোহণে ও গজচালনে অদ্বিতীয়।”
আবার ১৭৭৫ সালে লেখা ‘ভাষা-পরিচ্ছেদ’ নামক সংস্কৃত গ্রন্থের বঙ্গানুবাদে যে সরল বাংলা গদ্য ব্যবহৃত হয়েছিল, তার নমুনা এরকম ছিল—
“গৌতম মুনিকে শিষ্য সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন আমাদিগের মুক্তি কি প্রকারে হয় তাহা কৃপা করিয়া বলহ। তাহাতে গৌতম উত্তর করিতেছেন তাবৎ পদার্থ জানিলে মুক্তি হয়।”
আর প্রায় সমসাময়িক ‘বৃন্দাবনলীলা’ গ্রন্থে ব্যবহৃত প্রাঞ্জল বাংলা ভাষার নমুনা এরকম ছিল—
“(শ্রীকৃষ্ণ) যে দিবস ধেনু লইয়া এই পর্বতে গিয়াছিলেন সে দিবস মুরলির গানে গঙ্গা উজান বহিয়াছিলেন এবং পাষাণ গলিয়াছিলেন।”
সুতরাং এসব উদাহরণ থেকে স্পষ্টভাবেই একথা প্রমাণিত হয় যে, কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু আগেই সাহিত্যপদবাচ্য বাংলা গদ্যের উদ্ভব হয়ে গিয়েছিল। (বাংলা দেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, পৃ: ৪২৬-২৭) এমনকি খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে রচিত স্মৃতিশাস্ত্রের কোন কোন গ্রন্থও মোটামুটি সরল বাংলা গদ্যেই অনুদিত হয়েছিল। (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ: ১১৮-১৯) প্রসঙ্গতঃ একথাও উল্লেখ্য যে, রামমোহন রায় ইংল্যাণ্ডে অবস্থান করবার সময়ে নিজের জনৈক ইংরেজ বন্ধুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন—
“ষোড়শ বৎসর বয়সে আমি হিন্দুদিগের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে একখানি পুস্তক রচনা করিয়াছিলাম।”
তাঁর জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন যে, ১৭৮৮ বা ১৭৯০ সালে রামমোহন রচিত এই ‘পুস্তক’ যে (বাংলা)—
“গদ্যগ্রন্থ, তদ্বিষয়ে লেশমাত্র সংশয় হইতে পারে না।” (মহাত্মা য়াজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত, নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ: ৫ ও ৩১৯)
এছাড়া মাত্র ষোল বছর বয়সে রামমোহন যে সংস্কৃত, অথবা ফারসি, অথবা আরবিতে ধর্মালোচনা মূলক পুস্তক রচনা করবার উপযোগী ভাষাজ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন, একথাও কল্পনা করা যায় না। আর সাহিত্য ছাড়াও তখনও যে বাংলা গদ্য ব্যবহারিক জীবনেও প্রয়োগ করা হত, একথার যথেষ্ট প্রমাণও ইতিহাসে রয়েছে। যেমন—তখনকার জমিসংক্রান্ত দলিল বাংলা গদ্যেই লেখা হত। একথার উদাহরণস্বরূপ এখানে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ১৭৪৯ সালে কবি ভারতচন্দ্রকে জমি দান করবার জন্য যে সনদ দিয়েছিলেন, সেটির উল্লেখ করা যেতে পারে, যা নিম্নরূপ—
“সপরিবারে অধিকারস্থ হইয়া আনাওরপুর চাকলায় বসতি করিয়াছ অতএব চাকলা মজকুরে বেওয়ারেশ গরজমাই উজ্জট বাস্তু ও লায়েক বাগাতি জঙ্গলভূমি … বৃত্তি দিলাম বাস্তুতে সপরিবারে বসতি করিয়া বাগাতি জমিতে বাগিচা করিয়া জঙ্গলভূমি নিজ জোতে ভোগ করহ। …” (ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদ, শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য, পৃ: ৪১-৪২)
অন্যদিকে চিঠিপত্রে বাংলা গদ্যের ব্যবহার তো খৃষ্টীয় ষোড়শ শতক থেকেই প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। যেমন—১৫৫৫ সালে কোচবিহারের রাজা আসামের অহোম রাজাকে একটি পত্রে লিখেছিলেন—
“এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরন্তর বাঞ্ছা করি। এখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকুল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে।”
এরপরে ১৬৮২ সালে লেখা একটি চিঠিতে পাওয়া যায়—
“কএক দিবস হইল তথাকার মঙ্গলাদি পাই নাই। মঙ্গলাদি লিখিয়া আপ্যায়িত করিবেন। মহাশয় আমার কত্তা আমি ছাওল আমার দোষসকল আপনকার মাপ করিতে হয়।” (বাংলা দেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, পৃ- ৪২৮)
অতীতে ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন তাঁর ‘প্রাচীন বাঙ্গালা পত্র সংকলন’, ডঃ পঞ্চানন মণ্ডল তাঁর ‘চিঠিপত্রে সমাজচিত্র’, এবং আনিসুজ্জামান তাঁর সম্পাদিত ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’ নামক গ্রন্থে অষ্টাদশ শতকে বাংলা গদ্যে লেখা বহু চিঠি সংগ্রহ করে তুলে ধরেছিলেন। প্রসঙ্গতঃ এখানে মহারাজা নন্দকুমারের ১৭৭১ এবং ১৭৭২ সালে লেখা দুটি চিঠির, এবং ১৭৮৭ সালে কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল ও জয়নারায়ণ ঘোষালের লেখা একটি চিঠির কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। তাছাড়া ভারত সরকারের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত থাকা বাংলায় লেখা ১৭৫টি চিঠিও অতীতের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেনের সম্পাদনায় ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই পত্রগুলির অধিকাংশই আসাম, মণিপুর, কাছাড়, কোচবিহার ও ভুটান অঞ্চলের শাসকদের এবং তাঁদের কর্মচারীদের লেখা ছিল। এপ্রসঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ সেন জানিয়েছিলেন—
“ভুটান, কুচবিহার, আসাম, মণিপুর ও কাছাড়ের নৃপতিগণ এই ভাষায়ই (অর্থাৎ বাংলা ভাষায়) পরস্পরের সহিত এবং ইংরাজ সরকারের সহিত পত্রালাপ করিতেন। বাঙ্গালাই যে তখন পূর্বোত্তর ভারতের রাষ্ট্রভাষা ছিল আমাদের সঙ্কলিত পত্রগুলি পাঠ করিলে তাহাতে আর সন্দেহ থাকে না।”
বস্তুতঃ এই পত্রগুলি যখন লেখা হয়েছিল তখন আসাম, মণিপুর, কাছাড় ও ভুটানে ইংরেজদের রাজত্ব তো দূরে থাকুক, তাঁদের রাজনৈতিক প্রভাবও সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলেই ইতিহাসে দেখা যায়। সুতরাং ইংরেজদের আড়ালে বাঙালিরা তখন এসব অঞ্চলে প্রবেশ করে নিজেদের ভাষা স্থানীয় শাসকদের উপরে চাপিয়ে দিয়েছিলেন, এমন কথা বলা যায় না। আসলে এসময়ে বাংলা ভাষা ‘কেবল স্বমহিমায়’ সমগ্র পূর্ব ভারতে ‘আপনার প্রতিপত্তি বিস্তার’ করেছিল। এমনকি ঊনবিংশ শতকে আসামে কোম্পানির শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পরে সেখানে স্থানীয় ভাষার পরিবর্তে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা প্রচলিত হয়েছিল, এই মতও ইতিহাস-সম্মত নয়। কারণ, আজও ভারত সরকারের মহাফেজখানায় আরাকানি ভাষায় লেখা চিঠি থাকলেও অসমীয়া ভাষায় লেখা একটি প্রাচীন চিঠিও কিন্তু পাওয়া যায় না। তোৰে সুরেন্দ্রনাথ সেনের গ্রন্থে মুদ্রিত বাংলা চিঠিগুলির ভাষা অতি জটিল, সাহিত্যিক দিক থেকে মূল্যহীন এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে আহৃত শব্দের বিচিত্র সংমিশ্রণ বলে লক্ষ্য করা যায়। যেমন—১৭৯৪ সালে আসামের রাজার তিন মন্ত্রী—শ্রীযুত বুঢ়া গোহাঞি, শ্রীবড় গোহাঞি, এবং শ্রীবড় পাত্র গোহাঞি—ভারতের গভর্নর-জেনারেলকে ‘সকলরো নিবেদন’ জানিয়েছিলেন—
“স্বস্তি শ্রীপ্রভাকর কর প্রতাপ ব্যাপ্ত সকল ভূমণ্ডল জাচক মনোরথ পুরক কল্পপাদক মহামহিম গুণ-ধাত্র সুচারু চরিত শ্রীশ্রীগবনের কৌশল জেনারেল বাহাদুর বৃহন্নরারাক্ষেযু প্রীতিপূর্ব্বিকা লিপিরিয়ং বিরজিততরাং ভদন্ডাযুক মনবরত শ্রীশ্রী স্থানে সমিহামহে তদত্রাস্মাকং ভাবুকমব্যাহত।”
১৭৯৪ সালের একটি চিঠিতে আসামের রাজা ‘শ্রীশ্রী স্বর্গ নারায়ণদেব শ্রীমত গৌরীনাথ সিংহ’ লিখেছিলেন—
“সকল মঙ্গলালয় গোব্রাহ্মণ প্রতিপালক অসেস গণালঙ্কৃত গঙ্গাজল নির্মল পবিত্র কলেবর শ্রীযুত কলিকাতার বড় সাহেব সুচারু চরিতেষু: শ্রীশ্রী ঈশ্বর ঈশ্বরির স্থানে সদা সর্বদা তোমার কুশল বাঞ্চিতেছি … কুম্পানির সিফাই এখানে না থাকিলে রাজ্য রখ্যা পায় না … যাতায়াতে কুশল লিখিয়া প্যাইত করিবেন।”
১৭৯৮ সালে মণিপুরের রাজা ‘অনুপেক্ষনীয়’ ভাগ্যচন্দ্র সিংহ ‘মহামহিম শ্রীযুৎ লার্ড মারনিংটন গবনর জানরেল বাহাদুর দৌর্দণ্ড প্রতাপেষু’ ‘বিনয়পূর্বক সেলাম নিবেদন’ জানিয়েছিলেন—
“আমার মুক্তিয়ার উকিল … মজকুরকে সরফরাজ করিয়া ত্বরায় বিদায় হুকুম হইলে বহুত মেহেরবানগী লাভসাহেবের দৌলত জেয়াদার খএরাফিয়ত লিখিয়া খুসী করিতে হুকম হইবেক।”
১৭৭৯ সালে ভুটানের রাজার উকিল ‘করার’ লিখে জানিয়েছিলেন—
“দেখরাজ হিন্দু মোশলমান লোক আশীতে জাইতে তেজারতী করিতে কোন আটক করিছেন না তাহারা চন্দন নিল গুগুল সারব পান সুপারি নিতে পারিবেক না। …”
১৮১৫ সালের একটি চিঠিতে ভুটানের রাজা রংপুরের ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখেছিলেন—
“আপনের ২ আসাড়ের পত্রচিন্য দোরোখা বানাত ৫ পাচ জামা ও দুরবিন ১ একটা সহিত আপনের তরফ উকিল শ্রীরামমোহন রাএ ও শ্রীকৃষ্ণকান্ত বসুর মাঃ পাইয়া বহুত খুসি হইলাও। …”
এরপরে এই চিঠিতে আরও বলা হয়েছিল যে রামোহন রায়কে ফেরৎ পাঠানো হল, তাঁর—
“জবানিতে সমস্ত বিবরণ জ্ঞাতো হবেন।”
এই চিঠিটি আশ্বিন মাসে লেখা হয়েছিল, এবং রংপুরে সরকারি সেরেস্তায় ১৮১৫ সালের ১২ই নভেম্বর তারিখে নথিভুক্ত হয়েছিল। সুতরাং এথেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, রামমোহন রায় ১৮১৪ সালের কয়েকমাস (আষাঢ় থেকে অশ্বিন) ভুটানে অবস্থান করেছিলেন, এবং এরপরে তিনি হয়ত ১৮১৫ সালের শেষের দিকে কলকাতায় এসে বাস করতে আরম্ভ করেছিলেন; এর আগে তিনি কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন না।#